নারকান্ডা-সিমলা
সিমলা থেকে টানা ন’ঘণ্টার জার্নি করে রকশম যাব না বলে সারাহান থেমেছিলাম, রকশম থেকে সিমলা টানা ন’ঘণ্টার জার্নি করব না বলে থামব নারকান্ডায়। সিমলা থেকে ঘণ্টা দুয়েকের দূরত্বে চেনা হিলস্টেশন নারকান্ডা। রকশম চিৎকুলের তুলনায় রীতিমত মেট্রোপলিস বলা যেতে পারে। থেমে থেমে চা খেতে খেতে এলেও রাস্তায় কষ্ট হল। অনেকটা নেমে আসায় টেম্পারেচার বেড়ে গেছে, ওই ভর দুপুরে অতক্ষণ টানা গাড়িতে বসে থাকা, বিশ্রী। নারকান্ডায় আমরা এসে পৌঁছলাম সাড়ে তিনটের সময়। ভীষণ ক্লান্ত লাগছিল। পুরোটাই শারীরিক নয়। ছুটি আর মোটে এক রাত। কাল বাড়ি ফেরা। আমরা উঠেছি হিমাচল সরকারের হোটেল হাটু-তে। অনেক লোক। ঈদের লং উইকএন্ডে সকলেই বেড়াতে বেরিয়েছেন। সত্যি বলছি, ইচ্ছে করছিল শুধু বিছানায় শুয়ে শুয়ে পকোড়া খেতে খেতে টিভি দেখি, ইচ্ছেতে লাগাম পরালাম।
কারণ সময় আর হাতে বেশি নেই। নারকান্ডায় আমাদের হাতে শুধু একটা সন্ধ্যে। কিছুই দেখা হবে না, তবে হাটু হোটেল থেকে হাটু রোড ধরে সাত কিলোমিটার দূরে হাটু পাহাড়ের চুড়োয় হাটু দেবীর মন্দির দেখতে সবাই যায়, আমরাও যাব। পিচরাস্তা ধরে ঘণ্টাদুয়েক চড়লেই শৃঙ্গজয়। আমাদের মতো শখের হাঁটিয়েদের জন্য আদর্শ। যদিও ওই মুহূর্তে হাঁটার প্রশ্ন নেই। ঈশ্বরজীই ভরসা।
পকোড়া খেয়েটেয়ে আরাম করে সাড়ে পাঁচটায় বেরোনো হল। চমৎকার রাস্তা ধরে পাহাড়ে চড়ছি, আর দেখছি পাইনের ডালের জালে আটকা পড়া কুয়াশা। অনেকদিন আগে পড়েছিলাম ওয়েদার ডট কম হচ্ছে বুড়োদের এম টিভি,নিজের ক্ষেত্রে প্রমাণ পাচ্ছি হাতেনাতে। দিল্লির নেক্সট তিনমাসের আবহাওয়া আমার মুখস্থ, যাওয়ার আগে সারাহান, রকশম, চিৎকুল, নারকান্ডারও ওই ক’দিনের আবহাওয়া মুখস্থ করেছিলাম। সব জায়গায় মেঘ, বৃষ্টি দেখিয়েছিল। ছাতা নিয়ে গিয়েছিলাম দুটো বয়ে বয়ে। অথচ সারাহান, রকশম, চিৎকুল কোথাওই বৃষ্টি হয়নি, মেঘ পর্যন্ত পাইনি। স্রেফ ঝকঝকে রোদ। বৃষ্টি যেটুকু হয়েছে, রাতে। শেষরাতে লেপের তলায় শুয়ে শুয়ে টুপটাপ বৃষ্টির শব্দ পেয়েছি, ভোর ফোটার সঙ্গে সঙ্গে সব পরিষ্কার হয়ে গেছে।
নারকান্ডাতেও বৃষ্টি নেই, কিন্তু ভীষণ কুয়াশা। পাহাড় বেয়ে গাড়ি চলল। ঝকঝকে তকতকে রাস্তা, কিন্তু বেশ খাড়াই। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সাড়ে তিন হাজার মিটার উঁচুতে হাটু পিক, প্রায় চিৎকুলের সমান। ভাগ্যিস ঈশ্বরজী ছিলেন।
