ল্যান্ডোর ২/৩
পাহাড়ে, বিশেষ করে ল্যান্ডোরের
মতো নিরিবিলি পাহাড়ে আমার আসতে ইচ্ছে করে দু’তিনটে কারণে। প্রথমত, দৃশ্যপট পরিবর্তন। যা রোজ দেখি, তার থেকে অন্য দেখা। আমার মুখ, তোমার মুখ, বসের
মুখের বদলে গাঢ় পাহাড়, ফ্যাকাসে পাহাড়, নীল পাহাড়, সবুজ পাহাড়। দুদিকে হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা থাকা পাইনের বন, লাল
ছাদের সারি। রোদচিকচিক মাকড়সার
জাল। হলুদ প্রজাপতি।
দ্বিতীয় কারণ, গন্ধ। বাড়িতে মোটামুটি একটা গন্ধহীন অবস্থার মধ্যে দিনরাত কাটাই
বলা যেতে পারে। সকালবেলা একবার
ওলাক্যাবের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকার সময় কুড়া সংগ্রহের গাড়ি থেকে রাতভর জমে, ফুলে,
ভেপসে ওঠা ডাল, মাছের কাঁটা, তরমুজের খোসার গন্ধ। বিকেলে একবার বাজারের মেছো গন্ধ।
আর কিছু সিজনাল গন্ধ। জানুয়ারি মাসের রেজলিউশন সিজনে প্রায়ই অফিসের এ ডেস্ক ও
ডেস্ক থেকে কাঁচা পেঁয়াজ দেওয়া স্যালাডের গন্ধ আসে। আর কখনও কখনও, অটোয় বসে থাকা অবস্থায় ছাতিমের ঘ্রাণ। ব্যস।
পাহাড়ে এলে গন্ধের ভ্যারাইটি যে খুব বাড়ে
তেমন নয়, মূলত
গাছের গন্ধ। সেটা বর্ণনা করা খুব শক্ত। ঠাণ্ডা, সবুজ
রঙের গন্ধ। ল্যান্ডোরে পাইনি, অন্য অনেক পাহাড়ে অনেকসময় কাঠের
উনুনের গন্ধ পেয়েছি। ল্যান্ডোরে প্রকাশের দোকানের পাশ দিয়ে
যেতে যেতে টাটকা পাউরুটির গন্ধের ঝাপট নাকে লেগেছে।
তিন নম্বর কারণটা আমার পাহাড় ভালোবাসার
সবথেকে বড় কারণ। শব্দ। বা শব্দহীনতা। বাড়িতে চোখ বন্ধ করলে দৃশ্য আটকানো যায়, নাক
টিপে ধরলে গন্ধ তাড়ানো যায়, কিন্তু শব্দের হাত থেকে রেহাই
নেই। লোকজন চেঁচাচ্ছে,
হর্ন দিচ্ছে, কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করছে, মাইক বাজিয়ে টেবিলটেনিস প্রতিযোগিতার
পুরস্কার বিতরণ করছে। আমিও কালপ্রিট, এ সব যখন কিছু হচ্ছে না, তখন নিজেই কানে গান
গুঁজে রাখি। সংগীতপ্রিয়তার হদ্দমুদ্দ। মা বলেন, গান আরেকটু কম শুনে নিজে গাইলে হয় না সোনা? মা সারাদিন অনেক কথা বলেন,
সব শুনতে গেলে বিপদ। সে কথা থাক। পাহাড়ের শব্দের কথা হচ্ছিল, সে কথাই হোক।
বারান্দা থেকে ঘরে ফিরে এসে পাতা জানালার
সামনে পাতা ইজিচেয়ারে বসলাম। এমনি পিঠ সোজা করে বসলে দুয়েকটা পাইন গাছটাছ দেখা যায়, কিন্তু শরীর ছেড়ে মাথা
পেছনদিকে হেলিয়ে দিলে আর কিচ্ছু দেখা যায় না, খালি নীল রঙের একটা চৌকো, তার মাঝে সাদা ছোপ ছোপ মেঘ। আর কানের মধ্যে একটা বোঁ বোঁ শব্দ। ক্রমাগত ঘরঘর ঘুরে চলা ব্রেনের বোধহয়।
তারপর খানিকক্ষণ পর ধীরে, নিচু পায়ে অন্য শব্দরা ঢুকতে শুরু করে। নিচে একবার বরফি চেঁচালো কি? অনেক দূরে খট খট করে
