পারকিনসন'স ল



সিরিল নর্থকোট পারকিনসন (১৯০৯-১৯৯৩)
উৎস গুগল ইমেজেস

ছোটবেলায় শান্তিপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা মহম্মদ আলির জীবনী পড়া ইস্তক 'পারকিনসন'স' বললেই রিফ্লেক্সে ‘ডিজিজ’ শব্দটা মাথায় আসত, গত দুদিন ধরে অন্য একটা শব্দ মাথায় আসছে। 

ল। পারকিনসন’স ল। যদিও যদিও ল’এর অনেক আগে পারকিনসন এসেছেন (ল’ আবিষ্কারের সময়, বা আবিষ্কার জগতের কাছে উন্মোচনের সময় তাঁর বয়স ছিল ছেচল্লিশ) তবু তাঁর থেকে তাঁর ল বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ল না থাকলে সিসিল নর্থকোট পারকিনসনের নাম এই এতদিন পরে এত দূরে বসে আমি জানতেই পারতাম না। কাজেই ল-টা আগে বলে নিই। 

Work expands so as to fill the time available for its completion.

যে রকম শুনতে লাগছে, সে রকম গম্ভীর করে কথাটা পারকিনসন বলেননি। সিরিল নর্থকোট পারকিনসন ছিলেন ব্রিটিশ বুরোক্রেসির ভেতরের লোক। সিস্টেমের অপদার্থতা, ক্রমবর্ধমান আয়তন, গুচ্ছের অকাজের লোককে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়ানো, এ সব সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতা এবং গাত্রদাহ আর পাঁচটা বাইরের লোকের থেকে বেশিই ছিল। সেই নিয়েই একখানা বিদ্রূপাত্মক, ননসিরিয়াস লেখা, সিরিয়াস পত্রিকা দ্য ইকনমিস্ট-এ লিখেছিলেন পারকিনসন। ছাপা হয়েছিল উনিশশো পঞ্চান্ন সালের নভেম্বর মাসে। বিদ্রূপে ভরপুর সে লেখায় The Law of Multiplication of Subordinates গোছের থিওরি, সাবথিওরি, অ্যাক্সিয়ম, ভয়ালদর্শন ফর্মুলাটরমুলা সহকারে প্রমাণটমান ছিল।

সে সব সময়ের তোড়ে ভেসে গেছে, বেঁচে গেছে শুধু আড়াই হাজার শব্দের লেখার প্রথম লাইনটা। যেটা কোনও রকম আড়ম্বর ছাড়াই পারকিনসন পেশ করেছিলেন, এমনকি কৃতিত্বও নিতে চাননি। 

It is a commonplace observation that work expands so as to fill the time available for its completion. 

কমনপ্লেস তো অনেক কিছুই, কিন্তু সব কমনপ্লেস জিনিসই যে আমদের কমন সেন্সে জায়গা পায় তা তো নয়, তাই পারকিনসন যখন কাজ আর সময়ের মধ্যে সরল সম্পর্কটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন, তখন সবাই কমেন্টে এসে বলল, “খাঁটি কথা”। 

পারকিনসন ভালো শিক্ষক ছিলেন, কথা হাওয়ায় ভাসিয়েই হাত ঝাড়েননি, উদাহরণও দিয়েছেন। সময়ের নিয়ম মেনে সে উদাহরণ হয়তো স্বাভাবিকভাবেই সামান্য সমস্যাজনক, তবু ইতিহাসের মুখ চেয়ে সেই উদাহরণটাই এখানে দিলাম।

Thus, an elderly lady of leisure can spend the entire day in writing and despatching a postcard to her niece at Bognor Regis. An hour will be spent in finding the postcard, another in hunting for spectacles, half-an-hour in a search for the address, an hour and a quarter in composition, and twenty minutes in deciding whether or not to take an umbrella when going to the pillar-box in the next street. The total effort which would occupy a busy man for three minutes all told may in this fashion leave another person prostrate after a day of doubt, anxiety and toil.

