গোনাইল
মুখের সঙ্গে নামের, জায়গার সঙ্গে ঘটনার, খাবারের সঙ্গে স্বাদের, শব্দের সঙ্গে গন্ধের, ফোন স্ক্রিনে ফুটে ওঠা নামের সঙ্গে কণ্ঠস্বরের, কবির সঙ্গে কবিতার, পরিচালকের সঙ্গে সিনেমাহলে মাথা ধরার, ধার্মিকের সঙ্গে বকের, অফিসের সঙ্গে আতংকের, রঙের সঙ্গে সৌন্দর্যের, দম্ভের সঙ্গে বুদ্ধির, বিনয়ের সঙ্গে কাপুরুষতার। লক্ষ লক্ষ অ্যাসোসিয়েশন মগজে পুরে আমরা বাঁচি। পৃথিবীর পথে হাঁটি। বেশিরভাগ অ্যাসোসিয়েশনই অচেতন। কিছু পাভলভীয়, কিছু ফ্রয়েডীয়, আর কিছু অভিজ্ঞতাজাত। এই প্রথম দু’রকম অ্যাসোসিয়েশন বিজ্ঞান (এবং সামাজিক বিজ্ঞান)সম্মত, তাই মোটামুটি সকলেরই কমন পড়ে। যেমন শিউলিফুলের সঙ্গে প্যান্ডেলের, সানাইয়ের সঙ্গে সিঁদুরের। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জাত অ্যাসোসিয়েশনগুলো আলাদা আলাদা হয়। কোনও গান শুনে কারও দারুণ নাচ পায়, কারও পার্টির কোণে দাঁড়িয়ে স্বপ্নের মানুষকে অন্যের সঙ্গে নাচতে দেখার স্মৃতি মনে পড়ে কান্না পায়। আমাদের বাড়ির পাশের লিলুয়াপাড়ার মোড়ের সঙ্গে নিশ্চয় অনেকের অনেক রকম অ্যাসোসিয়েশন আছে। (থাকতেই হবে এমন কথা নেই) ওখানে রিকশাস্ট্যান্ড ছিল, এখনও আছে। লিলুয়াপাড়ার মোড় পেরোতে কারও হয়তো রিকশার কথা মনে পড়ে, কিংবা রিকশা না পেয়ে ট্রেন ফেলের আতংক হয়। আমারও ওই মোড়ের সঙ্গে একটা আতংক, বা ট্রমাই বলা উচিত, জড়িয়ে আছে। তবে সে ট্রমায় রিকশা নেই, আছে একটা সাইকেল, আমার নিজেরই লাল রঙের হিরো সাইকেল, আর আছে একটা নর্দমা। পেছন ফিরে কাকে যেন টা টা করতে গিয়ে, তখন রীতিমত ধেড়ে, ক্লাস টেন, সাইকেল নিয়ে সোজা নর্দমায় নেমে গিয়েছিলাম। ট্রমার কারণটা সেটাও নয়। ও রকম পতন আমার অনেক হয়েছে। এই সেদিনও আমি অফিসের সামনে সমতল মাটিতে আছাড় খেয়েছি, ডিরেক্টরকে ‘আহা’ বলে দৌড়ে আসতে হয়েছে। মোড়ের মাথায় আমার কাছাকাছি বয়সেরই পুংলিঙ্গের ক’জন প্রতিনিধি জটলা করছিল, বালিকা বিদ্যালয়ের ট্রমার প্রধান কারণ ছিল সেটাই। ওই মোড় দিয়ে যাওয়ার সময় এখনও মাঝে মাঝে সেই কান গরম, নাক ঘামা, মাথা ঝাঁ ঝাঁ অনুভূতিটা স্পষ্ট টের পাই।
শ্মশ্রুগুম্ফসম্বলিত, সামান্য ট্যারা চোখ, গেরুয়া পরিহিত, মাথায় ম্যানবান বাঁধা একটা বিশেষ মুখের সঙ্গেও আমার একটা অ্যাসোসিয়েশন আছে। এই মুখটা আজকাল খুব দেখা যায়। দেখতেই হয়। আমাদের পাশের পাড়ার বড় রাস্তার অনেকগুলো দোকানের মাথায়, তাদের আবার নাম মেগামার্ট, এই মুখটা জ্বলজ্বল করে। প্রকাণ্ড দোকানের মাথায় প্রকাণ্ড ব্যানার থেকে হাই রেজলিউশন বদান্য হাসি ছিটকোয়। যখনই দেখি তখনই আমার একটা দৃশ্য চোখে ভাসে।
