এ মাসের বই/সেপ্টেম্বর ২০১৭/২ঃ মিস্ট্রি ও মহাকাব্য
A Rising Man/ Abir Mukherjee
এ বছরের শুরুতে আমার বই পড়া সংক্রান্ত একটা রেজলিউশন ছিল, ননককেশিয়ান গোয়েন্দার স্টক বাড়ানো। বই পড়া সংক্রান্ত বাকি সব রেজলিউশনের মতো, এটা রক্ষাতেও আমি ডাহা ফেল করতে চলেছি। তবে হারা জেতায় লাজ নেই, যত লাজ নিশ্চেষ্ট হয়ে অদৃষ্টের হাতে সব ছেড়ে বসে থাকায়। সে জন্য হাফ বছর পেরিয়ে যেতে আমি নড়েচড়ে বসলাম। আর অমনি গার্ডিয়ান পত্রিকায় একখানা গোয়েন্দা উপন্যাসের গ্লোয়িং রিভিউ চোখে পড়ল। উপন্যাসটার কথা অনেকদিন ধরেই এদিকওদিক থেকে কানে আসছিল। গার্ডিয়ানের রিভিউ মনে জোর দিল, কিন্ডলে কিনে ফেললাম আবীর মুখার্জির আত্মপ্রকাশকারী উপন্যাস ‘আ রাইজিং ম্যান’। স্যাম উইন্ডহ্যাম সিরিজের প্রথম বই।
এই শেষের তথ্যটা আমি জানতাম না। আমি শুধু জানতাম মুখার্জির উপন্যাসের ঘটনা ঘটছে স্বাধীনতাপূর্ব ভারতবর্ষের কলকাতা শহরে। সেখানে একজন বাঙালি পুলিসের সাহসিকতার কথাও পড়েছিলাম, পড়ে ধরেই নিয়েছিলাম যে এ গল্পের গোয়েন্দাও কালা আদমি।
বই কেনার পর দেখি গোয়েন্দা আপাদমস্তক সাহেব, ক্যাপ্টেন স্যাম উইন্ডহ্যাম। গল্পের কালা আদমি সার্জেন্ট ‘সারেন্ডার-নট’ ব্যানার্জি, ক্যাপ্টেন উইন্ডহ্যামের তোপসের ভূমিকায়।
যাকগে, একটা রেজলিউশন (ননককেশিয়ান গোয়েন্দার বই পড়ার) রাখা হল না, আরেকটা (বই পড়ার) রাখা হল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধক্ষেত্রের আতংক স্বচক্ষে দেখে, স্ত্রীবিয়োগের যন্ত্রণা পেয়ে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দা ক্যাপ্টেন উইন্ডহ্যাম এসেছেন কলকাতায় ইম্পিরিয়াল পুলিশবিভাগের গোয়েন্দা হিসেবে যোগ দিতে। নতুন শহরের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাওয়ার আগেই একটি ঘনঘোর রহস্যে উইন্ডহ্যামের দায়িত্বে এসে পড়ে। একজন উচ্চপদস্থ ’সাহিব’, নেটিভ আদমিদের পাড়ার গলির নালার মধ্যে খুন হয়ে পড়ে আছেন, মৃতদেহের মুখে কাগজ পোরা, তাতে বাংলায় ভারত ছাড়ার হুমকি লেখা।
তদন্ত শুরু হল। যা যা গোলমাল বাধার সবই বাধল। উইন্ডহ্যামের সহকারী ডিগবি, ঘোর রেসিস্ট, ঘোর ভারতবিদ্বেষী। রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতির ঘুণধরা ব্রিটিশ রাজ। সরকারি আনুকূল্যপ্রাপ্ত দুর্নীতিগ্রস্ত পাটকলের ফিরিঙ্গি মালিক। বেইমান ভারতীয় খোচর। ‘টেররিস্ট’ স্বাধীনতাসংগ্রামী। কোঠাবাড়ির আবেদনময়ী মালকিন। রহস্যময়ী অ্যাংলোমেম টাইপিস্ট। এই পরিস্থিতিতে স্যাম উইন্ডহ্যামের একমাত্র সঙ্গী অধস্তন পুলিস সার্জেন্ট ব্যানার্জি। যার খটমট নাম জিভে কায়দা করতে না পেরে সাহেবরা ‘সারেন্ডার-নট’ করে নিয়েছে।
আ রাইজিং ম্যান-এর ফরে অনেক কিছুই, চরম ইন্টারেস্টিং প্রেক্ষাপট, সেই প্রেক্ষাপটের সদ্ব্যবহারও করতে ছাড়েননি/ভোলেননি শ্রী মুখার্জি। সে সময়ের কলকাতার বর্ণনা, স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস, টেরিটিবাজারে চিনা আফিমের আড্ডা, একই শহরে নেটিভ এবং সাহেবদের পাশাপাশি কিন্তু যোজনদূরত্ব অবস্থান, এ সব কিছুই ছুঁয়ে গিয়েছেন তাঁর গল্পে।
