মশাদের বুদ্ধি
মানুষের যেরকম ধাপে ধাপে লাফে লাফে অগ্রগতি হচ্ছে, বাকি পশুপাখিদেরও সেরকম হচ্ছে কি না, না হলে কেন হচ্ছে না, এসব নিয়ে কৌতূহল আমার অনেক দিনের। আপাতদৃষ্টিতে দেখে তো মনে হয় ওঁরা যে তিমিরে সেই তিমিরেই রয়ে গেছেন। হ্যাঁ, হয়তো সাইজে আরেকটু বড় ছিলেন, কিংবা গায়ে লোম একটু বেশি ছিল, কিন্তু সে সব গৌণ বদল। আমি সে সব বদলের কথা বলছি না। সে রকম বদল তো আমাদেরও হয়েছে, কাঁধ সোজা হয়েছে, চোয়াল ঢুকে গেছে - আমি বলছি বড় বড় পরিবর্তনের কথা। আমাদের ইতিহাস বইতে যেমন আগুন জ্বালাতে শেখা, চাকা আবিষ্কার, কৃষিকর্ম ইত্যাদি চ্যাপ্টার আছে, বাঘসিংহের বইতেও কি আছে সেরকম? মনে তো হয় না। কেন নেই? নিজেদের বুদ্ধিতে না কুলোক, ওঁদের নাকের ডগায় যখন আমরা আগুন জ্বালাতে শিখলাম, তখন আমাদের টুকে ওঁরা শিখলেন না কেন, এইটা আমার আরও অদ্ভুত, আরও অবিশ্বাস্য লাগে। (এত অবিশ্বাস্য যে মাঝে মাঝে মনে হয়, হয়তো ওঁরা জানেন সবই, আমরা জানতে পারছি না। এখনও তো সব বন কেটে সাফ করতে পারিনি, হয়তো সেই বনের মধ্যে বাঘেদের অফিস আছে, অফিসে ওয়াইফাই, হয়তো আমাদের থেকে বহুগুণ দ্রুততর, বাফারিং বলে কোনও বস্তু নেই, ডাউনলোড হয় চক্ষের নিমেষে। অবশ্য বাঘেদের অগ্রগতি আমাদের থেকে সম্পূর্ণ অন্যরকম কিছু হয়েছে সেটাও হতে পারে। ফাস্ট ইন্টারনেট কানেকশন যে সভ্যতার একমাত্র শর্ত নয় (অনেকক্ষেত্রে পরিপন্থী) সেটা নিয়ে আমার আবার কোনও সংশয়ই নেই।)
আমরা জামা পরতে শিখলাম, খুলতে শিখলাম, রাঁধতে শিখলাম, রান্না ভুলে হোম ডেলিভারি ধরলাম, ভাষা শিখলাম, এখন ভোলার জন্য প্রাণপাত করছি, অথচ বাঘমামা সেই হরিণ মেরে খাচ্ছিলেন, সেই খেয়েই যাচ্ছেন, ব্যাঙেরা সেই গ্যাঙর গ্যাং ডাকছিল, এখনও ডেকে যাচ্ছে।
এবং গলা ছেড়ে ডাকছে। প্রতিদিন ফোনে মায়ের গলা ছাপিয়ে তাদের ডাক শুনতে পাই। বর্ষাকালে যেমন বৃষ্টি হওয়া উচিত তেমনই তেড়েফুঁড়ে বৃষ্টি হচ্ছে রিষড়ায়। কুয়োতলা গোড়ালিডোবা পুকুর, বাগানে ফলন্ত কলাগাছ গোড়া নরম হয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে। আরও আফসোস যে আগের দিনই আরতিমাসি মাকে বলেছিল, “দুটো ডাণ্ডা কাটাকুটি করে এইবেলা ঠ্যাকনা দিন বৌদি”, আর পরদিন মা সকালে উঠে দেখেন কাঁদি কাঁদি কলাশুদ্ধু গাছ শুয়ে রয়েছে। "মানুষের মৃতদেহ দেখার মতোই কষ্ট হয় প্রায় দেখলে, জানিস সোনা।" শোকে মা দু’সেকেন্ডের নীরবতা পালন করছিলেন আর অমনি ফাঁক দিয়ে আগের থেকে দ্বিগুণ জোরে গ্যাঙর গ্যাং শোনা গেল। রীতিমত ভয় লাগে শুনলে। আপসে মুখ থেকে "বাবাগো" বেরিয়ে যায়।
