সপ্তমীতে অঞ্জন



গত কয়েকদিন ধরে ওলাশেয়ার উবারপুলে যা অপদস্থ হতে হল। সি আর পার্ক যাব শুনলেই সহযাত্রীরা রাখঢাক না রেখে মাথা নাড়ছেন, ছিকছিক শব্দ করছেন, ফোন তুলে ওপারের বাস্তব কিংবা কাল্পনিক বন্ধুকে বলছেন, কাহাঁ ফঁস গয়ে ইয়ার। তাঁদেরও দোষ দেওয়া যায় না, গোটা রাস্তা পক্ষীরাজের গতিতে ছুটে এসে সি আর পার্কের মুখে আধঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হলে এদিকে পুজোয় নতুন জামা না হলে রাগ হওয়ারই কথা। 

আমার নতুন জামা এমনকি নতুন জুতো পর্যন্ত হয়েছে, তবু আমারই মাথা ধরে যাচ্ছিল। সপ্তমীর দিন অফিস থেকে ফেরার পথে সব রাস্তা বন্ধ, রাস্তা জুড়ে পুলিশ, পাঁপড়, বিরিয়ানি এবং বাঁশ।  

বাড়ি এসে জামাকাপড় ছেড়ে শয্যা নিলাম। বেল বাজল। যত না ক্লান্তি, মুখচোখের ভাব তার থেকে দ্বিগুণ করে গেলাম দরজা খুলতে। অত ভালো অভিনয় কাজে দিল না যদিও। প্রতিবাদের সুযোগই পেলাম না, আধঘণ্টা বাদে আবিষ্কার করলাম, ফ্যাব ইন্ডিয়া থেকে কেনা সবুজ সিল্কের জামা পরে রসরাজ-এ দাঁড়িয়ে আছি। 

অর্চিষ্মান দাবি করেছে, ক্ষীরের সিঙাড়া আর বেকড রসগোল্লা খেয়ে নিলেই সব ক্লান্তি হাওয়া হয়ে যাবে। তখন আর হেঁটে হেঁটে ঠাকুর দেখতে কোনও কষ্টই হবে না। 

খেয়েদেয়ে ডি ব্লক আর মেলা গ্রাউন্ডের ঠাকুর দেখে আমরা হাঁটা দিলাম নবপল্লীর মাঠের দিকে। ওখানে আজ অঞ্জন দত্ত অ্যান্ড নীল দত্ত গাইতে আসবেন। পোস্টার দেখা ইস্তক অর্চিষ্মান বলে রেখেছে, ঝড় হোক, ঝঞ্ঝা হোক, এইটা মিস করা চলবে না। কোটি কোটি বাচ্চা, মাথায় কোটি কোটি হেয়ারব্যান্ড, চোখে সানগ্লাস, হাতে বুড়ির চুল এবং হাওয়াকল নিয়ে রাস্তা জ্যাম করে রেখেছে, সে সব পেরিয়ে আমরা নবপল্লীর মাঠে গিয়ে পৌঁছলাম। 

বলা বাহুল্য, সিট নেই। মাঝে মাঝে দু’চারটে খালি চেয়ার দেখে উত্তেজিত হচ্ছি, কাছে গেলেই বেরোচ্ছে রুমাল পাতা। ধুত্তেরি বলে একেবারে সামনে চলে গেলাম। লাল কার্পেট পাতা, নতুন জুতো খুলে বসে পড়লাম বাবু হয়ে। তখনও নবপল্লীর স্থানীয় ট্যালেন্টদের প্রোগ্রাম চলছিল। নতুন লোকগীতি, পুরোনো লোকগীতি, বেশিরভাগই দুর্গাপুজো সংক্রান্ত। শিল্পীরা দারুণ আনন্দ করে গাইছিলেন, বাজাচ্ছিলেন। দিব্যি লাগছিল। নিচ থেকে কর্মকর্তারা “আরও একটা আরও একটা” ইশারা করছিলেন। আমি আর অর্চিষ্মান বলাবলি করছিলাম, অঞ্জন দত্তর পাউডার মাখা শেষ হয়নি নির্ঘাত।
  
অবশেষে লোকগীতির অনুষ্ঠান শেষ হল। ঘোষক ভারি রহস্য করে হাসি হাসি গলায় জানালেন, অবশেষে মহালগ্ন সমাগত। এতক্ষণ কার্পেট ফাঁকা ফাঁকা ছিল, নিমেষে গিজগিজ হয়ে গেল। ছোট ছোট লাইট জ্বলানেভা জুতোরা আমার সিল্কের জামা পাড়িয়ে দৌড়ে চলে গেল। বিশাল লটবহর নিয়ে ছায়া ছায়া কয়েকজন মানুষ মঞ্চে উঠে এলেন।  

