এ মাসের বই/ অক্টোবর ২০১৬ঃ ছোটগল্প না উপন্যাস? ফর্ম না কনটেন্ট?



Olive Kitteridge/ Elizabeth Strout



এলিজাবেথ স্ট্রাউটের লেখা অলিভ কিটরিজ নামের উপন্যাসের কথা আমি শুনেছিলাম বেশ ক’মাস আগেই আমার প্রিয় এক বুকটিউব চ্যানেলে। পড়ব বলে ঠিকও করেছিলাম। তারপর ষষ্ঠীর আড্ডায় নতুন কী দেখলে? উত্তরে এক বন্ধু বলল, অলিভ কিটরিজ। 

দেখলে মানে? শুনলাম অলিভ কিটরিজ নাকি অলরেডি মিনি সিরিজ হয়ে গেছে। তাতে নামভূমিকায় অভিনয় করেছেন আমার অন্যতম প্রিয় অভিনেতা ফ্রান্সিস ম্যাকডারমন্ড, সেই ফার্গো-র ফ্রান্সিস ম্যাকডারমন্ড। বোঝো।আমারও দেখতে হবে। কিন্তু তার আগে কিনতে হবে। আড্ডায় বসে বসেই কিনে ফেললাম। কিন্ডলের এই ব্যাপারটা বেস্ট। ইনস্ট্যান্ট গ্র্যাটিফিকেশনের একেবারে তুঙ্গ। কিন্ডলের দু’নম্বর ভালো ব্যাপারটা হচ্ছে রাতে আলো না জ্বালিয়ে পড়া যায়। ষষ্ঠীর রাত একটায় শুরু করলাম, অষ্টমীর সকালে দু’শো অষ্টাশি পাতার অলিভ কিটরিজ শেষ হয়ে গেল। 

কৃতিত্ব আমার নয়, কৃতিত্ব এলিজাবেথ স্ট্রাউটের। এখনও দু'মাস বাকি, তবে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে বলা যায় দু’হাজার ষোলোয় পড়া সেরা পাঁচটা বইয়ের মধ্যে অলিভ কিটরিজ থাকবে। 

গল্পের পটভূমি অ্যামেরিকার আটলান্টিক তীরের নিউ ইংল্যান্ড অঞ্চলের মেইন রাজ্যের একটি পাড়া।  পাড়া। সেখানে থাকে হেনরি কিটরিজ, হেনরির স্ত্রী অলিভ কিটরিজ আর তাদের ছেলে ক্রিস্টোফার কিটরিজ। প্রথম গল্প হেনরি কিটরিজ আর তার ফার্মেসিতে কাজ করা ডেইজিকে নিয়ে। তারপর গল্প ছড়ায় শহরের অন্যান্য পরিবারেও। থিবোডু, ফস্টার, লার্কিন, গ্রেঞ্জার। প্রথমটা অদ্ভুত লাগে, যার নামে বই, তার চরিত্র এত আবছা কেন? মাঝে মাঝে কিটরিজদের বাড়িতে গল্প ফিরে আসে, অলিভ ক্রমশ স্পষ্ট হয়, বোঝা যায় গল্পের এটাই মূল সুতো। বইয়ের সঙ্গে সঙ্গে তার জীবনও এগোয়। 

এলিজাবেথ স্ট্রাউটের ভাষা নিচুস্বরে, কিন্তু নিখুঁত করে বাঁধা। স্ট্রাউটের গল্প আঞ্চলিক কিন্তু সর্বজনীন। ছোট শহরের বুকে বাসা নেওয়া গল্প আমার চিরকালের পছন্দের। এই চরিত্রগুলো হয়তো বড় শহরের ভিড়ে চাপা পড়ে যেত, কিন্তু ছোট শহরের নিস্তরঙ্গ প্রেক্ষাপটে তারা জ্বলজ্বলে। ওই ছোট শহরের মতো স্ট্রাউটের ভাষাও নিস্তেজ, ঢিমেতালা কিন্তু বর্ণময়। সমুদ্রতটের লোনা হাওয়ার মতো ধারালো, চোখে এসে বিঁধলে জ্বালা ধরায়।

তেরোটা ছোট ছোট খণ্ড নিয়ে তৈরি  নভেল, কিন্তু আলাদা করে পড়লে তাদের স্বয়ংসম্পূর্ণ গল্প বলে ধরাই যায়। দু’হাজার নয়ের পুলিৎজার পেয়েছিল অলিভ কিটরিজ।  

*****


A Girl is a Half Formed Thing/ Eimear McBride



গদ্যসাহিত্য ভাষার ভূমিকা আসলে কী? গল্পকে ঠ্যাকনা দেওয়া? গল্পকে পাঠক পর্যন্ত পৌঁছে দিতে যতটুকু দরকার ঠিক ততটুকুই নিজেকে উদ্ভাসিত করা? নাকি গল্প যেতে পারে যে চুলোয় ইচ্ছে, ভাষা চলবে নিজের খেয়ালে, নিজের ছন্দে, কারও তোয়াক্কা না করে। নাকি আদর্শটা এই দুইয়ের মাঝামাঝি কিছু?

