ছবিহীন বার্লিন/ ১



হোটেলে ঢোকার মুখে দেখেছিলাম রাস্তার ওপারে একটা ভাঙাচোরা সিংদরজা। সামনে থামওয়ালা একটা ঢাকা বারান্দা। মেঘলা আকাশের গায়ে ভাঙা মাথাটা কালো, পোড়া। দেখলেই বোঝা যায় একে সময় ভাঙেনি, ভেঙেছে মানুষ। বা মানুষের হাতে তৈরি বোমা। ভেবেছিলাম যদি এদিকমুখো ঘর পাই তাহলে ‘ভিউ’ ক্যাপশন দিয়ে সিংদরজাটার ছবি দেব অবান্তরে। 

ঘরে ঢুকে দেখলাম জানালার নিচে একটা পার্কিং লট, লট পেরিয়ে আরেকটা গগনচুম্বী হোটেলের গা, গা বেয়ে হু হু করে নামছে স্বচ্ছ সার্ভিস এলিভেটর। এলিভেটরের ভেতর একজন গাঁট্টাগোট্টা মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন হলুদ ট্রলিতে আলগোছে হাত রেখে। ট্রলির বিভিন্ন খোপে ঝাঁটা, সারি সারি ক্লিনিং লিকুইডের বোতল সাজানো। 

ঘরের ভেতরটাও মন ভালো করার মতো কিছু নয়। ভিট্রুভিয়ান ম্যান হয়ে শোওয়ার মতো খাট, খাটে দুধসাদা চাদর, ফুলকো বালিশ, উষ্ণ লেপ। পড়ার টেবিল, বসার এবং লোক বসানোর সোফা, আড়াল দিয়ে একখানা মাইক্রোওয়েভ আর ছোট্ট ফ্রিজ, ইলেকট্রিক কেটলি আর চা ব্যাগ। ঘরের বিভিন্ন কোণে মুড লাইটিং। এমন সাউন্ডপ্রুফিং যে কানের মধ্যে নীরবতা বুজকুড়ি তোলে। শীতল, কঠিন আরাম ঘিরে রয়েছে চতুর্দিক। এ আরামকে সহনীয় করে তুলতে পারে একমাত্র স্কাইপ। কিন্তু হাতের ঘড়ি বলছে দিল্লিতে এখন ভরা অফিসটাইম। এখনও অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে।  

দূরছাই বলে জানালা থেকে সরে আসতে যাব এমন সময় বাঁ দিকের মেঘ চিরে চিরে রোদ্দুর বেরোলো। তার আলোয় চকচক করে উঠেছে একটা হলুদ বাড়ির তিনকোণা কালো ছাদ, ছাদ ফুঁড়ে ওঠা লোহার ঢাকনা পরানো চিমনি। 

এই ছবিটাও তো দেখানোর মতোই ভেবে ফোনটার খোঁজ করলাম। এত কম সময় বলে ক্যামেরা আনিনি। ফোনে তোলা ছবিই অবান্তরে ছাপাব। ব্যাগের যেখানে ফোনটা থাকার কথা ছিল সেখানে নেই। যেখানে থাকার কথা ছিল না, সেখানেও না। প্লেন থেকে নামার সময় ছিল। পাসপোর্টের সঙ্গেই। পাসপোর্টটা ছিল ব্যাকপ্যাকের বাইরের ফ্ল্যাপে। হোটেলে ঢুকে রিসেপশনে সেটা দেখানোর সময় ব্যাকপ্যাক থেকে বার করতে গিয়ে দেখেছিলাম ফ্ল্যাপটা খোলা। নিজেকে বকেছিলাম এত বেখেয়াল হওয়ার জন্য। 