জনসমুদ্রের মাঝখানে উঁচু মাচা। বক্তৃতা চলছে। জনতা মন্ত্রমুগ্ধ। এমন সময় হঠাৎ গোলযোগ। পুলিশ রেড। পালানোর পথ না পেয়ে মাচা থেকে ঝাঁপ মেরেছেন বাবাজী। এর মাঝে কখন যেন ড্রেস চেঞ্জ করে নিয়েছেন। তাঁর পরনে এখন শাড়ি। নিচের জনতা প্রথমে একটা গোটা মানুষ ঘাড়ে এসে পড়ার আতংকে আর্তনাদ করে উঠেছিল কিন্তু স্বয়ং বাবাজী পড়ছেন দেখে সামলে নিয়ে অভ্যর্থনার ভঙ্গিতে দু’হাত তুলে ধরেছে। এই জায়গাটায় এসে দৃশ্য স্লো মোশন হয়ে যায়। আর খানিকটা ক্লোজ আপও। স্বর্গ থেকে থেকে নারীরূপে ভক্তদের মধ্যে নেমে আসছেন বাবাজি, তাঁর পূত আঁচল এবং দাড়ি পতপত করে উড়ছে। টিভি স্ক্রিন অর্ধেক করে ডানদিকে পাঠক চেঁচিয়ে খবর পড়ছেন, বাঁ দিকে বাবাজীর ঝাঁপ লুপে চালিয়ে রাখা হয়েছে। বাবাজী কেবলই লাফাচ্ছেন। কেবলই লাফাচ্ছেন। কেবলই লাফাচ্ছেন।
আর কথা বাড়ানোর আগে অ্যাসোসিয়েশন ব্যাপারটার আরও একটা বৈশিষ্ট্যের কথা বলে নেওয়া দরকার। অ্যাসোসিয়েশন, বিশেষ করে ব্যক্তিগত যেগুলো, অনেকক্ষেত্রেই আপেক্ষিক এবং তথ্যনিষ্ঠ নয়। আমার স্কুলের এক বন্ধুর সম্পর্কে ধারণা ছিল, ঝগড়ুটে। তারপর তার সঙ্গে পরে মাঝেসাঝে কথা হয়েছে, তখন দেখেছি ঝগড়ুটে তো সে নয়ই, বরং অধিকন্তু রকম নিরীহ। অথচ এখনও তার নাম মনে পড়লে আমার ঝগড়ূটে শব্দটাই প্রথম মাথায় আসে। আমার স্পষ্ট মনে আছে এক আত্মীয়ের বিয়েতে আমি বসে রসগোল্লা খাচ্ছি, অথচ সালতারিখ মেলালে দেখা যাবে ওখানে আমি থাকতেই পারি না, কারণ বিয়েটা ঘটেছে আমার জন্মের আগে। আমি প্রথমে অনেক প্রতিবাদের চেষ্টা করেছিলাম। বার বার বলেছিলাম, আমার স্পষ্ট মনে আছে কাকিমা কী রঙের বেনারসী পরে ছিলেন, তখন সবাই হেসে অ্যালবাম থেকে ফোটো বার করে বলল নির্ঘাত এই ফোটোটা দেখেছিস।
বাবাজীর ঝাঁপের স্মৃতিটাও এই গোত্রে পড়বে। ধরা পড়ত না, যদি না আমি লেখা থামিয়ে গুগল সার্চ করতাম। করলাম কারণ ভয় লাগল। এ তো আর কাকিমার বেনারসী নয়, এর সঙ্গে জাতীয় সংবেদনশীলতা জড়িয়ে আছে।
করতেই বেরিয়ে পড়ল স্মৃতিটা সত্যি নয়। পুরোটা কল্পনা নয়, অংশগুলো সত্যি। পুলিশের তাড়াটা সত্যি। বারো মিটার উঁচু স্টেজ থেকে বাবাজীর ঝাঁপ মারাটাও সত্যি। আমার কল্পনার মাচার উচ্চতা যদিও মিনিমাম একশো বারো মিটার। তারপর দেখা গেল ঝাঁপ মারার সময় তিনি পরে ছিলেন তাঁর চিরাচরিত গেরুয়া ইউনিফর্ম। আমি হতভম্ব। নারীরূপের গোটাটাই কি আমার মস্তিষ্কপ্রসূত? আবার সার্চ সার্চ সার্চ। উঁহু। এই তো। তবে শাড়ি নয়, সাদা সালওয়ারকামিজ। আর এখানে লাফালাফির ব্যাপারও নেই। দিব্যি সমতলে, ভিড়ের মাঝে ওড়না মাথায় দাঁড়িয়ে আছেন গুরুদেব।
