কেটলি ও কপোলকল্পনা
এখনও সবকিছু শান্ত, ফ্যানের ঘরঘর আর বাড়িওয়ালার পাম্পের আওয়াজ (আর আমার টাইপিং-এর খটাখট) ছাড়া চারদিক শব্দহীন। অর্চিষ্মান ঘুমোচ্ছে। আমার ভোরের কোটা দু’কাপ চা হয়ে গেছে, ও উঠলে ওর সঙ্গে আরেক কাপ খাব। মিনিটকুড়ি আবোলতাবোল আড্ডা দেব, ব্যস। তারপর একটা দক্ষযজ্ঞ বেধে যাবে।
আজ আমাদের বাড়ি গোছানোর দিন। অনেকদিন আগেই এই দিনটা আসা উচিত ছিল। করছি করব বলে ঠেলে রেখেছি। আর ঠেলব না। সারা সপ্তাহ ধরে নিজেদের প্রস্তুত করেছি। চ্যাটবাক্সে গানের লিংক চালাচালি করার আগেপিছে মনে করিয়েছি, "মনে আছে তো? এই উইকএন্ডেই কিন্তু… "
প্রথমে হাত দেব ওয়ার্ডরোবে। টান মেরে জামাকাপড়গুলো ফেলব। অফিসে যাওয়ার দুটো জামা থাকবে, বাড়িতে পরার দুটো। বালিশ, গদি সরিয়ে খাটের গহ্বরের হাঁ খুলব। তিনটে সুটকেস, পাঁচটা লেপ, সাতটা বালিশ, সতেরোটা বিছানার চাদর। হ্যাঁচকাটানে ড্রয়ার খুলব একে একে। কান ধরে ধরে সামনে আনব ঘাপটি মেরে থাকা যত বিল, রসিদ, পুরোনো ডায়রি। দুমদুম পা ফেলে যাব রান্নাঘরে। সংসারে দুটো লোক। তাদের ছ’টা থালা, তেরোটা বাটি, পনেরোটা চায়ের কাপ। আজকের পর আর থাকবে না। নেক্সট, ফ্রিজ। ফ্রিজের দরজায় যে সব সরুমোটা সাদাকালো শিশিবোতলেরা এক্সপায়ারি ডেটের অপেক্ষায়, কিংবা ডেট পার করে হাসিহাসি মুখে বসে আছেন, তাঁদের ফেলব। ঝাঁট দেওয়ার নামে গায়ে জ্বর, অথচ বারান্দার কোণে পাঁচ রকমের ঝাঁটা জমেছে। একটা লম্বা, একটা বেঁটে, একটার মাথায় মোরগের মতো ঝুঁটি, একটার গায়ে মেঘের মতো তুলো। সব ঝেঁটিয়ে বিদেয় করব। বার সাবান শেষ কবে মেখেছি মনে নেই, এদিকে বাথরুমের আয়নাবাক্সে একটা সবুজ, একটা গোলাপি, একটা নীল সাবানকেস। সব যাবে আজ প্লাস্টিকবন্ধ হয়ে কুড়ার ভাণ্ডে।
কিংবা যাবে না। মন চাইবে। মাথা বলবে ফেলে দাও, গত চার বছর যে শাড়িটা পরোনি, সেটা নেক্সট চল্লিশেও পরবে না। গত চার বছর যে হার লকারে রয়ে গেছে, সেটা নেক্সট চল্লিশও লকারে থাকবে। মাঝখান থেকে গচ্চা যাবে কিছু লকারের ভাড়া। আর সে হার বানাতে যা গেছে তা তো গেছেই। সে দুঃখের কথা আর না মনে করাই ভালো। মাথাকে চুপ করিয়ে শাড়ি আবার ধীরে ধীরে বাক্সে নামিয়ে রাখব। হয়তো এ বাক্সের বদলে অন্য বাক্সে। তাও একটু ফাঁকা লাগছে, না গো? নিজের মনকে চোখ ঠারাতে না পেরে একে অপরের চোখ ধার নেব। আবার রসিদগুলো ভাঁজ করে রাখব গুছিয়ে ড্রয়ারে। যদি লাগে।
