সম্বল



গত রবিবার সন্ধ্যেবেলা দোসা খেয়ে, এক হাতে ফ্রাইং প্যান আর অন্য হাতে বাঁধাইয়ের দোকান থেকে খবরের কাগজে মোড়া দু’খানা মধুবনী পেন্টিং (এখান থেকে কেনা) দোলাতে দোলাতে যখন বাড়ির দিকে ফিরছি, তখন আকাশ জুড়ে থালার মতো চাঁদের চারপাশে ঘন লাল মেঘের বৃত্ত দেখেই বুঝেছিলাম যে বৃষ্টি হবে।

অ্যাকচুয়ালি বুঝেছিলাম তারও আগে। ফ্রাইং প্যান কেনা আর ছবি বাঁধাতে দেওয়ার মাঝখানে যখন চশমার দোকানে ঢুকেছিলাম তখনই। যতক্ষণ হাঁটছিলাম ততক্ষণ কিছু টের পাচ্ছিলাম না। মানে স্বাভাবিক গরম লাগছিল। দরজা ঠেলে এসির ভেতর ঢুকলাম আর শরীরের সমস্ত রোমকূপ থেকে বর্ষার মতো ঘাম ঝরতে শুরু করল। আর অমনি আমার মায়ের কথা মনে পড়ে গেল। ঠিক মায়ের কথা নয়, মায়ের ব্যারোমিটারের কথা। 

মা বলেন ওঁর শরীরের মধ্যে নাকি একটা ব্যারোমিটার বসানো আছে। প্রথম কবে বলেছিলেন সেটাও মনে আছে। হাওড়া স্টেশনের সাবওয়ের টিউবলাইট জ্বালা টিমটিমে, স্যাঁতসেঁতে, ভ্যাপসা গর্তটায় সিঁড়ি দিয়ে নামছি, মা মেয়ে দুজনে পাল্লা দিয়ে ঘামছি। আমি যথারীতি রুমাল আনতে ভুলে গেছি। মা নিজের ব্যাগ থেকে একটা এক্সট্রা রুমাল বার করে আমার হাতে গুঁজে দিতে দিতে বলছেন, আজ বৃষ্টি হবে সোনা। ব্যারোমিটার বলছে। ঘোর নিম্নচাপ।  

সেই থেকে মায়ের ব্যারোমিটার বিরাজ করছে আমাদের জীবনে। আমাদের মানে আমার আর মায়ের। এ ব্যারোমিটারের পূর্বাভাস আবহাওয়া কোম্পানির মতো ভুলভাল নয়। আজ পর্যন্ত কোনওদিন এ ব্যারোমিটার ফেল করেনি। কেউ যখন বলছে না বৃষ্টি হবে, মায়ের ব্যারোমিটার একা হাতে বৃষ্টি নামিয়েছে, সবাই যখন নিশ্চিত এ বছর মা দুর্গা নৌকো চেপে আসছেন যখন বন্যা কেউ আটকাতে পারবে না, মায়ের ব্যারোমিটার ঠোঁট টিপে মাথা নেড়েছে, আকাশ থেকে একটি ফোঁটাও ঝরেনি।

যাই হোক, চশমার দোকানে ঢুকে আমি এমন ঘামতে শুরু করলাম যে অর্চিষ্মানকে পকেট থেকে রুমাল বার করে দিতে হল। ঘাম মুছতে মুছতে বললাম, নির্ঘাত বৃষ্টি হবে। ঘোর নিম্নচাপ।

তারপর সোমবার দুপুরবেলা যখন সিটের পেছনের জানালায় মেঘের ছায়া ঘনিয়ে এল, বাইরের চাতালে রাখা সিমেন্টের বড় বড় টবে পোঁতা পামগাছগুলো জোরে জোরে মাথা নাড়তে লাগল, অফিসের সবাই যে যার সিট ছেড়ে উঠে হাতের কাছের জানালার সামনে ভিড় করে দাঁড়াল আর সবার চোখের সামনে অদৃশ্য জুবিন মেহতার হাতের দুলুনিতে হঠাৎ ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল, তখন আমার ভীষণ, ভীষণ গর্ব হল। অবশেষে মায়ের মতো একটা ব্যারোমিটারের মালিক হতে পেরে। 

