ফাঁকির রুটিন
জমানো কাগজ ঘাঁটতে বসলে প্রায়ই একেকটা খোলা পাতা বেরিয়ে পড়ে, যেগুলোর দিকে ভালো করে না তাকিয়েই আমি বাজে কাগজের ঝুড়িতে চালান করি। কারণ ওই একনিমেষেই আমি দেখে নিয়েছি পাতাগুলোয় খোপ খোপ কাটা। আমি জানি ওই খোপের বাঁদিকের কলামে ওপর থেকে নিচে সাতটা খোপে লেখা আছে সাতটা দিনের নাম আর সবার ওপরের রোয়ে লেখা আছে সকাল চারটে থেকে রাত দশটা পর্যন্ত সময়, বিভিন্ন মাপে ভাগ করা। পাতার বাকি খোপগুলোয় অফিস, গান, অবান্তর, গান, হাঁটা, রান্না, বেড়ানো ইত্যাদি শব্দ সেজেগুজে বসে আছে। আমারই অপেক্ষায়।
রুটিন বানানোর রোগটা আমার এই সেদিন পর্যন্ত ছিল। দু’ঘণ্টা লিখব, একঘণ্টা হাঁটব, একঘণ্টা গাইব, আটঘণ্টা কাজ করব - কাজের সময় বসে বসে এইসব ভাবতে, নিত্যনতুন ভাবে চব্বিশঘণ্টাকে কাটাছেঁড়া কী যে ভালো লাগত।
যতদিন না মেনে নিলাম যে রুটিন মেনে চলা আমার পক্ষে অসম্ভব। কেন অসম্ভব সেটা বুঝতে লেগে গেল আরও অনেক সময়। অসম্ভব, কারণ আমি গোটা ঘটনাটাকে অ্যাপ্রোচ করছিলাম ভুল দিক থেকে। রুটিন তখনই কাজে লাগে যখন তা রুটিন পালনকারীর ধাত বুঝে বানানো হয়। কাজ আমার ধাতে নেই, কাজেই কাজের রুটিন আমার চলবে না। আমার দিনটাকে সাজাতে হবে অন্যভাবে, আমার ধাতের কথা মাথায় রেখে।
আমার পক্ষে আদর্শ রুটিন হবে যা ফাঁকি বা ফাঁককে ঘিরে বানানো হয়েছে। এই সহজ কথাটা আমি বুঝলাম এই সেদিন। যেদিন আবিষ্কার করলাম অজ্ঞাতেই আমার জীবনটা একটা রুটিনবাঁধা পথে চলতে শুরু করেছে। আর সে রুটিনটা দাঁড়িয়ে আছে আমার সারাটা দিনের কয়েকটা ফাঁকের কাঁধে ভর দিয়ে। বাড়িতে থাকার সময়টা পুরোটাই ফাঁকি, তাই সেগুলো বাদ দিলাম। সোম থেকে শুক্র প্রতিদিন অফিসে কাটানোর যে প্রাণঘাতী ন’ঘণ্টা, তার বুনিয়াদ যে ক’টা ফাঁক বা ফাঁকি, তাদের কথা রইল এই পোস্টে।
বোনাস ফাঁকিঃ প্রথমেই বলে নিই অফিসে পৌঁছনোর পরের আধঘণ্টার কথা। এই সময়টাকে অবশ্য আমি ফাঁকি বলতে রাজি নই। এর মধ্যে পনেরো মিনিট যায় বোতলে জল ভরতে, চায়ের জোগাড় করতে, মাকে ফোন করে পৌঁছসংবাদ দিতে, অর্চিষ্মানের পৌঁছসংবাদ নিতে। বাকি পনেরো মিনিট আমি তৈরি হই আসন্ন যুদ্ধের জন্য।
দিনের প্রথম বৈধ ব্রেকটা আমি নিই বেলা এগারোটা নাগাদ। এ সময় আমার পায়ে ঝিঁঝিঁ ধরে, চোখ ব্যথা করে, মন খারাপ লাগে। বেশি কাজ করে ফেলার লক্ষণ সর্বাঙ্গে ফুটে বেরোয়। তাছাড়া একটা কী খাই কী খাই ভাব হয়। আমি ফোন আর পার্সটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। আমাদের অফিসের পেছনে একটা ছোট কিয়স্ক আছে, সেদিকে হাঁটি। একজোড়া মাঝবয়সী ভদ্রলোক ভদ্রমহিলা কিয়স্কটা চালান। কিয়স্কে চা, সিগারেট, ম্যাগি পাওয়া যায়। বাইরে জালির তালাবন্ধ বাক্সে কুরকুরে আর বিংগো টেড়েমেড়ে, কিয়স্ক থেকে তেঁতুল গাছের ডাল পর্যন্ত টাঙানো দড়িতে হলদিরামের বেগুনি হলুদ প্যাকেট নমকিনের প্যাকেট। কিয়স্কের ভেতরের ফ্রিজে মাদার ডেয়ারির দই, তড়কা লস্যি, কোল্ড ড্রিংকসের ছোট ছোট কাচের বোতল আর সামনে কাচের হট বক্সে শিঙাড়া, ব্রেড পকোড়া। তেঁতুল গাছের গোড়ায় কাত করে দাঁড় করানো স্কুটারের চাকার কাছে থাবায় মাথা রেখে শুয়ে থাকে একটা কালো কুকুর, যার মাথা আর শরীরটা নেড়ি কিন্তু লেজখানা বাজখাঁই ঝালরের মতো।
