ফেরার পথে



ওয়ার্কশপ শেষ হবে বৃহস্পতিবার বেলা একটায় ডিনার শুরু হবে সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায়এই শেষতম গালা ডিনারটিতে যাব প্রতিশ্রুতি দিয়ে আগের দু’দিনের ডিনার এড়িয়েছি, কাজেই ঝড়ই উঠুক কিংবা জলোচ্ছ্বাস, আজ যেতেই হবে।

অর্থাৎ একটা থেকে সাতটা, এই হল আমার হাতে সময়। ছ’ছটা ফাঁকা ঘণ্টা। যখন আমার কিচ্ছু করার নেই, কিচ্ছু ভাবার নেই, কিচ্ছু জমা দেওয়ার নেই, কোথাও যাওয়ার নেই, কারও কোনও কথা রাখার নেই।

একেবারে কাজ ছিল না বলা ভুল হবে, একটা কাজ ছিল। অর্চিষ্মানের জন্য চকোলেট কেনা। সে কাজটা সারতে লাগত পাঁচ মিনিট, আমি লাগালাম পঁয়তাল্লিশ। একবার হ্যাজেলনাট সুগন্ধের চকোলেট বার তুললাম, নামিয়ে রেখে ক্যাপুচিনো তুললামতুলে গেলাম বেলজিয়ান ট্রুফলের দিকে। ট্রুফল নেড়েচেড়ে দেখে ফিরে এসে ক্যাপুচিনো যথাস্থানে রেখে আবার হ্যাজেলনাট তুলে ঝুড়িতে রাখলাম। ভাবলাম একবার ক্যান্ডির আইলটা দেখে আসি। পঁয়তাল্লিশ মিনিট এই করে কাটল। তারপর দু’প্যাকেট হারিবো গামি ভল্লূক, (কোলা ফ্লেভারের ক্যান্ডিগুলো কোকাকোলার বোতলের মতো দেখতে) একটা ক্যাপুচিনো আর একটা হ্যাজেলনাট চকোলেট বার, আর লাল গায়ে কালো টিপ পরা গুবরে পোকার মতো দেখতে কয়েকটা চকোলেট (তাদের পেটের তলায় আবার প্লাস্টিকের চারটে পা আর দুটো করে শুঁড় সাঁটা) তুলে দোকান ছাড়লাম।

তারপর একেবারে উদ্দেশ্যহীন ঘোরাঘুরি শুরু হল চার্চের চত্বর বেয়ে, পায়রাদের ঝাঁক পেরিয়ে ইউনিভার্সিটির মাঠের ধার ঘেঁষে ঘন সবুজ মহীরুহের পাঁচিল, সেটা টপকালেই ওপারে গম্ভীর রাইন নদী নীল আকাশের তলায় হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে রয়েছে। একজন আমাকে বলেছিল একদিন নাকি সে এমনিই ঘুরতে ঘুরতে রাইনের ধারে গিয়ে দেখে প্যান্ডেল বেঁধে বিরাট ফাংশান হচ্ছে। স্টেজে গিটার নিয়ে গান ধরেছেন বব ডিলান। বব ডিলান! সেই কথা শোনার পর থেকে মাঝে মাঝেই আমি ছুতোয়নাতায় রাইনের ধারে ঘুরতে যেতাম। দুঃখের বিষয় আমি যতবারই গেছি ততবার দেখেছি নদীতট খাঁ খাঁ, এককুচি ত্রিপলও নেই কোথাও, বব ডিলান তো দূর অস্ত। এবারও তাই হল। নদীর ধারে একজন জার্মান মনীষীর বিষণ্ণ মূর্তির নিচে বসে খানিকক্ষণ ব্যায়ামরত লোকজনকে নিরীক্ষণ করে উঠে চলে এলাম।

এইসব করে ক্ষিদে পেয়ে গেল। ব্রাটউর্স্ট খেলাম। থালিয়া নামের একটা বইয়ের দোকানের তিনতলায় ইংরিজি বই পাওয়া যায়। আগের বার কাজ শেষ করে ফেরার পথে ওই দোকানে বসে সিগ লার্সনের ‘দ্য গার্ল . . .’ ট্রিলজি শেষ করেছিলাম, নস্ট্যালজিয়ার মুখ চেয়ে সেই দোকানটাতেও একবার হানা দেওয়া গেল। একটা আইসক্রিমের দোকানেও যেতাম খুব, নস্ট্যালজিয়ার খাতিরে সেই দোকানটাতেও যাব ভেবেছিলাম কিন্তু অনেক খুঁজেও দোকানটা দেখতে পেলাম না। উঠে গেছে বোধহয়।

