আমোর




দুঃখের যদি কোনও স্কেল থেকে থাকে তাহলে তার টঙের দিকে থাকবে ভিসা না পাওয়ার দুঃখ। ভাবুন একবার, সবাইকে খবর দেওয়া সারা, সেরকম কাছাখোলা হলে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘোষণাও হয়তো করে ফেলেছেন, না হলে ঘোষণার পাঞ্চলাইন ভেবে রেখেছেন। আত্মীয়স্বজনকে খবর দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন মাবাবা। মাস্ট ডু, মাস্ট সি, মাস্ট ইট, মাস্ট বাই লিস্টে বুকমার্কে কম্পিউটার টইটম্বুর। আর তখন আপনি খবর পেলেন যে ভিসা আপনি পাবেন না। প্রথমে একটা শকের মতো লাগবে। এ রকম ঘটতে পারে? ঘটছে? আমার সঙ্গে? তারপর প্ল্যান বি-র জন্য ফ্র্যানটিক হাতড়ানি। কী করবেন? জাত্যাভিমান চুলোয় দিয়ে অফিসারের পায়ে ধরবেন? কেঁদে ফেলবেন? বলবেন, আপনার মানমর্যাদা, সুখশান্তি, আপনার মায়ের রাতের ঘুম, পাড়ায় বাবার প্রতিষ্ঠা, সব সব মাটি হয়ে যাবে এই ট্রিপটা না হলে? তাতে চিঁড়ে ভিজবে না। তখন হবে রাগ। মাথা জ্বলে যাবে। এমন সব কথা আপনার মাথায় আসতে থাকবে, যা আপনার প্রগতিশীল সত্তার সঙ্গে একটুও খাপ খায় না। হু কেয়ারস। ব্যাটা লালমুখো। শিক্ষা নেই, কালচার নেই, ইতিহাস নেই, উদ্বাস্তুর জাত, শুধু আছে পয়সা। ইয়াংকি কোথাকার।

সে রাগও একসময় পড়ে যাবে। তখন শুধু ভিসাহীন আপনি আর আপনার সামনে ডাইনে বাঁয়ে বিস্তৃত শান্তিপথ। পথের দুপাশে অমলতাসের বনে হলুদ ফুল ধরেছে, তকতকে নির্জন রাস্তায় একটা কুড়কুড়ের ছেঁড়া প্যাকেট ঠোক্কর খেতে খেতে উড়ছে।

এই জায়গায় পৌঁছে অর্চিষ্মান ভয়ে ভয়ে সহকর্মীকে জিজ্ঞাসা করেছিল, “ফির কেয়া কিয়া?” সহকর্মী বলেছিলেন, “ফির কেয়া। আমোর বিস্ত্রো চলি গয়ি। অ্যান্ড গট ওভার ইট।”

অর্চিষ্মান চ্যাটবাক্সে বলল, “বুঝলে এবার আমোর না কী একটা আছে সেখানে যেতে হবে।”

কিছুদিন দুঃখের অপেক্ষায় থাকলাম। আমোর-এ যাওয়ার একটা ছুতো তো চাই। দুঃখ এল না। জানতাম। যখন পথ চেয়ে বসে আছি তখন তার দেখা নেই। অসতর্ক মুহূর্তে এসে মাথায় হাতুড়ি মেরে বলবে, ‘সারপ্রাইজ!’ অপেক্ষা করে করে অধৈর্য হয়ে আমরা বিনাদুঃখেই আমোরে চলে গেলাম এক সন্ধ্যেবেলা।