বিশেষ করে অভ্যেস চলে যাওয়ার পর। বর্ষাকালে যে ব্যাঙ ডাকে ভুলেই গেছিলাম, প্রথমে ভেবেছিলাম মেঘ ডাকছে। দুঃখ দুঃখ গলায় মাকে বলেওছিলাম, "ইস তোমাদের কী মজা, বর্ষাকালে কেমন সুন্দর মেঘ ডাকে।" মা বললেন, ওটা মেঘ না, ব্যাঙ। মেঘও ডাকছে, তবে ঢের আস্তে। ফোনের ভেতর দিয়ে সে আওয়াজ আমার কান পর্যন্ত পৌঁছনোর মতো নয়।
আমি অভিভূত হয়ে ব্যাঙের ডাক শুনতে লাগলাম আর আবার ওই কৌতূহলটা মাথা তুলল। আমরা এগোলাম, ওরা থেমে রইল কেন। যার গলায় এত জোর, সে গ্যাঙর গ্যাং ছেড়ে এগোতে পারল না?
বলা বাহুল্য, আমার কৌতূহল নেচার-এ চিঠি লিখে উত্তর খোঁজার বা মিনিমাম গুগল করার মতোও জোরদার নয়। আমার কৌতূহল বাকি সব কৌতূহলের মতোই, অলস টাইমপাসের। তাছাড়া গুগলটুগলের থেকে যার উত্তর আমার পছন্দসই (এবং বিশ্বাসযোগ্যও) হবে অনেক বেশি, আমি তাকেই আমার সংশয়টা খুলে বললাম।
"মানুষের বুদ্ধি বাড়ল, ব্যাঙেদের বুদ্ধি বাড়ল না কেন গো মা? কিংবা বাঘেদের? বাকিরা মানুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বুদ্ধিমান হল না কেন?"
আমাকে এবং আমার সব কথাকেই মা মারাত্মক সিরিয়াসলি নেন (অনেকে বলে আরেকটু কম নিলে দুজনের পক্ষেই মঙ্গল হত) এই শখের কৌতূহলকেও দূরছাই করলেন না। “সত্যি তো সোনা, কেন হল না?” মা ভাবতে লাগলেন, আমি এদিক থেকে ব্যাঙেদের ডাক শুনতে লাগলাম।
হঠাৎ মা বললেন, “উঃ, মাগো।”
আমি আতংকিত হয়ে বললাম, “কী হল কী হল?”
মা বললেন, “হচ্ছে হচ্ছে সোনা, মশারা বুদ্ধিমান হচ্ছে লাফিয়ে লাফিয়ে।”
পাটুলি আর রিষড়ার শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতে বন্ধুত্বপূর্ণ তরজা হয়, তাতে রিষড়া সর্বদা হারে। জেতার কোনও চান্সই নেই। পাটুলি আলো করে আছেন আশাপূর্ণা দেবী, আলি আকবর, বুদ্ধদেব বসু আর রিষড়ায় টিমটিম করছেন বিশে ডাকাত, ফেলু ময়রা, আর অন্তর্ধানের আগে নেতাজীর একটি রাত। অনেক হাতড়ে আরেকজন বেরোন, তুরুপের তাসের মতো আমি তাঁকে টেবিলের ওপর ফেলি। শিশির ঘোষ। অমনি পাটুলির ঝুলি থেকে কৃশানু দে বেঁকা হাসি হাসতে হাসতে বেরোন। আমি পুনর্মূষিক অধোবদন।
কেবল একটা ব্যাপারে আজ পর্যন্ত প্রতি যুদ্ধে পাটুলি হার মেনেছে, সেটা হচ্ছে মশা। প্রতিবার প্রসঙ্গ উঠলেই পাটুলি সসম্মানে পশ্চাদপসরণ করে। "তোমাদের বাড়ির মশা, সিরিয়াসলি..."