সাড়ে ছ’টা নাগাদ হোটেলের দিকে হাঁটা লাগাতে হল। সকলেই ডিনারের জন্য সাজবে আমি যদি নাও সাজি তবু মুখেচোখে জলের ঝাপটা দেওয়া আর সারাদিনের পরে থাকা জামাটা বদলানো উচিত। হপ্টবানহফ চত্বরে চাষিরা সবাই ভ্যানে করে যে যার তরিতরকারি এনে ছড়িয়ে বসেছিলেন সারাদিন, এখন বাকি থাকা সবজি ট্রাকে তোলার সময় শেষবারের মতো হেঁকে হেঁকে খরিদ্দার ডাকার চেষ্টা করছেন।

ডিনার করতে আমরা গেলাম জর্জস্ট্রাসে। হপ্টবানহফ থেকে বাস নিয়ে মিনিট দশ গিয়ে ডরোথিনস্ট্রাসে স্টপেজে নেমে তিন মিনিট হেঁটেন জর্জস্ট্রাসে। খাওয়া হল। কথা হল। সাউথ অ্যাফ্রিকার রাইনো পোচিং থেকে শুরু করে ইন্ডিয়ার অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ।

এই সব ডিনারগুলোর বিরুদ্ধে আমার প্রধান অভিযোগ হচ্ছে এগুলোর দৈর্ঘ্য। লোকে খাচ্ছে তো খাচ্ছেই। স্মল টক করছে তো করছেই। বেশিরভাগ সময় স্যালাডের পালা শেষ হতে না হতেই আমার হাঁফ ধরে যায় ইচ্ছে হয়, “আচ্ছা তবে আসি?” বলে হাঁটা দিইকিন্তু বুদ্ধদেব বসু এক মেরুদণ্ডহীন প্রেমিকের গল্প লিখেছিলেন – সে না পারত একা একা পার্টিতে যেতে, না পারত একা একা পার্টি ছেড়ে বেরোতে। আমারও সেই দশা। যতক্ষণ না কেউ উঠে পড়ার সাহস দেখাচ্ছে, ততক্ষণ আমারও চেয়ারে বসে থেকে সকলের কথায় দাঁত বার করে ঘাড় ঝাঁকানো ছাড়া গতি নেই।

অবশেষে একজন দু’জন করে উঠল। আমিও উঠলাম। বাইরে তখন রীতিমতো ঠাণ্ডা। সঙ্গে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এ’রকম যে হবে পূর্বাভাস ছিলআমিও সেই দেখে শিলং পাহাড়ের মাথা থেকে কেনা লালসাদাকালো নাগা শাল আর কলেজ স্ট্রিট থেকে কেনা মহেন্দ্র দত্ত-র ছাতা সুটকেসে পুরে দিল্লি থেকে নিয়ে এসেছি। নিয়ে গিয়েই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, সত্যি সত্যি ব্যবহার করার মতো এনার্জি আর নেই।

বাস যখন আমাদের বাসস্টপে নামিয়ে দিয়ে গেল তখন সাড়ে দশটা বেজে গেছে। শহরের ঝাঁপ পড়ে গেছে অনেকক্ষণফাঁকা রাস্তা ধরে বিভিন্ন উচ্চারণে ইংরিজি বলতে বলতে আর উঁচুনিচু পর্দায় রোগামোটা সুরে হাহাহিহি করতে করতে আমরা হোটেলে ফিরলাম। হোটেলের লবিতে দাঁড়িয়ে টাটাবাইবাই সেরে নেওয়া হল। কাল সবাই বাড়ি চলে যাবে। সবার আগে বেরোব আমি। ভোর ছ’টায় আসবে আমার ট্যাক্সি। আমাকে ফ্রাংকফুর্টে পৌছে দেওয়ার জন্য।

