সিগারেট, মোবাইল আর বই। তিনটেই স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর।



সিগারেট অনেক লোকে অনেক ভাবে ছাড়ে। আমার মতে ছাড়ার বেস্ট উপায় না ধরা, কিন্তু যদি ধরেই ফেলে কেউ তাহলে নেক্সট বেস্ট হচ্ছে কোল্ড টার্কি পদ্ধতি। আমার বাবা ওইভাবেই ছেড়েছিলেন। তবে আরও নানারকম ভাবে ছাড়া যায় শুনেছি, ইলেকট্রিক সিগারেট ফুঁকে, গায়ে নিকোটিন প্যাচ লাগিয়ে। নেহেরু প্লেসের জ্যামে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝে বাবাজীদের বিজ্ঞাপনের কার্ড উড়ে এসে গায়ে পড়ে, সেখানে দেখেছি বাবাজী অ্যামেরিকায় চাকরি দেওয়ানো, কালো মেয়ের পাত্র জোটানোর সঙ্গে সিগারেটের নেশাও সফলভাবে ছাড়ানোর দাবি করেছেন। ফোন নাম্বারও দেওয়া আছে। সেভাবেও হয়তো ছাড়ে কেউ কেউ। কলেজ ইউনিভার্সিটিতে লোকজনকে আরেকরকম উপায়ে সিগারেট ছাড়তে (বা ছাড়ার চেষ্টা করতে) দেখেছি। সেটা হচ্ছে, নিজের পয়সায় খাওয়া বন্ধ করা। কেউ কিনে দিলে, বা বন্ধুদের থেকে কাউন্টার নিয়ে খাওয়া। আশায় থাকা এরকম ফ্রি রাইড বেশিদিন চালাতে বন্ধুরা অ্যালাউ করবে না, আর তখন এই মারাত্মক নেশার হাত থেকে মুক্তি মিলবে। 

মাসতিনেক আগে আমি যখন ফোনে গেম খেলা ছাড়ব ঠিক করলাম, এই পদ্ধতিটাই পছন্দ হল। অর্থাৎ আমি নিজের ফোনে গেম খেলব না, খেলতে হলে শুধু অন্যের ফোনে খেলব। এখন, অন্যের ফোন বলতে তো বাড়িওয়ালার ফোন চাইতে যাওয়া যায় না, অর্চিষ্মানই ভরসা। স্নানেটানে ঢুকলে বা ভুলে ফেলে রেখে আইসক্রিম আনতে গেলে, ঝট করে দুটো লেভেল খেলে নিই। আমি গর্বিত যে আমার শপথ রাখতে পেরেছি, গত তিন মাসে একটি বারও নিজের ফোনে গেম খেলিনি। খুব শক্ত কাজ, ফাঁকা বসে থাকলে মাঝে মাঝে ভীষণ ইচ্ছের বেগ আসে, মনে হয়, কী হবে একটা লেভেল খেললে? আচ্ছা, হাফ লেভেল?  সিকি লেভেল? তখন দুই হাত উল্টো করে তার ওপর বসে ঘন ঘন দুলি আর বিড়বিড় করি, ‘কেটে যাবে কেটে যাবে এক্ষুনি কেটে যাবে।’ 

খেলা ছাড়তে শুধু আমার মনের জোরই কাজে দিয়েছে তেমন নয়, আমার বাবাও হেল্প করেছেন। যদিও এটা গোড়া কেটে আগায় জল ঢালার একটা নমুনা হতে পারে, কারণ নেশাটা ধরিয়েছিলেনও বাবা। পার্টিকুলারলি এই নেশাটার কথা বলছি না, যাবতীয় নেশা। বাবা হাতে করে ধরাননি, কিন্তু চরিত্রের এই যে “নেশাখোর” বৈশিষ্ট্যটা, এটা জিনের মাধ্যমে আমার মধ্যে সংক্রামিত করেছেন। সিগারেট, তাস, নাটক, বেড়ানো, ক্ল্যাসিক্যাল গান - কোনও জিনিসটাই বাবা সুস্থ লোকের মতো করেন না, সেটাকে একটা চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যান। ছোটবেলায় শুনেছিলাম এটাকে বলে মাত্রাজ্ঞানের অভাব, বড় হয়ে জেনেছি এটাকে বলে অ্যাডিকটিভ পার্সোন্যালিটি। আমার এই দ্বিতীয় ডায়াগনোসিসটা বেশি পছন্দের, কারণ প্রথমটার মধ্যে একটা নালিশ নালিশ ভাব আছে। যেন মাত্রাজ্ঞান না থাকাটা আমার বাবার (এবং আমার) দোষ। কিন্তু কারও যদি পার্সোন্যালিটিই অ্যাডিকটিভ হয়, তার মধ্যে একটা নিয়তির মারের ব্যাপার থাকে। 