নীল দত্তকে চিনতে পারলাম, ড্রামারের পদবী পরে জানলাম বক্সী, বেস গিটারে প্রশান্ত। মঞ্চের ডানদিকে সামনে আরেকজন দাঁড়িয়ে গিটার টিউন করছিলেন, আমি সিরিয়াসলি ভেবেছি অঞ্জন দত্তর কোটি কোটি সাহেব বন্ধুর মধ্যে কেউ একজন হবেন। তারপর শুনলাম উনি বিখ্যাত গিটারিস্ট অমিত দত্ত। সত্যি বলছি, আমি ওঁর নাম জানতাম না, স্রেফ চেহারা দেখেই ফ্ল্যাট। তারপর বাড়ি এসে গুগল করে বেরোলো অমিত দত্ত নাকি রায়চাঁদ বড়ালের নাতি! 

সকলেই উঠে যে যার যন্ত্রের কান মুলছেন, উইংসের দিকে তাকিয়ে এইসব আঙুল তুলে এক নম্বরটা বাড়াও, দুই নম্বরটা কমাও এইসব নির্দেশ দিচ্ছেন, অঞ্জন দত্তর দেখা নেই। মঞ্চের মাঝখানে মাঝের মাইকটা একজন টেস্ট করছিলেন। খানিকক্ষণ বাদে আমাদের সন্দেহ হল ইনিই অঞ্জন দত্ত নয়তো? হয়তো মোটা হয়ে গেছেন, চুল বড় রেখে ঝুঁটি বেঁধেছেন। টিভিতে লোকের আসল চেহারা বোঝা যায় কি না কে জানে। আমরা ভদ্রলোককে কেটে ছেঁটে অঞ্জন দত্তর চেনা চেহারায় ফিট করানোর চেষ্টা চালাচ্ছি, এমন সময় আলোটালো সব ডিম হয়ে গেল, স্টেজের পেছন থেকে ভসভসিয়ে সাদা ধোঁয়া বেরিয়ে এল, এই ভদ্রলোক ও পাশের উইং দিয়ে ভেতরে চলে গেলেন, আর এ পাশের উইং থেকে কানফাটানো হাততালি আর হুপহাপ চিৎকারের মধ্যে নীল জিনসে কালো টি শার্ট গুঁজে গটগটিয়ে বেরিয়ে এলেন অঞ্জন দত্ত। এসেই কথাটথা না বলে মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে ধরলেন, “সেই বুড়ো পুরোনো গিটার”।

তারপর 'শুনতে কি চাও তুমি' থেকে 'মেরি অ্যান' থেকে 'রঞ্জনা' হয়ে 'বেলা বোসে' আসতে আসতে নবপল্লীর প্যান্ডেলে বিস্ফোরণ ঘটল। 

অবান্তরের অ্যাবাউট মি- পেজে খারাপ লাগা জিনিসের মধ্যে অঞ্জন দত্ত-র গান লিখে রেখেছি বটে, কিন্তু সত্যিটা হচ্ছে, খারাপ লাগুক আর জঘন্যই লাগুক, অঞ্জন দত্তর প্রতিটি গান আমার কণ্ঠস্থ। পুরোনো গিটার, শুনতে কি চাও, মেরি অ্যান, বেলা বোস, রঞ্জনা, খাদের ধারের রেলিংটা, তুমি না থাকলে, কত কী করার ছিলো যে… কোনওটা বাদ নেই। অঞ্জন দত্ত একেকটা গান ধরছেন, আর আমি নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছি, এইটার নিশ্চয় সুর মনে নেই, এইটার নির্ঘাত কথা ভুলে গেছি।

প্রত্যেকটি গানের প্রত্যেকটি লাইনের প্রত্যেকটি শব্দ মনে আছে। এমন নয় যে গানগুলো আমি নিত্যি দু’বেলা শুনছি, কারণ আমি তো অঞ্জন দত্তর গান ভালোবাসি না, তবু মনে রয়ে গেল কী করে সেটা একটা রহস্য। সেই কবে চোদ্দ পনেরো ষোলোতে শোনা গানগুলো এই সাঁইত্রিশে মনে রয়ে গেছে কী করে? 