ট্যাক্সি করে ফেরার কথা অবশ্য আমার ছিল না। কথা ছিল বন থেকে আমি ট্রেন ধরে যাব ফ্রাংকফুর্ট, সেখান থেকে প্লেন ধরে ইস্তানবুল হয়ে দিল্লি। কিন্তু করবি তো কর ওই সপ্তাহেই জার্মান রেলওয়েসের কর্মচারীরা হরতাল ঘোষণা করে বসলেন। কাজেই ট্রেন চলবে কি না, বা চললেও কখন ছাড়বে ঠিক নেই।

কোনও জার্মানের ওপর যদি আপনার প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছে থাকে তাহলে বসের কাছে তার নামে লাগানোর দরকার নেই। তার থেকে ঢের সোজা একটা উপায় আছে। তাকে কিছু একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেওয়া। মানে ধরুন সে যদি আপনাকে জিজ্ঞাসা করে সিনেমাহলের সামনে ক’টায় দেখা করতে হবে আপনি তাকে “কাঁটায় কাঁটায় ছ’টা” না বলে বলবেন, “এই ধর ছ’টা নাগাদ?” কোথায় দেখা করতে হবে বললে “বড় ঘড়ির তলায়, অমুক ল্যাটিচিউড তমুক লংগিচিউড-এ” না বলে বলবেন, “ওই তো, বড় ঘড়ির কাছাকাছিই থাকব। একটু খুঁজে নিও।”

যারা ওয়ার্কশপ শুরুর একমাস আগে থেকে মেনু পাঠিয়ে আমি কত নম্বর ডিনারে কী খাবার খাব প্রশ্ন করে করে পাগল করে ফেলে, তারা যদি ট্রেনের টাইমিং অক্ষরে অক্ষরে না জানতে পারে তাহলে কী অনর্থ হয় বলাই বাহুল্য। কিন্তু আমি জার্মান নই। ট্রেনলাইনে অবরোধ, হরতাল এসব আমি জন্ম থেকে দেখে আসছি। রিটা আমাকে খবরটা দেওয়ার পর আমি মাথা পেছনে হেলিয়ে খুব স্মার্টলি হেসে যখন বললাম, আরে কাইন পোহ্‌বলেম কাইন পোহ্‌বলেম, আমি একঘণ্টা আগে বেরিয়ে গিয়ে স্টেশনে বসে থাকব না হয়, দেখি রিটা হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

হাসি থামিয়ে মনোযোগ দিলাম।

রিটা লজ্জিত মুখে জানাল, এইরকম ঘনঘন প্ল্যান বদল করাটা খুবই খারাপ ব্যাপার, কিন্তু আমি যেন জার্মানদের ক্ষমাঘেন্না করে দিই। তাছাড়া ইট উইল বি লেস গ্রিন। দ্যাট ইস অলসো আনফরচুনেট। আমার টিকিট ক্যান্সেল করে সে জায়গায় একটি ট্যাক্সির ব্যবস্থা করা হয়েছে (মহিলা চালকসহ, যাতে আমি ভয় না পাই) যেটি আমাকে ফ্রাংকফুর্টে পৌঁছে দিয়ে আসবে।

হোটেলে ঢুকে স্কাইপে অর্চিষ্মানকে পাকড়াও করে বললাম, “কী গো? বরণডালাটালা সাজিয়ে রেখেছ তো, এসে তো পড়লাম বলে।” অর্চিষ্মান চোখ ঘুরিয়ে বলল, “পচা রসিকতা না করে তাড়াতাড়ি ঘুমোতে যাও। অ্যালার্ম দিয়ে শুও যাতে ঠিক সময় ঘুম ভাঙে।”

*****

পরদিন ভোরে উঠে ব্রাশপেস্ট হাওয়াই চটি ব্যাগে পুরে জানালার পর্দা সরিয়ে দেখি ঘুটঘুটে অন্ধকার। কী ব্যাপার? টেনশনে মাঝরাতেই ঘুম ভেঙে গেছে নাকি? উঁহু, ঘড়িতে তো প’নে ছ’টাই বলছে। তারপর দেখি মেঘ। থরে থরে কালো মেঘ জমেছে বনের আকাশে। আনন্দে মন নেচে উঠল। মেঘ দেখতে দেখতে যাব সারা রাস্তা, কী মজা। রিসেপশনে এসে ঘরের কার্ড জমা দিতেই ওদিক থেকে ভদ্রলোক আমার হাতে একটা লাল কার্ডবোর্ডের বাক্স ধরিয়ে দিলেন। ট্রেনে যেতে গেলে তো আমি সকাল সাতটায় ধীরেসুস্থে ব্রেকফাস্ট করেই বেরোতে পারতাম, সেটা যেহেতু হচ্ছে না তাই রিটা হোটেলের লোককে বলে রেখেছে যেন মিস বা-আ-ন-ডি-ও-পা-ঢি-আ-য় (ডিড আই সে দ্যাট কারেক্টলি? ইয়েস, ইউ ডিড) কে এই প্যাকড লাঞ্চ দিয়ে দেওয়া হয়।