*****
প্রেজেন্টেশন শেষ হওয়ার পর টেবিলের চারপাশ থেকে সবাই হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে থাকে। আমি যে এত মডেলের কথা বললাম, অত ডেটা, তত রিগ্রেশন — কেউ ইমপ্রেসড নয়। ডেটাকে টর্চার করে যে যা খুশি বলানো যেতে পারে, স্ট্যাটিসটিকস অতি ভয়ংকর লায়ার, এই সব প্রাচীন প্রবাদ সবাই মুখস্থ করে রেখেছে, ও দিয়ে চিঁড়ে ভিজবে না। মন্ত্রীমশাই থোড়াই তোমার রিগ্রেশন টেবিল পড়বেন, ওঁর কাছে সিগনিফিকেনস অ্যাট ফাইভ পার্সেন্টও যা ঘোড়াড্ডিমও তাই। তোমার এত ডেটা ধামসানো ফালতু, যদি তার কোনও পলিসি ইমপ্লিকেশন না থাকে। 

অবান্তরের পাঠকদেরও কারও কারও সেরকম মনে হতে পারে। ল পড়ে কী হবে, যদি আমার তাতে কিছু এসে না যায়? 

যাবে যাবে, নিশ্চয় আসবে যাবে। যাঁরাই কাজ করেন, (যেটা আমি ধরে নিচ্ছি, সবাই) তাঁদেরই আসবে যাবে। যাঁরা কাজ সময়ে শেষ করতে পারেন না বা করতে গিয়ে গলদঘর্ম হন (যেটা আমি আশা করছি, অনেকেই) তাঁদেরও। (এমন যদি কেউ থাকেন যে কাজ আসামাত্র লাফিয়ে সারেন, সেরে, হাত ঝেড়ে ডেডলাইন পর্যন্ত বাকি সময়টা পপকর্ন খান আর টিভি দেখেন, ওয়েল, আমি তাঁদের নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাই না।) 

পলিসি ইমপ্লিকেশনে যাওয়ার আগে ল-টা আরেকবার ঝালিয়ে নেওয়া যাক। 

Work expands so as to fill the time available for its completion.

টার্মপেপারের কথা মনে করুন। ক্লাসের কেউ লিখেছিল এক রাতে, কেউ এক সপ্তাহে, হাতে গোনা যমের অরুচি কেউ কেউ ছিল যারা সেমেস্টারের ফার্স্ট উইকে নোটিস পাওয়া থেকে কাজ শুরু করে সারা সেমেস্টার খেটে জমা দিয়েছিল।  

তাহলে একটা টার্ম পেপার লিখতে আসলে কত সময় লাগে?

উত্তর সোজা। যে যতখানি সময়ে টার্ম পেপারটা লিখে শেষ করেছে, তার একটা টার্ম পেপার লিখতে ততটাই সময় লাগে।

আপনি কতক্ষণে লিখেছিলেন? ঠিক আছে, বলতে হবে না, আমারটাই শুনুন বরং। আমি জানি আমার টার্ম পেপার লিখতে কত সময় লাগে, কারণ আমি শত শত টার্ম পেপার ওই একই সময়ের মধ্যে লিখেছি এবং জমা দিয়েছি।

এক রাত। 

আরেকটা উদাহরণ দিই। শনিবার সন্ধ্যে সাতটায় এস এম এস এল।

দু’নম্বরে। পাবদা কেনা হয়ে গেছে। দাদুর চপের লাইনে। কুন্তলার বেগুনী নিয়ে নিয়েছি, তুই আলু না পেঁয়াজি শিগগির জানা। পাঁচ মিনিটে দেখা হচ্ছে। 

ল্যাপটপের নিচ থেকে বেরোলাম। চানাচুরের শিশির ঢাকনা বন্ধ করে রান্নাঘরে রাখতে যাচ্ছি, যেতে যেতে ভেতরের ঘরের খাটের ওপর তিনটে জামার দিকে চোখ পড়ল। এমন নয় আগে পড়েনি। গত শনিবার কেচে ইস্তিরি হয়ে আসা থেকে বারবার চোখ পড়ছে, বারবার চোখ সরিয়েও নিচ্ছি। 