দিল্লির যে জায়গাটায় ধুলো নেই, ভিখিরি নেই, চওড়া ঝকঝকে রাস্তার মুখে সবুজ বোর্ডে সাদা রং দিয়ে হিন্দি আর উর্দুতে লেখা নামগুলো কায়দা করে ফ্রেমের বাইরে রেখে ছবি তুলতে পারলে যে জায়গাটাকে দিব্যি ফরেন বলে চালিয়ে দেওয়া যায়, আমোর বিস্ত্রো সেইখানে। চারদিকে অভিবাসীদের বাস। তারা সকার প্র্যাকটিস শেষ হলে এস ইউ ভি চেপে মায়ের সঙ্গে আমোরে আসে। এসে একেকজনে একেকটা গোটা গোটা পিৎজা সাবাড় করে ফেলে। দেওয়ালের জোরালো এসির হাওয়ায় ঘেমো টি শার্ট শুকিয়ে ফ্যাকাসে গা থেকে অবশেষে আলগা হয়ে যায়। আরেকদিন ভারতীয় হকি দলের ক্যাপ্টেন সর্দার সিং-কে দেখেছিলাম। বোঝা যাচ্ছিল আমোর-এ তিনি নিয়মিত খদ্দের। খাওয়া শেষ হলে দোকানের ম্যানেজার আর টেবিলের ভারপ্রাপ্ত একাধিক ওয়েটার টেবিলের কাছে গিয়ে সারি বেঁধে দাঁড়ালেন। আমরা কথা শুনতে পাচ্ছিলাম না, কিন্তু দোকানের পক্ষের সবাইকে শিউরে উঠে জিভ কেটে কানের লতি ছুঁতে দেখে বুঝলাম বিলের কথা উঠেছে। সর্দার সিং “কেয়া ইয়ার” ভঙ্গি করে রুপোলি বালা পরা দুই হাত বাতাসে ঘোরালেন। সোফা ছেড়ে উঠে জিনসের পেছনের পকেট থেকে মোটা এক তাড়া নোট বার করে সবথেকে কাছাকাছি দাঁড়ানো ওয়েটারের পকেটে গুঁজে দিয়ে সঙ্গীসাথীদের নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।


আমি আর অর্চিষ্মান লজ্জাটজ্জা ভুলে হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম। কী বডি! কংকালের কাঠামোর ওপর শুধু পেশী। তাও যেখানে যতটুকু থাকার কথা। জিমে গিয়ে মাসলের পাহাড় বানানো সিনেমার হিরোগুলোর লজ্জা পাওয়া উচিত।

সর্দার সিং-এর স্বাস্থ্যের মতোই ভালো আমোর-এর খাবার। কন্টিনেন্টাল, ইট্যালিয়ান, মেডিটেরেনিয়ান খাবারের দোকান আমোর। (হজ খাসে এদেরই আরেকটা ক্যাফে অ্যান্ড বার রেস্টোর‍্যান্ট আছে। ) প্রথম দিন অর্চিষ্মান খেয়েছিল স্টেক। আমি কী খেয়েছিলাম ভুলে গেছি। কিন্তু চামচ মুখে পুরে আনন্দে মাথা নেড়েছিলাম মনে আছে।  দ্বিতীয় দিন আমরা দুজনেই নিয়েছিলাম পিৎজা, আর কী একটা যেন স্টার্টার। আমরা সাধারণত দোকানে খেতে গিয়ে পিৎজা অর্ডার করি না। পিৎজা হচ্ছে আমাদের বাড়িতে রান্না/ রান্নার ইচ্ছে না থাকলে, মনে অপরাধবোধ চেপে রেখে সস্তার হোম ডেলিভারি। সেগুলো খিদের মুখে আর গরম থাকতে থাকতে দারুণ লাগে, কিন্তু লাস্ট ত্রিকোণে পৌছতে পৌঁছতে যখন পেট ভরে যায় আর পিৎজাও ঠাণ্ডা হয়ে যায়, তখন 'তুমি খাও তুমি খাও' বলে ঠেলাঠেলি করতে হয়। এবং সে ঠেলাঠেলির সঙ্গে সৌজন্যের কোনও সম্পর্ক নেই। আমোর-এর উডফায়ার আভেনের পিৎজার সুখ্যাতি শুনে অর্ডার করেছিলাম। ঠকিনি।