কথাবার্তা হতে হতেই গাড়ি এসে গেল। হোটেলের অটোমেটিক দরজা ফাঁক হয়ে যিনি ঢুকলেন তাঁর চেহারা ছোটখাটো, হাসিখুশি মুখে বেশ একটা ভরসা জাগানো মা মা ভাব। ইরানের লোক, কিন্তু বহুদিন ধরে বনে আছেন, বহুদিন ধরে ট্যাক্সি চালাচ্ছেন। ব্যাগপত্র সব মনে করে নিয়েছ তো? সিটবেল্ট বেঁধেছ তো? বেশি ঠাণ্ডা লাগলে বলবে এসি কমিয়ে দেব ইত্যাদি বলেটলে তিনি ট্যাক্সিতে স্টার্ট দিলেন। আমার ফিরতি যাত্রা শুরু হল।

ভোরবেলার ফাঁকা রাস্তায় মিনিট পাঁচেকের মধ্যে শহরের বাইরে বেরিয়ে এলাম, আর অমনি চার্চের ক্রুশ, বহুতল অফিসের মাথায় নিওন আলোর বিজ্ঞাপন সরে গিয়ে বিরাট আকাশ চোখের সামনে বেরিয়ে পড়ল। এখন সে আকাশের নীলের ছিটেফোঁটা দেখা যাচ্ছে না। নিচের গাছপালা মাটি নদী মাঠপাথরের ওপর আসন্ন দৈববাণীর মতো হুমড়ি খেয়ে আছে প্রকাণ্ড, কালো মেঘের দল। বৃষ্টি জমে জমে তারা এমন ভারি হয়েছে যে হাওয়ার সাধ্য নেই তাদের ঠেলে সরায়। চারদিকে একটা থমথমে ভাব। তবলা বাঁধা শেষ, মাইকের চ্যাঁচোঁ থেমে গেছে, শ্রোতাদের নড়াচড়া উশখুশ কাশি মিলিয়ে এসেছে, স্টেজের পেছন থেকে খুব মৃদু একটা ব্যাঁ –অ্যা-অ্যা-ও ব্যাঁ-অ্যা-অ্যা-ও তানপুরা শুরু হয়েছে। মাইকের সামনে চোখ বুজে, শিরদাঁড়া সোজা করে বসেছেন আমির খান। এক্ষুনি যেই না মল্লারের সা লাগাবেন অমনি মেঘেদের পেটে পেটে জমা যত বৃষ্টি সব হুড়মুড় করে নামবে। পালানোর কোনও পথই থাকবে না, গাছপালা কুকুরবেড়াল মানুষজন বিশ্বশুদ্ধু সবাই ভিজে গোবর।

সেই হুমকি মাথায় নিয়ে আমাদের ট্যাক্সি ছুটল। দু’পাশের সবুজ ক্রমে মাটি ছেড়ে আকাশের দিকে যাত্রা করল। অচিরেই দেখি একটা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলেছি। কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে কি এত ভালো রাস্তা থাকে, আর তার মাঝে মাঝে কি লালরঙের টালির ছাদ উঁকি মারে? ভাবতে ভাবতেই দেখি দূরে একটা পাহাড় আর পাহাড়ের মাথায় একটা কালো ছায়া। ঠিক মনে হচ্ছে একটা হাত বেরিয়ে আছে। Drachenfels! জার্মান দিদিমণি ফ্রাউ শার্লট এই পাহাড়ের গল্প শুনিয়েছিলেন। মাটির নিচের ফুটন্ত লাভা বেরোতে না পেরে এই পাহাড়ের জন্ম। এটা বিজ্ঞানীদের ব্যাখ্যা। যাদের এত শুষ্কং কাষ্ঠং ব্যাখ্যায় মন ভরে না তারা ধরে নেয় যে লাভাটাভা সব গাঁজাখুরি আসলে পাহাড়ের তলায় একটা ড্রাগন চাপা পড়ে আছে। আর ওই যে ছায়াটা সেটা হচ্ছে ড্রাগনের হাত। যেন হাত বের করে ড্রাগন বলতে চাইছে, কেউ আমাকে টেনে তুলুন, প্লিজ।

