ঠাকুমার পুজো
এককালে আমরা অষ্টমীর রাতে ঠাকুর দেখতে বেরোতাম, একডালিয়া আর কলেজ স্কোয়্যার আর মহম্মদ আলি পার্কের মণ্ডপে ঢুকে ঠাকুর দেখে আসতাম, আর ক’বছর পরে এই সব গল্প লোকের কাছে করলে লোকে বলবে, দেখেছ, চিরকেলে বাঙাল, জমিদারি ফলাচ্ছে।
আমি জীবনে চল্লিশ মিনিটের বেশি কোনও প্যান্ডেলে লাইন দিইনি। রিষড়ার শুনশান প্যান্ডেলে তো না-ই, কলেজ স্কোয়্যার, কুমোরটুলি, বাগবাজার ইত্যাদি হেভিওয়েট পুজোতেও দিইনি। দিইনি আমি বিরাট বিপ্লবী বলে কিংবা এই সব পুঁজিবাদী আস্তিক বাগাড়ম্বরে আমার অরুচি আছে বলে নয়, দিইনি দিতে হয়নি বলেই। গেছি, প্যান্ডেলে ঢুকেছি, নমো করে বেরিয়ে এসেছি। একবার কলেজ স্কোয়্যারের পুকুরপাড়ে অনেকক্ষণ দাঁড়াতে হয়েছিল মনে আছে, তাও চল্লিশ মিনিটের বেশি কিছুতেই হবে না।
এইবার লোকে আমার এজ শেমিং করবে, পরশু অঞ্জন দত্তকে যেমন করলেন একজন। “আপনি যখন রঞ্জনা লিখেছিলেন স্যার, আমরা ইশকুলে পড়তাম, উঃ, জাস্ট ভাবা যায় না।” বলবে, সে তো তোমাকে এককালে সোমবার সোমবার মানডে টেস্টও দিতে হয়নি, ইনস্ট্যাগ্রামে অ্যাকাউন্টও খুলতে হয়নি, হাসি বোঝাতে অল ক্যাপস-এ লোল-ও টাইপ করতে হয়নি। তুমি লোলচর্ম হয়েছে বলে তো পৃথিবী থেমে থাকবে না। মান্ধাতার, থুড়ি, তোমার আমলে লাইন ছিল না বলেই এ আমলেও প্যান্ডেলের সামনে লাইন পড়বে না এটা কেমন যুক্তি?
আমি না হয় মান্ধাতা, অর্চিষ্মানকে জিজ্ঞাসা করলাম, “তুমি হায়েস্ট কতক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়েছ?” অর্চিষ্মান ভেবেটেবে বলল, “পঁয়তাল্লিশ মিনিট।”
বছরদুয়েক আগে টিভিতে দেখলাম শ্রীভূমি না কোন একটা পুজোর লাইনে একজন হাসি হাসি মুখে বলছেন, “এই তো সবে সাড়ে তিন ঘণ্টা হল।” আগের বছর নাকতলার বাবামা চতুর্থীর সন্ধ্যেবেলা বেরিয়ে জ্যামে তিনঘণ্টা দাঁড়িয়ে আধখানা ঠাকুরও না দেখে বাড়ি ফিরে এবার বুদ্ধি খাটিয়ে তৃতীয়ার দুপুরবেলা বেরিয়ে কয়েকখানা পুজোতে টিক মেরে এসেছেন।
হঠাৎ হল কী? কলকাতার জনসংখ্যা কি চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে গেল গত ক’বছরে?
একজন বললেন, “কলকাতার কেন হতে যাবে রামোঃ, মফস্বল থেকে পালে পালে পাবলিক আসে আজকাল শহরের ঠাকুর দেখতে, এ হচ্ছে তাদের ভিড়।”
অস্বস্তিকর নীরবতা কাটাতে একজন প্রস্তাব দিল চুসকি খেয়ে আসার।
অনেক বেরসিক আছেন, লাইন দিয়ে ঠাকুর দেখাকে ভয়ানক বেঁকা চোখে দেখেন। “কারা এরা? কী দেখে?”