গত ক’মাসের খরার পর তাই যখন কোথাও খাওয়ার কথা উঠল তখন আমোর-এর নামটাই একসঙ্গে দুজনের মাথাতে এল। চলে গেলাম সকাল সকাল। গরম এড়ানোও হল, আর আমোর-এর ব্রেকফাস্টও প্রথমবারের জন্য চাখা হল।

কাল সকালটা খুব সুন্দর ছিল, রোদ ওঠেনি, আর অটোর জানালা দিয়ে ফুরফুরে হাওয়া এসে গায়ে লাগছিল। কিন্তু আমি সে সবে মনোযোগ দিতে পারছিলাম না। দোষটা আমারই। 'দোকানে গিয়ে তো খাবই' ভেবে চা না খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম। সময় যত পেরোচ্ছিল, মনে হচ্ছিল আমার মাথার ভেতর থেকে রক্তমাংসঘিলু বার করে নিয়ে কে যেন গলানো লোহা ঢেলে দিচ্ছে।


এখন ক্যামেরার দিকে তাকানোর সময় নেই।


নাও, এবার কত পোজ দিতে হবে দিচ্ছি।


আমরা নিলাম ফ্রিটাটিনা অর্থাৎ ছোটো সাইজের ফ্রিটাটা (বেসিক্যালি জিনিসপত্র দেওয়া ওমলেট)। মাশরুম আর অলিভ দেওয়া। সঙ্গে কমপ্লিমেন্টারি ফ্রেঞ্চ পাউরুটি, হ্যাশ ব্রাউন আর সেঁকা টমেটো। আর পাছে প্রোটিন কম পড়ে তাই বেকন হ্যাম সহযোগে কার্নিভোরাস প্ল্যাটার। এই প্ল্যাটারের সঙ্গে এল রুটি, হ্যাশ ব্রাউন, টমেটো, আমাদের পছন্দ মতো সানি সাইড আপ, এক্সট্রা রসুনগন্ধী অলিভ অয়েলে নাড়াচাড়া করা পুষ্ট মাশরুম আর বেকড বিনের ছোট্ট বাটি।


খাওয়া শেষ করে আমি আরেককাপ চা নিলাম। অর্চিষ্মানের প্রথম কাপ তখনও চলছে। আমাদের দুজনেরই পেট ভদ্রস্থ রকম ভরেছিল, কিন্তু সেটাকে আইঢাই স্টেজে নিয়ে যেতে না পারলে মজা নেই। ভাবছিলাম আর কিছু অর্ডার দেব কি না, এমন সময় ভদ্রলোক এসে সুখবর দিলেন। কার্নিভোরাস প্ল্যাটারের সঙ্গে এক টুকরো কেকও নাকি আমাদের প্রাপ্য।

লাল নীল সবুজ মোরব্বার টুকরো গাঁথা নরম গরম কেকের সঙ্গে চা খেতে খেতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতে দিব্যি লাগছিল। ধোপা এসে কাচা সোনালি রঙের ন্যাপকিনের বান্ডিল ফেরৎ দিয়ে নোংরা ন্যাপকিন গুনে বান্ডিল বেঁধে নিয়ে গেলেন। কাছেই বোধহয় মাদার ডেয়ারি আছে, দু’চারজন লোক চকচকে স্টিলের ক্যান হাতে দুলিয়ে গেল দেখলাম। তারপরই হঠাৎ এক ধাক্কায় মেঘটা সরে গিয়ে সূর্য ঝলমল করে উঠল। আমরা বিল মিটিয়ে প্রাণ নিয়ে বাড়ি পালালাম।


Comments

  1. Sokal bela ghum bhenge eta ii porlam. 😊😊😊😊.
    Bdw kalke tomar post kora bristi r gan ta Sunlam....kodin dhore janan dischilo kal bhir rat theke ekdom ajhore bristi hochche.... borsakal ese gelo mone hoe.