কাছে গেলে অবশ্য বোঝা যাবে ওটা ড্রাগনের হাত নয়, ওটা একটা ভাঙাচোরা কেল্লা। এগারোশো আটত্রিশ থেকে এগারোশো সাতষট্টি সালের মধ্যে এই কেল্লাটা বানিয়েছিলেন কোলোনের আর্চবিশপ। টঙে বসে আশেপাশের গোটা জায়গাটার ওপর নজর রাখবেন বলে। আর্চবিশপ আর নেই, কেল্লাও প্রায় যায় যায়, কিন্তু আশেপাশের জায়গা দিব্যি ফুলেফলে বেঁচেবর্তে আছে। বিশপের পাহারা ছাড়াই।

Drachenfels দেখা যেতেই জায়গাটাকেও চিনে ফেললাম। Königswinter। আগেরবার একটা ট্রেনিং-এর জন্য এই জঙ্গলের মধ্যে এসে থাকতে হয়েছিল খেপে খেপে ন’দিন। এত সবুজ জায়গা আমি আমার জীবনে আর দেখিনি। ছোট ছোট রাস্তার পাশে ছোট ছোট বসতি পেরিয়ে আমরা চললাম। ছবির মতো লাল রঙের ঢালু ছাদওয়ালা সাদা রঙের বাড়ি। এসব বাড়িতে যারা থাকে তাদেরও ঝগড়াঝাঁটি হয়? তারাও একে অপরের ওপর রাগ করে মুখ গোমড়া করে থাকে? বিশ্বাস হয় না আমার। এ যেন চিরশান্তির দেশ। ঝগড়াঝাঁটি, হর্ন, ঘাম, ধুলোধোঁয়ার নাগালের বাইরে। ভাবলাম বাড়ি গিয়ে অর্চিষ্মানকে বলব, চল আমরা Königswinter-এ গিয়ে থাকি। বলেওছিলাম। অর্চিষ্মান শুনে বলল, থাকাই যায়, তবে সাতদিন ভালো লাগবে। তারপর বাঁচাও বাঁচাও বলে শহরে ফিরে আসতে হবে। ধুলোধোঁয়া, জ্যাম, টেনশন, হেনস্থা আর ঝগড়াঝাঁটির মধ্যিখানে। ও সব ছাড়া বাঁচা খুব শক্ত। যাদের প্র্যাকটিস নেই তারা পারবে না।  

*****

ইস্তানবুল দেখার শখ আমার বহুদিনের। ঐতিহাসিক আর অবস্থানগত বৈশিষ্ট্যর জন্য তো বটেই, তাছাড়া ইয়াশিম গোয়েন্দার কীর্তিকলাপ জানার পর ওটোমানদের খাসতালুক এই শহরটির প্রতি আমার বিশেষ অনুরাগ জন্মেছে। এবার আসাযাওয়ার পথে ইস্তানবুল পড়বে শুনে তাই আমার খুব আহ্লাদ হয়েছিল। শহরের বদলে না হয় এয়ারপোর্টই দেখা হল, তবু তো হল। যাওয়ার সময় প্লেন লেটটেট হয়ে সে এয়ারপোর্টের স্বাদ ভালো করে আস্বাদন করা হয়নি, ফেরার সময় ঘণ্টা তিনেকের অপেক্ষায় সে আক্ষেপ মিটে গেল।

প্লেনে উঠে দেখি সোনায় সোহাগা। জানালা খালি না পাওয়ায় আইল সিট বুক করেছিলাম, যিনি জানালার সিট পেয়েছেন তিনি আমার সঙ্গে সিট বদলাবদলি করতে চান। যেচে জানালার সিট ছেড়ে দিতে চাওয়াটা আমার অবিশ্বাস্য মনে হল। মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, “হোয়াই?” উত্তরে ভদ্রলোক নিজের মধ্যপ্রদেশের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, “লার্জ।’