একটা শব্দ হচ্ছে একটানা। কাঠ কাটছে কেউ। একতলায় মিসেস ভাট্টি হাঁটছেন। কাঠের মেঝে মচমচ করছে।
আমাদের কিছু
প্ল্যান করা নেই। মুসৌরি যেতেও পারি, নাও যেতে পারি। এখন জুতো গলিয়ে
বেরোতেও পারি, আবার কিছু না করে সামনের নীল চৌকোর দিকে তাকিয়ে বসেও থাকতে পারি বই
মুখে করে।
তবু বেরোলাম। কারণ খিদে পেয়েছে। উডসাইডে দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা সাধারণত রাখেন না মিসেস
ভাট্টি। ঠিকই
করেন, কারণ বেশিরভাগ লোকেই সারাদিন বাইরে বাইরে থাকে। ডিনার হবে বাড়িতেই, বীণাজি রাঁধবেন, ভাত
রুটি ডাল তরকারি মাংস, যার যেমন রুচি। আমরা বেরোচ্ছি শুনে মিসেস ভাট্টি দুপুরের খাওয়ার জায়গা বলে
দিলেন। আমরা কিছু রিসার্চ করেই এসেছি, তবে আমরা ঘেঁটেছি সেকেন্ডারি ডেটা, আর
মিসেস ভাট্টি করেছেন প্রাইমারি ফিল্ড সার্ভে। ল্যান্ডোরে খাওয়ার তিন ধাপের ব্যবস্থা। একেবারে সস্তায় সারতে হলে আছে চারদুকান। চারদুকান হচ্ছে ল্যান্ডোরের বিখ্যাত মোড়, যেখানে,
একটা না, দুটো না, পাঁচটা
না, দশটা না, চারটে দোকান আছে। ম্যাগি, চা ইত্যাদি পাওয়া যায়। শ’দেড়েকের মধ্যে দুজনের খাওয়া হয়ে যাবে। দ্বিতীয় ধাপে রয়েছে ক্যাফে আইভি, ল্যান্ডোর
বেকহাউস ইত্যাদি। দুজনের হাজারখানেক পড়বে। আর ফ্যান্সি খেতে গেলে যেতে হবে এমিলি’স। রকেবি ম্যানর বলে এখানে একটা হোটেল আছে, তাদের
দোকান। মাসে এক শনিবার মিসেস ভাট্টি তাঁর বন্ধুর সঙ্গে
ডেটে যান ল্যান্ডোরের কোনও
এক ক্যাফেতে। ক্যাফে আইভি-তেও
গিয়েছিলেন, ঢালাও রেকোমেন্ডেশন দিলেন।
রাস্তাও বলে দিলেন মিসেস ভাট্টিই। এখন নাহয় তিনি ঘরবৈঠা, একসময় তো পাহাড়
দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। ল্যান্ডোরের রাস্তাঘাট সোজা নিয়মে চলে। সোজা চলতে চলতে পাহাড়ের দেওয়ালে গিয়ে ধাক্কা খায়, তখন
বাধ্য হয়েই তাকে দু’ভাগ হতে হয়। হয় বাঁদিকের রাস্তা নিতে হবে, নয়তো
ডানদিকের। সে রাস্তা গিয়ে
আবার কোথাও গোঁত্তা খেয়ে দু’ভাগ হবে, তখন আবার
সিদ্ধান্ত নিতে হবে ডাইনে যাব না বাঁয়ে। সিদ্ধান্ত ভুল হলেও চিন্তা নেই, যতক্ষণ
না পাহাড় থেকে একেবারে নেমে পড়ছেন ততক্ষণ আপনি সেফ। উডসাইড থেকে পাহাড় বেয়ে সিস্টারস বাজারে উঠে প্রথম দুমাথা
থেকে বাঁদিক বেঁকে সোজা গিয়ে কেলগ চার্চ। সেখানে থেকে আবার বাঁয়ের রাস্তা ধরে সোজা গেলেই চারদুকান।
হাঁটতে শুরু করলাম। এত পরিষ্কার একটা জায়গা হয় কী করে? পথের
পাশে একটিও শিখরের প্যাকেট নেই, একটাও প্লাস্টিকের বোতল নেই। দশ হাত অন্তর অন্তর পরিষ্কার চিহ্ন দেওয়া ডাস্টবিন, সবাই
কষ্ট করে সেখানেই সব আবর্জনা ফেলেছে নাকি?