For you. You’ll soon. You’ll give her name. In the stitches of her skin she’ll wear your say. Mammy me? Yes you. Bounce the bed. I’d say. I’d say that’s what you did. Then lay you down. They cut you round. Wait and hour and day. 

এই ভাবে শুরু হয় আ গার্ল ইজ আ হাফ ফর্মড থিং। এবং চলতে থাকে দু’শো সাতাশ পাতা ধরে। আপনার যদি খুব খারাপ লাগে এ ভাষা তাহলে না এগোনোই ভালো। কিন্তু যদি ধৈর্য থাকে বা কৌতূহল, তাহলে আমি বলব এগোতে। এগোতে এগোতে একটা গল্পের ছায়া বেরিয়ে আসবে। একটা মেয়ে, যার নাম আমরা জানতে পারব না, তার মা, ধর্মান্ধ। মেসোমশাই, যে মেয়েটিকে তেরো বছর বয়সে মেয়েটির সঙ্গে শারীরিকভাবে উপগত হন। আর ভাই, ছোটবেলায় টিউমার বাদ দিতে গিয়ে শৈশবে যার ব্রেন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। 

আ গার্ল ইস আ হাফ ফর্মড থিং অনেক দিক থেকে অন্যরকম। তার মধ্যে একটা অন্যরকমত্ব হচ্ছে গল্পের পারস্পেক্টিভ। সবথেকে বিরলব্যবহৃত পারস্পেক্টিভ, মধ্যম পুরুষে, লেখা হয়েছে গল্পটা। মেয়েটি সে কথা বলছে “তুমি”কে উদ্দেশ্য করে। এই ‘তুমি’ হচ্ছে তার ভাই। মেয়েটির জীবনে এই ভাইয়ের ভূমিকা আমার থেকে দ্য গার্ডিয়ান বেটার বলেছে, তাই আমি তাদের কথাটাই টুকে দিচ্ছি। "... the love she has for him is a clean space in a soiled world”. 

সয়েলড বললে অবশ্য কিছুই বলা হয় না। একজন মানুষের জীবনে যে এত কষ্ট, অন্যের এবং স্ব-আরোপিত এত অত্যচার, যন্ত্রণা, একটা জীবন যে এইভাবে অপচয় হতে পারে সেটা ম্যাকব্রাইডের প্রথম উপন্যাস পড়লে বিশ্বাস হয়। হ্যাঁ, আগের বাক্যে কোনও টাইপো নেই। এ বইয়ের চরিত্রদের কাউকে আমি ফেস করিনি কোনওদিন, কানাঘুষোয় এদের সম্পর্কে কোনও গুজবও আমার কানে আসেনি কোনওদিন, আসার সম্ভাবনাও কম, তবু এরা যে সত্যি, কল্পনা নয়, এই কথাটা একবারের জন্যও বিস্মৃত হতে পারিনি আমি। বইটা পড়ার সময়ও না, পড়ার পর এতদিন কেটে যাওয়ার পরও না। আমার ধারণা আরও অনেকদিন পরেও এরা আমার মনে সমান জ্বলজ্বলে থাকবে। 

এ বই আপনাকে আঘাত করবে। উত্তেজিত করবে। চরিত্রদের প্রতি ঘৃণায়, অনুকম্পায়, করুণায়, রাগে, হতাশায় আপনি অস্থির হবেন। সেনসিটিভ টাইপ হলে প্রকাশ্যে এ বই পড়া অ্যাডভাইজেবল নয়। বিব্রত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। 

আইমিয়ার ম্যাকব্রাইডকে কেউ বলছেন জয়েস, কেউ বলছেন জিনিয়াস। ম্যাকব্রাইডের জিনিয়াসটা এখানেই যে বইটা পড়ার পর কল্পনা করতে কষ্ট হবে যে অন্য কোন ভাষায় এই গল্প বলা যেত। এই তুলকালাম জীবনের গল্প বলার জন্য ওই তুলকালাম ভাষাই প্রয়োজন ছিল হয়তো। নিরীক্ষামূলক ভাষায় বাড়াবাড়ি রকম অ্যালার্জি না থাকলে বইটা পড়তে পারেন। আমি অন্তত এ’রকম কিছু আগে কখনও পড়িনি। 