পাসপোর্টটা ছিল। এখনও আছে। ফোনটাও ছিল। এখন ফোনটা নেই।  

ফোনটা আমার এখানে কোনও কাজে লাগত না। রবিবার ভোরে এয়ারপোর্টে অর্চিষ্মানকে খুঁজে বার করতে লাগবে। কিন্তু তার এখনও দেরি আছে। তাছাড়া খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরি করলে দেখা হয়েই যাবে দুজনের। এ ফোনটা পুরোনোও হয়ে গিয়েছিল। বার দুয়েক হাত থেকে পড়ে স্ক্রিনটা ফেটে গিয়েছিল। একটা কোনও সেন্সর খারাপ হয়ে গিয়েছিল যার জন্য কল চলাকালীন স্ক্রিন অন্ধকার থাকত। অপর পক্ষ ফোন না কাটলে আমি ফোন কাটতেও পারতাম না। 

ফোনটা আমার এখন লাগত শহরের ছবি তুলতে। সে ছবি তোলা হবে না। ছবি ছাড়া বেড়ানোর গল্প কেমন হবে? 

*****

এদিকে এখন বেশ শীত। দশের নিচে। তার মধ্যে বৃষ্টি হচ্ছে রোজই। সেই বুঝে একটা ছাতা এনেছিলাম। আমস্টারডামের  এয়ারপোর্টে সে ছাতা ধরা পড়ল। ভদ্রমহিলা মাথার ওপর ছাতা খুলে ঝাঁকিয়ে পরীক্ষা করলেন। সারাদুপুর জানালা দিয়ে মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে ফোনের শোকপালন করলাম। সন্ধ্যে ছ’টায় খেতে যাওয়া হল। হাঁটতে হাঁটতে সেই সিংদরজাটা পেরোলাম। এখানকার গাছে এখন ‘ফল কালারস’। প্লেন থেকে নামার সময় দেখেছিলাম সারা শহরটা লাল হলুদ রঙে ছেয়ে গেছে। সেই রং লাগা একটা গাছ সিংদরজাটাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে। আমার পাশে পাশে হাঁটছিল টি। এর ষাট বছরের জন্মদিন পালন করেছিলাম আমরা দু’হাজার তেরোয়, কেক কেটে, মোমবাতি জ্বালিয়ে। স্ত্রীর সঙ্গে জার্মানি আর পোল্যান্ডের বর্ডার বরাবর দু’সপ্তাহের বাইক রাইড হলিডে পালন করে টি-ও আজকেই বার্লিন এসে পৌঁছেছে। টি আমাকে সিংদরজাটা দেখিয়ে বলল, এইটা ছিল আসল আনহল্টার বানহফ স্টেশন। (এখনও ওই নামের স্টেশন আছে, ওটাতেই আমি এসে নেমেছি ট্রেন থেকে। সে আধুনিক কলকব্জামণ্ডিত ঝকঝকে স্যানিটাইজড স্টেশনে সব আছে, এই ভাঙাচোরা সিংদরজার ঔদ্ধত্য আর গরিমাটা ছাড়া) এ ঢিলএকসময়ের ইউরোপের প্রকাণ্ডতম টার্মিনাস। তারপর যুদ্ধে বোমা পড়ে এর এই দশা হল। 

টি বলল, আমরা এখন যেখানে আছি, সেখানটা হচ্ছে জার্মান ইতিহাসের - টি থেমে যোগ করল, “গুড অ্যান্ড ব্যাড” - একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। ব্র্যান্ডেনবুর্গ গেট,  রাইখস্ট্যাগ (পার্লামেন্ট) বিল্ডিং, বার্লিন প্রাচীরের ধ্বংসাবশেষ, হিটলারের বাংকার সব হাতের নাগালের মধ্যে। হোটেল থেকে সাড়ে চারশো মিটার হেঁটে আমরা পৌঁছে গেলাম গুস্তাভ রেস্টোর‍্যান্টে আমাদের ওয়েলকাম ডিনারের জন্য।

