ব্যাম্বু বোট, গুরগাঁও



কালকের মতো সুন্দর সকাল দিল্লিতে কমই আসে। ঝকঝকে রোদ। পিঠের শাল ভেদ করে ঠিক ততটুকুই তাপ আসছে যতটুকু দরকার। বারান্দায় দাঁড়ালে সজনে গাছের হাওয়ায় গা শিউরোচ্ছে। আউটিং-এর জন্য পারফেক্ট। 

আউটিং-এর কথা সবাই জানত। আমরাই, অর্চিষ্মান ভুরু কোঁচকাচ্ছে, আচ্ছা, আমরা নয়, আমিই জানিয়েছিলাম। সেলফ হেল্প গুরুরা বলেন সাফল্যের একটা শুরুর শর্ত হচ্ছে অ্যাকাউন্টেবিলিটি। অর্থাৎ তুমি যদি পাঁচটা লোককে বল যে তুমি এবার থেকে রোজ দু’ঘণ্টা করে লিখবে, তাহলে লোকের কাছে মুখরক্ষার জন্যই দু’ঘণ্টা না হোক, আধঘণ্টা করে লিখতে বসা হবে। নিজের কাছে প্রমিস করে কিছু হয় না। নিজেকে নিজে বললে, আজ থেকে রোজ দু’ঘণ্টা লিখব, তারপর ভোরবেলা উঠে গা মুচড়ে বললে, আজ মনটা ভালো নেই, বড্ড পেট কামড়াচ্ছে, আজ থাক, কাল থেকে হবে। প্রমিস। ‘নিজে’ কাঁধ ঝাঁকিয়ে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ল। 

গত ক’মাস ধরে নিজেদের কাছে কতবার যে বেড়াতে যাওয়ার প্রমিস করলাম। সকালে অফিস যাওয়ার পথে উইকএন্ড ডেসটিনেশন ফ্রম ডেলহি দেখতে দেখতে গেলাম। বাড়ি এসে ইন্ডিয়ান রেলের সাইট ঘাঁটলাম। শতাব্দীর কোন কোচে কবে কত সিট খালি মুখস্থ হয়ে গেল। যাওয়া হল না।

সব গিয়ে যখন কালকের আউটিং স্থির হল, আমি পত্রপাঠ ফোন করে বলে দিলাম। তিন্নিকে, মাকে। যে শনিবার আমরা বেড়াতে যাচ্ছি। মা সক্কাল সক্কাল ফোন করে মনে করালেন, ‘কী সোনা, আজ তোমাদের আউটিং তো? সাবধানে যেও। স্টাইল করতে গিয়ে টুপি বাদ দিও না।’

তারপর সাবধানে, পাছে মেয়ের পার্সোনাল স্পেসে পা দিয়ে ফেলেন, বললেন, ‘কোথায় যাচ্ছিস সোনা? নাকি সিক্রেট?’ আমি বললাম, ‘এই তো সিনেমা দেখে খেয়ে ফিরব।’ মা দু’সেকেন্ড পর বললেন, ‘ওহ, আমি ভাবলাম অনেক দূর যাচ্ছিস বুঝি।’ 

ন’টা পঞ্চাশে সত্যম নেহরু প্লেসে শো, সিনেমার নাম অ্যারাইভাল। একেকসময় এমন হয় একটাও পছন্দসই সিনেমা আসে না। আর এখন ফ্যান্টাস্টিক বিস্ট না অ্যারাইভ্যাল, কোনটা দেখব ঠিক করতে গলদঘর্ম। শেষপর্যন্ত বর্ণনায় বুদ্ধি করে ‘সাইফাই’এর সঙ্গে ‘মিস্ট্রি’ জুড়ে দেওয়ায় অ্যারাইভ্যাল জিতল। ফাঁকা হলে বসে পপকর্ন খেতে খেতে দু’ঘণ্টা কাটালাম। অ্যারাইভ্যাল আমাদের দুজনেরই ভালো লেগেছে। এ রকম সাইফাই সিনেমার একটা বোনাস ভালোলাগার ব্যাপার হচ্ছে কে ঠিক বুঝেছে আর কে ভুল সেটা নিয়ে টাইমপাস করা যায়। টুইটারে যে সব সেলিব্রিটি সিনেমা দেখে এসে একশোচুয়াল্লিশ বর্ণে সিনেমার গল্প না বলে থাকতে পারেননি তাঁদের বুদ্ধির দৌড় নিয়েও হাসাহাসি করা যায়। 

