জাহানারা রোশেনারা



মহাদ্বিতীয়ার দুপুর থেকে বৃষ্টি নামল। সে রকম বৃষ্টি চট করে দিল্লিতে দেখা যায় না। ঝমঝম দেখা যায়, ঝিরিঝিরি দেখা যায়, কিন্তু ঠায়লয়ে সারাদুপুর, ঘণ্টার পর ঘণ্টা, এইটা বিরল। তাপমাত্রা নামল তিরিশের নিচে, ডেফ কল থেকে মূলচন্দের রাস্তায় হাঁটুজল জমল, বাড়ি ফেরার রাস্তা তিরিশ মিনিট থেকে তিয়াত্তর মিনিট হয়ে গেল। বাড়ির সামনে উবার থেকে নেমেছি, বলা বাহুল্য, তক্ষুনি বৃষ্টিটা জোর হতে হবে, আমি লটবহর সামলে, বাটার জুতো প্যাচপেচিয়ে রাস্তা পেরিয়ে বাড়ির গেটের দিকে হাঁটছি, ভাবছি অর্চিষ্মানের নিশ্চয় আসতে ন’টা বাজবে, ভেবে ভেবে দুঃখী মুখ তুলেছি, অমনি চশমার কাচ বেয়ে ভরা বাদরের ধারার ফাঁক দিয়ে চেনা মুখ, চেনা গোঁফ। দরজার সামনে অর্চিষ্মান দাঁড়িয়ে হাসছে। 

শুক্রবারের রাতে বাড়িতে ঢুকে দরজার ছিটকিনি তোলা, জামাকাপড় ছাড়া, চা বসানো, এক বগলে বালিশ অন্য বগলে ল্যাপটপ নিয়ে খাটের দিকে হাঁটা, এমনকি আমাদের রোজকার জরাজীর্ণ রসিকতাগুলোর মধ্যেও যে একটা নতুন পালিশ পড়ে, সেটাকে অনেকসময় ভাষায় রূপান্তরিত করার কথা ভেবেছি আমি, এবং হাল ছেড়েছি। সে ক্ষমতা আমার জানা নেই। বা ভাষাই অক্ষম, তাও হতে পারে। আফটার অল, গোলাপের ফুটে থাকাকে শুধু গোলাপের ফুটে থাকার সঙ্গেই তুলনা করা যায়, বুঝেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।

জানালা দিয়ে আসা ঊনত্রিশ ডিগ্রির ভেজা হাওয়া আর কংক্রিটের ওপর টুপটাপ জলের আওয়াজ সেই অলরেডি অনির্বচনীয় শুক্রবারের সন্ধ্যেকে অন্য মাত্রা দিল।

*****

শনিবারের সকাল, স্বাভাবিকভাবেই হল দেরিতে। কিন্তু খুব যে দেরি করব তার উপায় নেই। ঘরের জমানো কাজ শেষ করে, খেয়েদেয়ে সোয়া দু’টোর মধ্যে বেরোতে হবে, তিনটে পাঁচে শো ‘ব্যোমকেশ ও অগ্নিবাণ’-এর টিকিট কাটা আছে। পালে পালে বাংলা সিনেমা রিলিজ করেছে দিল্লিতে। ব্যোমকেশ, কাকাবাবু, প্রজাপতি বিস্কুট, ককপিট। বুকমাইশো আমার দুর্বল জায়গা ধরে ফেলেছে, ক্রিস্টোফার নোলানের সিনেমা চললেও ক্রমাগত ‘মাছের ঝোল’-এর প্রোমো কোড পাঠাতে থাকে।

দেখতে পারলে আমরা চারটে সিনেমাই দেখতাম, কিন্তু সেটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। অগত্যা র‍্যাংকিং করতে হল। দুজনের র‍্যাংকিং-এরই লাস্টে ছিল ককপিট, ফার্স্টে ব্যোমকেশ।

অগ্নিবাণ এবং উপসংহার, এই দুটো গল্প মিশিয়ে তৈরি হয়েছে 'ব্যোমকেশ ও অগ্নিবাণ'। অগ্নিবাণের গল্প ওই দেশলাইয়ের গল্পটা, আর উপসংহারের গল্প হচ্ছে কোকনদ গুপ্তকে নিয়ে। গল্প নিয়ে বলার কিছু নেই, সিনেমা নিয়েও আমার বলার কিছু থাকা উচিত না। শাশ্বতকে তো ভালোই লাগে, যিশু অভ্যেস হয়ে গেছেন, ঊষসীর উপস্থিতি খুবই কম, তাতে একটা জিনিস ভালো হয়েছে, হিংস্র দাম্পত্য কলহ মাত্রা ছাড়ায়নি। ওপরচালাকিবর্জিত সংলাপ দিয়ে সিনেমা চালানোর সাহস দেখানোর জন্য অঞ্জন দত্তকে আমার বিনম্র ধন্যবাদ। 

