বাড়ির পথে
দিল্লি থেকে কলকাতা পৌঁছোতে যত সময় লাগে, নাকতলা থেকে দমদম এয়ারপোর্ট পৌঁছোতে লাগে তার থেকে ঠিক কুড়ি মিনিট বেশি।
কথাটা আমিও বিশ্বাস করতাম না, যদি না নিজের চোখে দেখা হত। আমার প্লেন ছাড়ল সন্ধ্যে সাতটা পঁয়ত্রিশে, অর্চিষ্মান বাড়ি থেকে রওনা দিল সাড়ে সাতটায়। ব্যাগট্যাগ নিয়ে আমি থ্রি এ থ্রি বি গেটের সামনে আসতে আসতে দশটা, অর্চিষ্মানের সঙ্গে দেখা হতে হতে আরও ঝাড়া কুড়ি মিনিট।
দায়ী বৃষ্টি। ফোনে শুনেছি, প্লেনের জানালা থেকেও দেখেছি। এয়ারপোর্টের জমিতে ছোট ছোট জলের ডোবা তিরতির করছে। জানালায় চশমা ঠেকিয়ে দেখার চেষ্টা করেছিলাম ল্যাম্পের আলো, নাকি এখনও বৃষ্টি পড়ছে।
আলোই। বৃষ্টি থেমে গেছে অনেকক্ষণ। তাতেই এই, এখনও চললে সেদিন রাতে আর বাড়ি পৌঁছনো হত না। এটাকে কলকাতাবিরোধী মতামত বলে ভাববেন না কেউ, কারণ দিল্লিতে এক ঘণ্টা বৃষ্টি হলে পরিস্থিতি এর থেকে খারাপ হয়। প্রিপেডের লাইনে অন্তত দেড়শো লোক দাঁড়িয়ে ছিল মুখ চুন করে। ওই লাইনে আমারও থাকার কথা ছিল, শেষমুহূর্তে প্ল্যান বদল হওয়ায় বেঁচে গেছি।
অর্চিষ্মানের ফোন পেয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। ভিড়ের মাঝে নিজেকে চেনানো খুব সহজ। সর্বদাই হয় কটকটে লাল নয় কুটকুটে সবুজ জামা পরে থাকি। কাজে দিল যথারীতি। মিনিট দেড়েকের মধ্যে অর্চিষ্মান বার করে ফেলল।
গাড়ি চলল ফিরতি পথে। উড়ালপুল জুড়ে সারি সারি গাড়ি নিশ্চল। তেঘরিয়া পাস করার সময় জানালা দিয়ে প্রতিবারের মতো ঝুঁকি দিয়ে দেখা হল মাসির ফ্ল্যাটের আলো জ্বলছে কি না। চিন্তা হল বিগ বেন অলরেডি দেহ রাখল নাকি, না হলে সারা গায়ে ভারা বাঁধা কেন? এর পর ডানদিকে ‘বর্তমান’ বিল্ডিং, বাঁ দিকে পরিবেশ ভবন, মাস্টার্সের গরমের ছুটিতে ইন্টার্নশিপে এই বাড়ির লাইব্রেরিতে ঘন ঘন আসতে হত। চতুর্দিকে বড় বড় ব্যানারে সোনার দোকানের বিজ্ঞাপন। আগের বার খুব গুরু গোবিন্দ সিং-এর ব্যানার চোখে পড়ছিল, আমি আর অর্চিষ্মান দুজনেই তাঁকে শিবাজী ভুল করেছিলাম, এখন গোবিন্দ সিং-এর জায়গায় জয়া আহসান মা দুর্গা সেজে দাঁড়িয়ে আছেন দিকে দিকে।
(সি আর পার্কেও প্যান্ডেলের কাজ প্রায় শেষ। আমাকে একজন ওলাভাইসাব গত সপ্তাহেই জিজ্ঞাসা করেছেন, দুর্গাপূজা তো এক মাহিনা দের হ্যায়, অভি সে প্যান্ডেল? আমি হেঁ হেঁ করে এড়ালাম। বললাম না যে, সারা বছর যে প্যান্ডেল বাঁধা থাকে না সেই নিয়েই তুষ্ট থাকুন। )
