মাই সিস্টার'স গ্রেভ
উৎস গুগল ইমেজেস
রহস্যকাহিনীর ইতিহাসে কোনটাকে স্বর্ণযুগ বলে ধরা হবে সে নিয়ে বিশেষ কোনও মতভেদ
নেই। থাকার কথাও না। উনিশশো কুড়ি তিরিশ
নাগাদ হইহই করে লিখছেন আগাথা ক্রিস্টি, ডরোথি সেয়ার্স, মার্জারি অ্যালিংহাম,
জোসেফাইন টে, নাইয়ো মার্শ, রেমন্ড চ্যান্ডলার, জন ডিকশন কার। কাজেই ওটাকে
স্বর্ণযুগ ধরে নিতেই হবে।
আমার অবশ্য মনে হয় ইদানীং স্বর্ণ না হলেও রৌপ্য কিংবা কাংস একটা কিছু যুগের
মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে রহস্যরোমাঞ্চ ফিকশন। একের পর এক বেস্টসেলার বিক্রির রেকর্ড
ভাঙছে, একের পর এক বেস্টসেলার থেকে ব্লকবাস্টার সিনেমা হচ্ছে, আর কী চাই। এসব
বহিরঙ্গের চমক যদি ছেড়েও দিই, এই ধারার সাহিত্যের (কেউ আপত্তি তুললে সাহিত্যের
জায়গায় লেখালিখি বসিয়ে নেওয়া যায়, লেখকদের তাতে দুঃখ হবে না বলেই আমার ধারণা) একজন
চুনোপুঁটি পাঠক হিসেবে আমার মতে গল্পগুলো সত্যিই ভালো লেখা হচ্ছে। অন্তত যে কটা আমি
পড়েছি। স্টিগ লারসন, রবার্ট গ্যালব্রেথ, জিলিয়ান
ফ্লিন, পলা হকিন্স-এর নাম তো সবাই জানে, এঁদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিয়মিত বেস্টসেলার
নামাচ্ছেন প্যাট্রিশিয়া কর্নওয়েল, এলিজাবেথ জর্জ, মাইকেল কনেলি।
চারদিকে এত এবং এত ভালো ভালো গোয়েন্দাগল্প লেখা হচ্ছে যে তাল রাখতে হিমশিম দশা।
তারই মধ্যে কিছুদিন ধরে একটা বইয়ের নাম কানে আসছিল, ‘মাই সিস্টার’স গ্রেভ।’ লেখক
রবার্ট ডুগোনি। রবার্ট ডুগোনি গত প্রায় আট বছর ধরে মিস্ট্রি লিখছেন, কাজেই তাঁকে
নতুন বলা চলে না। মিস্ট্রির যে
সাব-ধারাতে তিনি লিখছিলেন সেটা হচ্ছে লিগ্যাল থ্রিলার। অর্থাৎ পেরি মেসন, পি. কে. বাসু
বার অ্যাট ল, টিভিতে আদালত-এর কে ডি পাঠকের গল্পগুলো যে জাতের, ডুগোনির গল্পের
হিরো অ্যাটর্নি ডেভিড স্লোয়ানের গল্পগুলোও সে জাতের ছিল।
আমার লিগ্যাল থ্রিলার ভালো লাগে না। কাজেই আমি বিশেষ উৎসাহ বোধ করিনি। কিন্তু
হঠাৎ শুনলাম রবার্ট ডুগোনি ডিটেকটিভ বদলে ফেলেছেন। উকিল ডেভিড স্লোয়ানের বদলে এবার
ডুগোনির গল্পের হিরো পুলিশ ট্রেসি ক্রসহোয়াইট। সেই ট্রেসি ক্রসহোয়াইট সিরিজের প্রথম বই ‘মাই
সিস্টার’স গ্রেভ’ সম্পর্কে ভালো ভালো রিভিউ পড়ে আমি শেষমেশ বইটা পড়ে ফেললাম।