কাজেই আমি পুরোটা না হলেও, অল্প ভুল। কিন্তু এটাও ঠিক যে আমার কল্পনাটা - উঁচু মাচা থেকে ফরিশ্তার মতো অদৃশ্য ডানা মেলে সোনালি রোদ্দুরের জ্যোতির্বলয় মেখে নেমে আসছেন বাবাজী, শাড়ির আঁচল, দাড়ি পতপত করে উড়ছে - বাস্তবের থেকে অনেক বেশি গ্র্যান্ড। কাজেই আমি এক্ষুনি সেটা বাতিল করছি না।
মোদ্দা কথা হচ্ছে, কোনও মুখ দেখলেই যদি এই ছবিটা মনে পড়ে তাহলে সে মুখের ছবি লাগানো দোকানে ঢুকে জিনিসপত্র কেনা একটু কঠিন। কাজেই আমি কিনি না। অর্চিষ্মানও কোনওদিন কেনেনি, কেনার উৎসাহও দেখায়নি। ওরও কোনও অ্যাসোসিয়েশন থেকে থাকবে হয়তো। অর্থাৎ আমাদের সংসারে বাবাজী প্রবেশ করেননি এখনও। আমাদের চারপাশে অনেকের সংসারেই করেছেন। চোখের সামনে দেখেছি সিঁড়ির কোণে রাখা ফিনাইলের শিশি বদলে গোনাইল হয়ে যেতে। সে তাঁরা তাঁদের মেঝে ফিনাইল দিয়ে মুছবেন না গোনাইল দিয়ে তাঁরাই বুঝবেন। কিন্তু তাঁরা শুধু নিজেদের মেঝে মুছেই ক্ষান্ত দেন না, আমাদেরও বাবাজীর জিনিস কিনতে উদ্বুদ্ধ করেন। শুধু ভক্তিমতে চিঁড়ে ভিজবে না বুঝে অন্যপথে বিজ্ঞাপন চালান। বাবাজীর টুথপেস্টে কার ক্যাভিটি সেরে গেছে, বাবাজীর নুডল নাকি দু’মিনিটও লাগে না দেড় মিনিটেই রান্না হয়ে যায়, এই ভেজালের দুনিয়ায় একমাত্র বাবাজীর প্রোডাক্টই শুদ্ধ, এই মুনাফালোভী ধান্দাবাজির দুনিয়ায় একমাত্র বাবাজীর উদ্দেশ্যই মহৎ। তোমরা ইউজ করো না কেন? এবার থেকে করবে।
আমরা “নিশ্চয়, সত্যি এতদিন না করে খুবই বোকামো হয়েছে” ঘাড় নাড়ি, আর উল্টোদিকে বক্তা যতবার বাবাজীর নাম উচ্চারণ করেন ততবার, চোখ বন্ধ না করেই, তাঁর মাথার পেছনে শূন্য থেকে বাবাজীকে ঝাঁপ মারতে দেখি।
অবশেষে আর ঠেকানো গেল না। দীপাবলীর উপহার হিসেবে বাবাজী আমাদের সংসারে প্রবেশ করলেন। দরজা খুলে দেখলাম শোনপাপড়ির বাক্স হাতে নিয়ে বন্ধু দাঁড়িয়ে আছেন। তার পাঁচ মিনিট আগেই আমরা কী খাই কী খাই করছিলাম, বাড়িতে যা যা আছে কোনওটাই মনে ধরছিল না। চানাচুর? ছোঃ। পপকর্ন? মানুষে খায়? চকোলেট? তার থেকে ভুখা মরাও ভালো। শোনপাপড়ি দেখে মনে হল এর থেকে ভালো জলখাবার পৃথিবীতে আর হয় না। বন্ধুর এক হাতে শোনপাপড়ির প্যাকেট, অন্য হাত সে হাতের কনুই ছুঁয়ে। সামান্য কোমর ঝুঁকিয়ে বললেন, হ্যাপি দিওয়ালি। এই নাও বাবাজীর শোনপাপড়ি।
