জুসারের সঙ্গে
জানালার বাইরে জঙ্গলের মাথা আর মাথার ওপারে ছড়ানোছেটানো দু’চারটে বহুতল হোটেলের কাচের গায়ে রোদ্দুরের ঝলসানি দেখতে দেখতে, প্রতি চুমুকের মাঝে পাঁচ সেকেন্ড বিশ্রাম নিয়ে অর্ধেক বোতল জল শেষ করে, বোতলে আবার জল ভরে, খুব আস্তে হেঁটে হেঁটে সিটে ফিরে এসে দেখি পাঁচ মিনিটও নষ্ট করতে পারিনি। মনখারাপ করে ধপাস করে চেয়ারের ওপর বসে ফোনটা হাতে তুলে আঙুল বোলালাম, অমনি মা বাঁচিয়ে দিলেন। মিসড কল। ‘মা মোবাইল’।
মা ইদানীং মাঝে মাঝেই বলেন, “সব কাজ তো ফুরোলো, আর বেঁচে কী হবে?” মা না বাঁচলে যে রোজ রোজ, সকালবিকেল আমাকে বাঁচানোর কেউ থাকবে না, এটা মাকে কে বোঝাবে।
চেয়ার ছেড়ে উঠলাম। জল খেতে ওঠার সময় যে রকম একটা চোর চোর ভাব থাকে, এ বার সেসব নেই। ফোন কানে ধরে, ভুরু কুঁচকে, গটগট করে অফিসের দরজার দিকে হাঁটছি। চাপা, আর্জেন্ট গলায় একবার “হ্যালো” বললাম, যাতে কারও কোনও সন্দেহ না থাকে, দিস ইজ ইম্পরট্যান্ট। আই হ্যাভ টু টেক দিস।
“সোনাআআ!”
ভাগ্যিস ঠিক একসেকেন্ড আগে অফিসের চৌকাঠ টপকে এসেছি, না হলে এই রিনরিনে গলায়, বিস্ময় আর উত্তেজনা আর কৌতুক আর আরও পাঁচশোরকম নন-সিরিয়াস ইমোশন মাখামাখি ডাকটা কানে গেলে আমার কোঁচকানো ভুরু আর গটগটে পদক্ষেপ কাউকে বোকা বানাতে পারত না।
“জুসারের সঙ্গে নারকেল গাছ ফ্রি দিচ্ছে।”
কিছু কিছু বাক্যের সবগুলো শব্দ বোঝা গেলেও বাক্যটা অবোধ্য থেকে যায়। জুসার, নারকেল, গাছ, ফ্রি, কোনওটাই তো না বোঝার কিছু নেই, কিন্তু এগুলো পাশাপাশি বলে গেলে কোনও মানে দাঁড়ায় না। অন্তত সেই মুহূর্তে আমার কাছে দাঁড়াচ্ছিল না।
“কী?”
“নারকেল গাছ। ফ্রি দিচ্ছে। জুসারের সঙ্গে।”
মায়ের এই আরেকটা দোষ। কখনওই কনটেক্সট ক্লিয়ার করেন না। ছোটবেলায় শিখেছিলাম রচনা, গল্প, উপন্যাস, ফেসবুক পোস্ট, ব্লগ, টুইট, যা-ই লেখো না কেন তার সূচনা, বর্ণনা, উপকারিতা, অপকারিতা, উপসংহার থাকতে হবে। মা এ সব বস্তাপচা ব্যাকরণ মানেন না। মা শুরু করেন অ্যাকশন দিয়ে। আজীবন করে এসেছেন।
মালতী থালা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল, আমি গাজরসেদ্ধ খাব না, খাব না, খাব না। আমাকে আলুভাজা এনে দাও। মালতীর যে বাবা নেই, মালতীর মা যে দুঃখী, মালতীর চোখে যে হাই পাওয়ার, সে জন্য যে ডাক্তারবাবু বেশি করে গাজর খেতে বলেছেন, কিন্তু মালতী যে মায়ের কথা শোনে না (আমি যদিও শুনি, কাজেই এরপর মালতীর জীবনে ঘোর বিপর্যয় দেখা দেবে এবং আমার জীবন হবে কেকওয়াক), এ সব পরে দরকার হলে মা ব্যাখ্যা করবেন, না হলে নয়।
লিফটে ঢুকলে মাঝে মাঝে ফোন কেটে যায়, তাই আমি পাঁচতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করি।
“কে দিচ্ছে? কেনই বা দিচ্ছে?”
