থিম সেফটিপিন
সেদিন বাড়িতে ছোটদাদু-দিদা এসেছিলেন। আমি ভেবেছি বিলম্বিত বিজয়ার ভিজিট বুঝি। সন্ধ্যেবেলা মাকে ফোন করে যখন চার দিক থেকে চিৎকার, রিকশার ভেঁপু শুনলাম তখনও কিছু মনে পড়েনি। তারপর রাতে ফোন করে যখন খবর নিতে গেছি মা অক্ষত অবস্থায় বাড়ি ফিরেছেন কি না, (তাছাড়া রবিবার রাতে আমাকে ফেলে মা কোথায় বেড়াতে গেছিলেন সে বিষয়ে খোঁজ নিতেও) আর মা যখন বললেন ঠাকুর দেখতে, তখন আমার খেয়াল হল।
রিষড়ায় জগদ্ধাত্রীপুজো চলছে। সেদিন নবমী নিশি।
রিষড়ায় যে জগদ্ধাত্রীপুজো হয় এ খবর অনেকেই জানে না। ধুমধাম করেই যে হয়, সে শুনলে তো অর্চিষ্মানের মতোই আকাশ থেকে পড়ে।
‘জগদ্ধাত্রী তো চন্দননগরে, তোমাদের কী?’
‘জগদ্ধাত্রী তো চন্দননগরে, তোমাদের কী?’
চন্দননগরে জগদ্ধাত্রীপুজো হয়, রিষড়ার থেকে ভালো করেই যে হয় সেটাও আমি মেনে নিচ্ছি, কিন্তু রিষড়াতেও রীতিমত ভালো পুজো হয়। ইন ফ্যাক্ট, লেবুগুণ্ডা আর ফেলু মোদকের পর রিষড়ার বিখ্যাততম ব্যাপার জগদ্ধাত্রীপুজো।
রিষড়ার জগদ্ধাত্রীপুজোর বাড়াবাড়ি বেশি পুরোনো নয়। সালতারিখ বলতে পারব না, তবে বাড়াবাড়িটা আমার জন্মের পরেই শুরু হয়েছে এবং সময়ের সঙ্গে ক্রমে বেড়েছে। ছোটবেলায় গানের স্কুল থেকে ফেরার পথে পুজোর দিনে রিকশা করে বাড়ি ফিরতে স্টেশন রোডে জ্যামে পড়তে হত, বছরপাঁচেক পর থেকে আর রিকশাই পাওয়া যেত না, আর এখন তো রাস্তায় হাঁটাই দুষ্কর হয়ে পড়েছে। মা বললেন, গোটা রিষড়াই নাকি নেমে পড়েছে রাস্তায়।
স্বাভাবিক। রিষড়ার লোকের এমনি বিনোদন বলতে খুব বেশি নেই। কোচিংফেরৎ ভিড়ের জন্য ‘আপ্যায়ন’ গোছের নামওয়ালা দুয়েকখানা রেস্টোর্যান্ট আর প্রবীণদের জন্য স্টেশনের ধারের মুদির দোকান এবং বিবিধ বস্ত্রালয়ের সামনের নড়বড়ে বেঞ্চ। এর মধ্যে একটা পুজোটুজো বাধলে লোকে যে বাঁধনছাড়া আনন্দ করবে তাতে সন্দেহ কী। দুর্গাপুজো ক্রিসমাসে কলকাতার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া প্রশ্নাতীত, কালীপুজোতে নৈহাটির নেতৃত্ব অবিসংবাদিত, জগদ্ধাত্রীতেও চন্দননগর প্রতিযোগিতাহীন, তবু জগদ্ধাত্রীর ওপরেই রিষড়ার চোখ পড়ল কেন সেটা একটা রহস্য। চন্দননগরের মতো অত সুন্দর বাঁধানো গঙ্গার ঘাট আমাদের নেই, চওড়া রাস্তাও না, ঐতিহ্যও তো না-ই। তাই যতখানি সম্ভব চন্দননগরের সঙ্গে সরাসরি প্রতিযোগিতা এড়িয়ে পুজো করতে নামতে হয়েছে রিষড়াকে।
রিষড়াতে পুজো জমে মোটে দু’দিন। নবমী-দশমী। চন্দননগর যারা পুজো দেখতে যাওয়ার তারা সপ্তমী-অষ্টমীতে দেখে নিয়ে বাকি দু’দিন রিষড়ার জন্য খালি রাখতে পারবে, সেই আশাতেই সম্ভবত। আমার মাবাবা এ বছর চন্দননগর যাননি, তবে নবমীতে রিষড়ায় বেরিয়েছিলেন। বেশ কয়েকটা ঠাকুর আর থিম প্যান্ডেল দেখেছেন। একটা প্যান্ডেলের থিমের কথা বিশেষ করে বললেন মা। এঁরা নাকি বরাবরই ভালো থিম বানান। আগের বছর পুরোনো জমিদারবাড়ি বানিয়েছিলেন, এবং সেটা ‘আমি সত্যিকারের বাড়ি ভেবেছি, বিশ্বাস কর সোনা!’ লেভেলের ভালো হয়েছিল।