বাইপাসে জ্যামে দাঁড়ালে অর্চিষ্মান বলে, “এই বাইপাস দিয়ে যখন স্কুলে যেতাম, সাঁ সাঁ করে বাস ছুটত, দুদিকে জলাজমি, জেলেরা মাছ ধরত। আর এখন ছিরি দেখ।”
এখনটা সত্যি জঘন্য।
এর পর শুরু হয় রাস্তা জুড়ে ‘ব’ এর খেলা। ফোয়ারাপরিবৃত বিশ্ববঙ্গের বল ঘুরছে বনবন। দূর থেকে পাটুলির মোড়ের আলোকসজ্জা চোখ ধাঁধায়। ছোটবেলায় এই লেকে বোটিং করতে আসাটা নাকি একটা মহা উত্তেজনার ব্যাপার ছিল, অর্চিষ্মান আমাকে জানায়। তারপর এগলি ওগলি ঘুরতেই এসে যায় আশাপূর্ণা দেবীর বাড়ি। এমনিতে আমার ভয়ানক ইমপ্রেসড হওয়ার কথা, হইও, কিন্তু চেপে রেখে উদাসীনতার ভান করি। কারণ এই ঘোষণায় “তোমাদের রিষড়ায় খালি মশা আর আমাদের দেখ কেমন আশা” এই দেমাক প্রচ্ছন্ন থাকে। তারপরই ঢ্যাঙা ফ্ল্যাটবাড়ির গুচ্ছ। ওয়েস্ট উইন্ড। প্রথম যখন উঠেছিল, তখন রামগড়ে ‘ওয়েস্ট উইন্ড’ শুনে হাসি পেয়েছিল সবার খুব। আমরা বলাবলি করি, “অ্যাডভার্টাইজমেন্টে নির্ঘাত ‘লাশ গ্রিন সারাউন্ডিংস’ লিখেছিল বড় বড় করে, না গো?” তার থেকে আমার ঢের ভালো লাগে রাস্তার বাঁ পাশের মধ্যবিত্ত হাউসিং, যার কোনও এক ফ্ল্যাটের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ক্লাস ফাইভের অর্চিষ্মান গাছের ডালে কাকের বাসা আর বাসায় বাচ্চা কাকের হাঁ করা লাল মুখ দেখত হাঁ করে।
অবশেষে দূর থেকে বাড়ির গেট। গেটের মাথায় সাঁচি স্টাইলের ধাপ। কাছে গেলে ফলকে পদবী। কুকুরগুলো গাড়ির চারপাশে ভিড় করে আসে, আমাদের চেহারা দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে কিংবা করুণা করে গুটি গুটি ফিরে যায় যে যার ছায়ায়।
বাবা এসে দরজা খুলে দাঁড়ান। সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসতে মা বলেন, “কুন্তলা, ডাল আছে, আর আছে আলুভাজা, আলুপোস্ত। ক্ষীরকদম্ব আছে আর আছে জ্বাল দিয়ে ঘন করা নোটো ক্ষীর। আমি বলি সবগুলোই খাও, তবে তোমার যা ইচ্ছে যতটুকু ইচ্ছে তাই খেলেও আমি একটুও রাগ করব না।"
*****
যার সৌজন্যে বাড়ি আসা, এই আমাদের সেই ইরা, তিন্নি সায়কের যৌথ উদ্যোগ। ইরা অচেনা লোক দেখলে একটুও কাঁদে না, কোলে চড়তে ভীষণ ভালোবাসে আর ভালো না বাসলেও শান্ত হয়ে কুমড়োসেদ্ধ খায়। খেয়ে ইরার গায়ে ভয়ানক জোর হয়, তখন ইরা ঘনঘন ঊরু চাপড়ে সবাইকে মল্লযুদ্ধে আহ্বান জানায়। বলা বাহুল্য এখনও পর্যন্ত কারও কলজেয় কুলোয়নি সে চ্যালেঞ্জ অ্যাকসেপ্ট করে।
ahaha. darun darun. tomar lekha. kolkata ektuo bhalo na. Ira khub bhalo thakuk. may she win all the mollojuddho in days to come.