গর্বের ভাবটা অবশ্য কেটে গেল একটু পরেই, তার জায়গায় এসে গেল একগাদা দুঃখ। এমন সুন্দর আকাশমাটি এক করা বৃষ্টি অথচ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দেখার উপায় নেই, কম্পিউটারের স্ক্রিন থেকে আধাখ্যাঁচড়া রিপোর্ট কটমট করে তাকিয়ে আছে। সিটে ফিরে এসে টাইপ করতে শুরু করলাম। প্রতিশোধ হিসেবে রিপোর্টে একের চার মন রাখলাম, তিনের চার মন বৃষ্টিকে দিয়ে দিলাম। সে স্ক্রিনে ছায়া ফেলা মেঘের দিকে তাকিয়ে রইল আর ভাবতে লাগল, যদি নিজেই নিজের মালিক হত তাহলে এমন একটা দিন নিয়ে কী কী করত।

১। সকালে উঠে ডিসিশন নিত, আজ রেনি ডে। অফিস ছুটি।

২। জানালা খুলে দিত হাট করে, পর্দা সরিয়ে দিত। কোণাকুণি বাড়িটার তিনতলার বারান্দা থেকে চোখ বাঁদিকে ফেরালেই এই ঘরটা সোজা দেখা যায়, কিন্তু তাতে একটুও ঘাবড়াত না। চুলোয় যাক প্রাইভেসি। তাছাড়া যে নিজের মনে থাকে তার থেকে যে চুরি করে দেখে লজ্জার অংশটা তারই বেশি। অ্যাকচুয়ালি, পুরো লজ্জাই তার।

৩। ভাবত আদা দিয়ে চা খেলে কেমন হয়। যদিও সেটা বাস্তব হত না, কারণ বাইরের প্রকৃতি বদলেছে, ভেতরেরটা তো রয়ে গেছে যে কে সেই। যখন মালাইকারি খেতে ইচ্ছে করছে তখন নারকেলের দুধ নেই, যখন আদা দিয়ে চা খাওয়ার আদর্শ পরিস্থিতি তখন আদা নেই। গত একমাস ধরে ফ্রিজের নিচে গড়াগড়ি খাওয়া আড়াই ইঞ্চি আদা ফেলে দিল এই পরশু না তরশু। 

৪। মনটা খারাপ হয়ে যেত। কেন ও এরকম? কেন ও অন্যদের মতো নয়? গুছোনো? দূরদর্শী? রান্নাঘরের জানালার ওপাশে সানসেটের তলায় পায়রাগুলো রোজ ডানা ঝাপটাঝাপটি করে। আজ পায়রাদেরও রেনি ডে। ঝাপটার শব্দ মিস করতে করতে ভাবত, এই বৃষ্টির দিনটা ও কীভাবে কাটাবে? সেলফ পিটিতে ভুগে? না সমস্ত চিন্তা চুলোয় দিয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে? এই আচমকা ছুটির আরাম নিংড়ে নিতে নিতে?

৫। উত্তর বেরিয়ে গেল ঝট করে। অফিস যাবে কি যাবে না সেই শক্ত প্রশ্নটার উত্তরটার মতোই। বৃষ্টির দিনে উত্তর খুব সহজে পাওয়া যায় দেখা যাচ্ছে। বাইরেটা যত ঘোলাটে, ঘরের ভেতরটা যত আবছা, দৃষ্টি ততই পরিষ্কার। 

৬।  চায়ের কাপ নিয়ে গ্রিলের বাইরে তাকিয়ে দেখত মোটা মোটা জলের ফোঁটার ঘা খেয়ে বাড়িওয়ালার সজনেফুলে ভরা গাছ কেমন মাথা নাড়ছে।

৭। দেখত আর মনে পড়ত একটা পেঁপে গাছের কথা। এরকম কুচি কুচি পাতা নয় সে গাছের। তার একেকটা শাখার অন্তে ছড়ানো আলপনার মতো বড় বড় পাতা, তার মিহি দেহের একদিক দিয়ে ঢুকে অন্যদিক দিয়ে বেরোনোর সময় রোদের রং সবুজ হয়ে যায়। এ রকম দিনে সেই পাতা বেয়ে জলের ফোঁটা এসে নামছে জানালার শিকে। তারপর সোজা পথ বেয়ে সারি বেঁধে চলেছে। একে অপরের সঙ্গে ঠিক সমান দূরত্ব বজায় রেখে। কী নিয়মনিষ্ঠ, ছাব্বিশে জানুয়ারির প্যারেডও লজ্জা পাবে। চলতে চলতে পুষ্ট হবে, তারপর ভার সইতে না পেরে টুপ করে খসে পড়বে। দেখতে দেখতে ইচ্ছে হবেই, আঙুল দিয়ে তাদের মিছিল মাটি করে দেওয়ার। কিছুক্ষণ অনিয়ম, দোলাচল, তারপর আবার মিছিল শুরু। আগের নিয়মে। যেন জীবনের ছোট একটি ডেমো। একে অপরের পিছু পিছু অন্ধের মতো চলেছি, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দুঃখ, অহংকার, চর্বি জমতে জমতে মুটোচ্ছি, মুটোতে মুটোতে যখন জীবনের গ্রিপ আলগা হয়ে যাবে, পড়ে মরে যাব। 