সাড়ে চারশো মিটার? পাতা উল্টে গুগল ম্যাপের স্টিল শট দেখে অর্চিষ্মান চোখ কপালে তুলেছিল। এ কী রকম লজিস্টিকস বুকলেট? এই বুকলেট আমাদের কাছে পৌঁছেছিল মাসখানেক আগেই। যে সাড়ে তিনদিন আমরা এদের আতিথেয়তায় থাকব, সেই সাড়ে তিনদিনের পুঙ্খানুপুঙ্খ শেডিউল। সকালে ব্রেকফাস্ট থেকে শুরু করে হলে জড়ো হওয়ার সময় থেকে শুরু করে কোন রাস্তায় কতখানি হেঁটে মিউজিয়াম, সেমিনার হল, বাসে চড়ার সময়, মাঝখানে লাঞ্চ ব্রেকে আবার কোন রাস্তায় কতখানি হেঁটে রেস্টোর‍্যান্ট, রাতে সাংস্কৃতিক শো দেখতে যাওয়ার সময় আবার কোন রাস্তা, কোন বাঁক, ক’পা সব লিখে ছবি এঁকে বুঝিয়ে দেওয়া। 

এবার তো তাও কম। এমনও ঘটেছে যে এক মাস আগে লাঞ্চের মেনু এসে পৌঁছেছে জিমেলে। টিক দাও কী খাবে, মাছ না মাংস। ডিপ ফ্রায়েড না স্টিমড। গ্লুটেন ফ্রি না লো প্রোটিন। যারা ফ্রি স্পিরিট তাদের হয়তো এত বাঁধাবাঁধিতে অসুবিধে হতে পারে। আমার হয় না। এরা যত বেশি ভাববে আমাকে ভাবতে হবে তত কম। আমার সারাজীবনের একটা বুকলেট কেন কেউ আমার মায়ের হাতে ধরিয়ে দেয়নি নার্সিং হোম থেকে বেরোনোর সময়, সেটাই আমার সবথেকে বড় নালিশ। 

তা বলে একেবারেই কি গোলমাল হয় না? কোনও কারণে যদি একটা ধাপ ভুল হয় তাহলেই তাসের ঘরের মতো পুরো প্ল্যান ভেঙে পড়তে থাকে। আসার সময় আমার কথা ছিল বাস ধরে ব্র্যান্ডেনবুর্গ আসার, সেখান থেকে ট্রেন নিয়ে আনহল্টার বানহফ। বাসে বসে চারদিক দেখতে দেখতে আসছি, বৃষ্টির জলে ধোয়া গাছের পাতা, পাথরের রাস্তার খাঁজে খাঁজে জমা ছোট জলের পুল, উঁচু দোকান, নিচু বাড়ি, পার্ক, মিউজিয়াম, দেওয়ালের আড়ালে কনস্ট্রাকশন সাইটে আকাশ ছোঁয়া জার্মান ক্রেন। মন দিয়ে দেখছিলাম, কারণ এবার এত কম সময়ের জন্য আসা যে ঘোরাঘুরির সময় প্রায় হবেই না। এমন সময় মাইকে ড্রাইভার জার্মান ভাষায় বক্তৃতা শুরু করলেন। পাশের সহৃদয় মেয়েটি আমাকে সেটা অনুবাদ করে দিল। ব্র্যান্ডেনবুর্গে কী একটা মিটিং হচ্ছে তাই রুট ঘুরিয়ে দেওয়া হল। 