ভেবেছিলাম গুরগাঁও পর্যন্ত যেতে যেতে মাঝপথে কথা ফুরিয়ে যাবে, তাই একবার মনে হয়েছিল ব্যাগে দু’খানা বই ভরে নেব। একে অপরকে সিনেমার মানে বোঝাতে বোঝাতে আর সেলেব্রিটিদের নিয়ে হাসাহাসি থামতে থামতে দেখি অর্ধেক রাস্তা ফুরিয়ে গেছে। গুরগাঁও থেকে বহু লোকে দিল্লিতে রোজ চাকরি করতে আসে এবং ফিরে যায়। যারা যায় না তাদের কাছেই দূরত্বটা মনে হয় অনতিক্রম্য। ইদানীং জোম্যাটোতে পছন্দসই অনেক দোকানের ঠিকানাই গুরগাঁও দেখি। অনেক দূর বলে সরিয়ে রাখি।

সময়পুর বদলি-র মতো চমৎকার নামওয়ালা ষ্টেশন থেকে ইয়েলো লাইনের মেট্রো যায় হুডা সিটি সেন্টারমার্কা বদখত নামওয়ালা ষ্টেশনে। আমাদের মেট্রোটা অবশ্য একেবারে হুডা সিটি সেন্টার যায়নি, কুতুবমিনার ষ্টেশনে শেষ হয়ে গেল। প্ল্যাটফর্ম থেকে দিগন্তে জঙ্গলের মাথার ওপর জেগে থাকা কুতুবমিনারের তিনটে থাক দেখে ফোন তাক করলাম। করতে না করতেই পেছনে গুমগুম শব্দ, পাশের প্ল্যাটফর্মে ট্রেন ঢুকে গেছে। অর্চিষ্মান কনুই ধরে টান মারল, কোনওমতে স্ক্রিনে আঙুল ছুঁইয়ে ছুটলাম। দুটো করে সিঁড়ি টপকে নেমে দুটো করে সিঁড়ি টপকে উঠে ট্রেনে ঢুকে ফোন খুলে দেখি ক্যামেরা ঘোরানো ছিল সেলফি মোডে, কুতুবমিনারের বদলে নিজের নাকের ক্লোজ আপ তুলেছি। 

ইন্ডিগো গুরু দ্রোণাচার্য, সিসকা এল ই ডি এম জি রোড ষ্টেশন পেরোতে পেরোতে দেখলাম জঙ্গলের ওপারে পলিউশনের ধোঁয়ার মধ্যে মাথা তুলেছে বিরাট বিরাট অট্টালিকা। শালিমার হুডা সিটি সেন্টার ষ্টেশন থেকে দু’কিলোমিটার দূরে সুপারমার্ট টু। তার পেছনে ব্যাম্বু বোট রেস্টোর‍্যান্ট। দিল্লিতে থেকেই খোলা বুককেস ধুলোমুক্ত রাখতে আমাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়, গুরগাঁওয়ের লোকেরা কী করেন আমি জানি না। চারদিকে বাড়ি বানানো চলছে, রাস্তা ছেড়ে ফুটপাথে নামলে দু’ইঞ্চি ধুলোয় জুতো ডুবে যায়। 

ব্যাম্বু বোট। মূলত ডেলিভারির জন্য বানানো হয়েছিল, খদ্দেরদের দাবিতে বসার জায়গার ব্যবস্থা পরে করা হয়েছে। ব্যাম্বু বোট-এ কোরিয়ান, জাপানিজ, ভিয়েতনামিজ আর টিবেটান গোটাদুই আইটেমও পাওয়া যায়। আমরা গিয়েছিলাম মূলত বান মি-র আকর্ষণে। বান মি হচ্ছে ভিয়েতনামিজ একরকমের স্যান্ডউইচ। স্যান্ডউইচ আমার অন্যতম প্রিয় ফুড গ্রুপ আর আমার প্রিয়তম স্যান্ডউইচ হচ্ছে বান মি। ভিয়েতনামিজ ব্যাগেটের ভেতর পোরা মাংস কিংবা মাংসের পেস্ট কিংবা অন্য কিছু। তবে আমার মতে মাংসটা আসল নয়, আসল হচ্ছে ভিয়েতনামিজ ব্যাগেট যেটা ফ্রেঞ্চ ব্যাগেটের থেকে বেঁটে আর নৌকোর মতো দেখতে আর তার থেকেও আসল হচ্ছে ভিনিগারে ভেজানো শশা, ধনেপাতা, গাজর, ডাইকন আর পাতলা পাতলা লাল কচি মুলো মিলিয়ে যে একটা তাজা সুগন্ধী কম্বিনেশন। 