অর্থাৎ কি না, জানালার পাশের ঘুপচিতে ঢুকতে গেলে তাঁর লার্জ ভুঁড়ি আটকে যেতে পারে কাজেই তিনি সে ঝুঁকি নিতে চান না।

ভদ্রলোককে আমার পছন্দ হয়ে গেল। আলাপ বাড়ানোর ইচ্ছে ছিল কিন্তু ভদ্রলোক নিজের মাতৃভাষা ফরাসি ছাড়া আর কিছুই জানেন না। ভদ্রলোকও আমার সঙ্গে আলাপ করতে চাইছিলেন মনে হল, একের পর এক ফরাসি শব্দ বলে জানতে চাইছিলেন আমি সেগুলো জানি কি না। “এটাও জানো না? এটাও না? সে কী এটাও জানো না?” শেষটা আমি তাড়াতাড়ি বললাম, “আমি শুধু জানি বোঁজু, মেহসি আর পার্দোঁ। ওহ আর প্যারিসের মেট্রো স্টেশনে তীরচিহ্ন দিয়ে ‘সর্তি’ লেখা থাকে দেখেছি, ওটাও জানি ধরে নিতে পারেন।” ভদ্রলোক দুঃখিত হয়ে চুপ করে গেলেন।

প্লেন ছেড়ে দিল। সন্ধ্যের আলোয় ইস্তানবুল ঝকঝক করছে। কত আলো। একটা জ্যামে ঠাসাঠাসি চওড়া রাস্তাকে ওপর থেকে ঠিক জড়োয়া হারের মতো দেখতে লাগছে। এ কী, এখনই পানীয় দিতে শুরু করেছে দেখছি। গুড, একটু ক্ষিদে ক্ষিদে পাচ্ছে। ওয়াটার প্লিজ। নো, নাথিং এলস। আমার পাশের ভদ্রলোককে পরিবেশক ঠ্যালাগাড়ি থেকে শিশিবোতল তুলে তুলে দেখাচ্ছেন। ভদ্রলোক সবেতেই সম্মতি জানাচ্ছেন মনে হচ্ছে। আমি জলে চুমুক দিতে দিতে জানালায় নাক ঠেকিয়ে ইস্তানবুল দেখতে লাগলাম।

এমন সময় হঠাৎ খোঁচা। ভদ্রলোক তাঁর তিনটের মধ্যে একটা ওয়াইন গ্লাসের কানা দিয়ে খোঁচা মেরে আমার মনোযোগ টানার চেষ্টা করছেন। আমি তাকাতেই একগাল হেসে গ্লাস উঁচিয়ে ধরে বললেন, “সন্তি”। আমি আমার জলের গ্লাসটা তুলে নিয়ে ওঁর গ্লাসের সঙ্গে ঠেকিয়ে বললাম, “উল্লাস”তুলোর মতো মেঘের তলায় ইস্তানবুল মিলিয়ে গেল। 


Comments

  1. Ki sundor Leela Majumdar, Leela Majumdar lekha hoyechhe! :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. কবে যে রবীন্দ্রনাথের মতো হবে। যাই হোক, আপাতত লীলা মজুমদারেই সন্তুষ্ট থাকছি। থ্যাংক ইউ, বিম্ববতী।

      Delete
    2. Ei uttor ta pore khub haslam.

      Delete
  2. Erokom forashi bolar shujog peyeo "hyaddehowa"-ta bolley na??!! Dhuss! Beroshik!

    ReplyDelete
    Replies
    1. সেই, মনে ছিল না। না হলে বসে আসতাম, সোমনাথ।

      Delete
  3. Chobi neyi keno? :-(
    Tobey darun laglo pore ... jongol diye jawar bornona ta pore e mone holo chobi lagbe na.