এ বছর তাঁরা বানিয়েছেন সেফটিপিনের প্যান্ডেল। সেফটিপিনের দেওয়াল, সেফটিপিনের আলপনা, সেফটিপিনের ঝাড়লন্ঠন। এই ঝাড়লণ্ঠনটা শুনে অর্চিষ্মান আর আমি দুজনেই ঘাবড়ে গেলাম। বাই চান্স হঠাৎ ভেঙে পড়লে ওপর থেকে কোটি কোটি সেফটিপিনের বৃষ্টি দর্শনার্থীদের মাথায়, নাকে মুখে, বুকে… ভয়ানক জানি, কিন্তু আমরা চরম ইনসেনসিটিভের মতো হাসলাম। মা প্রতিবাদ করলেন। সেফটিপিনের মুখ একেবারে লুকোপ্লাসটার দিয়ে আঁটা। দুর্ঘটনার কোনও সম্ভাবনাই নেই। তা না হলে ‘নিরাপদ জগদ্ধাত্রী’ ক্যাটেগরির প্রাইজ হাতছাড়া হয়ে যাবে। ওই একই কারণে প্যান্ডেলে ঢোকার মুখের দু’দিকের তোরণের মুখে কলকা এঁকে, কলকার মধ্যিখানে লাল টুকটুকে শুঁড় তোলা অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র রাখা হয়েছে, যাতে কোনওমতেই জাজদের চোখ না এড়ায়।
আরেকটা প্যান্ডেল নাকি হয়েছে মাদল বা ড্রাম থিমের। পুঁচকে থেকে প্রকাণ্ড সব ড্রাম জড়ো করে প্যান্ডেল হয়েছে। দেখেশুনে মা মুগ্ধ। বললেন, ‘আমরা খালি এ যুগের ছেলেমেয়েদের খারাপ খারাপ বলি, অথচ এরাই তো অষ্টমীর সারারাত জেগে জেগে বসে এ সব করেছে। কী নিষ্ঠা, কী উদ্দীপনা, কী মন্ত্রগুপ্তি।’
মন্ত্রগুপ্তির ব্যাপারটা কী জিজ্ঞাসা করায় মা বললেন, তাঁকে কোন কর্মকর্তা নাকি বলেছেন, এসব থিমের কাজ অতি গোপনে সারা হয়। মানে এ গলির লোক জানে না ও গলির থিম ড্রাম, আবার ও গলির লোক জানে না এ গলির থিম সেফটিপিন। থিম চুরির প্রব্যাবিলিটি নাকি মারাত্মক হাই।
শুনেটুনে মনে হল মায়ের মতে সেফটিপিন থিমের প্যান্ডেলই সেরা হয়েছে। বললেন, প্যান্ডেলের উপকরণ হিসেবে সেফটিপিনের ব্যবহার তো অভিনবই, তবে সেরার কারণ সেটা নয়। সেফটিপিনের থেকেও অভিনব হচ্ছে সেফটিপিন প্যান্ডেলের স্বেচ্ছাসেবীরা।
দশের নিচে পাড়ায় যত বাচ্চা আছে, সবার চুলে তেল মাখিয়ে, সিঁথি কেটে আঁচড়িয়ে, নতুন জামাপ্যান্ট পরিয়ে, জামার বুকে রঙিন ফিতের কুঁচি দেওয়া ব্যাজ সাঁটিয়ে প্যান্ডেল জুড়ে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমার বাবামা সাধারণত খুবই নিয়ম মেনে চলেন, কিন্তু সেফটিপিন দেখে উত্তেজনা না সামলাতে পেরে বাবা প্যান্ডেলের দেওয়ালের একবার হাত দিয়ে ফেলেছিলেন, অমনি দু’ফুট লম্বা স্বেচ্ছাসেবী বাঁশির মতো গলায় চেঁচিয়ে উঠেছে, ‘ধরবেন না, ধরবেন না!’ বাবা লজ্জা পেয়ে বলেছেন, ‘না, এই দেখছিলাম আসল নাকি,’ তাতে সেই স্বেচ্ছাসেবী বলে কি না, ‘আমাদের থিমে কোনও ভেজাল পাবেন না দাদু, সব আসল।’