আর সেটা করতে গিয়েই গল্পটার দিকে নজর দেননি। বা আরেকটু ক্রিটিক্যাল হয়ে বলা যায়, উল্টোভাবে বলা যায়, সেটা করেছেন বলেই গল্পের দিকে নজর না দিয়েও পার পেয়ে গেছেন।
রাইজিং ম্যান-এর ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং যতটা টানটান, রহস্য সমাধানের প্রক্রিয়া ততটাই ফুটোফাটা। বা বলা উচিত ফুটোগুলো চাপা দিতে অক্ষম লেখক। গোয়েন্দাগল্প পড়েটড়ে আমার যা মনে হয়েছে, ভুল ধরতে চাইলে সব তদন্তেরই ভুল ধরা যায়। যাকে জেরা করলে সেকেন্ড সিনে খুনি বেরিয়ে যাবে তার জেরা টাঙিয়ে রাখা হয়ে লাস্টের আগের সিন পর্যন্ত। করিৎকর্মা লেখক এইসব ধাপ্পাবাজি সাফল্যের সঙ্গে চাপাচুপি দিয়ে রাখতে পারেন। মাঝখানে রেড হেরিং, ফলস ক্লু দিয়ে পাঠককে এমন গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে রাখেন যে সে অন্য কথা ভাবার সময় পর্যন্ত পায় না। আবীর মুখার্জি সেটা পারেননি। উইন্ডহ্যাম পাগলের মতো দৌড়চ্ছেন এদিকসেদিক, আর আমি ভেবে চলেছি ওই ব্যাপারটার কী হল, ওই লাইন অফ ইনভেস্টিগেশনটা পারসু করল না তো। (মনে রাখতে হবে, আমি কিন্তু অত্যন্ত বিশ্বাসী পাঠক, আমি ভুল পথে ভেসে যেতেই চাই, সেই আমারই যখন এতসব প্রশ্ন মনে জাগছে, সেয়ানা পাঠকদের জাগতে বাধ্য।)
তবে লেখকের এটা প্রথম গোয়েন্দা উপন্যাস, কাজেই গ্রেস দিতে চাইলে দেওয়া যায়। যে বিষয়টায় আমি গ্রেস দিতে পারছি না (নাকি চাইছি না?) সেটার কথা বলে শেষ করি। স্যাম উইন্ডহ্যাম সবে একবেলা হল কলকাতায় এসে নেমেছেন, এর আগে তিনি আধখানা বাঙালিও চোখে দেখেননি, অথচ বাঙালি এবং কলকাতা নিয়ে তাঁর উচ্ছ্বাস দেখার মতো। ভারতবর্ষের বাকি প্রদেশের ওপর ব্রিটিশসাম্রাজ্য আরামসে আধিপত্য চালাচ্ছে, কেবল এই বাগ্মী, তেজস্বী এবং মোস্ট ইম্পরট্যান্টলি, বুদ্ধিমান বাঙালির দল তাঁকে স্বস্তিতে থাকতে দিচ্ছে না। আর কলকাতা, আহা। এরকম বর্ণময়, ইউনিক শহর পৃথিবীতে আর দুটি আছে কি না সন্দেহ। এ কি সদ্য প্রিয়বিরহে শোকার্ত, দেশ ছেড়ে আসা সাহেবের জবানবন্দী, নাকি প্রবাসী কলকাতাবাসীর ফেসবুক পোষ্ট, মাঝে মাঝে আমার সত্যি গুলিয়ে যাচ্ছিল।
২০১৭র সেপ্টেম্বরে একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার ঘটল, আমি আমার জীবনের প্রথম গ্রাফিক নভেলটা পড়লাম। তাও আবার যে সে নভেল না, একেবারে মহাভারত। শিবাজি বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আর শঙ্খ ব্যানার্জির ছবিতে মহাভারতের শুরুর দিকের অংশ নিয়ে গ্রাফিক নভেল বার করেছে পেঙ্গুইন র্যান্ডম হাউস, নাম দিয়েছে ব্যাসঃ দ্য বিগিনিং, দাম করেছে চারশো টাকা। দামটা আমার মতে খুবই ন্যায্য, কারণ মোটা বই, মোটা পাতা, ঝকঝকে বাঁধাই।