আমি গত প্রায় দু’বছর ধরে ওই একই সময়ে ওই কিয়স্কে যাই। হয় শিঙাড়া নয় নাট ক্র্যাকারের পাঁচ টাকার প্যাকেট কিনি। নাট ক্র্যাকার কিনলে ঝামেলা নেই, শিঙাড়া কিনলে ভদ্রলোকের সঙ্গে একটা কথোপকথন চালাতে হয়। আমি শিঙাড়াটা প্যাক করে দিতে বলি। ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করেন প্লেট এবং টমেটো সসের পাউচও প্যাক করতে হবে কি না। আমি দুটোতেই না বলি। অবিকল এই কথোপকথনটা গত দু’বছর ধরে চলছে। আমি প্রথমটা ভাবতাম ভদ্রলোক আমাকে অপছন্দ করেন তাই আমার সঙ্গে অপরিচয়ের দূরত্বটা একইঞ্চিও কমাতে রাজি নন। কিন্তু এখন সন্দেহ হয় ঘটনাটা শর্ট টার্ম মেমোরি লস-এরও হতে পারে।
আমার দিনের দ্বিতীয় রুটিনমাফিক ফাঁক হচ্ছে লাঞ্চ। অফিসের বেশিরভাগ লোকই বাড়ি থেকে খাবার আনে। কেউ কেউ কাছাকাছি রেস্টোর্যান্টে খেতে যায়। কয়েকজন বাইরে থেকে অর্ডার করে। আর হাতে গোনা কয়েকজন যায় অফিসের ক্যান্টিনে। ক্যান্টিনটা আমাদের অফিসের নয়। আমাদের অফিসের পাশাপাশি আরও অনেক অফিস আছে ও তল্লাটে। তাদের সবার কথা মাথায় রেখে ক্যান্টিন বানানো হয়েছে। শসা, আচার, ডাল, একটা সবজি, ভাত, রুটি এবং একটি মিষ্টি পদ পঁয়ত্রিশ টাকায় পাওয়া যায়। আমি ওখানেই খাই। আমার ধারণা ছিল সবাই ওখানেই খায়। ইন ফ্যাক্ট, কেন কেউ ওখানে ছাড়া আর কোথাও খাবে সেটাই আমার ধারণায় ছিল না। কিন্তু দেখলাম ঘটনাটা সত্যি নয়। যাঁদের খরচ করার মতো পয়সা আছে তাঁরা প্রায় কেউই ক্যান্টিনে খান না। দেড়শো টাকার মাঞ্চুরিয়ান কিংবা আড়াইশো টাকার সুপ + স্যালাড বোনানজা অফার অ্যাভেল করেন।
ক্যান্টিনের খাবার না খাওয়ার অবশ্য গোটা দুই যুক্তি আছেও। অনেকেরই শুধু নিরামিষ খাবারে অসুবিধে হয়। অনেকের বোরিং লাগে। রোজ রোজ সেই ডাল তরকারি। এই অভিযোগটা সত্যি। বৈচিত্র্যের সন্ধানে থাকলে ক্যান্টিনের খাবার হতাশ করবে। আমার আবার ওই একঘেয়েমিটাই পছন্দ। নানারকম থাকলেই বাছতে হয়। মাথা খাটাতে হয়। আমার দিনের হাতে গোনা হক্কের ফাঁকিতে আমি সে পরিশ্রমটুকু করতে রাজি নই।