খিদেয় ততক্ষণে পাগল হওয়ার জোগাড় হয়েছিল, নিরীহ গরুটার মুখখানা চড়াৎ করে ছিঁড়ে শোনপাপড়িতে পৌঁছলাম। তাড়া ছিল, কিন্তু একটা কৌতূহলও যে ছিল সেটা স্বীকার করছি। কীসে কীসে খুঁত বার করা যায়। প্যাকেজিং খারাপ না। অ্যাকচুয়ালি বেশ ভালো। প্যাকেটের ভেতর একটা বাক্স। অর্ধেক খেয়ে ঢাকা দিয়ে রাখা যাবে। আমরা অবশ্য শোনপাপড়ি কিনে খাই না, এটাই স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজিং কি না জানি না। ঝুরঝুরে শোনপাপড়ি। হাতে করে তোলা মুশকিল। চামচে করে তুলে মুখে পুরলাম। ভালো খেতে। অবশ্য শোনপাপড়ি খারাপ খেতে বানানোটাই প্রতিভা।
একটা শেষ করে আরেকটা শোনপাপড়ি শুরু করেছি এমন সময় টিভিতে ওই চ্যানেলটা এল যেটাতে সর্বক্ষণ হয় বাবাজীর প্রোডাক্ট নয় এক ইঞ্চি লকেটের মধ্যে গোটা হনুমান চালিশা নয় পবিত্র কুরআন এইসব চলে। আমরা টাইমপাস হিসেবে মাঝে মাঝে দেখি। তখন, কী আশ্চর্য সমাপতন, বাবাজীর অ্যাড চলছিল। বাবাজী প্রকৃতির ভেতর ঘুরছেন ফিরছেন, স্বচ্ছতোয়া নদীর জলে হাত ধুচ্ছেন, পাখিসব কিচমিচ করে তাঁর জয়গান গাইছে, এর মাঝে বন থেকে বালাকৃষ্ণ, যার কি না বাবাজীর ব্র্যান্ডে চুরানব্বই শতাংশ শেয়ার, হাসি হাসি মুখে বেরিয়ে আসছেন। পেছন থেকে একটা ভক্তিগদগদ গলা প্রাচীন ভারতের গৌরবের কথা আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে। প্রাচীন ভারতের মুনিঋষি, গরুরা, তাদের পবিত্র শিং, ল্যাজ, গোবর ও চোনা, সবই যে পবিত্র এবং উপকারী, ভণ্ড অধার্মিকদের দ্বারা চেপে যাওয়া এই তথ্যটা যে বাবাজী বেদপুরাণ খুঁড়ে বার করে এনেছেন, মানুষের কল্যাণে প্রয়োগ করেছেন . . .
আমার চোয়াল থেমে গেল। চামচ টলে শোনপাপড়ি মেঝেতে পড়ে গেল। এই ভয়ানক সম্ভাবনাটা আমার মাথা এড়িয়ে গেল কী করে। বাক্স দেখে মহা খুশি হয়ে ওপরের মোড়কটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম, দু’বার না ভেবে বাস্কেটের ভেতর হাত ঢুকিয়ে সেটা উদ্ধার করলাম। ইস, ইনগ্রেডিয়েন্ট লিস্ট আর নিউট্রিশনাল ইনফোর ঠিক মাঝখান দিয়ে ছিঁড়েছি। কোনওমতে দু’হাত দিয়ে দুটো অংশ যতখানি সম্ভব পাশাপাশি রেখে পড়তে লাগলাম। প্রায় সাত রকমের ময়দা, বেসন, হ্যানাত্যানা, কাউ’স . . . কাউ’স! মাগো. . . কাউ’স পিওর ঘি, যাক বাবা, সুগার এবং আরও সব নিরীহ জিনিস। শোনপাপড়িতে যা যা এক্সপেক্ট করে লোকে, তাই তাই। তার বাইরে কিছু নয়।