ট্রেসি ক্রসহোয়াইট সিয়াটল পুলিশের হোমিসাইড গোয়েন্দা। উত্তর অ্যামেরিকার প্যাসিফিক নর্থওয়েস্টের ছোট্ট মফস্বল সেডার গ্রোভের জনপ্রিয় এবং সম্মানিত ডাক্তার ছিলেন ট্রেসির বাবা জেমস ক্রসহোয়াইট। স্ত্রী অ্যাবি ক্রসহোয়াইট, দুই মেয়ে ট্রেসি আর সারাকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার ছিল। মেয়েরা ছিল যাকে বলে রূপে লক্ষ্মী, গুণে সরস্বতী। ভালো রেজাল্টের সঙ্গে সঙ্গে দুজনেই বন্দুক ছোঁড়ার চর্চা করত। সিংগল অ্যাকশন শুটিং-এ ডাক্তারবাবুর মেয়েরা ছিল যাকে বলে অবিসংবাদিত চ্যাম্পিয়ন।
কিন্তু সুখ অস্থায়ী। ট্রেসি যখন
বাইশ আর সারা আঠেরো, তখন একদিন এক কম্পিটিশন থেকে ফেরার পথে সারা নিখোঁজ হয়ে গেল। বহু খুঁজেও
তাকে আর পাওয়া গেল না। সন্দেহ করা হল স্থানীয় যুবক এডমন্ড পার্কারকে। পার্কার একটা
রেপ কেসে অলরেডি ছ'বছর জেল খেটে এসেছিল। তার বিরুদ্ধে মামলা
চলল। এডমন্ড থাকত কাকা আর্থার পার্কারের বাড়িতে। সারার বডি পাওয়া গেল না, কিন্তু দ্বিতীয়বার তল্লাসি চালাতে গিয়ে আর্থার পার্কারের বাড়ি থেকে পাওয়া
চুল এবং কানের দুলের ভিত্তিতে এডমন্ড পার্কারের জেল হল।
তাতে অবশ্য ক্রসহোয়াইট পরিবারের
স্বস্তি কিছু হল না। কিছু বছর পর ডাক্তার জেমস ক্রসহোয়াইট একদিন
নিজের ঘরে বসে মুখে শটগান পুরে ট্রিগার টেনে আত্মহত্যা করলেন। অ্যাবি হোয়াইট মারা
গেলেন। সারা নিখোঁজ হওয়ার সময় ট্রেসির প্রেমিক ছিল বেন, পরে দুজনের
বিয়েও হয়েছিল। কিন্তু ছ'মাস যেতে না যেতেই সে বিয়ে ভেঙে গেল।
বিয়ে ভাঙার জন্য বেন দায়ী
করেছিল সারার নিখোঁজ হওয়ার ঘটনার প্রতি ট্রেসির অবসেশনকে। কথাটা খুব একটা ভুল নয়।
দোষীর শাস্তি হয়েছে ভেবে সারা সেডার গ্রোভ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও
ট্রেসি শান্তি পায়নি। ট্রেসি জানত সারার কেসে এডমন্ড পার্কারকে মিথ্যে সাক্ষ্য আর
প্ল্যান্টেড এভিডেন্সে ফাঁসিয়েছে সেডার গ্রোভের শেরিফ রয় ক্যালওয়ের দলবল।
যত না এডমন্ড পার্কারকে সুবিচার
পাওয়ানোর জন্য, তার থেকেও বেশি
সারার আসল খুনিকে ধরার জন্য উঠে পড়ে লাগল ট্রেসি। প্রথমেই বুদ্ধি খাটিয়ে স্কুলের
চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুলিশে ঢুকল। যাতে সারার কেসের ফাইলপত্রের নাগাল পাওয়া সহজ হয়। এক