স্যাডলি, ব্যাম্বু বোট-এর বান মি-তে এ দুটোর কোনওটাই নেই। ব্রেডের ব্যাপারটা ভদ্রমহিলা শুরুতেই বলে দিলেন। ভিয়েতনামিজ ব্যাগেট ওঁর খরিদ্দাররা পছন্দ করেনি। শক্ত বলে অভিযোগ করেছে। এই অভিযোগটা আমি কল্পনা করতে পারি। অর্চিষ্মানও কড়মড়ে পাউরুটি পছন্দ করে না, ওর ভালো লাগে অ্যামেরিকান স্টাইল হোয়াইট ব্রেড যেগুলো চিবোতে গেলে টাকরায় সেঁটে যায়। কাজেই ব্যাম্বু বোট এখন ভারতীয় পাউরুটি দিয়ে বান মি বানায়। 

পুলড পর্ক বান মি। ভেতরে শশা ধনেপাতা মুলোও নেই। বেসিক্যালি পুলড পর্ক স্যান্ডউইচ। ভালো খেতে। অর্চিষ্মান খুব তারিয়ে তারিয়ে খেয়েছে। আমি বান মি-র জন্য হন্যে হয়ে না থাকলে আমারও ভালো লাগত।

এই হার্টব্রেকটা বাদ দিলে ব্যাম্বু বোটের আর সব ভালো। বসার জায়গা ভালো। ডানদিকে উঁচু পাঁচিলের আড়াল থেকে এসে পড়া সূর্যের রশ্মি ভালো, গাছের সবুজ সজ্জা ভালো, ভদ্রমহিলার ব্যবহার অত্যন্ত ভালো। সবথেকে বড় কথা বাকি যে দুটো খাবার আমরা অর্ডার করেছিলাম, টুনা কিমবাপ আর চিকেন রমেন, সে দুটোও মারাত্মক ভালো।

আমার বেস্ট লেগেছে টুনা কিমবাপ। কিমবাপকে কোরিয়ান সুশি বলে চালানো যায়। শুকনো সিউইডে জড়ানো আঠাভাত আর টুনামাছের পেস্ট। বান মি-তে যে জিনিসটা থাকার কথা ছিল, ওই শশা ধনেপাতার কম্বোটা, এই কিমবাপে আছে। টুনার পরিমাণেও কিপটেমো নেই। তিল ভাসানো সয়া সসে চুবিয়ে মুখে পুরলেই স্বর্গ। 

চিকেন রমেন, খুব সরল করে বললে, ম্যাগির সুপ। খারাপ লাগার কথাও ছিল না, লাগেওনি। আবহাওয়া ঠাণ্ডা হয়ে আসতে বাড়িতে আমরা আজকাল ঝোলঝোল ম্যাগি খাচ্ছি মাঝে মাঝে, ব্যাম্বু বোটের রমেনে এক্সট্রা হল গিয়ে মিসো পেস্টের নোনতা স্বাদ, মোটা মোটা মুরগির মোটা কিন্তু নরম টুকরো, আর মাশরুম। মচৎকার।

দূরত্ব আর অ্যাকটিভিটির মাপকাঠিতে আমাদের কালকের বেড়ানোকে আউটিং বলাটা বাড়াবাড়ি হবে হয়তো, কিন্তু আনন্দ দিয়ে মাপলে দশটা আউটিং-এর সমান হয়েছে।



Comments

  1. Bah, tor chobita darun hoyeche !:)

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ।

      Delete
  2. "ফ্যান্টাস্টিক বিস্ট" কিন্তু ভালোই হয়েছে - না দেখলে পস্তাতে হবে !!

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে আমরা তো ভেবেছিলাম দেখব, কিন্তু দুটো দেখা পকেটের পক্ষে ক্ষতিকারক। তবে ক্ষতি সহ্য করেই দেখতে হবে মনে হচ্ছে। পরামর্শের জন্য অনেক ধন্যবাদ, কুন্তল।

      Delete
  3. আ্যজ ইউজুয়াল, খাবারের বর্ণনা অত্যন্ত উপাদেয় হয়েছে। গুড়গাঁও, অধুনা গুরুগ্রামের বর্ণনা পড়ে খুব হাসলাম। আমি রোজ ওই তল্লাটে ফাঁকিবাজি করতে যাই, আর আপনি কিনা সময় কাটানোর জন্য ব্যাগে বই পুরে নিয়ে গেছেন!

    ReplyDelete
    Replies
    1. নানা, যাইনি, দেবাশিস। যাব ভেবেছিলাম। নিয়ে যাইনি ভালোই হয়েছে, পড়ার সময় হত না।

      Delete
  4. Eyi thanda e jhol jhol maggi ... onekdin khaini. Ramen amar o khub bhalo lagey. Onekdiner pore aaj e ektu berate berobo bhablam ... korta babu shordi baadhiye boshechen. :)
    Arrival ar Fantastic beasts er moddhe ekhono atke achi. Konta dekhbo bujhte parchi na.