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে এবার বেশি ছবি তোলা হয়নি, শর্মিলা। লেখাটা তোমার ভালো লেগেছে জেনে খুব খুশি হলাম। থ্যাংক ইউ।

      Delete
    2. ্"ইস্তানবুল দেখার শখ আমার বহুদিনের" আমারও । ঝঝরে লেখা তরতর করে শেষ করে ফেললাম
      মিঠু

      Delete
    3. ঝরঝরে লেখা হবে। উফ

      Delete
    4. ধন্যবাদ, মিঠু।

      Delete
  4. Ekta Tax document porchhilam. Setar modhey khane eta pore je ki darun laglo! Choto, choto sada bari, dhalu lal chaad. Chhotobelai a(n)ka chhobir sohor ei prithibite achhey?

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওরে বাবা, ট্যাক্সের কথা আর মনে করিও না, রুণা। আমারও ফর্ম সিক্সটিন এসে পড়ে আছে, নিয়ে বসতে হবে। যত ঝামেলা।

      ছোটবেলায় পড়া গল্পের মতো বাড়িই তো দেখে এলাম। সেই থেকে ওই রকম বাড়িতে থাকার ইচ্ছে হচ্ছে।

      Delete
  5. eki kono chobi nei keno Kuntala di? tumi travelogue lekhay super expert.. :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. এবারে ক্যামেরাটা ঠিক করে উশুল করতে পারিনি রে, ঊর্মি। খানিকটা সময়ের অভাব, খানিকটা আমার গাফিলতি। পরের বার বেশি করে ছবি তুলে আনব।

      Delete
  6. Khub sundor lekha... Archisman er janye chocolates anis ? Khub moja toh or !!! Keu baire gele oi chocolates gulor janye amio bose thaki khub... Lekha ta khub sundor... Kintu oto sundor chobir moto jaiga tar photo tule rakhisni ? Chotto sada bari , dhalu lal chad.. Sotti emon poribese thakle jhogra korte mon chaibe na. Ar ultimately flight a bhodrolok er bhurir jonye tor labh e holo bol? ;)

    ReplyDelete
    Replies
    1. লাভ বলে লাভ, ভট্টা? সারা রাস্তা জানালার ধারে বসে চলে এলাম। আমার সঙ্গে বিয়ে হয়ে ওর যে কত উপকার হয়েছে সে কথা অর্চিষ্মানকে তো আমি সকালবিকেল মনে করাই।

      Delete
  7. আকাশ থেকে জড়োয়ার হার নিচে এলেই কাঁচকলা। ছ ঘন্টার ছলাত ছলাত তবু ফেরার পথে উন্মনা।

    ReplyDelete
    Replies
    1. বাঃ, আপনি তো দারুণ কবিতা লেখেন, শুভাশিস। এটা আমার আর এ জন্মে হল না।

      Delete
    2. হা হা। একটু ফুললাম। আপনার লেখাটা পড়ে এটাই মনে এসেছিল যে বলার জন্য। আর আপনার কবিতা লেখা নিয়ে আপনার বিনয় আপাতত মনে রাখলাম পরে বিস্তার করার জন্য। যাই হোক। কবিতাই যদি এল তাহলে বলি সমস্ত ব্লগারকে মনে রেখে আমি নিচের নৈবেদ্য রেখেছি। সময় পেলে পড়ার অনুরোধ জানালাম।
      http://icchemotolikhi.blogspot.in/2015/05/for-blogger-to-blogger.html

      Delete
  8. কাইন পোহ্‌বলেম - শুনে মনটা ফ্রেশ থুরি ফেরেশ হয়ে গেল। আমি আবার আমার আগের কোম্পানির দু লক্ষ টাকা খসিয়ে, গোটা চল্লিশ সুইস জার্মান শব্দ শিখেছিলাম কিনা, মানে এক একটি শব্দ পাঁচশো টাকা, তাই বুঝে শুনে খরচা করি।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমি আবার চান্স পেলেই জার্মান বলি, অনির্বাণ। জার্মানিতে নয়, বাড়িতে। থ্যাংক ইউ-র জায়গায় বলি ডাংকে, এক্সকিউজ মি-র জায়গায় বলি এন্টশুলডিগং, রবিবার সকালে চা খেতে খেতে অর্চিষ্মানকে বলি, রসরাজ থেকে কচুরি আর কার্টোফেলের চচ্চড়ি নিয়ে এস না গো।

      Delete
    2. হেহে :) ভালো। আম্মো তাই করতাম। মানে যেখানে পারতাম চল্লিশটা শব্দের একটা ঢুকিয়ে দিতাম।