আর তারপর দু’কাপ চা নিয়ে বসব দুজনে যে যার ল্যাপটপ কোলে নিয়ে। অর্চিষ্মান কী ভাববে বা আদৌ কিছু ভাববে কি না জানি না, আমার ভাবনা স্ক্রিন থেক উঠে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াবে। আলমারির পাল্লা খুলে দীর্ঘশ্বাস ফেলবে। বন্ধ ড্রয়ারের হাতলে হাত বোলাবে। ভাববে, যদি পারতাম। সব টান মেরে ফেলে দিতে।
কেমন হত? ওয়ার্ডরোব খাঁ খাঁ, ড্রয়ার ঢুঁ ঢুঁ, খাট নেই, গাদাগুচ্ছের চেয়ার নেই, চোদ্দ বাই বারো ফুট ঘরে আছে শুধু কটা বুককেস, কয়েকটা বই, কয়েকটা ছবি, আর কয়েকটা গাছ। হালকা হালকা, কী হালকা। গোটা বাড়িটা যেন ভাসছে হাওয়ায়, পর্দাগুলো দুলছে। মাঝে মাঝে মেলা গ্রাউন্ডের দিক থেকে হাওয়ার একেকটা ঝাপটা আসছে, বুককেসের হালকা বইগুলো খসে পড়ছে টুপটাপ, দেওয়ালে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসা আমরা দুজন হেলে যাচ্ছি, বাঁদিকে কিংবা ডানদিকে। একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসছি। ভয় লাগছে না একটুও, যেন খুব শান্ত ভদ্র একটা নাগরদোলায় চেপেছি। চারদিক নিঝুম, খালি রান্নাঘরে চায়ের কেটলির জল ফুটছে গব গব করে।
*****
বাই দ্য ওয়ে, আমাদের বর্তমান ইলেকট্রিক কেটলি অবশেষে দেহ রেখেছে। বা রাখব রাখব করছে। দু’হাজার বারোতে যখন এ বাড়িতে নতুন এসেছিলাম, বা অর্চিষ্মান এসেছিল বলা উচিত, যখন বাড়িটা আমার স্বপ্নের মতো হালকা ছিল, এমনকি স্বপ্নের থেকেও বেশি, কারণ বই, গাছ, ছবিও ছিল না - তখন এই কেটলিটা ছিল। বছরদেড়েক পর যখন আই ব্লক থেকে আরেক দফা খাট বুককেস, টিভি নিয়ে আমি এলাম আর তারও একমাস পর কলকাতা থেকে সুটকেসভর্তি শাড়ি, শার্টপ্যান্টের পিস বেডকভার, বই, চায়ের সেট আর অস্বচ্ছ প্লাস্টিকের বাক্সভর্তি গাদা গাদা মুখে মাখার ক্রিম, পাউডার, পারফিউম নিয়ে আমরা দুজনে এলাম, তখনও ছিল। ওই যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্যে বসে আমরা এই কেটলি থেকেই জল ঢেলে দু’কাপ চা খেয়েছিলাম। আর সাহস পেয়েছিলাম, বন্ধ সুটকেস ডিঙিয়ে দরজায় তালা মেরে সিনেমাহলে চলে যাওয়ার। এই কেটলির ঢাকনিতে একটা চিড় আছে, আমার সিপ্রালেক্সবিহীন কোনও মুহূর্তের অবদান। ওই একই মুহূর্তে ঢাকনাটা বাকি শরীর থেকে খুলে এসেছিল। এখন কাত করে জল ঢালতে গেলে মাঝে মাঝে ঢাকনাটা খুলে কাপের ওপর পড়ে। আর লিটারখানেক ফুটন্ত জল হাতের ওপর। সাবধানে চলা যায়, চলছিও প্রায় বছরখানেক ধরে। কিন্তু অফিসে যাওয়ার আগের মুহূর্তে কিংবা ফেরার পরমুহূর্তে সাবধানতার ওপর ভরসা করা যায় না, তখন একটা কেলেংকারি ঘটতে পারে, ঘটবেই যে কোনও দিন।