৮। বাড়ির বিভিন্ন কোণ থেকে ইনডোর প্ল্যান্টগুলোকে তুলে এনে জানালার বারান্দায় রেখে, দুহাতে তাদের পাতা জড়ো করে জানালার বাইরে বার করে দিত। বেচারারা দেখুক, কী জিনিস মিস করছে।

৯। বুককেসের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবত, কী পড়া যায়। ভাবাটা অবশ্য টাইমপাস, কারণ ও জানে এমন দিনে সঙ্গ দেওয়ার জন্য ওর বুককেসে একটাই (বা একজন লেখকেরই) বই আছে। ইন্ডিয়াফেরৎ স্মৃতিকাতর মেজরের দল, ভিকারেজে বিকেলের চায়ের আসর, ইঞ্চ-এর ট্যাক্সি সার্ভিস, লোকাল গেজেটের বিজ্ঞাপনে খুনের ঘোষণা নিয়ে আগাথা ক্রিস্টি গায়ে হালকা চাদরের মতো মুড়ে থাকতেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যেত।

১০। মাঝখানে খেতে উঠতে হত অবশ্য। আজকের মতো অন্যরকম দিনেও রোজকার মতো খিদে পায় কেন? আর যদি পায়ই তাহলে মুখের সামনে খাবার ধরে দেওয়ার কেউ থাকে না কেন? (অ্যাকচুয়ালি থাকে না যে সেটা ভালোই, থাকলে তার উপকারের বদলে তার আদেশ মানতে হত।) কিন্তু নেই যখন সেই নিয়ে ভেবে মাথা ঘামানোর মানে হয় না। সমাধান হল গোটা ব্যাপারটা যথাসম্ভব শর্টে সারা। সসপ্যান, ফুটন্ত জল, ম্যাগি। দু’মিনিটটা বিজ্ঞাপনের ফাঁকি, আসলে রান্নাঘরে ঢোকা থেকে বেরোনো পর্যন্ত মিনিট পাঁচেক লাগে। সেটা অ্যাফোর্ডেবল। 

১১। হঠাৎ জেগে উঠে দেখত, বুকের ওপর বই ভাঁজ করে রাখা, ঘর অন্ধকার, বাইরে একটানা বৃষ্টির শব্দ। মাথা ভার, তার থেকেও বেশি মন খারাপ। কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। ইস, দিনটা ফুরিয়ে গেল। দৌড়ে গিয়ে চা বসাত, ঘরের আলো জ্বালাত। এই গানটা জোরে চালাত ল্যাপটপে। 

১২। মনে পড়ত, আজ স্নান করা হল না। 

১৩। চায়ে চুমুক দিতে দিতে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকত। এখন আর সজনে গাছটাকে দেখা যাচ্ছে না। এখন শুধু ঘন ছায়ার মাঝে মাঝে কয়েকটা জানালার আলো। ব্যারোমিটারের কাছে খোঁজ নিত। কালও কি এমন কাটবে? উঁহু। পূর্বাভাস বলছে কাল খটখটে রোদ, সকালবেলা অফিসে পৌঁছে মেল খোলার সময় বুকের ভেতর মৃদু ভূমিকম্পের সম্ভাবনা।

১৪। ভয়ানক অবসাদ সেট করবে করবে এমন সময় সকালের প্রশ্নটা মনে পড়ে যেত। উত্তরটাও। রেনি ডে-তে দুঃখের জায়গা নেই।  গত ক'ঘণ্টাকে যত্ন করে মুড়ে বুকের ভেতর রেখে দিত ও। সামনের রৌদ্রকরোজ্বল দিনরাতের যুদ্ধক্ষেত্রে এইটুকুই তো সম্বল। 


Comments

  1. Tui Bombay aye:):)sudhu brishti hocche, pratyekdini miya ki malhar sonar din!

    ReplyDelete
    Replies
    1. আসছি আসছি। কাল তোর জানালার বাইরের ছবি দেখে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম।

      Delete
  2. Ar ko ta din shomoye dao ... emon borsha naambe je roj e rainy day korar icche hobe. Amio eyi asha niye e benche achi apatoto. :-)
    Ekta ada r powder er packet ene rekhe dao ... ada na thakle o brishti r diner ada cha ta miss hobe na.