ReplyDeleteতোমার এই অসম্ভব সুন্দর আর কাজের শুভেচ্ছাটা যথাস্থানে পৌঁছে দেব, কুহেলি।
DeleteIra toh bhaaaari mishti.. khub khub ador pathalam..
ReplyDeletesob kichur moddhe dal, alubhaja, alu postoy bhoyanok lobh hocche. :)
Daruun laglo lekha pore.. khub bhalo hoyeche..
Indrani
ইরা সত্যি অবিশ্বাস্য মিষ্টি, ইন্দ্রাণী।
DeleteAha. Airport theke bari pherar rasta ta amaro pray ek. Mon ta hu hu kore uthlo.
ReplyDeleteIra naam ta ki bheeshon sundor. :)
নামকরণের কৃতিত্ব সায়কের, বিম্ববতী। এক রাস্তা, হাই ফাইভ।
DeletePatuli obdhi amaro same. Tarpor kamalgazi porjonto soja giye left turn niye sonarpur.
Deleteকী আর বলি, তীর্থ, পাটুলি থেকে কামালগাজি হয়ে বাঁদিক বেঁকে সোনারপুর আমরা এবারেই গেলাম, আরেকটা মুখেভাত খেতে। সবার রুট কেমন কমন পড়ে যাচ্ছে, দেখলেও মন ভরে যায়।
DeleteIsh, bhebechhilam beranor aar onushahantar ektu details pabo, peye dudher swad ghol e metabo, dum kore tumi alooposto tei sesh kore dile. Ira ke niye eto chhotto paragraph ! obichar noi ki ? ei prothom tomar lekha pore puro tripti pelam na. Ektu bishode lekha jeto na ki ?
ReplyDeleteইরার গল্প সামনাসামনিই জমবে, তিলকমামা।
Deleteইরা তো ভয়ানক কিউট। এই বয়সে পৃষাদেবীও এতটুকুই লক্ষ্মী ছিলেন, এখন একটা লম্বা ন্যাজ গজিয়েছে। কিন্তু ইরা নিশ্চয় লক্ষ্মীমেয়ে হয়েই থেকে যাবে।
ReplyDeleteসায়কের পিসেমশাই অভিজ্ঞ মানুষ, ইরাকে সারাদিন লক্ষ করে চিন্তিত মুখে বলেছেন, এ মেয়ে পরে ভোগাবে। এখন যে রেটে শান্ত, পরে অশান্তি গ্যারান্টি।
DeleteAha, namer motoi Ira boddo misti....ok onek ador janalam. :)
ReplyDeleteBari ferar description tao khasha, monta halka hu-hu kore uthhlo....
ইরা আর ইরার মামীর তরফ থেকে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, অরিজিত।
Deleteকি মিষ্টি গাবলু ! ওর খুব, খুউব ভালো হোক|
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, অন্বেষা।
Deleteইরা-র জন্য রইল অনেক আদর আর আশীর্বাদ। লেখাটা, অ্যাজ ইউজুয়াল, ক্ষীরকদম্বর মতোই।
ReplyDeleteআরে থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ, ঋজু। ইরা থ্যাংক ইউ বলছে আপনার আদর আর আশীর্বাদের জন্য, আর আপনি যে এই লেখাটাকে পৃথিবীর অন্যতম সেরা মিষ্টির সঙ্গে তুলনা করলেন, সে জন্য ইরার মামী নতজানু।
Deleteইরা তো ভারি লক্ষী মত ভালো মেয়ে।শান্ত হোক বা অশান্ত, শুধু নিজের আনন্দে বড় হোক - শুভেচ্ছা রইল।
ReplyDeleteতবে এ লেখাতে মন্তব্য করতে আসার কারণ কিন্তু ইরা নয়, ইরার দিদিমা।
"আমি বলি সবগুলোই খাও, তবে তোমার যা ইচ্ছে যতটুকু ইচ্ছে তাই খেলেও আমি একটুও রাগ করব না।"-- এরকম মা পাওয়া বড় ভাগ্যের ব্যাপার।
মন্তব্যের গোটাটার সঙ্গেই একমত, অস্মিতা।
DeleteOnekdin holo porchi kintu comment kora hocche na.. Ira ke dekhei or sathe khelte icche korche ...