হয়তো চোদ্দ পনেরো ষোলো বলেই গেছে। 

হাততালি দিতে দিতে হাত লাল হয়ে গেল, চেঁচিয়ে গাইতে গাইতে গলা খুলে গেল। এগারোটা নাগাদ অর্চিষ্মান একবার কানে কানে বলার চেষ্টা করল, “বাড়ি যাবে নাকি, কাল আবার অফি…” আমি বললাম, “ক্ষেপেছ, অফিস তো থাকবে, অঞ্জন দত্ত তো থাকবে না।” 

পনে বারোটার প্যান্ডেলশুদ্ধু লোকের কোরাসে ‘পুরানো সেই দিনের কথা’ দিয়ে ফাংশান সাঙ্গ হল। পকেট ফর্টির গলিতে বেরিয়েই দেখি একটা টিংটিঙে লোক, ছাগলদাড়ি নেড়ে নেড়ে ফোনে কাকে বলছে, “বেসিক্যালি, গানবাজনাটা ছাড়া আর সবই হচ্ছে বাঙালির।” মনে মনে “আঁতেল কোথাকার” গালি দিয়ে অর্চিষ্মানকে বললাম, “তুমি না থাকলে সকালটা ইত্যাদি ইত্যাদি সে সব তো জানাই ছিল, কিন্তু তুমি না থাকলে আজকের সন্ধ্যেটাও যে এত ভালো কাটত না, এইটা আরও সাংঘাতিক।” 

সেই থেকে মেরি অ্যান আর হরিপদ লুপে শুনে যাচ্ছি।



Comments

  1. কুন্তলা দি, আমি বাংলাদেশ থেকে নওশীন বলছি। তোমার লেখা কোনটাই মিস দেই না আমি সাধারনত, কিন্তু তুমি অনেকদিন ফুড রিভিউ লিখোনা, মিস করি খাবারদাবারের ছবি, আলোচনা, নতুন গলি, রেস্টুরেন্ট, সবকিছু।
    অন্তত আমার জন্য হলেও কম বাজেটের একটা রিভিউ দিও পারলে।
    ভালোবাসা রইলো। শুভ বিজয়া দশমী

    ReplyDelete
    Replies
    1. বিজয়ার অনেক শুভেচ্ছা ভালোবাসা তোমাকেও, নওশীন। আচ্ছা, এবার একটা রিভিউ ছাপব'খন।

      Delete
    2. ফুড রিভিউ! ফুড রিভিউ ! আমিও দাবি জানাচ্ছি !

      Delete
    3. নোটেড, অন্বেষা।

      Delete
  2. কুন্তলা: আপনার এবং আপনার প্রিয়জনদের জন্য শুভ বিজয়ার অনেক অনেক শুভেচ্ছা রইল। পকেট ফর্টিতে নাকি কলকাতার আদলে রাস্তায় আলপনা দিয়েছিল?

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনাদের সবাইকেও আমার তরফ থেকে শুভ বিজয়ার অনেক প্রীতি শুভেচ্ছা ভালোবাসা জানালাম, দেবাশিস। হ্যাঁ, আলপনা দিয়েছিল তো। আবার সোশ্যাল মিডিয়ায় ডিসক্লেমারও দিয়েছিল শুনলাম যে আমরা কিন্তু কলকাতারটা টুকিনি।

      Delete
  3. হাহাহা এটা সেরা ছিলো , অঞ্জন দত্ত অপছন্দ করে গলা ফাটিয়ে আনন্দ করে আসা । আমিও এরকম করে থাকি প্রচুর । আচ্ছা ইয়ে এবারে দিল্লীতে নাকি কোনো এক জায়গায় নিরামিষ খাওয়ার হুকুম জারী হয়েছিলো? জল মেশানো না সত্য?

    ReplyDelete
    Replies
    1. এ রকম কোনও খবর তো আমার কানে আসেনি, প্রদীপ্ত।

      Delete
  4. Not an Anjan Dutta fan, in fact khub osojyo arrogant lage. chele ta ke to dekhlei juto chhure marte icche kore. But Ranjana ami ar asbo na amaro akdom shuru to sesh mukhostho. Ajob bepar botey.

    ReplyDelete
    Replies
    1. খুবই আজব, কুহেলি।

      Delete
  5. Kuntala Di Darjeeling shuncho ki??sunle I jete ichche korbe warranty.