    ReplyDelete
    Replies
    1. আদা পাউডার পাওয়া যায় বুঝি? দেখব তো। তবে তুমি যেরকম বৃষ্টির কথা বলছ শর্মিলা, সেরকম বৃষ্টি দিল্লিতে নামে না। কাজেই আমাদের তোমাদের জায়গায় ঢুঁ মেরে আসা ছাড়া গতি নেই।

      Delete
    2. Dried ginger powder Everest er ... je kono supermarket ba mudir dokane bolle diye debe. North India te Sonth bole mone hoye.

      Delete
    3. এবার আদা দিয়ে চা খাওয়া আমার আর কেউ ঠেকাতে পারবে না। থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ, শর্মিলা।

      Delete
  3. "কিছুক্ষণ অনিয়ম, দোলাচল, তারপর আবার মিছিল শুরু। আগের নিয়মে। যেন জীবনের ছোট একটি ডেমো। একে অপরের পিছু পিছু অন্ধের মতো চলেছি, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দুঃখ, অহংকার, চর্বি জমতে জমতে মুটোচ্ছি, মুটোতে মুটোতে যখন জীবনের গ্রিপ আলগা হয়ে যাবে, পড়ে মরে যাব। "

    বাঁচালেন মশাই| মাঝে এতদিন পোস্টের বিরতি ছিল যে ভাবলাম 'চাঁদে চড়, চাঁদে চড়' করতে করতে কম্বলের মতন নিরুদ্দেশ হয়েই গেলেন বুঝি বা |

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে না অন্বেষা, অত সহজে নিরুদ্দেশ হতে পারলে তো হয়েই যেত।

      Delete
  4. সমাপতন কি না জানি না, তোমার এই লেখাটা পড়ার সময় এইটা চলছিল - https://www.youtube.com/watch?v=w4rYXGdZILY
    কেমন আছ, দি?

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমি তো ভালোই, তুমি কেমন আছ আবির?

      Delete
    2. আমিও ঠিকঠাক দি।।

      Delete
  5. হাহা, থ্যাংক ইউ। কেমন আছেন?

    ReplyDelete
  6. Malhar aar agatha christie sange pliss can i get khichuri and machh bhaja...je kono machh holei cholbe!!!

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, তথাস্তু, শম্পা।

      Delete
  7. khub sundor :) , niyei nao na ekdin omon rainy day , khub kajer chap thakleo darun lagbe , ami nije bar dui tin korechi :P --PB

    ReplyDelete
    Replies
    1. সে রকমই একটা কিছু করতে হবে মনে হচ্ছে, প্রদীপ্ত।

      Delete
  8. daarun likhechhe. Oi 1,2,3 numbering naa rakhle lekhata mone hoy 'to do list' er chhand bhenge aaro sundar hoto. :)

    Aar oi penpe gachcher byaparta amar nijer Kasba r barir katha mone koriye dilo. "যেন জীবনের ছোট একটি ডেমো। একে অপরের পিছু পিছু অন্ধের মতো চলেছি, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দুঃখ, অহংকার, চর্বি জমতে জমতে মুটোচ্ছি, মুটোতে মুটোতে যখন জীবনের গ্রিপ আলগা হয়ে যাবে, পড়ে মরে যাব।" Eta ek ghar hoyechhe.

    ReplyDelete
    Replies
    1. Sorry Pratham line-e ota 'Likhechho' Habe.

      Delete
    2. ধন্যবাদ, ধন্যবাদ।

      Delete
  9. সব নোট করে রাখলুম,লিস্টিতে টিক দিতে দিতে সব কটা করবো, কেবল একটা রেনি ডে পাবার অপেক্ষা...

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা শাল্মলী, কেমন লাগল জানিও কিন্তু।

      Delete
  10. Barometer er kotha sune mone porlo Swadesh movie te ekta scene ache - Tate sohodeb namer ekjon dudiner weather report advance e dite parto. Khub mojar drishyo ta.

    Bristir sathe khichuri telebhaja e sbcheye bhalo combination.

    ReplyDelete
    Replies
    1. স্বদেশ-এ এরকম চরিত্র ছিল বুঝি? আমি অনেকদিন আগে দেখেছি, মনে নেই। খিচুড়ি ডিমভাজা আমারও খুব প্রিয়, হংসরাজ।

      Delete

Post a Comment