রিষড়ার পুজোর কাণ্ডকারখানা শুনে অর্চিষ্মান হেসে অস্থির। আমিও হাসছিলাম, তবে আমার হাসির সঙ্গে একটু একটু মনখারাপও মিশে ছিল। অবশেষে আমি বললাম, ‘এ বছর মিস হয়ে গেল, সামনের বছর জগদ্ধাত্রীপুজোতে রিষড়া যাব। পাঁচদিন পুজোর একদিন চন্দননগর যাওয়া হবে, বাকি চারদিন রিষড়ায় ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখব। সেফটিপিন, মাদল, আখের ছিবড়ে, পুরোনো বাড়ি, বাবুইয়ের বাসা, কোনও থিম বাদ দেব না।’
শুনে থেকে অর্চিষ্মান আর বেশি হাসছে না।
শুনে থেকে অর্চিষ্মান আর বেশি হাসছে না।
durdanto!
ReplyDeleteDurga Pujo'ey ebar amader parate Submarine-themed pandal chhilo - matha mundu jodio kichhui bujhlam na, tao besh dhalao bheer chhilo - aar boy scout type volunteer!
আরে সাবমেরিন থিম প্যান্ডেলের গল্প তো খুব শুনলাম, আমার চেনা অনেকেই দেখতে গেছিল।
Deleteshon naktalar pujor anek video dekhlam ebar, kicchu bujhini !! Jishnuke bolish toh ektu bujhie dite :D
ReplyDeleteসেকি, এসব ভালো ভালো ভিডিও আমি দেখিনি কেন! আগে আমি দেখি দাঁড়া, তারপর বুঝিয়ে দিতে বলব।
Deleteosadharon... boro miss hoye gelo jagadhatri pujo dekha
ReplyDeleteমিস বলে মিস, ইন্দ্রাণী।
Deleteআমি এখন পুজো এলে পাড়ার হতভাগ্য নেড়িকুকুরটার মতো একটা শান্ত আর ঠাণ্ডা কোণ খুঁজে বেড়াই, যাতে ভিড় আর রোল-লোভী জনতাকে এড়িয়ে বই হাতে লম্বা হওয়া যায়। কিন্তু এই বিবরণ পড়ে মনে হচ্ছে, এইরকম থিম-আশ্রিত পুজো না দেখলে সত্যিই লোকসান।
ReplyDeleteআমারও দেখতে বেরোনোর নামে গায়ে জ্বর আসে, ঋজু, কিন্তু একবার রাস্তায় নেমে পড়লে স্রোতে ভেসে যাই। আর সেফটিপিন থিম মিস হওয়াটা জাস্ট আনঅ্যাকসেপ্টেবল।
DeleteAmi konodin baroari Jogottdhhatri pujo dekhini. Theme pujo toh chherei dao.
ReplyDeleteওহ, একবার চন্দননগরে চলে যাও, রুণা। দেখার মতোই ব্যাপার। রিষড়াতেও আসতে পার। নেমন্তন্ন রইল।
DeleteThank you Kuntala!
Deleteshubho jagaddhatri pujo Kuntala :). kakima r positive observation for "ei generation" pore bhalo laglo..
ReplyDeletelast sentence tay besh moja pelam...- Bratati.
Anekdin por Abantor e dhuun marchhi, backlog clear korte time lagbe.
হ্যাঁ, আমার মা এই জেনারেশনের প্রতি খুবই সমব্যথী, ব্রততী। সত্যি অনেকদিন পর কথা হচ্ছে, আশা করি সব ভালো চলছে।
Deleteআমি কখনও জগদ্ধাত্রী পুজো দেখিনি ঘুরে ঘুরে ...সেফটিপিনের থিম কিন্তু সত্যিই অভিনব :)
ReplyDeleteতবে? রিষড়ার থিম বলে কথা।
Delete