বুকটা তখনও এত ধড়ফড় করছিল যে চেয়ারে বসতে হল। কান ঘেঁষে বেঁচেছি। সামান্য শোনপাপড়ি খেতে গিয়ে এত টেনশন? বাবাজীর খাবারদাবার শরীরের পক্ষে ভালো হতে পারে, হার্টের জন্য খুবই বিপজ্জনক দেখা যাচ্ছে। প্রতিজ্ঞা আমার কখনওই টলেনি, এই ঘটনায় সেটা আরেকটু শক্ত হল। বাবাজীর যেখানে থাকার কথা সেখানেই থাকুন, অর্থাৎ কি না মাথায়, শোনপাপড়ি আর ফিনাইলে তাঁকে আমার না পেলেও চলবে।
করতেই বেরিয়ে পড়ল স্মৃতিটা সত্যি নয়। পুরোটা কল্পনা নয়, অংশগুলো সত্যি। পুলিশের তাড়াটা সত্যি। বারো মিটার উঁচু স্টেজ থেকে বাবাজীর ঝাঁপ মারাটাও সত্যি। আমার কল্পনার মাচার উচ্চতা যদিও মিনিমাম একশো বারো মিটার। তারপর দেখা গেল ঝাঁপ মারার সময় তিনি পরে ছিলেন তাঁর চিরাচরিত গেরুয়া ইউনিফর্ম। আমি হতভম্ব। নারীরূপের গোটাটাই কি আমার মস্তিষ্কপ্রসূত? আবার সার্চ সার্চ সার্চ। উঁহু। এই তো। তবে শাড়ি নয়, সাদা সালওয়ারকামিজ। আর এখানে লাফালাফির ব্যাপারও নেই। দিব্যি সমতলে, ভিড়ের মাঝে ওড়না মাথায় দাঁড়িয়ে আছেন গুরুদেব।
কাজেই আমি পুরোটা না হলেও, অল্প ভুল। কিন্তু এটাও ঠিক যে আমার কল্পনাটা - উঁচু মাচা থেকে ফরিশ্তার মতো অদৃশ্য ডানা মেলে সোনালি রোদ্দুরের জ্যোতির্বলয় মেখে নেমে আসছেন বাবাজী, শাড়ির আঁচল, দাড়ি পতপত করে উড়ছে - বাস্তবের থেকে অনেক বেশি গ্র্যান্ড। কাজেই আমি এক্ষুনি সেটা বাতিল করছি না।
মোদ্দা কথা হচ্ছে, কোনও মুখ দেখলেই যদি এই ছবিটা মনে পড়ে তাহলে সে মুখের ছবি লাগানো দোকানে ঢুকে জিনিসপত্র কেনা একটু কঠিন। কাজেই আমি কিনি না। অর্চিষ্মানও কোনওদিন কেনেনি, কেনার উৎসাহও দেখায়নি। ওরও কোনও অ্যাসোসিয়েশন থেকে থাকবে হয়তো। অর্থাৎ আমাদের সংসারে বাবাজী প্রবেশ করেননি এখনও। আমাদের চারপাশে অনেকের সংসারেই করেছেন। চোখের সামনে দেখেছি সিঁড়ির কোণে রাখা ফিনাইলের শিশি বদলে গোনাইল হয়ে যেতে। সে তাঁরা তাঁদের মেঝে ফিনাইল দিয়ে মুছবেন না গোনাইল দিয়ে তাঁরাই বুঝবেন। কিন্তু তাঁরা শুধু নিজেদের মেঝে মুছেই ক্ষান্ত দেন না, আমাদেরও বাবাজীর জিনিস কিনতে উদ্বুদ্ধ করেন। শুধু ভক্তিমতে চিঁড়ে ভিজবে না বুঝে অন্যপথে বিজ্ঞাপন চালান। বাবাজীর টুথপেস্টে কার ক্যাভিটি সেরে গেছে, বাবাজীর নুডল নাকি দু’মিনিটও লাগে না দেড় মিনিটেই রান্না হয়ে যায়, এই ভেজালের দুনিয়ায় একমাত্র বাবাজীর প্রোডাক্টই শুদ্ধ, এই মুনাফালোভী ধান্দাবাজির দুনিয়ায় একমাত্র বাবাজীর উদ্দেশ্যই মহৎ। তোমরা ইউজ করো না কেন? এবার থেকে করবে।