দু'হাজার ষোলোর প্রথম পাঁচে এটাও ঢুকে গেছে। 

*****


So Many Ways to Begin/ Jon McGregor



ডেভিড একজন মিউজিয়াম কর্মচারী। বেশিরভাগ লোকই কাজ পেটের দায়ে করে, ডেভিড করেন ভালোবেসে। ডেভিড যুদ্ধক্ষেত্র (তখনও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডেবরি ইতিউতি পড়ে থাকত) এনে ঘরের ভেতর মিউজিয়াম সাজিয়ে বসে থাকত। শখ ছিল নিজের মিউজিয়াম খোলার। সে স্বপ্ন সত্যি হয়নি। ডেভিডের স্ত্রী, এক সন্তান। অত্যন্ত সাধারণ একটি জীবন ডেভিডের, শুধু একটি অসাধারণত্ব ছিল সে জীবনে। ডেভিডের মা ডরোথির এক বন্ধু, জুলিয়া, যিনি ছোটবেলা থেকে ডেভিডের অত্যন্ত কাছের মানুষ ছিলেন, অকালে স্মৃতিভ্রংশতার কোপে পড়েন, এবং এক বিস্মরণের মুহূর্তে তিনি ডেভিডকে বলে দেন যে ডেভিড আসলে ডরোথির সন্তান নন। যুদ্ধকালীন লন্ডনে একটি অজানা মেয়ে হাসপাতালে ডেভিডকে প্রসব করে দত্তকের জন্য ছেড়ে দিয়ে যায়।

ডেভিড শুরু করে তার সেই হারানো মাকে খুঁজতে। 

একদিক থেকে এটাই গল্পের মুখ্য প্লট পয়েন্ট হলেও সব সময় গল্প এই অভিমুখে ধাবিত হয়নি। জন ম্যাকগ্রেগরের লেখা অত্যন্ত ছড়ানো, শাখানদীর মতো একেকটা সুতো একেক চরিত্রের হাত ধরে বেরিয়ে পড়েছে, ডেভিডের স্ত্রী এলেনর, জুলিয়া আন্টি, ডেভিডের মা ডরোথি। গল্পের চলন অনেকটা অলিভ কিটরিজ-এর মতোই। চ্যাপ্টারগুলো আলাদা আলাদা ভাবে পড়লেও একেবারে অর্থহীন মনে হবে না। তবে অলিভ কিটরিজের মতো স্বয়ংসম্পূর্ণও নয় গল্পগুলো। অলিভ কিটরিজের মতোই শান্ত, বর্ণনামূলক ভাষা। 

আমার মতে একটু বেশিই বর্ণনামূলক। লেখার জগতে একটা উপদেশ খুব চলে “শো ডোন্ট টেল।” বাংলায় যাকে বলে ছবির মতো ফুটিয়ে তোলা। এখন সে ছবির বদলে ক্যামেরা কল্পনা করুন। এবার ক্যামেরাটা একেবারে অভিনেতার ঘাড়ের ওপর কল্পনা করুন। তার প্রতিটি ভ্রুভঙ্গি, হাত নাড়া, চেয়ার ছেড়ে ওঠা, খাটে এসে বসা, সব যদি আপনি পরপর দেখতে থাকেন তাহলে যেটা হয়, 'সো মেনি ওয়েজ টু বিগিন'-এ তাই হয়েছে। শব্দবাহুল্য। তাতে গল্প অনাবশ্যক ঢিলে হয়েছে বলে আমার মত।

জন ম্যাকগ্রেগরের প্রথম উপন্যাস “ইফ নোবডি স্পিকস অফ রিমার্কেবল থিংস” সাড়া ফেলেছিল। ছাব্বিশ বছর বয়সে লেখা প্রথম উপন্যাস একেবারে বুকার প্রাইজের লং লিস্টে। এখন কিন্ডলে 'রিমার্কেবল থিংস' রীতিমত সস্তায় পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু আমি যখন খুঁজেছিলাম তখন পাওয়া যাচ্ছিল না, তাই আমি 'সো মেনি ওয়েজ' ই কিনে ফেলেছিলাম। এটা পড়ার পর 'রিমার্কেবল থিংস' পড়ার বিশেষ উৎসাহ পাচ্ছি না, তবে দেখা যাক, মত বদলাতেও পারি।

*****

বইয়ের ছবির উৎস গুগল ইমেজেস। 


Comments

  1. besh sundor laglo boigulir bornona.
    jogar kore porte hobe, bishesh kore Olive Kitteridge

    ReplyDelete
    Replies
    1. অলিভ কিটরিজ সত্যি পড়ার মতো বই, অরিজিত। পড়ে ফেলুন।

      Delete
  2. Olive Kitteridge porte hobe to!!

    ReplyDelete

Post a Comment