ল্যান্ডোর একেবারে অকাজের জায়গা নয়। একটা ল্যাংগোয়েজ স্কুল আছে এখানে। বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীই বিদেশী, কারণ
হয় ওঁদের সাহস বেশি, কিংবা ওঁদের দেশে নিরাপত্তা বেশি। তাই কুড়িপঁচিশ বছর বয়সের ছেলেমেয়েরা আইটি-তে ঢোকার লাইন না দিয়ে এক
বছরের ব্রেক নিয়ে হিন্দির মতো একটা ভাষা শিখতে ভারতবর্ষের মতো একটা দেশে পড়ে থাকতে পারে। দুদিনে এঁদের অনেকের সঙ্গেই দেখা হল। রেস্টোর্যান্টে কোণের টেবিলে বসে মন দিয়ে পড়াশোনা করছেন, ছোট
চৌকো কার্ডের একদিকে শব্দ, অন্যদিকে শব্দের মানে লিখছেন। একপাশে ম্যাকবুক, অন্যপাশে ইন্টারন্যাশনাল টেক্সটবুক অফ
হিন্দি (বা ওইরকম নামওয়ালা কোনও বই) খোলা। রাস্তাঘাটে চলতেফিরতেও ছাত্রদের সঙ্গে দেখা হচ্ছিল। এদিক থেকে একজন হিপি মেম চলেছেন, ওদিক
থেকে আসছেন আরেকজন হিপি সাহেব। গায়ে ঢোলা কুর্তাপাজামা, মাথায় ঝুঁটি, পায়ে কিটোস, কাঁধে রুকস্যাক,
বোতলে জল। ইনি বললেন “আপ য়িঁহাপে কিতনে মহিনে
সে রহ্ রহে হো?” অন্যজন চারটে আঙুল তুলেছেন কিন্তু কনফিডেন্সের
অভাবে ভুগছেন। খানিকক্ষণ আঙুলের দিকে তাকিয়ে থেকে বলছেন, “তিন?”
এদিকের মেম মাথা নাড়ছেন। সাহেব কনফিউজড এবং নার্ভাস। “ওহ ইয়াহ, চার মহিনে।” মেমসাহেবের মুখে হাসি ফুটেছে। সাহেব জিজ্ঞাসা করছেন, “অ্যান্ড আপ?” মেম
গর্বিত মুখে বলছেন, “আঠ মহিনে।” সাহেব বিস্ময়ে এবং অ্যাপ্রিশিয়েশনে নুয়ে
পড়ছেন। “ওয়াও।” এতক্ষণে দুজনেরই ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছে,
(আমার বিশ্বাস, হিন্দির স্টকও শেষ) দুজনে
গড়গড়িয়ে ইংরিজি বলতে শুরু করেছেন। কী বলছেন আর শোনা হয়নি।
এই হচ্ছে কেলগ চার্চ।
ওই ঘিঞ্জি শহরটা হচ্ছে মুসৌরি।
আর এই যে চমৎকার স্বর্গের মতো পথটা ধরে আমরা
হাঁটব, এটা
হচ্ছে ল্যান্ডোর। এই রাস্তা ধরে সোজা
গেলে চারদুকান।
এই হল চারদুকান। ল্যান্ডোরের অন্যতম পুরোনো বসতি। ওটা ল্যান্ডোরের প্রথম পোস্ট অফিস। বেজায় পুরোনো।
চারদুকানের গায়ে সেন্ট পলস চার্চ। এই চার্চে জিম করবেটের…উঁহু, জিম করবেটের নয়…জিম করবেটের মাবাবার বিয়ে হয়েছিল।
চারদুকানের উল্টোদিকে এই হচ্ছে ক্যাফে
আইভি।
যদ্দূর মনে পড়ছে আমরা খেয়েছিলাম স্যান্ডউইচ
আর ইজিপশিয়ান স্ক্র্যাম্বলড এগ আর টোস্ট আর সোডা লাইম। সবক’টা খাবারই চমৎকার খেতে।
কিন্তু সবথেকে ভালো ব্যাপারটা হচ্ছে খাবারের সঙ্গে পর্যাপ্ত পরিমাণে
আলুভাজা।
ক্যাফে আইভি থেকে বেরিয়ে চারদুকানকে