এই সব ভেবেটেবে আমরা নতুন কেটলি কিনেই আনলাম। কতরকমের কেটলি পাওয়া যায় আজকাল বাজারে, লাল নীল হলুদ, কতরকমের এক্সট্রা ফিচার। কোনও রকম পরীক্ষানিরীক্ষায় যাইনি আমরা, কারণ কেটলি আমাদের কাছে ফ্যান্সি গ্যাজেট নয়, বাঁচামরা। আমরা সেই ট্রায়েড অ্যান্ড টেস্টেড ব্র্যান্ডের, কালো প্লাস্টিক আর স্টিল মেশানো বডি, খাটো তারওয়ালা, এক লিটারের মডেল কিনেছি। প্রথম যখন কাঁচি দিয়ে পিচবোর্ডের বাক্স কেটে, সেলোটেপ আর বাবলর্যাপ খুলে কেটলিটা বার করলাম, বুক ধড়াস করে উঠল, এতটুকু! আগেরটা কি তবে দেড় বা দু’লিটারের ছিল? নির্ঘাত। মনটা দমে গিয়েছিল নিমেষে। কেটলি হাতে রান্নাঘরের দিকে হাঁটার পনেরো পায়ে কতকিছু মনে এল। ফেরৎ দেব? ফেরৎ দিতে গেলে কত ঝামেলা করতে হবে? নাকি যা পেয়েছি তাতেই কাজ চালিয়ে যাব? জলের সংকুলান হলে, বার বার উঠে কেটলিতে জল ভরতে হলে চা খাওয়ার ঘটা কিছু কমতে পারে, হয়তো।
রান্নাঘরে পৌঁছে পুরোনো কেটলিটার গায়ে নতুন কেটলি লাগিয়ে দেখলাম, অবিকল এক। মাথার ওপর বসিয়ে দেখলাম, বেড় এক্স্যাক্টলি সমান। পাশাপাশি রেখে হাঁটুতে ভর দিয়ে চোখ খুব সামনে নিয়ে গিয়ে মাপলাম, জল ঢালার জন্য ঠোঁটের মতো অংশটা এক, এমনকি ঠোঁটের নিচে যে ফুটো ফুটো মতো করা আছে, সম্ভবত বাষ্প বেরোনোর জন্য, তার সংখ্যাও কাঁটায় কাঁটায় সমান সমান।
অথচ পুরোনো কেটলিটার পাশে নতুনটাকে কী খেলনাসুলভ দেখাচ্ছে। যেন চাসুড়ের রান্নাঘরে নয়, কোনও শখের চাপ্রেমীর ড্রয়িংরুমে সাজিয়ে রাখার জন্য বানানো। অথচ এত মাপামাপির পর সন্দেহের কোনও জায়গাই নেই যে দুজনে আসলে এক ও অবিকল। তবে? খানিকক্ষণ ভেবে অবশেষে এই সিদ্ধান্তে এসেছি যে আসলে ব্যবহার এবং উপযোগিতা, জিনিসকে (মানুষকেও হয়তো) একটা আলাদা মহত্ব দেয়। এই কেটলিতেও যখন জল ভরব, সুইচ অন করব, রক্তচক্ষু জ্বেলে কেটলি গরম হতে শুরু করবে, শোঁ শোঁ শব্দ ক্রমে টগবগটগবগ, একদল বন্য ঘোড়া যেন কেটলি ফাটিয়ে বেরোনোর উপক্রম করবে, তাদের ক্ষুরের ধুলো আর নিঃশ্বাসের আগুনের আঁচ বেরোবে কেটলির গা দিয়ে, থরথর করে কাঁপবে কেটলি, আর তারপর তা থেকে আমরা যে যার কাপে ঢেলে নেব সঞ্জীবনীসুধা, তখন এই চকচকে খেলনাসুলভ কেটলিকেও ততখানিই প্রকাণ্ড আর মহান আর সর্বশক্তিমান দেখাবে, যেমন আমাদের সংসারের প্রথম কেটলিকে দেখাত এতদিন।
Biyer por onek bochor amra ekdom furniture chara thekechi ... maati te godi pete dhalao bichana, boro matir haanri te speaker lagiye gaan shona, ar kitchen e bare minimum jinish. Thakar moddhe chilo shudhu boi ar boi. Ma kakima ra dekhe dukku peten :)
ReplyDeleteEkhon protyek bochor ek gada jinish Big Bazar e diye ashi ... abar porer bochor thik otokhani e jome othe.