তিন নম্বর এবং শেষ বিরামটা আমি নিই সাড়ে তিনটে থেকে চারটের মধ্যে। ওই সময়টা আবার চায়ের প্রয়োজন পড়ে। এই চা-টা আমি অফিসে খাই না। সকালের কিয়স্কেও না। এই ব্রেকে আমি যাই অফিসের অন্যদিকের খাঁটি রাস্তার চায়ের দোকানে। পাঁচিলের গা ঘেঁষে খেলিয়ে বানানো। মাথার ওপর ত্রিপলের ছাউনি। দোকানের পেছনদিকে পাতা চাদর বালিশ দেখে বোঝা যায় সাময়িক রাত্রিবাসের ব্যবস্থা আছে। চাদরের সামনে বাবু হয়ে বসে চা বানান হয় মা, নয় ছেলে, নয় ছেলের বউ। সম্পর্কগুলো আমি চেহারা আর বয়স দেখে আন্দাজ করেছি। একটা কাঠের সেকেলে সুটকেসের ভেতর প্লাস্টিকের প্যাকেটে বিস্কুট রাখা থাকে। পুরীর খাজার মতো দেখতে কিন্তু খাজার থেকে অনেক হালকা একরকমের নোনতা বিস্কুট, যাকে বলে ফেন আর মোটা মোটা মঠ্ঠি। একটা খেলে পরের দু'ঘণ্টা আর খাবার চিন্তা মাথায় আসবে না। আমি নিই একখানা 'ফিকি' চা আর খিদে বুঝে কোনওদিন ফেন, কোনওদিন মঠ্ঠি। এ দোকানের লোকজন আমার সঙ্গে রীতিমত কথাবার্তা বলেন। লোকজন মানে শাশুড়ি। আমি একদিন হাজিরা কামাই দিলে শাশুড়ি রীতিমত অভিযোগ জানান। ছেলে মুখচোখে ফ্রেন্ডলি ভঙ্গি জাগিয়ে রাখেন কিন্তু দরকারের বাইরে কথা বলেন না। ছেলের বউ তিনজনের মধ্যে সবথেকে গম্ভীর। চিবুক পর্যন্ত টানা ঘোমটার আড়ালে তার মুখ আমি কোনওদিন দেখিনি, কিন্তু গলা শুনেছি। পার্সোনালিটি টইটম্বুর। তবে বোধহয় আমি ওঁর গুডবুকে আছি। আমার দিকে চায়ের কাগজের কাপ এগিয়ে দেওয়ার আগে উনি সর্বদা আরেকটা প্লাস্টিকের কাপের ভেতর সেটাকে রেখে তবেই দেন। পাছে আমার আঙুলে ছ্যাঁকা লাগে। আমি খেয়াল করে দেখেছি আর কোনও খদ্দেরের ভাগ্যে এ ট্রিটমেন্ট জোটে না।
সারাদিনে আর কোনও কাজ হোক না হোক, এই ফাঁকের রুটিনে আমার একদিনও ফাঁকি পড়ে না। জীবনে একটা রুটিন অবশেষে মানতে পেরে কী যে গর্ব হয়।
Kajer routine theke fakir routine onek beshi kajer.r achieve korar satisfaction o thake. Bhalo laglo pore
ReplyDeleteধন্যবাদ, প্রিয়াঙ্কা।
DeleteKhubi bhalo routine. Fakibaj loker sathe mela mesha korleo mon bhalo thake. Ki labh ei jeebon ke ato seriously niye.
ReplyDeleteনা সে হয়তো লাভ আছে, কুহেলি। কিন্তু যা হবার নয় তা আর হওয়াই কী করে। কাজেই এরকমই চলুক।
Deleteএ কি ফাঁকি গো..! এতো ম্যানেজার এর রুটিন। তুমিও কি ম্যানেজার ? চা খেতে না গিয়েও চা খেয়ে আসছি বলার ব্রেক নেই , চা এর ব্রেক এ গিয়ে বন্ধুর জন্মদিন তাই খাওয়াবে আর লেট হবে বলা নেই , ফোন ধরতে বেরিয়ে কারুর সাথে দেখা করা নেই , টয়লেট গিয়ে গল্প করা নেই, দরকারি কাজে ব্যাঙ্ক এ গিয়ে বন্ধুর সাথে দেখা করে ফেরা নেই, আর সকালে অফিস গিয়ে অনলাইন কাগজ পড়া, কারুর ফেয়ারওয়েল এর চাঁদা তোলা এগুলো দরকারি ব্রেক এর মধ্যে ধরি ... আমি তো দেখছি স্কুল থেকে বেরিয়ে মহা বিচ্ছু হয়ে গেছি ... :(
Deleteআরে বিচ্ছু কীসের, চাঁদা তোলাটা তো আমার মতে কী বোর্ড পেষার থেকে অনেক শক্ত কাজ। তুই সেটা করিস (কী বোর্ড পেষার সঙ্গে সঙ্গে) দেখে আমি ইমপ্রেসড, ঊর্মি।
Deleteআমি তো ফাঁকিবাজি কিছুই দেখলাম না, ন ঘন্টায় মাত্র তিনটি ছোট break !