পেছনে রেখে নাকবরাবর চললে এসে যাবে নিউ লাল টিব্বা। ওল্ড লাল টিব্বা কোথায় আমাকে জিজ্ঞাসা করবেন না, বলতে
পারব না। এই নিউ লাল টিব্বা
হচ্ছে একটি টুরিস্ট পয়েন্ট, এবং আমার মতে বাতিলযোগ্য। যদিও আমরা বাতিল করিনি, কারণ আমাদের আর কিছু করার ছিল না। একটা
কোল্ডড্রিংকসের দোকানের ছাদে পাঁচটা প্লাস্টিকের চেয়ার আর একটা দূরবীন। দুজনের কুড়ি কুড়ি চল্লিশ টাকার টিকিট কাটলে সেই দূরবীন
দিয়ে আপনাকে দূরের পাহাড়ের একটা সাদা রঙের মন্দির, দিখ রহা হ্যায়? বহোৎ
আচ্ছা। এবার দূরবীন বাঁদিকে ঘোরান…সাদা বাড়ি দেখতে পাচ্ছেন? বহোৎ আচ্ছা। ওগুলো হচ্ছে ব্রিটিশদের বাংলো। ডানদিকে
ঘোরান… ডানদিকে কী দেখিয়েছিল আমি অলরেডি ভুলে গেছি।
টিব্বা থেকে নেমে এসে রাস্তা দু’ভাগ
হল। ক্রমাগত বাঁদিকে বেঁকতে বিরক্ত লাগছিল,
তাই এবার ডানদিকের রাস্তাটা নিলাম। এই রাস্তা সোজা ফিরে গেছে কেলগ চার্চ। চমৎকার
রাস্তা। সামান্য ঢালু, চলতে কষ্ট নেই, বাঁদিকে
নেমে গেছে পাহাড়, ডানদিকে উঠে গেছে পাহাড়, তার গায়ে মাঝে মাঝে
কয়েকখানা বাড়ি। আর একটা কবরখানা। রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছেন পাথর হয়ে
যাওয়া সাহেবমেমেরা। লাজবন্তী
ম্যাকআর্থার, লাভিং ওয়াইফ অফ জর্জ ম্যাকআর্থার। আমরা লাজবন্তীর মুখোমুখি বসলাম রাস্তার ধারের কংক্রিট
রেলিং-এর ওপর। চারপাশে গমগম করছে
ঝিঁঝিঁর ডাক। মাঝে মাঝে একটাদুটো পাখি আর কুকুরের ডাক। আরও মাঝে মাঝে একটাদুটো বাইক। ভটভটিয়ে যাচ্ছে যখন অন্য শব্দরা গাছের আড়ালে লুকোচ্ছে,
ভটভটানি মোড় ঘুরলেই আবার এসে বসছে রাস্তা জুড়ে।
এই কবরখানার ডানদিকে নয়তো বাঁদিকে,
কোনদিকে ভুলে গেছি, একটা বাড়ি আছে। বাড়ি ল্যান্ডোরে আছে যথেষ্টই, গাছের থেকে সংখ্যায় অনেক কম বলে চোখে পড়ে না। ভারতের যত সেলিব্রিটি আছেন, সবাই একেকখানা করে
সে সব বাড়ি কিনে রেখেছেন। বিশাল ভরদ্বাজ থেকে সঞ্জয় নারং। অন্য বেশিরভাগ
বাড়িরই রং সাদা বা হলুদ বা ওই গোছের, জঙ্গলের মধ্যে জেগে থাকে।
এই বাড়িটা তাদের থেকে আলাদা। রাস্তা থেকে কাঠের সিঁড়ি উঠে গেছে বাড়ি পর্যন্ত।
বাড়িটার রং কেমন শ্যাওলা শ্যাওলা, চারপাশের গাছ জঙ্গল পাহাড়ের সঙ্গে একাকার। একবার ভাবলাম একটা ছবি তুলি। তারপর সাহস হল না। এমনই ব্যক্তিত্বপূর্ণ বাড়ি। তাছাড়া অত সুন্দর বাড়িকে কি
ছবিতে ধরা সম্ভব? পাহাড়ের গায়ে ফলকে বাড়ির নামটা পড়ে রাখলাম।
অনেক পর, সম্ভবত দেরাদুন থেকে দিল্লির বাসে বসে অর্চিষ্মান ফোন থেকে মুখ তুলে
বলল, "ওই বাড়িটা কার বলত?"