সিরিয়াসলি, শর্মিলা। এত জমে কী করে সেটা একটা রহস্য। বিগ বাজারে পুরোনো জিনিস নেয় বুঝি?
DeleteEvery February oder ekta exchange scheme chole ... jinish er bodol e coupons deye with some percentage off ... kokhno kaaje laage, abar kokhono lage na ... kintu jinish deyar ekta jaayega paayi ... ekhan okhan khujte hoye na kothaye jinishgulo debo.
Deleteওহ, এটার খোঁজ নেব তো। থ্যাংক ইউ, শর্মিলা। এটা ঠিকই বলেছ, জিনিস দেওয়ার জায়গা পাওয়া মুশকিল।
Deleteবাড়ি হাল্কা হলো কিনা জানাবেন কিন্তু। পজিটিভ রেজাল্ট হলে আমরাও উদ্বুদ্ধ হব, কে জানে হয়ত সামনের শনিবারেই...
ReplyDeleteওক্কে, দেবাশিস।
Deletepuratan ketlitar ki gati holo theke gelo naki
ReplyDeleteএখনও আছে আশিস, তবে শীঘ্রই যাবে।
DeleteTar mane Ami eka noi.. Jodi lage Jodi lage bhebe purono prescription, 100-150 ta polythene packet, 5 yrs e ekbar pora saree, jamar botam sob roye jay... Tobe Ami cleaning operation e nami.. 30% Moto korte Pari.. Tumi kotota korle janio.. Inspiration pabo..
ReplyDeleteআমিও ওই তিরিশচল্লিশ শতাংশই পারব, ঊর্মি। তার বেশি ক্ষমতায় কুলোবে না।
Deleteduto topic e darun hoyeche.. coincidentally, aami ekhon ketli kinchi, aar sanghatik bhabe joruri ghor gochanotake postpone kore cholechi.
ReplyDeleteনতুন কেটলির অভিনন্দন, ইন্দ্রাণী। ঘর গোছানো পোস্টপোন করারই জিনিস। আমরাও যা ভেবেছিলাম তার অর্ধেক করতে পেরেছি। বাকি অর্ধেক নেক্সট উইকএন্ডের জন্য তুলে রেখেছি।
Deletemojar likhechho...ami sob guchhiye rakhi pore lagbe bhebe, kokhono dorkar poreo but ami r khunje paina, eta recently eto besi ghotchhe je ma amake brahmi shak khete bolechhen :( ami bhabchhi shak er bodole indexing suru korbo othoba sob i fele debo, rakhlei bipod...
ReplyDeleter bari ghor abar gochhabo jokhon Shree school er boi er Sathe broken (but never new ones) hair clips, Disney ticket, purono bottle, ripped into pieces packing box etc etc etc rakha bondho korbe...I have no idea ki kore or kachhe ogulo too important....je closet e guchhiye rakhe!! bole bole Hal chhere diyechhi... aboshyo golper boira kichhuta ador pay or kachhe.....- Bratati.
হাহা, শ্রী-এর জিনিসগুলো সত্যিই জরুরি মনে হচ্ছে কিন্তু ব্রততী। কী আর করবে, বাড়ি হালকা করার জন্য নিজের জিনিসগুলো ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দাও। আর ঠিক বলেছ, যেগুলো গুছিয়ে রাখি সেগুলো দরকারের সময় খুঁজে পাওয়া অসম্ভব।
DeleteElectric Kettle chhara amaro cholena, Amar tao khub i purono hoye gechhe, 2012 theke chalachhi. Cable tar o ak jayegai ektu chhire geche. Roj i bhabchii akta notun order debo online ar roj i mone hoy 'Cholcheto..thak'..
ReplyDeleteআরে না না, নতুন কেটলি কিনে নাও, রণদীপ। কেবল ছিঁড়ে যাওয়া অনিরাপদ হতে পারে। ফ্লিপকার্টে সেল চলছিল একসপ্তাহ আগে, আমরা ওটাতেই কিনলাম। তুমি চেক করে দেখো এখনও চলছে কি না, না চললেও নতুন কিনে নাও।
Delete