দুই করে বছরের পর বছর কাটল, খড়কুটোর মতো খুঁটে খুঁটে জড়ো করা
তথ্যে ট্রেসির ফাইল ক্রমশ মোটা হতে লাগল, কিন্তু সেই প্রমাণ,
যা রবার্ট ক্যালোওয়ের শয়তানি সব সন্দেহের ঊর্ধ্বে গিয়ে প্রমাণ করবে,
সেটা ট্রেসি খুঁজে পেল না। সারা ক্রসহোয়াইটের বডি।
তারপর একদিন, ঘটনার কুড়ি বছর
পর জল সরে যাওয়া এক ড্যামের নিচে চাপা পড়ে থাকা এক অগভীর
গর্তের ভেতর থেকে একটা কংকাল বেরিয়ে পড়ল।
রবার্ট ডুগোনির নিজের জীবনটাও
বেশ গল্পের মতো। ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, লস এঞ্জেলেস থেকে আইন পড়ে সান ফ্রান্সিসকো
শহরে তেরো বছর ধরে উকিলি করেছেন তিনি। অবান্তরের পাঠকদের মধ্যে যদি কেউ উকিল থাকেন
এবং উকিলি করে করে তিতিবিরক্ত হয়ে গিয়ে থাকেন তাহলে তিনি পেশা বদলে রহস্যরোমাঞ্চ
লেখক হওয়ার কথা বিবেচনা করে দেখতে পারেন। উকিল থেকে মিস্ট্রি/থ্রিলার লেখায়
ঝাঁপানো এবং ঝাঁপিয়ে সফল হওয়ার উদাহরণ আগেও দেখা গেছে। যেমন জন গ্রিশাম।
যাই হোক, তেরো বছর
গুণ্ডাবদমাস পাজির পাঝাড়াদের হয়ে সওয়াল করে করে ডুগোনি ঠিক করলেন যথেষ্ট হয়েছে।
গোটা জীবনটাকে একখানা ইউ হল-এ চাপিয়ে তিনি রওনা দিলেন প্যাসিফিক নর্থওয়েস্টের
দিকে। গন্তব্য সিয়াটল শহর। 'মাই সিস্টার'স গ্রেভ' এবং ট্রেসি ক্রসহোয়াইট সিরিজের পরের
উপন্যাসগুলোর পটভূমি এই সিয়াটল। ইন্টারভিউতে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে
খুনোখুনির জায়গা হিসেবে সিয়াটলের মতো শান্ত ভদ্র শহরকেই তাঁর পছন্দ হল কেন। তাতে
রবার্ট বলেছিলেন যে এই প্রশ্নটা নাকি তাঁরও মাথায় এসেছিল।
I asked that question of a forensic anthropologist, and her answer was chilling. She said the reason we have so many serial killers is there are so many ways to dispose of a body. We have deserts. We have lakes. We have rivers, streams, bogs, marshes. We have mountains and forests. We also have weather that, because we are so far north, can change violently and quickly. We can have bright sunshine and then sudden severe rains. We get snow, sleet, hail, thunder and lightning, and high winds. All of that is wonderful for creating the mood in a good thriller.