ReplyDeleteইরা চমৎকার খেলার সঙ্গী, ঊর্মি।
DeleteEita pore utsahito holam, kintu tarpor porer lekhay chokh buliye bujhlam apnara fire gechhen. Amra patuli bypass er khub e kachhe thaki, porer bar ele barite asar onurodh roilo.
ReplyDeleteIra khub boro hok, bhalo hok, ar prithibi ke pisi (naki Masi) r Moto chokhe dekhuk.
আমন্ত্রণের জন্য অনেক ধন্যবাদ, শিবেন্দু। চেষ্টা করব নিশ্চয়। ইরার প্রতি আপনার শুভেচ্ছার জন্য অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা, এবং শেষের অংশটুকুর জন্য একই সঙ্গে কুণ্ঠাও। ইরার মামীর দৃষ্টি সব অর্থেই মারাত্মক মায়োপিক।
Deleteএত সহজ করে লেখ কি করে? ওই WESTWIND এর বিজ্ঞ্যাপন এ লেখা থাকত "18 minutes from Gariahat" !! জানলুম কী কোড়ে? আমি ঐ প্রোজেক্ট বিক্রির দায়িত্তে ছিলাম তো !!! :)
ReplyDeleteঅ্যাঁ! ছি ছি, ওয়েস্ট উইন্ড-কে নিয়ে হাসাহাসি করলাম বলে রাগ করলেন না আশা করি?
DeleteIra r jonye roilo onek Subhechha r bhalobasa. Darun misti chhobi tomader.
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, ইচ্ছাডানা।
DeleteIra ke anek ashirbaad. naam ta bhari mishti :) Bratati.
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, ব্রততী।
Deleteকমেন্ট করতে গিয়ে নিজেই নিজের আলসেমির বহর দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছি। বহুদিন ধরেই ভাবি, প্রতিটা পোস্ট পড়ি, ঘুরে ফিরে পুরোনো অবান্তর ও পড়ি প্রায়ই। শুধু কমেন্ট করতে গেলে রাজ্যের আলস্য ঘিরে ধরে। কৈফিয়ত দেওয়ার একটা অজুহাত ও নেই।
ReplyDeleteএই এতদিনের পোস্ট টা আবার পড়ছিলাম আজ। কিছু মনে না করলে একটা কথা জিগ্যেস করব? মানে খুব জানার ইচ্ছে। সাঁচির গেটের আদলে তৈরি তোমাদের বাড়িটা কি সাদা রঙের তিনতলা? গোল্ডেন রঙে সাঁচি স্তূপের আদল? আগের মাসে কিউ ব্লকে এক আত্মীয়ের বাড়ি গিয়েছিলাম। সকালে হাঁটতে বেরিয়ে সাঁচি স্তূপের আদলটা এতই স্পেশ্যাল লাগে, হাঁ গেটটার সামনে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম। জানি না অজান্তে তোমাদের বাড়িটার সামনেই গিয়ে হাজির হয়েছিলাম কিনা।
ময়ূরী
না, ওটা নাকতলার বাড়ি হওয়ার চান্স কম, ময়ূরী। ওখানে ব্লক নেই, কিউ ব্লক তো নেই-ই। তাছাড়া নাকতলার বাড়ি দোতলা আর গেটও সোনালি নয়।
Deleteঅবান্তরকে অবিচ্ছিন্ন মনোযোগ দেওয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
আবিষ্কারের সম্ভাবনায় উত্ফুল্ল হয়ে গেছিলাম প্রায়, নাহ দিল্লি দূর অস্ত ! ব্লকটা পাটুলির, পাটুলি মোড় আর সাঁচি স্তূপে অতিরিক্ত মনোযোগ দেওয়ার অত্যুত্সাহে নাকতলা বাদ পড়ে গেছে !
ReplyDeleteহাহা।
Delete