    ReplyDelete
    Replies
    1. তাহলে এই মুহূর্তে না শোনাই ভালো, প্রিয়াঙ্কা, অলরেডি আমার বেড়াতে যেতে ভয়ানক ইচ্ছে করছে। ইয়ার্কি অ্যাপার্ট, শুনছি। অঞ্জন শুনব দার্জিলিং-এর দেখা পাব না, এ কি হয়?

      Delete
  6. "পাড়ায় ঢুকলে ঠ্যাং খোঁড়া করে দেবো" গান নি উনি? ওনার কিছু কিছু গান একসময় বেশ ভাল লাগতো, কিন্তু ওই আর কি, কিছু কিছু গায়ক আছেন যাঁরা ভালো গানের মতো নিজের ইমেজও ভালো করে ভাঙ্গতে জানেন।

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ, গাইলেন তো। রঞ্জনা না গাইলে জনতা বিদ্রোহ করত।

      Delete
  7. আহা! আপনার সৌজন্যে আমারও অঞ্জন-দর্শন প্লাস দিল্লির পুজোয় মাতামাতি দেখা হয়ে গেল।
    অঞ্জনকে প্রথমবার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে আনা হয়েছিল ১৯৯৪-এর সংস্কৃতি-তে, যতদূর মনে পড়ে। তার আগে তাঁর নাগরিক লোকগান খুব বেশি লোকের মুখে শুনিনি (অবশ্য স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতা করতেই পারে)। লোকের চোখে লাগে, কিন্তু আমার কানে সেই যে মোহাঞ্জন লাগল...

    ReplyDelete
    Replies
    1. চুরানব্বইতেই বোধহয় প্রথম ক্যাসেটটা বেরিয়েছিল অঞ্জন দত্তের, ঋজু।

      Delete
  8. Amar kintu Anjan Dutta ke khubei bhalo lage! Archisman ke deao tomar dialogue ta durdanto!Subho bijoya Kuntala! Asche bochhor abar hobe!

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমার তরফ থেকেও বিজয়ার অনেক শুভেচ্ছা, রুণা।

      Delete
  9. Amra buro hoye gelam, Anjan kintu buro honni! jato ninda mondoi thakuk, loktar energy dekhar moto

    ReplyDelete
    Replies
    1. অ্যাবসলিউটলি, তিন্নি। আমার অলরেডি এনার্জি ওঁর একশো ভাগের এক ভাগ, ওই বয়সে বিছানা ছেড়ে উঠতে পারব বলে মনে হয় না।

      Delete
  10. আহা , চোদ্দ বছর বয়সে পাড়ার পুজো প্যান্ডেলে প্রথম অঞ্জনের অনুষ্ঠান | তারপর মাসছয়েক 'পুরনো গীটার' আঁকড়ে ধরে ঘুমোতে যেতাম :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, এইটা মজার গল্প, অন্বেষা।

      Delete
  11. Shubho Bijaya! Amra Choturthir din CR Park er kichhu pujo pandal e gechhilam; Kali Mandir e tokhon just thakur elo ar last moment er prostuti cholchhe, telebhaja,mishtir stall kintu tokhon shuru hoye gechhe :) Mela Ground er pandal kintu tokhono besh phaka..
    Nabapally er poster gulo chokhe porchhilo-Anjan Dutta, Pandit Ajay Chakrabarty etc..

    ReplyDelete
    Replies
    1. শুভ বিজয়া, রণদীপ। অনেক শুভেচ্ছা, ভালোবাসা রইল। আশা করি পুজো ভালো কেটেছে। সি আর পার্কের পুজো অষ্টমী নবমীতেই জমে।

      Delete
  12. ছোট ছোট লাইট জ্বলানেভা জুতোরা আমার সিল্কের জামা পাড়িয়ে দৌড়ে চলে গেল

    line ta ki bolbo..khub sundor..oshadharon hoeche,khub bhalo.

    prosenjit

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, প্রসেনজিৎ। শুভ বিজয়া।

      Delete
  13. শুভ বিজয়া !!! ভালো থাকিস ..... তোর লেখাটা দারুন লাগল ...

    ReplyDelete
    Replies
    1. শুভ বিজয়ার ভালোবাসা তোকেও, বৈশালী।

      Delete
  14. eita khub adbhut...onar gaan gulo extremely bhalo lage r loktake tar cheye dher besi asojhyo...keno ke jane..- Bratati.

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহাহা, এটা আমার এত বেশি সেলিব্রিটির সঙ্গে হয় যে বলার নেই।

      Delete

Post a Comment