প্যাসিফিক নর্থওয়েস্টের এই জলহাওয়াকে তাঁর গল্পে চমৎকারভাবে কাজে লাগিয়েছেন রবার্ট ডুগোনি। বিশেষ করে গল্প যখন শেষের কাছাকাছি পৌঁছেছে তখন চরিত্রদের মানসিক অবস্থার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে থান্ডারস্টর্মের সমাপতনটা আমার দিব্যি লেগেছে। যদিও ব্যাপারটা বিশেষ অভিনব নয়, মানুষের মনের সঙ্গে আকাশবাতাসের মেজাজের মিল দেখানোটা নাটকনভেলে আগেও অনেক হয়েছে, তবু।
রবার্ট ডুগোনির লেখা নিয়ে মন্তব্য করতে বললে ওই একই কথা বলতে হবে। অভিনব কিছু নয়। প্লটের তেমন কিছু ঘোরপ্যাঁচ নেই। রহস্য উন্মোচনের প্রক্রিয়াও সাদামাটা। তাছাড়া চরিত্রদের মধ্যে ভালোমন্দের প্রভেদ একেবারে পাথরে খোদাই করা। যে ভালো সে শুধু ভালো নয়, ভালো দেখতেও। ট্রেসি রোগা, লম্বা (পাঁচ দশ), ব্লন্ড এবং বুদ্ধিমান। ট্রেসির ছোটবেলার বন্ধু ড্যান, যে শহরের দামি উকিলের চাকরিতে প্রচুর টাকা রোজগার করে শেষে সবকিছু ছেড়েছুড়ে এসে ছোটবেলার শহরে শান্ত জীবনযাপন করছে তারও নীল চোখে যখনতখন দুষ্টুমি ঝলকায়। বোঝাই যাচ্ছে ট্রেসি আর ড্যানের প্রেম হবে, কাজেই এটা ফাঁস করার জন্য "এইও! স্পয়লার!" বলে আমার মাথা হাতে কাটবেন না প্লিজ। ট্রেসি আর ড্যানের প্রেমের দৃশ্যগুলো আমার মোটে ভালো লাগেনি। মিলস অ্যান্ড বুন-এর কথা মনে পড়ে যায়। বিশেষ করে রোম্যান্সের শুরু হিসেবে ড্যানকে দিকে ট্রেসিকে গলফের স্ট্যান্স শেখানোর মতো ঘিসিপিটি দৃশ্যের অবতারণা করাটা জাস্ট অমার্জনীয়।
রবার্ট ডুগোনির লেখায় বলার মতো ভালো জিনিসটা হচ্ছে তাঁর গল্পের গতি। গল্প তো নয়, যেন বাঘ। একবার পিঠে চড়লে আর নামার উপায় নেই। রাত দুটো বেজে যাক, পরদিন অফিস থাকুক, গল্পের শেষ না দেখে আপনি ছাড়তে পারবেন না। অসামান্য গল্প সাজাতে পারেন ভদ্রলোক। আমি ওঁর অন্য বই পড়িনি, কাজেই শুধু 'মাই সিস্টার'স গ্রেভ'-এর কথাই বলতে পারি, ছোট ছোট দৃশ্যভিত্তিক চ্যাপ্টারে একঘেয়েমি জন্মানোর কোনও সুযোগই নেই। গল্পের মাঝে মাঝে কুড়ি বছর আগের দৃশ্যও দক্ষতার সঙ্গে গুঁজেছেন ডুগোনি। কোথাও তা গল্পের গতিকে রুদ্ধ করেনি।
দুহাজার ছয় সালে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস 'জুরি মাস্টার'-এর পর এই ন'বছরে দশটি উপন্যাস লিখে ফেলেছেন রবার্ট ডুগোনি। ট্রেসি ক্রসহোয়াইট সিরিজের তিন নম্বর বই 'ইন দ্য ক্লিয়ারিং' দু'হাজার ষোলয় বেরোনোর জন্য তৈরি। বোঝাই যাচ্ছে লেখার মতো লেখকের স্পিডও হিংসে করার মতো। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে ডুগোনিকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়েছে যে উঠতি লেখকদের প্রতি তাঁর পরামর্শ কী, ডুগোনি বলেছেন, "It takes time, it just takes time."
eisob goenda galpo gulor kono bangla onubaad nai kuntala di,jana thakle khoj dio to..
ReplyDeleteনিশ্চয়, প্রসেনজিৎ। তবে এগুলো অপেক্ষাকৃত নতুন গল্প তো, এখনই অনুবাদ পাওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে আমি চোখকান খোলা রাখব, খোঁজ পেলে নিশ্চয় জানাব।
DeletePost ta ektu porei mone holo spoilers achhe. Tai egolam na :(
ReplyDeleteমিছেই ভয় পেলে সোমনাথ। গল্পের দুই সুশ্রী প্রধান চরিত্রের মধ্যে প্রেম হবে, সে ছাড়া আর কোনও গোপন তথ্য আমি ফাঁস করিনি।
Delete