অকারণ, তবু নামটা শুনে গর্ব হল। মনে হল, এ তো হতেই হত। বাড়ির মালিকের নাম আমি বলছি না, দুটো হিন্ট দিচ্ছি। এক, উনি আমার (এবং আরও অনেক বাঙালির) অন্যতম প্রিয়
চরিত্রের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। আর, এঁর এই বাড়িটার গেটেই নাকি একটা বোর্ডে লেখা
ছিল (যদিও আমরা দেখিনি, হয়তো সরিয়ে ফেলেছেন) “বিওয়্যার, র্যাবিড থেসপিয়ান”। বলুন দেখি কার বাড়ি?
সিস্টারস বাজারে ফিরে মনে পড়ল ল্যান্ডোর
বেকহাউসে ব্রেকফাস্ট করব ভেবে রেখেছিলাম দিল্লিতে থাকতেই। ব্রেকফাস্ট তো হয়ইনি, লাঞ্চও অন্যজায়গায় সেরে নিয়েছি। তাতে অসুবিধে নেই। আমাদের মতো প্রিভিলেজড লোকজনের খাওয়ার তো খিদের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক নেই। ইচ্ছে হলেই যখনতখন খেতে বসতে পারি। অনেকক্ষণ হাঁটাও হয়েছে। তাছাড়া এখন যদি বাড়ি ঢুকে যাই
তাহলে আবার পাহাড় ঠেঙিয়ে উঠে আসার ইচ্ছে থাকবে না। কাজেই ঘোরাঘুরি আরেকটু দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য আমরা
বেকহাউসে ঢুকে পড়লাম।
আর পড়ামাত্র ল্যান্ডোরের একমাত্র নিন্দে
করার জিনিসটা হাতে চলে এল। দোষটা বেকহাউসের নয়। দোষটা বেকহাউসের
লোকেশনের। সিস্টারস বাজারের
একেবারে মোড়ের মাথায়, টুরিস্টের ভিড় লেগেই থাকে। আমিও টুরিস্ট, আমিও ইরিটেটিং, কিন্তু এই টুরিস্টরা আমার থেকেও
ইরিটেটিং। অবশ্য লিখতে গিয়ে একটা
কথা মনে হচ্ছে, এঁরা সবাই ঘুরছিলেন দল বেঁধে, একটা এস
ইউ ভি-তে মিনিমাম ছ- সাত জন। সে জন্যই বোধহয় অত কথা বলতে হচ্ছিল আর অত চেঁচিয়ে। তার মধ্যে বেকহাউস কর্তৃপক্ষ দোকান সাজিয়েছেন ফেসবুক আর
ইনস্টাগ্রাম আর হোয়াটসঅ্যাপে দেখানোর মতো করে। সবথেকে কেলেংকারি করেছেন একখানা
রাজকীয় আর্মচেয়ার রেখে, তাতে বসে ছবি তোলার জন্য আক্ষরিক লাইন
পড়েছে। আর কেউই তো শুধু
বসছেন না, বসে,
ঠ্যাং তুলে, জিভ বার করে, টুপি ঘুরিয়ে, কাঁচকলা দেখিয়ে একাকার করছেন। বেকহাউসের পেছনদিকে একটা চৌখুপি মতো আছে, জানালা
দিয়ে পাহাড় দেখা যায়। সে জায়গাটা মোটামুটি ল্যাংগোয়েজ স্কুলের ছাত্রদের একচেটিয়া। একটু পরে তাঁদের দু’জন উঠে গেলে আমরা
তাঁদের টেবিলে উঠে গেলাম। এখান থেকেও কলরব কানে আসছে, চোখে অ্যাট লিস্ট দেখতে হচ্ছে না। আমরা বসলাম, আর আমাদের “খেপ”
আর আদা লেবু মধু চা এসে গেল।
দোকান থেকে বেরিয়ে বুঝলাম জানালা দিয়ে যেটাকে পাইনের ছায়া ভেবেছিলাম সেটা
আসলে মেঘ। বাড়ির ছাদে, বনের
মাথায় ঘন হয়ে জমেছে। দিল্লি থেকে বয়ে আনা ছাতা রয়ে গেছে ব্যাগের ভেতরেই। জোরে হাঁটা লাগালাম। উতরাই বেয়ে নামতে নামতে, অ্যালশেসিয়ানের
প্রতিবাদ ছাপিয়ে মেঘের ডাক প্রবল হয়ে উঠল। শেষরক্ষা হল না, শেষ বাঁকটা পেরোতে পেরোতে বৃষ্টি নেমে গেল। উডসাইডের অল্প ফাঁক গ্রিল গেট তাক করে ছুটছি, গ্রিল পেরিয়ে গেছে, এবার বাগানে পাতা একেকটা লাল পাথরে একেক পা ফেলে ছুটছি, চশমার