হাটু এসে গেল। গাদাগাদা গাড়ি, বেশিরভাগই ফিরছে। এত লোকের থাকার জায়গা নারকান্ডায় নেই আমি নিশ্চিত। বেশিরভাগই এসেছেন সিমলা, খানিকটা সময় বাঁচিয়ে এসেছেন দু’ঘণ্টা দূরের এই অপেক্ষাকৃত খালি শহরটিতে।
হাটু পিকের মাথায় হাটুমাতার মন্দির, যিনি আমাদের চেনা মন্দোদরী।
কুয়াশার একটা ভালো ব্যাপার হচ্ছে যে আশেপাশে চিৎকারচেঁচামেচি না থাকলে নিজেদের বুঝিয়ে নেওয়া যায় যে পাহাড়চুড়োয় শুধু আমি আর আমার ফোটোগ্রাফার ছাড়া আর কেউ নেই।
ছুটি টেকনিক্যালি শেষ। কিন্তু ঈশ্বরজী আমাদের এত সহজে ছাড়বেন না। বলেন, সিমলা দিয়েই তো যাব, ওখানে ঘুরে নেবেন দেড়দুই ঘণ্টা। আমরা যত হাতেপায়ে ধরি, ছেড়ে দিন ভাইসাব, গালেমুখে চুনকালি পড়ে যাবে, উনি কিছুতেই ছাড়বেন না। অবশেষে নিজেদের ইচ্ছেতে নয়, ঈশ্বরজীর জোরাজুরিতেই থামতে হল সিমলাতে।
ওপরের প্যারাগ্রাফটা নির্জলা মিথ্যে। সিমলা আসার জন্য আমরা যথেষ্ট মুখিয়ে ছিলাম। এবং সিমলায় নেমে কী কী খাওয়া যেতে পারে সে নিয়ে অনলাইন রিসার্চও চালিয়েছিলাম জোর। আমাদের ইচ্ছে ছিল অথেনটিক হিমাচলি খাবার খাওয়ার। খুঁজেটুজে বিশেষ সুবিধে হল না।
ম্যাল রোডের ধারে আমাদের নামিয়ে দিলেন ঈশ্বরজী। ম্যাল রোডে গাড়ি ঢোকা নিষেধ। প্রায় রথের মেলার মতো ভিড়। লং উইকএন্ডের শেষদিনে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ঘোড়া, মানুষ, আইসক্রিম, বাচ্চা, বাচ্চার হাতে ফুঁ দিয়ে ওড়ানো বুদবুদখেলনা, সেলফিস্টিক এবং হাঁসঠোঁটে গমগম, জমজম করছে সিমলা ম্যাল। আমরা কোথাও যাবটাব না, ইচ্ছেও নেই, সময়ও নেই, তবে নাকের ডগায় চার্চ, একবার নমো না করে আসাটা ভালো দেখায় না। দশ হাতের মধ্যে গুফা-আশিয়ানা বার অ্যান্ড রেস্টোর্যান্ট, ঢুকে পড়লাম সেখানে। এই দোকানের নাম আগেও এসেছে আমাদের রিসার্চে। (যদিও অত রিসার্চ কোনও কাজে লাগেনি। লাঞ্চটাইম শুরু হয় একটা থেকে, তখন থেকেই হিমাচলি খাবার মেলে, আমরা পৌঁছেছি সাড়ে বারোটায়। কাজেই আমাদের ভাগ্যে খালি চিজ টোস্ট আর মাশরুম অমলেট আর চার কাপ চা।
গুফা আশিয়ানা সরকারি দোকান, কাজেই লোকেশন চমৎকার, একেবারে ম্যাল রোডের ওপর। আশিয়ানায় আমাদের টেবিলের লোকেশনও চমৎকার। একেবারে রাস্তার পাশে। ভিড়ে গা না ঠেকিয়ে ভিড় দেখার জন্য আদর্শ।