তাছাড়া আরও একটা শক্ত কাজ তাঁকে করতে হয়েছে, গল্পের স্ত্রীচরিত্রদের পাল্টানো। ঝগড়ুটে, স্নেহহীন, শুচিবায়ুগ্রস্ত। পরম স্নেহময় স্বামীর স্নেহ যিনি স্রেফ স্বভাবদোষে পেলেন না উল্টে বিষবৎ ঘৃণা জুটল, অফ কোর্স, নিজের স্বভাবদোষেই। “অন্যান্য নারীসুলভ সদগুণের মধ্যে বাচালতাও” যার চরিত্রে ভরপুর। বইয়ের পাতায় এ সব পড়লে যে রকম ওয়ার্ম কোজি ফিলিং হয়, চোখে দেখলে হয়তো নাও হতে পারে। তাই সে সব চরিত্রে নতুন মোচড় আনতে হয়। নতুন মনস্তাত্ত্বিক ঠ্যাকনা। দুঃখের বিষয়, সে সব ঠ্যাকনাই শেষপর্যন্ত 'স্বামী সময় দেন না, তাই স্ত্রী যত গোলমাল বাধান'-তে গিয়ে ঠেকে। এর থেকে প্লেন ঝগড়ুটে নারীসুলভ নারী দেখালেও খুব বেশি অসুবিধে হত বলে মনে হয় না। শরদিন্দুর দূরদৃষ্টির প্রশংসা করতে হয়।

*****

ভাড়াবাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঘাড় বাড়ালে যে পুজোর প্যান্ডেল দেখা যায়, আমার মা পনেরোশো কিলোমিটার দূর থেকে ফোন করে খবর দিলেন, তারা নাকি নবমী নিশিতে মহানট অসীমকুমারের নির্দেশনায় চাণক্য পালার আয়োজন করেছে। যাত্রা আমি খুব ছোটবেলায় দেখেছি, তখনও রিষড়ার সব কারখানাগুলো ঝপাঝপ বন্ধ হয়ে যায়নি, ধুঁকছিল। আর সে সব কারখানার মাঠে মাঝেমাঝেই যাত্রাপালার আয়োজন হত। আমার বাবা প্রতিটি যাত্রা দেখতে যেতেন। সাইকেলের রডে সাঁটা ছোট্ট সিটে বসে সন্ধ্যের পালাগুলোতে আমিও গেছি মাঝে মাঝে, বাবা আর ঠাকুরদার বাঁকানো হ্যান্ডেল ছাতার সঙ্গে। সে ছাতার হাইট তখন আমার থেকে বেশি। রাত দশটা নাগাদ ঘুমন্ত আমিকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে বাবা আর দাদুর ছাতা আবার মাঠে ফিরে যেতেন, পালা শেষ করে বাড়ি ফিরতে কখনও মাঝরাত, কখনও শেষরাত।

ওই সময়টা এইসব যাত্রামাত্রা মা কত সুনজরে দেখতেন আমার সন্দেহ আছে, কিন্তু সময় মানুষকে বদলে দেয়, যাত্রাকে বদলে দেয়, যাত্রার প্রতি মানুষের মনকেও। এখন যাত্রা শব্দটা শুনলেই মায়ের মনে পড়ে তাঁর নিজের শৈশবের ঔরংজেব, বাবু হয়ে বসা বয়কাট ছাঁট মা ঊর্ধ্বপানে মঞ্চের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছেন, ঔরংজেবের অট্টহাস্যে মায়ের ছোট্ট শিরদাঁড়ায় বিদ্যুৎ খেলছে, আর একটা পুরোনো দুঃখ মাথাচাড়া দিচ্ছে আবার। জাহানারা রোশেনারার মতো এমন নাম থাকতে তাঁর কপালে কিনা অর্চনা?


Comments

  1. Jahanara ar Roshenara Kolkata zoo te duto hathiro naam chhilo. Eta ki Archana janen?

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, রুণা, না এটা বোধহয় জানে না। তবে জানলেও কিছু যেত আসত না মনে হয়, অর্চনার থেকে সব ভালো, সঅঅঅব, তাঁর মতে।

      Delete
  2. ei dekho. amake yeti obhijan dekhte utsahito kore tumi seshe Bymokesh? ar cockpit na please, dohai tomar. Projapoti Biscuit sunechi khub bhalo hoyeche.