কাচ বেয়ে জলের ধারা নেমেছে। ওদিকে বারান্দা থেকে বরফি চেঁচাচ্ছে, জোরে, আরও জোরে। বসার ঘরের সোফায় একগাদা খাতা পেনসিল বই স্ক্র্যাবলবোর্ড আর
জুসের গ্লাস নিয়ে মিসেস ভাট্টি বসে ছিলেন, আমাদের দেখে অবাক হয়ে বললেন, "ছাতা নিয়ে বেরোওনি? পাহাড়ে বেড়ানোর এক নম্বর রুলটাই
তো ভেঙেছো।"
আমরা আর লজ্জার মাথা খেয়ে বললাম না যে, আমাদের
প্রকৃতিটাই রেবেলিয়াস। দিনে একটা করে রুল না ভাঙলে ভাত
হজম হয় না।
এরপর দুটো কাজ করা যেত। এক, মিসেস ভাট্টির বুককেস থেকে বই কিংবা
নিজেদের ব্যাগ থেকে কিন্ডল বার করে ইজিচেয়ারে বসে টেবিলে পা তুলে, কিংবা ডিভানে উপুড় হয়ে, হাঁটু থেকে পা সিলিংপানে ভাঁজ করে, জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে, খোলা দরজা দিয়ে আসা ভেজা পাহাড়ের গন্ধ শুঁকতে বই পড়া যেত। নয় তো মিসেস ভাট্টির নরম গদির ওপর নরম লেপ গায়ে দিয়ে
ভোঁসভোঁস করে ঘুমোনো যেত। আমরা করব ভেবে
রেখেছিলাম একটা, কাজে হয়ে গেল অন্যটা।
চোখ খুলে দেখি ঘর ঘুটঘুটে অন্ধকার। জানালার বাইরেও আলো নেই, শুধু একটা ঘন নীলচে আভা। সুইচবোর্ডটা মনে হয়ে দেখেছিলাম ঘরের অন্য প্রান্তে, জানালার
পাশে। হাই তুলতে তুলতে, অচেনা
মেঝেতে পা ঘষটে ঘষটে সেদিকে চললাম। সুইচবোর্ড পর্যন্ত পৌঁছোনোর আগেই থামতে হল। কারণ জানালার দিকে চোখ পড়েছে। দেরাদুন। ঝলমল করছে।
ল্যান্ডোর ২/৩
ladour jete icche korche!darun bhraman kahini..ota ki sashi kapoorer bari?
ReplyDeleteদেখেছ, যেই বলেছি প্রিয় চরিত্র, অমনি সবাই লাফিয়ে ফেলুদা ধরে নিয়েছে। উঁহু, ওটা শশী কাপুরের বাড়ি নয়। দিল্লি আয়। ল্যান্ডোর যাব সবাই মিলে।
Deletebarita Victor Banerjee r. R ashe pashei kothao Ruskin Bond er bario achhe. jodio jantamna, miss korechhi, r Kolkata phire apshosh korechhi.
ReplyDelete-Ipsita
ঠিক উত্তর, ঈপ্সিতা। আপনি কবে গিয়েছিলেন ল্যান্ডোর? কেমন লেগেছিল?
Delete2015 e gechhi. samay ta chhilo kalipujo. tai niche Doon Valley r alor bahar bolai bahulyo.
Delete-ipsitA
ওরে বাবা, সে তো চমৎকার হয়েছিল নিশ্চয়।
DeleteVictor Banerjee bangali-r kon priyo choritre obhinoi korlen ? Ghore-Baire-r Nikhilesh ? Se ki karor priyo choritro ?
Deleteআমার তো ভীষণ প্রিয়, ঘনাদা।
DeleteHmm. Ami kichu bismito holam. Nikhilesh khub e osadharon choritro; Nikhilesh ke adorsho hishabe kolpona kora jai. Ek i songe komol o kothor. Tobe priyo choritro hote pare na. Onek ta durer mone hoi. Priyo hote pare Sandeep, jodio se adorsho noi, subidhabadi, swarthopor, biswaghatok, mithyabadi. Aro beshi kore priyo hote pare Amulyo.