সেদিন সরালাম না। চানাচুরের শিশি নামিয়ে রেখে জামাগুলো তুললাম, আলমারির দরজা খুললাম, ভেতরে রেখে দরজা বন্ধ করলাম। ডিসিশন নেওয়া থেকে কাজটা শেষ করা পর্যন্ত আমার সময় লাগল সাত সেকেন্ড।

ওই মুহূর্তে “জামা খাট থেকে আলমারিতে তুলতে কত সময় লাগে?" জিজ্ঞাসা করলে আমার উত্তর হত, “সাত সেকেন্ড”। এস এম এস পাওয়ার আগে ওই একই প্রশ্নের উত্তর সাত দিন, এমন কি ওই মুহূর্তে এস এম এস টা না পেলে চোদ্দ দিন, একুশ দিন, এক মাস, তিন মাস… যা খুশি হতে পারত।

প্রোডাকটিভিটি গুরুরা বলছেন, একটা কাজকে ঠিক ততটাই সময় দিন যতখানি তার প্রাপ্য, এক সেকেন্ডও বেশি নয়। জামাগুলো সাত সেকেন্ডেই তুলুন, কারণ আপনি জানেন, হাতেনাতে প্রমাণ পেয়েছেন, জামাটা তুলতে সত্যিই সাত সেকেন্ডের বেশি সময় লাগে না। সাত সেকেন্ডে জামা তোলার জায়গায় সাত দিন ধরে সেটাকে তুলছি তুলব করে মানবসম্পদের অপচয় করবেন না।

আপনি যেহেতু জানেন টার্ম পেপার এক রাতে লেখা সম্ভব কাজেই সেটা এক রাতেই লিখুন, তার পেছনে আর একবেলাও বেশি খরচ করবেন না।

(ওয়েল, এই পরামর্শের দায় প্রোডাকটিভিটি গুরুরা নিতে চাইবেন কি না আমি নিশ্চিত নই, তবে পারকিনসন ল-কে নিজের সুবিধার্থে ব্যবহার করার মূল এসেন্সটা আপনাদের ধরাতে পেরেছি আশা করি।

হ্যাঁ, এমন অনেক কাজ থাকবে যেগুলো করতে কত সময় লাগবে আপনার জানা থাকবে না। জীবনে একটাও উপন্যাস না লিখে থাকলে আপনার জানা সম্ভব নয় একটা উপন্যাস লিখতে আপনার কত সময় লাগা উচিত। জীবনে একটাও প্রেম না করে থাকলে আপনার জানা অসম্ভব কতক্ষণ আপনি একটা প্রেমের পেছনে পরিশ্রম করবেন আর কখনই বা বুঝে নেবেন যথেষ্ট হয়েছে, এবার বলার সময় এসেছে, নে-এ-এ-ক্সট।

একটু রিসার্চ করুন, তবে সময় বেঁধে। (কারণটা ঠিকই ধরেছেন, রিসার্চ এক্সপ্যান্ডস সো অ্যাজ টু ফিল দ্য টাইম অ্যাভেলেবল ফর ইটস কমপ্লিশন। আরও একটা কথা মনে রাখলে সুবিধে, একটা কাজ করতে যত সময় লাগবে বলে আপনার বিশ্বাস, প্রায় সবক্ষেত্রেই সে কাজটা করতে আসলে লাগে তার থেকে অনেক কম সময়।) অভিজ্ঞ লোকদের পরামর্শ নিন, গুগল করুন, তারপর সময়সীমার যে রেঞ্জটা পাচ্ছেন তার লোয়ার লিমিটে নিজেকে বাঁধুন। কাজটা আপনি ওই সময়ের মধ্যে শেষ করবেন। 

চরমপন্থীরা আরও একধাপ এগোন। তাঁরা বলেন ওই ন্যূনতম সময়েরও অর্ধেক সময় নিজেকে দিন। অর্থাৎ কেউ যদি মোটে তিন ঘণ্টায় একটা কাজ শেষ করে থাকে, তাহলে আপনি ঠিক করে নিন, আপনি দেড়ঘণ্টায় কাজটা শেষ করবেন।