আমরা “নিশ্চয়, সত্যি এতদিন না করে খুবই বোকামো হয়েছে” ঘাড় নাড়ি, আর উল্টোদিকে বক্তা যতবার বাবাজীর নাম উচ্চারণ করেন ততবার, চোখ বন্ধ না করেই, তাঁর মাথার পেছনে শূন্য থেকে বাবাজীকে ঝাঁপ মারতে দেখি।
অবশেষে আর ঠেকানো গেল না। দীপাবলীর উপহার হিসেবে বাবাজী আমাদের সংসারে প্রবেশ করলেন। দরজা খুলে দেখলাম শোনপাপড়ির বাক্স হাতে নিয়ে বন্ধু দাঁড়িয়ে আছেন। তার পাঁচ মিনিট আগেই আমরা কী খাই কী খাই করছিলাম, বাড়িতে যা যা আছে কোনওটাই মনে ধরছিল না। চানাচুর? ছোঃ। পপকর্ন? মানুষে খায়? চকোলেট? তার থেকে ভুখা মরাও ভালো। শোনপাপড়ি দেখে মনে হল এর থেকে ভালো জলখাবার পৃথিবীতে আর হয় না। বন্ধুর এক হাতে শোনপাপড়ির প্যাকেট, অন্য হাত সে হাতের কনুই ছুঁয়ে। সামান্য কোমর ঝুঁকিয়ে বললেন, হ্যাপি দিওয়ালি। এই নাও বাবাজীর শোনপাপড়ি।
খিদেয় ততক্ষণে পাগল হওয়ার জোগাড় হয়েছিল, নিরীহ গরুটার মুখখানা চড়াৎ করে ছিঁড়ে শোনপাপড়িতে পৌঁছলাম। তাড়া ছিল, কিন্তু একটা কৌতূহলও যে ছিল সেটা স্বীকার করছি। কীসে কীসে খুঁত বার করা যায়। প্যাকেজিং খারাপ না। অ্যাকচুয়ালি বেশ ভালো। প্যাকেটের ভেতর একটা বাক্স। অর্ধেক খেয়ে ঢাকা দিয়ে রাখা যাবে। আমরা অবশ্য শোনপাপড়ি কিনে খাই না, এটাই স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজিং কি না জানি না। ঝুরঝুরে শোনপাপড়ি। হাতে করে তোলা মুশকিল। চামচে করে তুলে মুখে পুরলাম। ভালো খেতে। অবশ্য শোনপাপড়ি খারাপ খেতে বানানোটাই প্রতিভা।
একটা শেষ করে আরেকটা শোনপাপড়ি শুরু করেছি এমন সময় টিভিতে ওই চ্যানেলটা এল যেটাতে সর্বক্ষণ হয় বাবাজীর প্রোডাক্ট নয় এক ইঞ্চি লকেটের মধ্যে গোটা হনুমান চালিশা নয় পবিত্র কুরআন এইসব চলে। আমরা টাইমপাস হিসেবে মাঝে মাঝে দেখি। তখন, কী আশ্চর্য সমাপতন, বাবাজীর অ্যাড চলছিল। বাবাজী প্রকৃতির ভেতর ঘুরছেন ফিরছেন, স্বচ্ছতোয়া নদীর জলে হাত ধুচ্ছেন, পাখিসব কিচমিচ করে তাঁর জয়গান গাইছে, এর মাঝে বন থেকে বালাকৃষ্ণ, যার কি না বাবাজীর ব্র্যান্ডে চুরানব্বই শতাংশ শেয়ার, হাসি হাসি মুখে বেরিয়ে আসছেন। পেছন থেকে একটা ভক্তিগদগদ গলা প্রাচীন ভারতের গৌরবের কথা আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে। প্রাচীন ভারতের মুনিঋষি, গরুরা, তাদের পবিত্র শিং, ল্যাজ, গোবর ও চোনা, সবই যে পবিত্র এবং উপকারী, ভণ্ড অধার্মিকদের দ্বারা চেপে যাওয়া এই তথ্যটা যে বাবাজী বেদপুরাণ খুঁড়ে বার করে এনেছেন, মানুষের কল্যাণে প্রয়োগ করেছেন . . .