আমার বাবা ভিডিও গেমও খেলেন, এবং নেশাখোরের মতো খেলেন। বাবা অবশ্য ফোনে খেলেন না, বাবার ভিডিও গেম খেলার যন্ত্র আছে। প্লেস্টেশন নয়, বাবার আছে ট্রেনে বিক্রি হওয়া প্লাস্টিকের লম্বাটে যন্ত্র, দাম পনেরো থেকে পঞ্চাশের মধ্যে, ঊর্ধ্বাংশে সরু অনুজ্জ্বল স্ক্রিন, নিম্নাংশে হলদে বোতামের সারি। টিপলে প্যাঁপোঁ আওয়াজ বেরোয়। এ বি সি ডি নানারকম গেম আছে। আমার বাবা (আমারও) ফেভারিট ‘এম’ গেম। স্ক্রিনের ওপর থেকে নিচে নানারকম আকৃতি ঝরে ঝরে পড়ে, বোতাম টিপে টিপে সেগুলোকে থাকে থাক খাপে খাপ সাজাতে হয়। আমি যখন বাড়ি যাই, এই ঘরের খাটে চিৎ হয়ে শুয়ে মায়ের ফোনে স্নেক খেলি, ওই ঘরে বাবা অবিকল এক ভঙ্গিতে চিৎ হয়ে শুয়ে প্যাঁ প্যাঁ করে ‘এম’ গেম খেলেন। 

মা মাথা নাড়েন। 

সপ্তাহখানেক আগে অফিসের ইমেলে চিঠি এল একটি অনলাইন সমীক্ষায় অংশগ্রহণ করার অনুরোধ নিয়ে। চিঠিটা পাঠিয়েছে অফিসেরই টেলিকম প্রোজেক্টের টিম। সমীক্ষার বিষয় হচ্ছে মোবাইল ফোন বা মোবাইল ফোনের ওপর আমার নির্ভরতা। সাধারণত এই রকম সার্ভেটার্ভে দেখলে পত্রপাঠ ডিলিট করি এবং সেই জন্যই জানি যে এর উত্তর জোগাড় করা কী ঝামেলার। অফিসের লোককে অফিসের লোক ছাড়া কে দেখবে, ভেবে শুরু করলাম। 

কতক্ষণ নেট দেখি? কতক্ষণ খেলি? কতক্ষণ সোশ্যাল মিডিয়ায় কাটাই? ফোনে সবথেকে বেশি কী করি? কথা বলি, এস এম এস করি, চ্যাট করি, নেট ঘুরি না গেমস খেলি? ধরে ধরে সবক'টার উত্তর দিলাম। শেষেরটার উত্তর মাসতিনেক আগেও দেওয়া সহজ ছিল, এখনও দেওয়া সোজা। যদিও দুটো উত্তর আলাদা। তিনমাস আগে আমি ফোনে সবথেকে বেশি গেমস খেলতাম। ক্যান্ডি ক্রাশ, ক্যান্ডি ক্রাশের লাইফ ফুরিয়ে গেলে ক্যান্ডি ক্রাশ সোডা, সোডার লাইফ ফুরোলে পেপার প্যানিক, প্যানিক ফুরোলে স্ক্রাবি ডাবি। তারপর তিনমাস আগে আমার ফোন ভেঙে গেল, আমা বাবা পেনশনের এরিয়ার পেয়ে আমাকে নতুন ফোন উপহার দিলেন। আমি ঠিক করলাম, এই সুযোগে জীবনে একটা পজিটিভ পরিবর্তন আনা যাক। গত তিনমাসে আমি আমার ফোনে একবারও গেমস খেলিনি, কম্পিউটারে খেলেছি, অর্চিষ্মানের ফোনে খেলেছি, কিন্তু নিজের (বাবার দেওয়া) ফোনে খেলিনি।