মনে রাখবেন, একটা কাজকে আপনি যত সময় দেবেন, সে ঠিক ততটাই সময় নেবে। 

*****

গোটা আর্গুমেন্টে আমার মতে প্রোডাকটিভিটি গুরুরা একটাই ফাঁক রেখে দিয়েছেন। কাজ সময়ে শেষ করতে একটি তৃতীয় শক্তির অনুপ্রবেশ লাগে। আমার অভিজ্ঞতায় যেটা কাজ এবং সময়, দুইয়ের তুলনাতেই বেশি শক্তিশালী। 

হুমকি। আলটিমেটাম। 

টার্মপেপার আজ না লিখলে, ফেল। 

রিপোর্ট আজ সাবমিট না করলে, বেকার।

অতিথি আসার আগে ঘর না গুছোলে, জাজমেন্ট।

এইটুকু ভুল শোধরানো সোজা। পারকিনসন’স ল-কে নিজের সুবিধার্থে সার্থকভাবে প্রয়োগ করতে গেলে নিজের জন্য উপযুক্ত হুমকির ব্যবস্থা করে নিন। মুখে কালি, বসের বিরাগভাজনতা, যার যা কাজে দেয়। তারপর কাজে নামুন। মনে রাখবেন, আপনি যতখানি অ্যালাউ করবেন, কাজ ঠিক ততখানিই সময় নেবে। 

*****

এই পোস্টটা আমি গত তিনদিন ধরে পাবলিশ করব করব ভাবছি। লিখছি ক’দিন ধরে সে কথা মনে করে আর গ্লানি বাড়াতে চাই না। প্রতিদিনই ঘণ্টাখানেকের কাজ বাকি থেকে যাচ্ছে। আজ সকালে উঠে ঠিক করলাম এক ঘণ্টা নয়, আধঘণ্টায় আমি পোস্টটা শেষ করে ছাপাব। না হলে ব্লগ লেখা ছেড়ে দেব। সারাদিন শুধু অফিসের কাজ করব মন দিয়ে।

পোস্ট শেষ করে ছাপাতে কত সময় লাগল বলুন দেখি? 

কুড়ি মিনিট।

জয় পারকিনসন। জয় পারকিনসনের ল। 


*****

পারকিনসনের মূল লেখাটি যদি কারও পড়ার ইচ্ছে থাকে, এই রইল লিংক।

http://www.economist.com/node/14116121


Comments

  1. Bah.. Jantam na to.. Etodin bhabtam kaj amake time limit Dey.. Ekhon ulto dik theke bhebe inspiration pacchi mone hocche... :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমিও তাই ভাবতাম, ঊর্মি।

      Delete
  2. aami ei quote ta jaantaam, kintu purota pore darun laglo.. ekdom thik bolechen.. ebaar theke mone rakhte chesta korbo..

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওহ, আমি এই প্রথম শুনলাম কথাটা, ইন্দ্রাণী। ভালো কিন্তু, তাই না?

      Delete
  3. Besh laglo lekhata. :)
    example gulo ekdom dil e giye dhhil marlo....amar songeo erokom i ghote kina :P
    deadline prosonge ekkebare ekmot.
    Joy Parkinson!
    Joy Parkinson's Law!!
    Joy Kuntala!!!
    :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. আহা, আমার নামে জয়ধ্বনি এই আপনি দিলেন, অরিজিত, আর কেউ দেয়নি, দেওয়ার কোনও সম্ভাবনাও দেখতে পাচ্ছি না. থ্যাংক ইউ.

      Delete
  4. ore baba! ekdom notun information ...thank you Kuntala...
    tabe Tomar example gulo information ke aro pokto korechhe undoubtedly..- Bratati.

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, ব্রততী।

      Delete
  5. This is one of my most favorite laws. Its corollary, Expense rises to meet income, is also very true. - Gautam Banerji

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ, খরচের ব্যাপারটাও সত্যি।

      Delete

Post a Comment