ReplyDeleteবেশ কর্মবীরের রুটিন ই তো লাগলো :)
হাহা কাকলি, কথাটা হচ্ছে দিনের বাকি কাজগুলো অপশনাল, এই তিনটে ফাঁকি অপশনাল নয়।
Deletedurdanto laglo phnakir routine.. aami o ekta banabo bhabchi.. oboshyo tate mone hoi ghum chara sob somoytai dhuke porbe..
ReplyDeleteoffice e giye altopka net browse kore somoy noshto nei dekhchi.. aar whatsapp er ting tang.. :)
হোয়াটসঅ্যাপে আমি নেই, কাজেই সে ডিসট্র্যাকশন নেই ইন্দ্রাণী। নেট সার্ফিং আছে, কিন্তু সেটা বাকি সব কাজের সঙ্গে এমন জড়িয়ে আছে যে তাকে আলাদা করে বাছা মুশকিল। তাছাড়া সেই ফাঁকিগুলো তো ঠিক রুটিনমাফিক নয়। সময় পেলে হল, না পেলে হল না। এই যে তিনটে ফাঁকি, এরা সময় থাকলেও হবে, না থাকলেও হবে। সেইজন্য এরা স্পেশাল।
Deleteআমার সবচেয়ে ভালো লাগলো ৩ নং ফাঁকিটা। এক্কেরে খাঁটি দেহাতি ফাঁকি বা দেহাত জড়ানো ফাঁকি। ফেন আর কিন্তু মঠ্ঠি অসাধারন। কিন্তু গল্পটুকু, না আসার অনুযোগটুকু, আরেকটা প্লাস্টিকের কাপের ভেতর রেখে চা এগিয়ে দেওয়ার ভঙ্গিমাটুকুর জন্যই এই ৩ নং ফাঁকিটা বেস্ট।
ReplyDeleteহাই ফাইভ, কৌশিক। আপনি যে জিনিসগুলো বললেন, ওইগুলোর জন্য আমারও তিন নম্বর ফাঁকিটাই বেস্ট লাগে।
Deleteআরে এ তো আমাদের রুটিন পুরো কেটে বসানো! ল্যাব আসার পর থেকে মিনিট গুনতে থাকি, কখন চা খেতে যাব আর হাহা হিহি হবে| ইদানীং অবশ্য মনে হচ্ছে পয়সা বাঁচানো উচিত, তাই ফ্লাস্কে চা আনছি| তাতে পয়সা বাঁচছে, সময় নয় ;)
ReplyDeleteএত অফুরন্ত সময়, বাঁচিয়ে কী হবে অন্বেষা। আরও বেশি করে খরচ কর, আরও ঘন ঘন চা খাও।
Deletekhub sundar hoyechhe lekhata... Macher jhol er gaan sunle naaki? http://www.sawandutta.com/#!macherjhol/kf04t
ReplyDeleteরোদ্দুর রায়ের বাজার গেল তো। নাকি মাঝখানে আরও কেউ ছিল?
DeleteEkebaare roddur roy er category te fele dile?? :D
Deletedarun darun darun. phnakir routine ta amar khub pachhondo holo.
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ ইচ্ছাডানা। আপনার অবান্তরের পোস্ট ভালো লাগলে আমার যে কী ভালো লাগে।
Deleteissh teen nombor phanki ta ki daroon....erokom "organically" gojiye otha dokan aami atibo priyo :)
ReplyDeleteআমারও শম্পা। হাই ফাইভ।
DeleteAmi to kaj ta thik ekebare ei rokom routine Mene kori.. almost ek routine....
ReplyDeleteদলে লোক পেয়ে খুশি হলাম, শিবেন্দু।
Delete