Deleteযার চিত্তে যা লয়, ঘনাদা।
Deleteএই কাছের দূরের ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং। চরিত্রচিত্রায়ণ নিয়ে যে সব টিপস অ্যান্ড ট্রিকস দেখেছি, সবেতেই পই পই করে বলা থাকে যে চরিত্রদের 'খুঁতো' হওয়া মাস্ট। না হলে পাঠকরা রিলেট করতে পারবে না এবং মুখ ফিরিয়ে নেবে। কথাটার যুক্তি আছে। আমরা চারপাশে সবসময় খুঁতো লোকদেরই দেখি, আমরা নিজেরাও খুঁতো। এর মধ্যে হঠাৎ একজন সর্বগুণসম্পন্ন লোক এসে গেলে তাকে মাথায় তুলব না মাটিতে ফেলব, স্থির করতেই সময় চলে যাবে।
আমি ব্যাপারটা বুঝি, কিন্তু রিলেট করি না। আমি ব্যক্তিগত ভাবেও সন্দীপের থেকে নিখিলেশকে বেশি পছন্দ করব, নিখিলেশের সঙ্গে সময় কাটাতে চাইব। আমার কাছে নিখিলেশ সন্দীপের থেকে ঢের বেশি ইন্টারেস্টিং। তার একটা কারণ হচ্ছে, আমি এবং আমার চেনা লোকেদের অনেকেই চাইলে সন্দীপের মতো হতে পারব, কারণ আমরা সকলেই অলরেডি অল্পবিস্তর সুবিধেবাদী, স্বার্থপর, বিশ্বাসঘাতক, কিন্তু নিখিলেশ হতে পারব না।
Darun likhechen. Amar nijer dharone Rabindranath o Nikhilesh ke onek momota niye likhechilen, hoito nijer kichu mishiye-i. Amar mone hoyeche, ghore-baire-r ekta ongsho bimola-r nikhilesh ke chena. Jotodin Bimola ghore chilo totodin se Nikhilesh ke sebhabe chile uthte pareni. Pore golper seshe jokhon Sandeep sombondhe tar somyok upolobdhi holo tokhon Nikhilesh-ke o se chinte parlo.
DeleteAmi jokhon kom boyeshe ghore-baire porechilum tokhon amar ekrokom lagechilo, boyesh ar obhigotya songe Rabindranath ke o natun kore bujhchi. Koekdin age abar 'gora' porlam, prai du soptaho dhore. Bortoman rajnoitik poristhite 'gora' khub i gurutwopurno bole mone holo. Ei boita-o kom boyeshe ami chinte parini. Hoito aro 20 bochor pore abar porle abar natun upolobdhi hobe. Sudhu ei asha te i aro 20 bochor b(n)ache thaka jai.
কুড়ি বছর তুশ্চু, ঘনাদা। আরও বেশিই বাঁচবেন। বিমলার নিখিলেশকে চেনার ব্যাপারে একমত। স্বদেশী স্বাতন্ত্র্য ইত্যাদি গুরুগম্ভীর বিষয়ের মধ্যে একজন মানুষের একছাদের তলায় থাকা অন্য মানুষকে চেনাটাও সমান জরুরি বিষয়। আমিও অবশ্য ঘরে বাইরে পড়েছি বহুদিন হল। এখন পড়লে হয়তো অন্যরকম লাগতে পারে। তবে নিখিলেশের প্রতি নিষ্ঠা কম পড়াটা অসম্ভাব্য বলেই মনে হয়।
Deletebere lagche ta to ager dini bollam , sathe aro duto kotha .
ReplyDelete1. tomar lekha porte porte ek chilte hasi khele jay , bhalo laga hoy eguloi bodhay roj abantar dhu marar karon
2. erokom shantite ghurte parina keno ami? mane oi saradin khali emni edik odik hete berabo ar lepmuri diye ghumiye porbo er jonyoi kothao berate jachhi e ami bodhay parboi na . elomelo ghurtei pari kintu sref baranday bose boi porbo ba aramer ghum debo....amar dhoirjo bodhay khub kom :(
-Pradipta
ধৈর্যটৈরয কিছু নয়, প্রদীপ্ত। আমি বলছি কেন পার না। ১। তুমি আমার মতো কুঁড়ে নও। ২। আমার মতো বুড়োও নও। অবশ্য আমার থেকেও অনেক বয়স্ক লোক অনেক হুড়ুমদুড়ুম করে ঘোরেন, কাজেই কুঁড়েমোটাই আসল কারণ হবে। শুনতে খুবই অদ্ভুত লাগবে, কিন্তু আমি অ্যাকচুয়ালি শুধু বসে থাকার/ঘুমোনো/বই পড়ার জন্যই টাকা খরচ করে অনেক দূরে যেতে রাজি আছি।
Deleteodbhut na moteo , alada alada dhoron khali . achha oi khabarta khete kemon chilo? barite banano moglai porotar moto dekhte - Pradipta
Deleteকিন্তু খেতে একেবারেই মোগলাই পরোটার মতো নয়, প্রদীপ্ত। এটা বেসিক্যালি একটু ফ্যান্সি গোলা রুটি। ভেতরে নানারকম পুর দেওয়া থাকে। আমাদেরটায় ছিল জ্যাম।
Deletebesh interesting to :) - Pradipta
Deleteখুব ভালো লেখা, অ্যাজ ইউজুয়াল।
ReplyDeleteআমিও প্রথমে ভেবেছিলাম ওটা সৌমিত্রর বাড়ি হবে। নিখিলেশ আপনার প্রিয় চরিত্র?