      কিন্তু একবার সুইজারল্যান্ডে একটা বাঙ্গালী বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে গেছি। বাড়ির পাঁচ বছর বয়েসি বাচ্চা ছেলে দৌড়ে এসে আমায় উত্তেজিত হয়ে জার্মানে কিছু বলল। মানে সহজ কথা হলে বাংলাতেই বলত, কিন্তু কিছু একটা জরুরী ব্যাপার তাই সে জার্মান, মানে যে ভাষায় সব চেয়ে দক্ষ, তাতে কথা বলছে। আমার বিদ্যে কিন্তু ওই এনশুলডিগং, লেদিগ এসবেই সীমাবদ্ধ।

      পরে জেনেছিলাম, যে সেদিন আইকিয়ায় বাচ্চাটির পায়ের করে আঙ্গুলের ওপর দিয়ে অন্য কোন ক্রেতা ট্রলি নিয়ে চলে গেছেন, তাতে সে কষ্ট পেয়েছে। এবং সেইটেই আমায় সে বোঝাচ্ছিল। জার্মানে কড়ে আঙ্গুলটা খড়দার বাঙ্গালী ধরতে পারে নি।

      তারপর থেকে হাফ জার্মানে কথা বলার বিলাসিতা ছেড়ে দিয়েছি।

      Delete
  9. Ki bhalo lekha! Ektana pore fellam office-e dhukei :) Monta torrrr hoye gelo ekebare :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ, সায়ন। আপনার কমেন্ট পড়ে আমারও একই দশা।

      Delete
  10. সত্যি সত্যি মন ভালো করে দেওয়া লেখা|

    ReplyDelete
    Replies
    1. বলছ, অপরাজিতা? যাক, বাঁচা গেল। থ্যাংক ইউ।

      Delete
  11. এটা বোধহয় সেই মে মাসের বনবাস? নাকি আবার ঘুরে এলেন? বলাই বাহুল্য, পড়ে খুবই ভালো লাগলো, আপনার সাথে আপনার পাঠকেরাও বন চিনে ফেলেছে অনেকটাই।

    ReplyDelete
    Replies
    1. না না, আবার যাইনি। এটা সেই আগের মাসের শেষাংশটুকু, দেবাশিস। ভালো লেগেছে জেনে খুশি হলাম।

      Delete
  12. খুব, খুব ভালো লাগলো লেখাটা। আপনার বর্ণনা পড়ে সব যেন চোখের সামনে দেখতে পাই। এই কালকেই পড়ছিলাম লা গার্ডিয়া এয়ারপোর্টে প্লেন লেট করছিল ছঘন্টা। যাত্রীদের মধ্যে আলাদিন আর লায়ন কিং ব্রডওয়ে শোয়ের অভিনেতারা ছিলেন, তাঁরা হঠাত এয়ারপোর্ট শুদ্ধ লোককে গান করে শুনিয়েছেন। আপনার ওই বব ডিলানের গল্পটা পড়েও সেরকম লাগলো। সত্যি, মানুষের ভাগ্য থাকে বটে!

    আপনার গুনে গুনে ফ্রেঞ্চ শব্দ বলার গল্পটা শুনে এইটা মনে পড়ে গেল।

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, দারুণ মজার পোস্ট, সুগত। লিংক দেওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। খুব ভালো লাগল পড়ে।

      Delete
  13. truffle tao niye nilei parte.. Bhaloi lagto..rastar description ta anabadya...r erom bhuriwala lok thakle rastay bhari subidhe....janala na paoya gele plane e amar o bhari dukkho hoy...

    Tobe tumi apatato amake bipode felechho.. Tomar lekha pore ekhon amar ma baba dujone amar matha kheye jachhey bohudiner na lekha blog take abar suru korte...

    ReplyDelete
    Replies
    1. শুরু কর, শুরু কর, চুপকথা। আমিও পড়ব বলে এই লাইন দিয়ে থাকলাম।

      Delete
  14. aha chomotkar, chokh buje bon shohorTa dekhe fellam :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, প্রদীপ্তা।

      Delete
  15. khub bhalo lijhechho Kuntala :) - Bratati.

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ, ব্রততী।

      Delete
  16. দারুণ লেখা! সন্তি কুন্তলা। :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, সন্তি, অরিজিত।

      Delete

Post a Comment