একতলা পৌঁছোতে পৌঁছোতে গোটা ব্যাপারটা ক্লিয়ার হয়। খেয়ে উঠে দুখানা খবরের কাগজে খুনরাহাজানি, তহবিল তছরুপ, পাত্রপাত্রী, জ্যোতিষী, কুকুরের জন্মদিনের ঘোষণা, গলা কেটে আনলে পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি, কাবাডিতে ভারতের বিশ্বজয়, গমের ফলন খুঁটিয়েখুঁটিয়ে বারদুয়েক পড়ার পরও মায়ের হাতে মারাত্মক লম্বা একটা দুপুর পড়ে থাকে, তখন মা টিভি চালিয়ে নাপতোল চ্যানেল দেখেন। সেখানে জুসার বিক্রি হচ্ছে। ন’শো নিরানব্বই টাকার জুসারের সঙ্গে ন’শো নিরানব্বই টাকার নারকেল গাছ ফ্রি।
“ভ্যাট।” আমি প্রতিবাদ করতে বাধ্য হই। নারকেল দিলে তাও বুঝতাম… অ্যাকচুয়ালি, তাও বুঝতাম না। জুসারের সঙ্গে এমন ফলই ফ্রি দেওয়া সম্ভব যার জুস বার করা যায়। আম, মুসাম্বি, তরমুজ। নারকেল দেবে কেন? আর যদি বা দেয়ও, গোটা গাছ দেবে কেন? শুধু নারকেল দেওয়াই কি যথেষ্ট নয়?
“আরে কেন দেবে সে আমি কী করে বলব, দিচ্ছে দেখছি, তাই তোকে জানালাম। এই তো একটা হলুদ জামা পরা মেয়ে জুস খেতে খেতে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলল, ন’শো নিরানব্বই টাকার জুসার কিনলে ন’শো নিরানব্বই টাকার নারকোল গাছ ফ্রি ফ্রি ফ্রি।”
পাশ দিয়ে একটা পায়রা যাচ্ছিল, ঘাড় বেঁকিয়ে তাকালো। মায়ের গলা কানে গেছে বোধহয়। ঠিকই ধরেছে ও, ঘটনাটাতে ফ্রি নারকেল গাছটাই সবথেকে আশ্চর্যজনক ব্যাপার নয়।
“ন’শো নিরানব্বই টাকা?! নারকেল গাছ এত দামি হয় নাকি?”
“সেটা আমিও ভাবছিলাম জানিস। এখান দিয়ে মাঝে মাঝে সাইকেলে করে চারা নিয়ে যায়, আমি দর করেছি। নারকেল গাছের চারা চারশো টাকা বলে। দেখে তো বেশ পুষ্টই লাগে। এরা ন’শো নিরানব্বই টাকায় কী দেবে কে জানে।”
“ফলন্ত গাছ এনে বাড়িতে বসিয়ে দিয়ে যাবে বোধহয়। ঝুনো ঝুনো নারকেল হয়তো ঝুলবে থোকা থোকা।” দৃশ্যটা কল্পনা করে আমি আনমনা হয়ে পড়ি। তারপর একটা অন্য চিন্তা হয়। সে রকম গাছ নতুন করে পুঁতলে বাঁচবে? অফিসে অবশ্য দেখেছি, পূর্ণবয়স্ক সুপুরি নারকেল পান্থপাদপ ট্রাকে চাপিয়ে নিয়ে এসে পুঁতে দিচ্ছে এদিকসেদিক। দিব্যি বাঁচে। আমি যেখানটায় দাঁড়িয়ে আছি তার সামনেই তিনখানা সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে। যদিও এদের ফলটল নেই। আমি মুখ উঁচু করে, চোখ সরু করে পরীক্ষা করি। এগুলো বোধহয় স্রেফ ডেকোরেশন পার্পাস।
ওদিক থেকে মা কথা বলছেন। "হয়তো বাঁচবে, আজকাল তো কতরকম কী বেরিয়েছে।"
"তা বটে, আজকাল…"
আজকালের সঙ্গে মা যোগাযোগ হারিয়েছেন অনেক আগেই, আমারও গ্রিপ হড়কাতে শুরু করেছে। অদ্ভুত, অযৌক্তিক, অব্যাখ্যনীয়, সবের দায় আজকালের ঘাড়ে চাপিয়ে নিশ্চিন্ত হই। মা চেঁচিয়ে ওঠেন, “এই, এই, আবার বলল। ন’শো নিরানব্বই টাকার জুসারের সঙ্গে ন’শো নিরানব্বই টাকার নারকোল গাছ ফ্রি। এখন মেয়েটার জায়গায় একটা ছেলে এসেছে, আর হাতে করে টাকা ছড়াচ্ছে চতুর্দিকে। এত টাকা, প্লাস্টিকের মনে হয়। না রে সোনা?”