সিমলা ম্যাল রোড দেখার মতোই। অত লোক কিন্তু কী ঝকঝকে পরিষ্কার। অত লোকে আইসক্রিম খাচ্ছে, একটি থ্যাঁতলানো কোন গড়াগড়ি খাচ্ছে না। নো চিপসের প্যাকেট, নো ঘোড়ার নোংরা, নো নাথিং। মেন্টেন্যান্স কাকে বলে শিখতে হয় সিমলার কাছ থেকে।
খাওয়া শেষ। এবার হেঁটে হেঁটে আমাদের যেতে হবে সিমলা রেলস্টেশন। ট্রেনে চাপব বলে নয়, ঈশ্বরজী ওখানে দাঁড়িয়ে থাকবেন, আমাদের পৌঁছে দেবেন কালকা, যেখানে আমাদের জন্য শতাব্দী এক্সপ্রেস অপেক্ষা করছে। ম্যাল রোড থেকে রেলস্টেশন যাওয়ার রাস্তাটা শান্ত ছবির মতো, বাঁদিকে দূরে পাহাড়, ডানদিকে বড় বড় অফিসবিল্ডিং, পোস্টঅফিস। চোখ পড়ল জ্বলজ্বলে চারটি অক্ষরে। বি এস এন এল। মনে মনে স্যালুট করলাম। আমাকে খাইয়ে পরিয়ে মানুষ করেছে।
সারি সারি লোক আমাদের সঙ্গে চলেছে। সকলেরই প্রশান্ত মুখ, কারও হাতে সেলফি স্টিক, কারও হাতে বাচ্চা, বাচ্চার হাতে বুড়ির চুল, পতাকার মতো উঁচু করে ধরা। সকলেই কথা বলতে বলতে চলছে, একটা গুনগুন কানে আসছে, আলাদা করে কে কী বলছে বোঝা যাচ্ছে না, তার মধ্যে বাংলা শুনলে একটু যা কান খাড়া। আমাদের পেছনে একদল আসছিলেন, বিশুদ্ধ বাঙাল। আমরা স্পিড কমিয়ে তাঁদের কাছাকাছি হাঁটার চেষ্টা করলাম।
দূর থেকে প্ল্যাটফর্মের ঢালু টিনের ছাদ দেখা গেল। এইখানে আসবেন ঈশ্বরজী, আমাদের পিক আপ করতে। এই জায়গায় পুলিসের খুব কড়াকড়ি, যেখানেসেখানে গাড়ি দাঁড়াতে দেবে না। গোটা হিমাচল জুড়েই মহিলা ট্র্যাফিক পুলিসের দাপাদাপি দেখেছি, ঈশ্বরজী অনেকেরই মুখ চেনেন। চেনা জায়গার চেনা মোড় পেরোতে পেরোতে বলেছেন, এই ম্যাডাম লোক ভালো তাই যেতে দিল, আরেক ম্যাডামের ডিউটি পড়ে এই মোড়ে, এক নম্বরের খড়ুস। এখানেও এক ম্যাডাম টুপি পরে লাঠি নেড়ে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করছেন। সদাশয় না খড়ুস মুখ দেখে বুঝতে পারছি না, কাজেই সতর্ক থাকতে হবে। ঈশ্বরজীকে দেখা মাত্র দৌড়ে উঠে পড়তে হবে। অর্চিষ্মান আমার এক হাত ধরে অন্য হাতে ফোনে ওঁকে কনট্যাক্ট করার চেষ্টা করছে।
মনে মনে সিমলাকে বললাম, আসব আবার, সময় নিয়ে। ছুটি বাঁচিয়ে। ম্যাল রোডের খুব ঘুরব, খুব আইসক্রিম খাব, ঘোড়ায় চাপব না দূর থেকেই অ্যাপ্রিশিয়েট করব, আর তোমার ফাঁকা ফাঁকা রাস্তা দিয়ে হাঁটব এদিকেসেদিক। চিৎকুলের পাইনবন, তোমার সঙ্গে দেখা হবে না হয়তো আর, তোমার ভাইবেরাদর কল্পা, কাজা, নাকো…তাদের পাইনবনও তো দেখতে হবে, সে সব বনের