ব্যাস দি বিগিনিং-এর বেশিরভাগ গল্প - সত্যবতী পরাশর, সত্যবতী শান্তনু, ভীষ্মের শপথগ্রহণ, অম্বা অম্বিকা অম্বালিকা বৃত্তান্ত, দ্রোণ বনাম দ্রুপদ, শর্মিষ্ঠা বনাম দেবযানী, যযাতির যৌবনযাতনা ইত্যাদি আমার জানা ছিল, আবার জন্মেজয়ের যজ্ঞে মহাভারতের কথা শুনে এসে নৈমিষারণ্যে বসে সেই গল্প যে শোনাচ্ছিলেন যে উগ্রশ্রবা সৌতি, তাঁর বাবাও যে চমৎকার গল্প বলিয়ে ছিলেন আর বাবার নাম যে ছিল লোমহর্ষণ, এটা জানা ছিল না।
ব্যাস-এর ভাষা আমার চেনা লোকদের কারও কারও অপছন্দ হয়েছে, কিন্তু আমার খুবই পছন্দ হয়েছে। সাধারণত মহাকাব্য আমরা যে রকম শ্রদ্ধাপূর্ণ, নতমস্তক ভাষায় পড়তে অভ্যস্ত শিবাজি সেটা সম্পূর্ণ পরিহার করেছেন। যেমন শর্মিষ্ঠা দেবযানী ঝামেলায় চরিত্ররা একে অপরকে অবলীলায় ‘দ্যাট বিচ!’ বলে তিরস্কার করছে, উগ্রশ্রবার শ্রোতারা তো ভয়ানক রসিক।
লেখার থেকেও নজর কেড়েছে আমার ব্যাস-এর ছবি। মহাভারতের (বা যে কোনও মহাকাব্যেরই) যা মূল সুর, হিংস্রতা, সেটা ব্যাস দ্য বিগিনিং-এর প্যানেলে প্যানেলে পরিস্ফুট। জন্মেজয়ের যজ্ঞে সাপদের ধরে ধরে আগুনে ফেলার সময় সাপদের চোখেমুখে যে মৃত্যুআতংক, আমি দ্বিতীয়বার তাকাতে পারিনি। উগ্রশ্রবা এ গল্পে দাড়িওয়ালা বোরিং সাধু নন, তিনি রীতিমতো গল্পের মুড বুঝে মেকআপ পাল্টান, চোখ নাক মুখ আঁকেন, প্রপ্স বদলান।
বইটি একটি সিরিজের অংশ। ব্যাসঃ দ্য বিগিনিং শেষ হয়েছে দ্রৌপদী এন্ট্রি নেওয়ার ঠিক আগে। পরের বইগুলো অতি অবশ্যই পড়ব, ঠিক করে রেখেছি।
হল! এবার আরো তিনটে (আজ্ঞে হ্যাঁ, আবীর মুখুজ্যে এ বছর তাঁর দু' নম্বর বই "আ নেসেসারি ইভল" প্রকাশ করে ফেলছেন) বই শপিং কার্টে উঠল।
ReplyDeleteসামনে ভাইফোঁটা, তাই হাজার চারেক খসবেই। তার মধ্যে আবার...
হ্যাঁ, বাহরিসনস-এর শেলফে নেসেসারি ইভিল দেখলাম, ঋজু। আমি আবীর মুখার্জির ব্যাপার জানি না, তবে এই ব্যাস দ্য বিগিনিংটা ইন্টারেস্টিং, রেকমেন্ড করছি।
DeleteGraphic Novelta porar ichhe holo. Ei boitar kotha shunechhi. Eta apnar prothom graphic novel jene bhalolaglo. Apni aro kichhu try korte paren. Bhalo lagbe. Ei muhurte ekta graphic novel-i porchi. Berterd Russel er jibon niye "Logicomix an Epic Search for Trurh: An Epic Search for Truth". Apurbo.
ReplyDeleteওহ, এই বইটার নাম শুনেই তো পড়তে ইচ্ছে করছে সায়ন, থ্যাংক ইউ।
DeleteNon Caucasian detective chaile Detective Galileo Portey Paaro...(Keigo Higashino)
ReplyDeleteহিগাশিনোর ডিটেকটিভ কাগা সিরিজের একটা বই পড়লাম কদিন আগে, ম্যালিস। খুব একটা ভালো লাগেনি। গ্যালিলিও সিরিজটা পড়ে দেখব নিশ্চয়, অর্পণ। খোঁজ দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
DeleteVyasa to darun interesting mone hochhe... kinbo bhabchhi.....-Bratati.
ReplyDeleteকিনতে পার, ব্রততী। অর্চিষ্মান আর আমার দুজনেরই খুব ভালো লেগেছে।
Delete