    ReplyDelete
    Replies
    1. ইয়েতি অভিযান দেখার ব্যাপারটা সারকাজম ছিল, কুহেলি। আমারও মনে হচ্ছিল তুমি সিরিয়াসলি নিয়েছ। রক্তজল করে রোজগার করা পয়সার প্রতি মায়া নেই বলে এই সিনেমাগুলোর একটাদুটো দেখি, মায়া থাকলে একটাও দেখতাম না।

      Delete
  3. durdanto! Roshanara urf Archana r sange shiggir dekha korte chai.:)

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, রোশেনারাও খুশি হবেন এ প্রস্তাবে, তিন্নি।

      Delete
  4. K., Jahanara aar Roshanara'r choto bon chilo Gauharara. Onar naam temon shona jayna karon bhishon low profile maintain korten :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওহ, এটা জানতাম না, শম্পা। থ্যাংক ইউ। গওহরারা বুদ্ধিমান ছিলেন মনে হচ্ছে।

      Delete
  5. Bhalo laglo porte....apnar maa er moto chhotobelate amar o onyo naam er proti akorshon chhilo...

    Aar Byomkesh er review er jonyo dhonyobaad.

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওহ, রিভিউ তো সেভাবে লিখিনি, সুস্মিতা। ওই দু'লাইন। নিজের নাম অনেকেরই পছন্দ হয় না, আমারও হত না। এখন সয়ে গেছে।

      Delete
  6. Erokom sukrobarer sondhye jeno aro onek onek ase. Chokher samne dekhte pelam baire jhim jhim bristi porche , r thanda howya te gachera dulche.
    Yeti abhijaan .😀😀😀😀 amra dekhlam gotokal.
    Happy pujo kuntala Di.

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাপি পুজো তোমাকেও প্রিয়াঙ্কা। খুব ভালো কাটুক সামনের পাঁচদিন।

      Delete
  7. Gauhara Begum chhilen shei shontan jaake jonmo dite giye Mumtaz Mahal mara jaan. Kajei mohila-r low profile howata choice na hoye mojburi howar shomuho shombhabona!!!

    Byomkesh cinemata shombondhe mot prokash kora ta apni shojotne ediye giyechhen. Sheta ki nichhok indifference naki ekta Bangla cinema-r flop howar bindumatro daybhaag neoar onichha?

    iti
    Shuteertho

    ReplyDelete
    Replies
    1. গওহরা বেগমের ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং, সুতীর্থ। ঠিকই বলেছেন, হয়তো অনামুখো বলেই লো প্রোফাইলে থাকতে হয়েছে। তবে কারণ যা-ই হোক না কেন আদতে লাভই হয়েছে বলে আমার ধারণা।

      এড়িয়ে যাই কি আর সাধে? কত আর নিন্দে করব বলুন দেখি। ওই যে বলে না, ইফ ইউ হ্যাভ নাথিং গুড টু সে... এটসেটরা এটসেটরা... শেষটায় বিশ্বনিন্দুক বলে বাজারে নাম পড়বে। যদিও এই সিনেমাটায় নিন্দের সঙ্গে প্রশংসা করার মতো অনেককিছুই ছিল। করলাম না তার আরেকটা কারণ হচ্ছে, ইদানীং ঘন ঘন দু'খানা সিনেমার "রিভিউ" লিখেছি। সিনেমার রিভিউ লেখার যোগ্যতা তো সত্যিই নেই, খালি প্রতিক্রিয়া জানানো, সেটা অত ঘটা করে কী আর লিখব এই সব ভেবেটেবে...

      Delete
  8. Jogyota achhe na nei shei bichar ta nahoy amader (orthat Abantor-er pathhok-pathhika der) opor chhede dilen.

    Ar ki janen, "Raja tor kapod kothay" bolar moto lokeder prochondo obhaab aajkal. Khoborer kagoj ar internet portal gulor beshir bhag shomalochona gulor niropekkhotar opor loke bishwas hariyechhe. Eirokom obosthay apnar moto independent lokera jodi kolom (orthat keyboard) na dhoren, to amader moto sorol-moti, nishpap pathhok-pathhikara kothay jaabe?

    iti
    Shuteertho

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, এইটা ভালো বলেছেন, সুতীর্থ।

      Delete
  9. তোমার এই পোস্টটা পড়তে পড়তে পাশে তোমারই শেয়ার করা 'বর্ষণ লাগি বাদরিয়া' বাজছে , তোমার বৃষ্টি ভেজা দুজনের দরজায় ছবিটা ভারী জ্যান্ত ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, প্রদীপ্ত।

      Delete

Post a Comment