আমার চোয়াল থেমে গেল। চামচ টলে শোনপাপড়ি মেঝেতে পড়ে গেল। এই ভয়ানক সম্ভাবনাটা আমার মাথা এড়িয়ে গেল কী করে। বাক্স দেখে মহা খুশি হয়ে ওপরের মোড়কটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম, দু’বার না ভেবে বাস্কেটের ভেতর হাত ঢুকিয়ে সেটা উদ্ধার করলাম। ইস, ইনগ্রেডিয়েন্ট লিস্ট আর নিউট্রিশনাল ইনফোর ঠিক মাঝখান দিয়ে ছিঁড়েছি। কোনওমতে দু’হাত দিয়ে দুটো অংশ যতখানি সম্ভব পাশাপাশি রেখে পড়তে লাগলাম। প্রায় সাত রকমের ময়দা, বেসন, হ্যানাত্যানা, কাউ’স . . . কাউ’স! মাগো. . . কাউ’স পিওর ঘি, যাক বাবা, সুগার এবং আরও সব নিরীহ জিনিস। শোনপাপড়িতে যা যা এক্সপেক্ট করে লোকে, তাই তাই। তার বাইরে কিছু নয়।
বুকটা তখনও এত ধড়ফড় করছিল যে চেয়ারে বসতে হল। কান ঘেঁষে বেঁচেছি। সামান্য শোনপাপড়ি খেতে গিয়ে এত টেনশন? বাবাজীর খাবারদাবার শরীরের পক্ষে ভালো হতে পারে, হার্টের জন্য খুবই বিপজ্জনক দেখা যাচ্ছে। প্রতিজ্ঞা আমার কখনওই টলেনি, এই ঘটনায় সেটা আরেকটু শক্ত হল। বাবাজীর যেখানে থাকার কথা সেখানেই থাকুন, অর্থাৎ কি না মাথায়, শোনপাপড়ি আর ফিনাইলে তাঁকে আমার না পেলেও চলবে।
Hahaha, ami akhono sahos kore babajir kichu barite anini
ReplyDeleteআমরা যে পরিমাণ প্রেশারের মধ্যে আছি, ভাবতে পারবি না।
Deletebabar product bhaloi..madhu ar dant er majon use korechi..dekho sob mal e khrap...budget fmcg...industrialzed production...ta..bideshi company te munafa na die dishi company munafa koruk na...
ReplyDeleteঅফিসের সঙ্গে আতংকের
যেমন শিউলিফুলের সঙ্গে প্যান্ডেলের, সানাইয়ের সঙ্গে সিঁদুরের।
আমার নিজেরই লাল রঙের হিরো সাইকেল, আর আছে একটা নর্দমা। পেছন ফিরে কাকে যেন টা টা করতে গিয়ে, তখন রীতিমত ধেড়ে, ক্লাস টেন, সাইকেল নিয়ে সোজা নর্দমায় নেমে গিয়েছিলাম। ট্রমার কারণটা সেটাও নয়। ও রকম পতন আমার অনেক হয়েছে। এই সেদিনও আমি অফিসের সামনে সমতল মাটিতে আছাড় খেয়েছি, ডিরেক্টরকে ‘আহা’ বলে দৌড়ে আসতে হয়েছে।
tomar lekha gulo khub sweet
prosenjit
ধন্যবাদ, প্রসেনজিৎ।
DeleteHehe. On principle babajir product kini na/use kori na. Tobey eita mathay asheni kokhono. Ebar protigya aro drirho holo.
ReplyDeleteহাই ফাইভ, বিম্ববতী।
Deleteএই কালই আমাদের অফিসে সবার ঘাড় ধরে একটা ট্রেনিং করানো হল, টপিক ছিল - আনকনশাস বায়াস। অর্থাৎ কিনা গুণাগুণ বিচার না করে স্টিরিওটাইপের পথ ধরে ধাঁ করে কারও সম্পর্কে ইতিবাচক/নেতিবাচক ডিসিশন নিয়ে ফেলা। আমাদের সবাইকে বলা হল, এটা খুব খারাপ - বাঙালি মানেই ভিতু, অম্বলে ভোগে, মাছ খায়... এই ধরণের ব্যাপারস্যাপার আরকি।
ReplyDeleteবাবাজির প্রোডাক্ট খারাপ নয়। বাজারের অন্য বিকল্পগুলোর সাথে তুলনা করলে - কোয়ালিটি কম্পারেবল, দাম সস্তা। তবে কিনা আপনার পুরনো ইশকুলে এবার বিজয়াদশমীর দিন রাবণের মূর্তির জায়গায় বাবাজির মুখাগ্নি করা হয়েছে। এই যদি আপনার আপত্তির কারণ হয়ে থাকে, তাহলে কিছু বলার নেই।
ওহ, আমার পুরোনো স্কুলের খবরটা জানতাম না। আনকনশাস বায়াস যে আমার আছে সেটা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তবে এটা কনশাস বায়াস।
DeleteHahaha....khub bhalo laglo lekhata.
ReplyDeleteAmi obosso babajir bishkut kheyechhi :D
থ্যাংক ইউ, অরিজিত।
Deletehaha darun moja pelam :) -PB
ReplyDeleteধন্যবাদ, প্রদীপ্ত।
DeleteDaarun, lekha porae aekhono hanschi. Asholey babajir byaparey allergy ta amaro. Tai aaro moja laglo.