মশারা বোকা এ অবশ্য আমার কোনওদিনও মনে হয়নি। অন্তত রিষড়ার মশারা। রিষড়ার মশারা চিরকালই বুদ্ধিমান ছিল, তবে সাইজে বড় হয়েছে, সংখ্যায়ও বেড়েছে অনেক। সেটা আমি এখন গিয়েও টের পাই। পৌরসভা উন্নয়ন খাতে একান্ন কোটি টাকা এসেছিল নাকি, খুব ঢাকঢোল পেটানো হয়েছিল, কাজের ধুম পড়েছিল। রাস্তার দুপাশে ঝটপট মোটা মোটা নর্দমা কাটা হল, তারপর টাকা ফুরিয়ে গেল। ঢাকনা লাগানোর পরিকল্পনা ছিল কি না জানি না, টাকা ফুরিয়ে গেল বলে ঢাকনা লাগানো গেল না, না কি পরিকল্পনাই ছিল না, সে সব জানা যায়নি, শুধু দেখা যাচ্ছে নর্দমাগুলো এখন মশা তৈরির কারখানা।
আধুনিক মশাদের বুদ্ধিও নাকি বেড়েছে। অন্তত মা সেই রকমই দাবি করলেন। বললেন, তাঁর ছোটবেলায় মশারা যেখানে পেত সেখানেই কামড়াত, এবং চাপড় খেয়ে মরত। এখনকার মশারা অনেক স্ট্র্যাটেজিক। এই যে মোবাইলে আমার সঙ্গে কথা বলছেন, মশাগুলো নাকি কামড়াচ্ছে ঠিক কানের কাছে ফোন ধরে থাকা আঙুলের গাঁটে। আর কোথাও না। ভোরবেলা গ্যাস জ্বালিয়ে চা করার সময়, শাড়ির পাড়ের নিচে যেটুকু পায়ের পাতা বেরিয়ে থাকে, শুধু সেখানে কামড়ায়। গ্যসের সামনে দাঁড়িয়ে ক্রমাগত লেফট-রাইট করে না গেলে রক্ষা নেই। যখন সাঁড়াশি ধরে বাটি থেকে কাপের ওপর রাখা ছাঁকনিতে চা ঢালেন তখন পা ছেড়ে এসে হাত আক্রমণ করে। তবে মশাদের ফেভারিট কামড়ানোর সময় এগুলোর কোনওটাই নয়। মশারা বুঝে ফেলেছে, একজন মানুষের সবথেকে নিরস্ত্র, অসহায় সময় কোনটা। ভুজঙ্গাসনে থাকা অবস্থায় কেউ মশা মারার অ্যাটেম্পট পর্যন্ত করেছে, এ জিনিস শোনা যায়নি। আমার মা ঠেকে শিখেছেন, এখন ব্যায়ামট্যায়াম সব মশারির ভেতরে করেন। ঘুম ভেঙে দাঁত মেজে এসে যখন আবার মশারির ভেতরে ঢোকার উপক্রম করেন, তখন নাকি বাড়ির সব মশা, “মিনিমাম দেড় হাজার”, ম্যাট্রেস আর মশারির সংযোগস্থলে এসে লাইন দিয়ে বিনবিন করতে থাকে। এক ইঞ্চি ওপরে না, নিচে না, ডাইনে না বাঁয়ে না। সে যেন ঠিক পাঁচটা চল্লিশ ঢোকার মুখে হাওড়া স্টেশন আর সে বিনবিনানি নাকি ব্যাঙের ডাক কেন, পনেরোই অগস্টের আকাশে মিলিটারি প্লেনের প্যারেডের গর্জনের থেকে হাজারগুণ ভয়ংকর।
অনেকদিন পরে কমেন্ট করতে এলাম, রোজ একবার করে উঁকি দিয়ে যাই যদিও|