    ReplyDelete
    Replies
    1. বৃষ্টির খবর মার কাছ থেকে পেলাম, প্রিয়াঙ্কা। ফোনের মধ্য দিয়ে আওয়াজ পর্যন্ত কানে আসছিল। বাকিটুকু কল্পনা করে নিতে হল। এত খারাপ লাগে, ওইরকম বৃষ্টি কতদিইইইইন দেখিনি। দেখবও না। কিন্তু তা বলে হিংসে করছি না, তোমরা জানালার ধারে বসে খুব আনন্দ কর।

      Delete
    2. Your wish has been granted! :D Y'day it rained in Delhi!

      Delete
    3. হাহা, যা বলেছ, রণদীপ। কাল রাতে কত যুগ পরে যে জানালা খুলে বাইরের হাওয়া খেলাম...

      Delete
  2. Khub bhalo post mon bhalo kora.
    Aj sara sakal ajhore bristi porchhe :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ, সেরকমই খবর পেলাম, সায়ন। রেনি ডে নিলেন নাকি?

      Delete
  3. হাঁ গো, তোমাদের মনে এট্টুসখানিকও দয়ামায়া নি?? একে কিনা ডায়েট খাবার খেতে খেতে রোগা হয়ে যাচ্ছি, সেই কবে থেকে পিজা খাবার জন্য প্রাণ আনচান করছে, কিন্ত বাড়ির লোক,বন্ধুবান্ধব সবাই মিলে ভেটো প্রয়োগ করছে, তার মধ্যে এসব ছবি আর লেখাপত্তর দিতে হয়!! রাগে দুঃখে খিচুড়িটা অব্দি খেতে পারলাম না মন দিয়ে! দূর! এবার জোম্যাটোটা ফেলেই দেবো ফোন থেকে। একটা যদি কাজের কাজ করতে পারে!!

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা শাল্মলী, বৃষ্টির দিনে খিচুড়ি খেতে খেতে পিৎযার জন্য হাহাকার? ইত্যালিয়ানরাও হাসবে। আমাকে যদি কেউ রোজ বৃষ্টি নামিয়ে খিচুড়ি খাওয়ানোর গ্যারান্টি দেয়, আমি সারাজীবন পিৎজার মুখে দেখা ছেড়ে দিতে রাজি আছি।

      Delete
    2. এ খিচুড়ি সে খিচুড়ি নয়কো! এ হইল ডালিয়া নামক একটি অখাদ্য বস্তর খিচুড়ি, যা কিনা আমায় খেতে হয়।

      Delete
    3. ও আচ্ছা। হেলদি খিচুড়ি।

      Delete
  4. English b'fast onekdin khete jawa hoyeni. Khub bhalo laglo jene je tomra abar baire khete jete parcho.

    ReplyDelete
    Replies
    1. টুকটাক যাচ্ছি, শর্মিলা। যাকে বলে টেস্টিং দ্য ওয়াটারস। আমার ইংরিজি ব্রেকফাস্ট ভালোই লাগে, কেবল ওই বেকড রাজমাটা বাদে। সকালবেলায় ডিম পাউরুটির সঙ্গে চামচে করে ডাল খাওয়া খুবই অদ্ভুত।

      Delete
  5. khub bhalo je abar baire khete jaoa jachhe... chhobi to darun , khabar o darun chhilo bojhai jachhe..

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, ইচ্ছাডানা।

      Delete
  6. নরম গরম কেকের সঙ্গে চা--darun lage na khete?...kake are cha..darun.
    enzoy enzoy..
    prosenjit

    ReplyDelete
    Replies
    1. এটা আমারও খুব ভালোলাগার কম্বো, প্রসেনজিৎ। হাই ফাইভ।

      Delete
  7. এটা আমার বাড়ির খুব কাছে । মালচা মার্কেট । ফুজিয়াতে একবার খেয়ে দেখতে পারো
    মিঠূ

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমরা প্রত্যেক বার আমোর-এ গিয়ে ফুজিয়াতে খাওয়ার প্ল্যান করি, মিঠু। আজ সকালেও ইন ফ্যাক্ট ফুজিয়ার আলোচনা হচ্ছিল। এবার যাবই। থ্যাংক ইউ।

      Delete

Post a Comment