“তাই তো মনে হয়। তবে আজকাল কিছুই… “
ফোন কেটে হেঁটে হেঁটে পাঁচতলা উঠে এলাম। এটা আপাতত দিনের মধ্যে আমার একমাত্র ব্যায়াম। তাছাড়া খানিকটা সময়ও নষ্ট করা যাবে।
সিটে বসার দশমিনিটের মধ্যে ফোনে আলো জ্বলল। 'মা মোবাইল' কলিং।
“হ্যালো, সোনা?” মায়ের গলা আস্তে। অ্যাপোলজিপূর্ণ। আধঘণ্টার মধ্যে দ্বিতীয়বার ফোন করলে মা এই গলাটায় কথা বলেন।
“ব্যস্ত না রে? সরি সরি। আসলে একটা কথা তোকে ভুল বলেছিলাম, তাই ঠিক করে দিতে ফোন করতে হল।” মেয়েকে মা প্রাণ থাকতে ভুল কিছু শেখাতে চান না।
“নারকেল গাছ ফ্রি দিচ্ছে না। আমি সাউন্ড বাড়িয়ে, ভালো করে শুনলাম। বলছে ন’শো নিরানব্বই টাকার জুসারের সঙ্গে ন’শো নিরানব্বই টাকার নাপতোল ক্যাশ ফ্রি। ওই নাপতোল ক্যাশটাকেই আমি…”
আমি মুখ হাঁ করি, কিন্তু আওয়াজ বেরোয় না। আমার বাকরুদ্ধতাকে মা ব্যস্ততা ভেবে ভুল করেন। “সরি রে সোনা, মন দিয়ে কাজ কর, আমি আর ডিস্টার্ব করব না” বলে ফোন কেটে দেন।
তোমার দিকে চাহিয়া আমাদের বিস্ময়ের অন্ত নাই!
ReplyDelete(বোনাস প্রশ্নঃ সত্যজিৎ রায়ের কোন ছোটগল্পে শরৎচন্দ্রের এই লাইনটা কোট করা হয়েছিল?)
প্রথম বিস্ময়, ঠিক বিস্ময় না, প্রশ্ন - নাপতোল টা আপনি মা'কে ধরিয়েছেন, না ভাইসি ভার্সা?
দ্বিতীয় বিস্ময়, অবশ্য এটাও টেকনিক্যালি প্রশ্নঃ গল্পটা সত্যি তো? জল মেশাননি তো?
তৃতীয় বিস্ময়, এটা বিস্ময়ই, প্রশ্ন নয়ঃ এই ছোটছোট কথাগুলো এত খেলিয়ে লেখেন কি করে? হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গেল। বসের বস একবার উঁকি মেরে দেখে গেছেন।
আগাপাশতলা সত্যি গল্প...নয়, ঘটনা, দেবাশিস। নাপতোলটা মা আর আমি দুজনেই দুজনকে ধরিয়েছি বলা যেতে পারে। আমি এদিকে একা একা দেখছিলাম আর হাসছিলাম, মা ওদিকে একা একা দেখছিলেন আর হাসছিলেন। তারপর একদিন ফোনে দুজনের প্যাশন দুজনের কাছে প্রকাশ হয়ে পড়ল, এখন তো রীতিমত নাপতোল নোট বিনিময় হয়।
DeleteDebashiser proshner uttor -- Manpatra!
Deleteeibar ami kolkata giye naptol ki jinish dekhboi dekhbo :)
ReplyDeleteনাপতোল চ্যানেল, "টেন থিংস টু সি বিফোর ইউ ডাই" লিস্টে যে কোনও দিন আসার ক্ষমতা রাখে, কাকলি।
Deletehahaha...jata rokom bhalo hoyeche :D -PB
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, প্রদীপ্ত।
DeleteEk to mojar incident. Tar opor tomar lekhoni. Uff hese pet byatha hoe gelo. Office e bose ni:shobde hasa ki jese byapar. Bratati
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, ব্রততী।
Deletekhub sundar laglo tar sange free swarge jaoar pass naptol dekhar sujog hoiche monoharan
ReplyDeleteধন্যবাদ, আশিস।
Deleteasadharon!!!
ReplyDeleteধন্যবাদ।
Deletesadharon ghotonagulou apnar lekhar gun-e osadharon lage.....:)
ReplyDeletekurnish!!
আরে থ্যাংক ইউ, অরিজিত।
DeleteAmar apnar Ma k j ki bhalo lagchhe ... Mother's Day te eta chorom ekta srodhyagyapon hote pare amar mote ... Shotye to, Ma era (ebong Baba ra o), chhele meyeder shobshomoy thik ta sekhate chan .... Apni ebong apnar Ma khub bhalo thakun ...
ReplyDeleteআমার মাকে আমারও ভীষণ ভালো লাগে, অনুরাধা, এ ব্যাপারে হাই ফাইভ। আপনিও ভালো থাকবেন।
Deleteonobodyo....oshadharon......odwitiyo....Tumi, tomar maa ebong Naaptol.
ReplyDeleteBhalo kotha, aajkal mon kharap lagle amio naaptol dekhi.
মনখারাপ সারাতে নাপতোল-এর জুড়ি নেই, তিলকমামা, আশা করি উপকার পাচ্ছ।
Delete