ReplyDeleteগুড। সমস্যাটা হচ্ছে এধরণের বিষয়ে মত মিললে একরকম, না মিললে গা-জ্বালা গ্যারান্টিড।
Deleteআমি বাবাজির তেল শ্যাম্পু প্রভৃতি ব্যবহার করে দেখেছি (বাবাজির জিনিস বলেই কিনেছি এমনটা নয়), কাজের জিনিস| বাজারের থেকে খানিকটা কম দামেও পাওয়া যায়, প্যাকেজিং ভালো| তবে ওই 'গো' মার্কা জিনিসপত্তর হজম হবে না, তাই সে চেষ্টাও করিনি| শনপাপড়ি লঞ্চ হয়েছে জানতাম না, খেতে কেমন?
ReplyDeleteবেশ ভালো খেতে, অন্বেষা।
DeleteHaha khub haslam.. Ekta shampoo peyechilam orange er Khosa dewa... Mathar khosa uthe jawar jogar.. Ki dry chul hoye gelo.. Onake dekhe kichu kenar icche hoyni..
ReplyDeleteতোকে দলে পেয়ে কী যে বল পাচ্ছি বুকে, ঊর্মি...
DeleteAmi baba boli na, Karon nischoi sahaj onumeyo. Kaka boli.
ReplyDeleteTa Ami debasish babu r sathe ek mot. Kaka jir besh Kichhu jinis e Amar buddhiman better half er totporotay try kora hoyechhe. Beshir bhag e batite ar dekhi na. Tobu amrao mone hoyechhe quality/cost quotient er bichar a jinis gulo egiye.
Sab theke mojar, ebong Bhoy er Katya holo, kaka jir ei salwar pore sunyo theke obotoron er khobor ta beriye gechhe, shata chesta teo mone porchhe na kokhono emon Sundar ghotona sunechhi kina. Ghumiye theke uthe sakalbela drishyo ta bhebe jemon finki diye bhakti aschhe, Abar bhule jaoa r jonyei Bhoy o. Ar ki ki bhule gechhi?
কিছু কিছু জিনিস ভুলে যাওয়াই ভালো, শিবেন্দু। মনে থাকলেই ঝামেলা। বাবাজীর জিনিস ব্যবহার করে উপযোগিতা পেয়েছেন শুনে ভালো লাগল।
Deletedarun laglo lekhata---aar somoyopojogi...shonpapri r khetre bolte pari oi packaging je kono standard brand er paoa jai.
ReplyDeleteaar belated bijoya aar dipabalir shubhechchha janai...agami dine anek sundar lekha pabar apekkhai roilam.
আপনাকেও বিজয়া আর কালীপুজোর অনেক শুভেচ্ছা, সুস্মিতা। লেখা ভালো লেগেছে জেনে খুশি হলাম।
DeleteAmi ei soptaho duyek age babaji r ekta cream kinlam. Recently product composition niye khub khutkhute hoyechi. Kintu babaji r product e to composition e lekha nei clearly. Color , vitamin e r sugandito dravya.... ki sanghatik bepar.
ReplyDeleteEr cheye beshi kichu bolchi na
কমপোজিশন দিয়ে কী হবে, প্রিয়াঙ্কা, ওঁর আশীর্বাদই কাফি।
Deleteaamaaro babaji ke osojjho lage.. kono product ekhono kinini.. onar noodles er ekta packet barite eseche somehow.. keu e seta khacche na dekhchi.. completely conscious bias.. sei onulom bilom diye cancer saranor somoy thekei..
ReplyDeleteaamaro dharona chilo uni salwar kameez pore stage theke jhnap diyechilen.. sada salway kameez chilo mone hocche.. oi drishyo ta amar mathateo royeche...
Khub bhalo hoyeche lekhata
গুড, ইন্দ্রাণী। লেখা ভালো লেগেছে জেনে ভালো লাগল। ধন্যবাদ।
Deleteকুন্তলাদি, ব্যাপক লাগলো লেখাটা! এটা একদম তোমার vintage form! সেই প্রথমদিন তোমার ব্লগে এসে "ত্রিফলা" বা "হ্যাদ্দেহোয়া" পড়ে ঠিক এইরকমই মজা পেয়েছিলাম। অবান্তর ২-এর জন্য এটা তুলে রেখো।
ReplyDeleteআর বাবাজীর ব্যাপারে হায়েস্ট ফাইভ!
থ্যাংক ইউ, পিয়াস।
Delete