ReplyDeleteমশার বুদ্ধি নিয়ে কোনো কথা হবে না| আমি রাত্রে বাড়ি ফেরার সময় অটো করে ফিরি| জানেন নিশ্চই কলকাতার অটো তে ড্রাইভারের ডানদিকেও লোক ঝুলতে ঝুলতে যায়| এবারে আমি ডানদিকে বসে ঝুলছি আর বাঁহাত দিয়ে অটোচালকের সিটের পিছনটা আঁকড়ে ধরে আছি যাতে পড়ে না যাই| এমনসময় বুদ্ধিমান মশা এসে বাঁহাতের কনুই-এর কাছে কামড়াতে লাগলো| ভাবুন অবস্থাটা, মশা মারতে হলে অটো থেকে পড়ে যেতে হয়, না হলে অটোদাদা কে বলতে হয় যে দাঁড়ান-দাঁড়ান মশা মারব! দুঃখের কথা হল যখন অটো থেকে নামলাম সে মশাও রক্ত খেয়ে উড়ে গেল| কি রাগ হচ্ছিল কি বলব, নিজেকে না টুনটুনির গল্পের বিড়ালের মত লাগছিল! ইয়ে ওই টুনটুনির গল্পেও কিন্তু মশার activity কে খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখানো হয়েছিল| মনে আছে তো? - সৌগত
হাহা, এই সিচুয়েশনটা জব্বর, সৌগত। অটোওয়ালাকে মশা মারার জন্য অটো থামাতে বললে ওঁর মুখটা কেমন হয় সেটা দেখার জন্যই জাস্ট আমি ভাবছি একবার বলব। মশা বাংলা সাহিত্যে প্রায় চোরের মতোই গুরুত্বপূর্ণ।
Deleteলেখাটা দারুণ হয়েছে। মাছি, বেড়াল, কুকুর, বাঁদর এদেরও প্রচুর বুদ্ধি বাড়ার প্রমাণ পেয়েছি। তবে মশারা এগিয়ে।
ReplyDeleteহ্যাঁ, তিলকমামা, মশাদের শ্রেষ্ঠত্ব তর্কাতীত।
Deletemoshar kachhe je ki naakaal hoyechi se r bolar noy. - Bratati.
ReplyDeleteআমাকে ইদানীং কম হতে হয়, তবে রিষড়া গেলে আর রক্ষা নেই।
Deletedurdanto hoyeche lekhata..
ReplyDeleteধন্যবাদ, ইন্দ্রাণী।
Deletehahaha eta darun hoyeche, moshader buddhi kom je bolbe tar buddhi niyei songshoy hobe e amio mani - Pradipta
ReplyDeleteতাই তো দেখছি, প্রদীপ্ত।
Deletemosader budhi nie amr sonsoy ache...ami ekta experiment kortam choto belay..sondhe belay porar somoy mosar utpate teka day... bhablam eto gulo mosha na mare ekta mosha ke halka kore mare tar dead bodyta fele rakhi..jodi tate baki ra voy pay...kintu ato akutovoy jati ami dekhi dekhi ni age..
ReplyDeleteমশাদের ডেডবডি জমিয়ে ভয় দেখানোর আইডিয়াটা ভালো, অনিরুদ্ধ, আমার ঠাকুমাকেও করতে দেখেছি এটা, কিন্তু ও দিয়ে ওঁদের কাবু করা মুশকিল।
Delete