ছায়ায় ছায়ায় কত লালসাদাবেগুনি ফুল ফুটে আছে, তাদেরও তো এড়িয়ে এড়িয়ে পা ফেলতে হবে। তা বলে ভেব না তোমার ফুল, ছায়া, প্রজাপতিদের ভুলে যাব। বুকের ভেতর গর্জন উঠল। তোমাকে তো মনে রাখবই, ছোট্ট বসপা, যদি আর জীবনেও না দেখি তোমায়, অন্য পাহাড়ি নদীদের সঙ্গে তোমাকে গুলিয়ে ফেলব না কিছুতেই। প্রমিস। আঙুলের ডগায় তোমার ঠাণ্ডা ছোঁয়া পুরে নিয়েছি, কানে তোমার ডাক, চোখে তোমার ঊর্ধ্বশ্বাস ছোটা। আমার চিহ্ন হিসেবে একখানা পুঁচকে নীল নুড়ি তোমার বুকের মধ্যে ছুঁড়ে দিয়ে এসেছি, তুমিও মনে রেখো আমাকে।
হাতে টান পড়ল। চোখ খুললাম। রাস্তার ওপারে গাড়ির জানালা থেকে ঈশ্বরজী হাত নাড়ছেন।
হাতে টান পড়ল। চোখ খুললাম। রাস্তার ওপারে গাড়ির জানালা থেকে ঈশ্বরজী হাত নাড়ছেন।
tomar chokh diye dekhle prakritir soundarja jano anek bere jai
ReplyDeleteওহ, থ্যাংক ইউ, আশিস।
DeleteKhub bhalo laglo kuntala Di. Aro Bhalo laglo karon amra o eta experience korlam just dudin age. R himachali khabar ta next time kheyo...just too good.
ReplyDeleteধন্যবাদ, প্রিয়াঙ্কা। তোমরা এখন কোথায়?
DeleteAmra naggar theke masovra hoye ekhon shoghi te. Kalke fire jabo.
Deleteআহা, মচৎকার। গল্প শুনতে চাই ব্লগে।
Deletepore monta besh shant hoye jay emon bhalo :) Thank you . - Pradipta
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ-টা সম্পূর্ণভাবে আমারই বলার কথা, প্রদীপ্ত।
Deletesob beranor sesh belate monta bicchiri rokom kharap hoye jaye. even tomar golpo'r last para poreo besh dukkho dukkho laglo.
ReplyDeleteআমার তো প্রত্যেকবার বেড়িয়ে ফেরার সময় কান্না পায়, কুহেলি।
Deletekhub bhalo laglo braman kahini,oi sarahan na rakshom puro pahar bhorti charidike..opurbo...okhane jabar ekta eechehe dhuke gelo mone...tomar lekhoni o baro bhalo
ReplyDeleteprosenjit
পাহাড় ভালো লাগলে রকশম চিৎকুল বেশ সহজে যাওয়ার জায়গা, প্রসেনজিৎ। লেখা ভালো লেগেছে জেনে খুশি।
Deletechhobir moton dekhte pelam chokher samne
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, চুপকথা।
Deletebesh Ekta shanto-aah-aaraam feeling holo bhraman kahini ta pore... Bratati.
ReplyDeleteধন্যবাদ, ব্রততী।
Delete