হয়ে গেল আমার শহর দেখা। কাঠ হয়ে বসে সামনের বোর্ডের দিকে তাকিয়ে থাকলাম যেখানে আমার নতুন স্টপেজের নাম ফুটে উঠবে। পাশ দিয়ে হুস হুস করে বেরিয়ে যেতে লাগল লালহলুদ পাতা, পাথরের খাঁজে জলের পুল, উঁচু দোকান, নিচু বাড়ি, পার্ক, মিউজিয়াম, জার্মান ক্রেন। নিজেই বুঝতে পারছিলাম এত টেনশনের কিছু হয়নি। বোর্ডের লেখার সঙ্গে সঙ্গে ঘোষণাও হবে আর জার্মানে ঘোষণা হলেও স্টেশনের নাম আমার কান চিনতে পারবে। নিজেকে জোর করে জানালার দিকে ঘাড় ঘোরাতে বাধ্য করলাম। আর যেই না করলাম অমনি দেখি একটা উঁচু বাড়ি হুস করে বেরিয়ে যাচ্ছে যার মাথায় বড় বড় অক্ষরে লেখা আছে B E H A L A। 

                                                                                                                             (চলবে)


Comments

  1. কি কান্ড!
    প্লেন, ফোন আর কুন্তলাদেবীর মধ্যে একটা ত্রহ্যস্পর্শ যোগ আছে বলে আমার ধারণা। একবার কলকাতা এয়ারপোর্টেও ফোন হারিয়েছিল না? আরেকবার অ্যাডাপ্টর না নিয়ে বিদেশ পাড়ি দিয়েছিলেন না?
    আরও সহৃদয় পাঠকদের হাটে নিজের হাঁড়ি ভাঙুন! এমন ছোটলোক, সব মনে করে রেখে দেয়, আর নুনের ছিটেটুকু ঠিক সময়ের জন্য তুলে রাখে। ঝাঁটা মারতে হয় এমন পাঠকদের মুখে...
    অদ্যই তো শেষ রজনী, এক সপ্তাহ তো আজই শেষ হচ্ছে? তার মানে কি শনিবার শেষরাতে/রোববার সকালে ব্যাক? ভালোয় ভালোয় ফিরে আসুন। বাকি গল্প শোনার আশায় রইলাম। ফাঁকতালে একটা আইফোন সেভেন কিনেই ফেলুন এইবেলা, শুনেছি একটা কিডনি বেচে দিলেই দামটা উঠে আসে।
    ওই ভাঙা সিংদরজাটার একটা ছবি অনেক আগে দেশে দেখেছিলাম। নিচে ক্যাপশন ছিল - আর যুদ্ধ নয়।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আর বলবেন না, দেবাশিস। হারানো যায় এমন জিনিস (রুমাল, ফোন, ছাতা, টিফিনবাক্স, আইডি কার্ড, চাবি) সবের সঙ্গেই আমার ত্র্যহস্পর্শ যোগ আছে। আজ সকালেই চাবি ঘরের ভেতর রেখে দরজা টেনে দিয়ে রিসেপশনে গরুচোরের মতো মুখ করে গিয়ে বলতে হল যে আমাকে দয়া করে আরেকটা চাবি দিন।

      আজ শেষ নয়, আজ পেনালটিমেট রজনী। আমি বেরোব এদের রবিবার দুপুরে। প্রিন্সিপল ভেঙে ম্যাকবুক কিনে নাকখত দিয়েছি, আই ফোনে আমি নেই। (আই ফোনও আমাকে নেই অবশ্য।)

      Delete
  2. "ভিট্রুভিয়ান ম্যান হয়ে শোওয়ার মতো খাট" - এবার থেকে হোটেল এর বিছানা দেখলেই এটা মনে পড়ে যাবে!

    যাক, ভালোয় ভালোয় বেহালা পৌঁছে গেছো শুনে নিশ্চিন্ত হলাম :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, থ্যাংক ইউ, কাকলি।

      Delete
  3. Tumi likhle toh chobir dorkar hoye na ... moner chokh diye dibbi dekhchi. :-)

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে, থ্যাংক ইউ, শর্মিলা।

      Delete
  4. BEHALA - Berliner Hafen und Logistik mbH.

    Shoja bhashay Crgo Company.

    Shuteertho

    ReplyDelete
  5. chhobi sottii lekhai chole esechhe...

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, ইচ্ছাডানা।

      Delete

Post a Comment