    ReplyDelete
    Replies
    1. দুটোই দেখে ফেল, শর্মিলা।

      Delete
  5. ramen soup ta khub khetam ghore banano,enuf tometo sauce,jhal achar,ei sob mishiye debe..vinegar,kachalnkao dite paro,,tomar khushi...top ramen er e ekta soupy maal ache..oi ta..tobe tumi to abar maggir bhakto..

    prosenjit

    ReplyDelete
    Replies
    1. বাঃ, রেসিপিটা ভালো। থ্যাংক ইউ, প্রসেনজিৎ।

      Delete
  6. Arre, Huda City center to amar barir sobcheye kachher station; Amra okhan thekei MG Road ba Ambience esobe jai..
    BTW, Gurgaon te kintu arro onek bhalo restaurant achhe.. Specially Cyberhub e.

    ReplyDelete
    Replies
    1. তোমাদের পাড়া থেকেই তো ঘুরে এলাম, রণদীপ। একবার যখন বাঁধ ভেঙেছে এবার প্রতি সপ্তাহেই গুরগাঁও যেতে ইচ্ছে করবে। নেক্সট ভাবছি বার্মা বার্মা ট্রাই করব। রেটিং তো চমৎকার, গেছ নাকি?

      Delete
    2. Burma Burma akhono try kora hoini :( ATB; But other restaurants in Cyberhub - Sutra, Raasta, Smoke and Grill, Delhi Heights are also good.
      BTW did you see the blackboard in 'Sodabottleopenerwala'? Jetate lekha thake 'No gossip, No jokes...' etc ?

      Delete
    3. খান মার্কেটের সোডাবটলে একটা ব্ল্যাকবোর্ড আছে নানারকম লেখা। তবে কী কী লেখা আছে সে সব মনে নেই।

      তোমার রেকোমেন্ডেশনগুলো মনে রাখব। আমার তো মনে হচ্ছে এখন প্রতি সপ্তাহেই গুরগাঁও যাই। অর্চিষ্মান বলছে সেটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে।

      Delete
    4. Next bar gele kintu pakka akbar board ta dekhe neben...
      Here's a sample-
      http://www.mid-day.com/articles/mumbai-food-ad-singhs-tribute-to-irani-cafe-culture/16381169

      Ar ha..protyek saptaho tei Gurgaon asun :) Mamagoto, Farzi cafe :) kotto jayga..

      Delete
    5. নিশ্চয়, রণদীপ। তুমি যে দুটো দোকানের নাম বললে, সে দুটোর দিল্লি শাখায় আমি খেয়েছি। মামাগোতো খুব ভালো লেগেছে, স্যাডলি ফারজি ভালো লাগেনি। তবে গুরগাঁওএর ক্যাফেটার রেটিং চমৎকার, আরেকবার ট্রাই নেওয়া যেতে পারে।

      Delete
  7. jak baba tumi ferot esechho dekhe khub anando hochhey. Bohudin update nei dekhe sorir torir thik achhey kina bhebe chintay porechhilam. Roj ese ekbar kore ghure gechhi.

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে সরি, চুপকথা। শরীর খারাপ নয়, এমনিই নানা বিষয়ে নাস্তানাবুদ ছিলাম। তাছাড়া চারদিন না পোস্ট করলে পঞ্চমদিন পোস্ট না করাটা ভীষণ সোজা হয়ে যায়, সেই ফ্যাক্টরটাও ছিল।

      Delete
  8. Bah tumi amar pray para tei esechhile bola jai! Gurgaon theke Delhi te joto na lok roj jai tar thekeo beshi Delhi theke Gurgaon te ashe chakri korte. Tai distance ta kono byapar e noi!

    ReplyDelete
    Replies
    1. সেটাই তো, রুণা। মেট্রোতে তো আরামও দারুণ। আবার কবে যাব সেই ভাবছি।

      Delete
  9. Anekdin por Abantor e esei khabar er post, monta khushi hoye gelo.. beranor anondoi to Asol Kuntala- seta 10 times mane boro paona ..- Bratati.
    O han, amra ekhon deshbashi hoye gechi, mojai moja.

    ReplyDelete
    Replies
    1. বাঃ বাঃ, দারুণ খবর, ব্রততী। দেশে কোথায় আছ?

      Delete
    2. Bangalore.
      restaurant explore kora jodio besh kom hoyechhe :(

      Delete
  10. are bah.. eirokom outing khub bhalo jinis.. ramen ta ki barite banano jabe?

    ReplyDelete
    Replies
    1. না বানানোর তো কোনও কারণ দেখি না, ঊর্মি। মিসোহীন রমেনই বা খারাপ কী?

      Delete

Post a Comment