যথাসম্ভব সততার সঙ্গে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করলাম। সততার দরকার, কারণ অজান্তেই নিজের উত্তরে জল মেশানোর একটা সম্ভাবনা থেকে যায়। আমার ভাবতে ভালো লাগে আমি ঘণ্টাআধেকের বেশি গেমস খেলি না, বা ঘণ্টা খানেকের বেশি ফোনে ইন্টারনেটে ঘুরি না, কিন্তু সকলেই জানে যে সেটা সত্যি নয়। পারি না, কিন্তু চেষ্টা করি ফোনের দিকে সর্বদা তাকিয়ে না থাকতে। কেন চেষ্টা করি, ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকলে খারাপ কীসের, সে সম্পর্কে স্বচ্ছ কোনও ধারণা নেই যদিও। সবাই বলে, তাই আমি বিশ্বাস করি, ফোনের দিকে দরকারের বেশি তাকিয়ে থাকা খারাপ। অটোতে বসে ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকা খারাপ, অথচ বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকাটা, সামহাউ, প্রশংসার। ইন্টারনেটে লাখ লাখ আর্টিকল ঘুরছে, এই ফোনের দিকে তাকিয়ে তাকিয়েই কীভাবে মানবসভ্যতা একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে। সেদিন (ফোনেই) আরেকটা আর্টিকল পড়ছিলাম, ঠিক এই সেন্টিমেন্টের প্রতিফলন। তফাৎ শুধু ফোনের বদলে বই। ছাপাখানা যখন শুরু হল, বই সহজলভ্য হল, কারা যেন বলেছিলেন, এই শুরু হল ধ্বংসের। মানুষ আর মানুষের সঙ্গে কথা বলবে না, বই মুখে করে উঠবে বসবে খাবে শোবে। তাছাড়া ছাপাখানা যখন এসেছিল তখনও ঘরে ঘরে ইলেকট্রিসিটি আসেনি। এদিকে ঘরে ঘরে লোকে বই পড়তে শুরু করেছে। আর যারা বই পড়ে তারা জানে, আলো ফুরিয়ে গেছে বলে কিংবা ঘুম পেয়ে গেছে বলে বই অর্ধেক পড়ে ছাড়া যায় না, তখন লন্ঠন আর আধপড়া বই নিয়ে শুতে যেতে হয়। এমন নাকি অনেক হয়েছে যে পাঠক বই এবং লন্ঠন নিয়ে বিছানায় গেছেন, সকালবেলা প্রতিবেশীরা উঠে দেখেছেন বাড়ির জায়গায় পড়ে আছে একমুঠো ছাই। 

*এই আর্টিকলের লিংকটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না, এখন পেলাম।

The Dangers of Reading in Bed



Comments

  1. হাহাহা এটা সাংঘাতিক ভালো হয়েছে । আমি নিজেই মোবাইল নেশার দাস । প্রতিদিন ভাবি কমাবো এটা কিন্তু ওই অলস সময় বা ফাঁকা সময় পেলেই মনে হয় কি আছে একটু চেক করিনা একবার তো কি হবে । তোমায় দেখে মনে জোর বাড়ালাম , আপিসে মোবাইল ঘটবে না ব্যাস । মানে ইয়ে চেষ্টা করবো ।
    যাক বই পড়া নিয়েও এরকম মোট আছে জেনেও মনটা শান্তি পেলো । -প্রদীপ্ত