হ্যাঁ, দেবাশিস।
Deleteei rokomer ghora ta amar best lage, Shanto jaygay giye uddeshyoheen bhabe ghure berabo, no macbook, no phone....ah ki aaram tate. recently 2 diner jonyo Coorg giye tai korechhi, sudhu meyer jonyo Ekta elephant camp e gechhilam, byas...tomar lekhar gune amar ekhon landour jete ichhe korchhe..- Bratati.
ReplyDeleter choritro Nikhilesh to?
একদম ঠিক, ব্রততী। কুর্গের ছবি দেখেছি, ভীষণ সুন্দর তো। আমি তো কিছু করা যায় এমন জায়গা এড়িয়ে চলি আজকাল, চাইলেও কিছু করতে পারব না, এমন জায়গায় যাই বেছে বেছে।
DeleteKhub bhalo laglo pore. Pahadi brishti te dariye bhalo kore ektu bhijle na? :-)
ReplyDeleteDehradun Musourie giyechi onek agey. Kintu ashol pine er sugondho peyechi Himachal e Kangra, Dalhousie te. Borsha e giyechilam, shonda gondho ta pagol kore deyar moton sundor.
Ekkhuni Landor chole jete icche korche kintu eyi matro Rajasthan theke phirlam ... tai ektu dhoirjo dhora uchit mone hoye. :-)
হাহা, হ্যাঁ, একটু ধৈর্য ধরে নাও, শর্মিলা, তারপর যেও'খন। ডালহৌসি, কাংড়া, কোনওটাই যাইনি। দেখি হয় কি না।
Deletelandour jawar khub lobh hocche... darun jaiga toh.. aami bhebechilam oi barita rajit kapur er aar priyo choritro byomkesh!.. jaakge.. Victor banerjee shunei beshi bhalo laglo.. khub khub sundor hoyeche lekha.. aamadero porei half berano hoye gelo.
ReplyDeleteহাহা, এই আন্দাজটাও ভালো হয়েছিল, ইন্দ্রাণী। ভিক্টর ব্যানার্জির হয়েই যে বেশি ভালো হয়েছে সে বিষয়ে আপনাকে হাই ফাইভ।
Deletesotti darun to jaygata.. bujhte parchina tomar lekhar gune emon sundor lagche kina.. amar chena keu jayni age .. oi rasta ta diye hantar khub iccha roilo.. odike temon jawai hoyna.. ami oboshyo eirokom niribili ghora ta trip er modhye ekdin rakhi.. no plan.. jemon khusi hobe.. jam dewa soruchaklir recipe pawa jabe naki go..?
ReplyDeleteনো প্ল্যান ইজ দ্য বেস্ট প্ল্যান, ঊর্মি।
Deleteএই নে জ্যাম ভরা সরুচাকলি রেসিপি।
https://www.youtube.com/watch?v=f9pdUo8PwBw
Tarpor? Tarpor?
ReplyDeleteহাহা। সব ফাইন্যাল করে ফেললে, বিম্ববতী? কবে যাচ্ছ?
DeleteEibela Ruskin Bond er sompadona kora The Landour Cookbook ta pore felun. Tahole Delhi te nijer barite bosheo 100 bochhor ager Landour ke tarie tarie upobhog korte parben. Ar Victor Banerjee er barir dudh e kivabe jol meshano hoto, tao jaante parben.
ReplyDeleteওহ। বইটার খবর দেওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
DeleteKi chomotkar lekha!
ReplyDeleteজায়গাটা আরও চমৎকার, সায়ন।
Delete