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওরে বাবা, মোবাইল একেবারে বাদ, প্রদীপ্ত? তার থেকে আইটেম ধরে ধরে ছাড়লে ভালো হয় না, মানে এই সাইটে যাব না, তারপর আরেকটা সাইট নিষিদ্ধ লিস্টে যোগ হবে, ইত্যাদি? তবে একবারে সব বাদ দিলে দারুণ হবে।

      Delete
    2. হাঁ বাদ মানে ওই আর কি , ফেসবুক বাদ , মেসেঞ্জার বাদ আর হোয়াটস্যাপ বাদ দিলাম । এই তিনটি তো সময় খায় । :( - প্রদীপ্ত

      Delete
  2. বাহ্ জেনে ভালো লাগলো যে বই নিয়েও এরকম ভবিষৎবাণী ছিল এবং তা সত্যি হয় নি!
    তার মানে শেষের সেদিন আগত নয়!

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ, আমিও হাঁফ ছেড়েছি, কাকলি।

      Delete
  3. khub resonate korlo lekhata..

    aami mobile e game kheli, tobe khub ekta beshi noy.. khub taratari battery phuriye jay :(.. aamaar diagnosis onujayi aami khub ekta mobile addicted noi

    aamaar bhai ei muhurte cigarette charche.. 3 weeks and counting.. kothin somoy.. tobe fingers crossed..

    aami 1 mas holo boi pora chere diyechi.. jani na, hoi toh na pore thakte parbo na sesh obdhi.. tobe gyan howa istok yearly 100-150 boi pora chere dite parlam, ek maas mote hoye thakleo, aami nijei aschorjo hocchi.. jai hok apatoto boi theke mukh tule life e participate kora e thik hoyeche.. aaro kichudin lagbe bujhte je siddhanto ta thik na bhul..

    bhalo thakben

    Indrani

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনার ভাইয়ের সাধনা সফল হোক, এই কামনা করি, ইন্দ্রাণী।

      আপনার বই পড়া ছাড়ার সিদ্ধান্তটা ইন্টারেস্টিং। আমি এখনও পর্যন্ত সবাইকেই ধরার চেষ্টা করতেই দেখেছি। আপনার রেজলিউশন সফল হোক, ফলাফল জানার অপেক্ষায় রইলাম।

      Delete
  4. Cigarette ebong mobile niye ekmot, kintu boi motei khotikarok noy! ki sanghateek sob research!!
    Boi porun, onyo k poran, ebong bhalo bhalo boiyer khobor blog er madhyome chhoran, Kuntala :) :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, চেষ্টা করব, অরিজিত।

      Delete
  5. M game ta ki onek ta tetris er moto ? Amar oi khela-tar bhoyanok nesha chilo, tobe chere diyechi. Ar boi pora boro bhoyanok nesha, abong khub khotikari karon ote manuch chinta korte badhyo hoi ar ke na jane chinta kore i joto bipod.

    ReplyDelete
    Replies
    1. টেট্রিসই বটে, ঘনাদা। ভয়ানক নেশা। চিন্তা করা খারাপ, সেটা আমিও মানি।

      Delete
  6. khub Bhalo laglo lekhata...nesha katate ami phn theke sudoku bidaay korechilam 2014 end e. ekhono resolution e tike achi...tabe iPad e ache but I rarely use that, mushkil holo Shree ei sudoku nesha ti peyechhe..r Ekta nesha abantor pora. roj dhun marchina edike tar mane holo chorom chaap e achi :(- Bratati.

    ReplyDelete
    Replies
    1. তোমার চাপ দ্রুত কমুক এই কামনা করি, ব্রততী।

      Delete
  7. না না,সিগারেট,গেম আর বই পড়া এক নাকি!বই পড়া কিছুতেই ছাড়া সম্ভব না,যারা বই পড়ে তারা এটা জানে |আর এই অভ্যাসটা ছাড়ার কোনো ইচ্ছাও নেই |আপনি পোস্টে যা বলেছেন তা মনে হয়না কোনোদিন হবে বই নিয়ে |গেম আর সিগারেট ছাড়াটা কোনো
    ব্যাপারই না |

    ReplyDelete
    Replies
    1. মন্তব্য করার জন্য অশেষ ধন্যবাদ।

      Delete

Post a Comment