আপনি যদি আশা করেন লোকে প্যান্ডেলে যায় দশ হাত, টানা চোখ, শুঁড়, কেশর, বীণা কিংবা বাবরি দেখতে, তাহলে অবাক হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি আপনাকে, ও সব কেউ দেখে না। এমনকি সবাই এক জিনিসও দেখে না। বিভিন্ন লোক বিভিন্ন জিনিস দেখে। বেশির ভাগ বড়রা অন্য বড়দের দেখে। প্যান্ডেলের গায়ে কাচের কাজ থাকলে চট করে নিজেকে দেখে নেয়। বেশিরভাগ ছোটরাই আই লেভেলে ইঁদুর, হাঁস, পেঁচা, সিংহ দেখে। অবশ্য ঢাক না বাজলে তবেই।
বাগপাড়ার পুজোয় একবার সরস্বতীকে মাখন জিনসের প্যান্ট পরানো হয়েছিল, শেয়ালদা স্টেশনের ভিড় হয়েছিল সেই প্যান্ট দেখতে। বাবামায়ের সঙ্গে বাঁশবেড়িয়ার তাঁদের এক সহকর্মীর বাড়িতে গিয়েছিলাম একবার, তাঁদের বাড়ির পুজো দেখতে। আর কে কী দেখছিল জানি না, আমি দেখছিলাম কড়িকাঠের নিচে টানা বারান্দার ওপর ইজিচেয়ারখানা। বাঁশের ঘন কাটাকুটি পিঠ আর বসার জায়গা, চকচকে কালো কাঠের গোলাপফুল খোদাই বর্ডার, হাতলটা কবজির কাছে রীতিমত চওড়া, চায়ের কাপ তো বটেই, মাস মার্কেট পেপারব্যাকও দিব্যি রাখা যাবে। আমাদের বাড়ির ফোল্ডিং কাঠামোর গায়ে ডুরিকাটা শতরঞ্চি পরানো ইজিচেয়ারের তুলনায় সে ইজিচেয়ার যেন রিকশাস্ট্যান্ডের শনিমন্দিরের তুলনায় তাজমহল।
বম্বেতে লোকে ঠাকুর দেখতে যায়, সে মুখে যাই বলুক না কেন, ফাঁকতালে রাণী মুখার্জিকে দেখতে। অনেকে অভিজিৎ ভট্টাচার্যের পুজোও দেখতে যান, কী দেখতে আমি শিওর নই। আমি এ বছর বম্বেতে ঠাকুর দেখতে গেলে অবশ্য ইরা ছাড়া কাউকে দেখতাম না। এ বছর ইরাও দেখছে পুজো। স্যাডলি, ভুলেও যাচ্ছে। না হলে জিজ্ঞাসা করা যেত, কী দেখল ও জীবনের প্রথম পুজোতে।
অগ্রদূত স্পোর্টিং-এ দুর্গার মুখ এবছর নাকি অবিকল শ্রীদেবী কাটিং বানিয়েছে, বাবামা সপ্তমীতে গিয়েছিলেন নিজের চোখে দেখতে। "সত্যি শ্রীদেবীরে সোনা", উত্তেজিত হয়ে বললেন দুজনেই। ছবিও তুলেছেন নাকি। পাঠাননি এখনও, না হলে আপনাদের দেখাতাম।
আমরাও বেরিয়েছিলাম সপ্তমীতে, নবপল্লীর প্যান্ডেলে অঞ্জন দত্ত, তস্য সুপুত্র নীল দত্তকে দেখতে। সে অভিজ্ঞতা অবান্তরে আসছে শিগগিরই। এই নবপল্লীতেই আমি ক্যাকটাসকে দেখেছিলাম, জুন মালিয়াকে দেখেছিলাম, সম্ভবত ভূমিকেও।
আশেপাশে সেলিব্রিটি না থাকলে আমি প্রধানত ঝাড়লণ্ঠন দেখি। আর দেখি পেডেস্ট্যাল ফ্যানটা কোনদিকে।
আমার ঠাকুমা গত বেশ কিছু বছর ধরে সিলিং ফ্যান ছাড়া আর কিছুই দেখেন না। আমার যে তেজস্বিনী ঠাকুমার গল্প আপনাদের শুনিয়েছি, যিনি ডাকাতদের ভয় পাওয়াতে ফাঁকা ঘরে গামবুট পরে হাঁটতে হাঁটতে জোরে জোরে বলতেন, “হ্যাঁরে তপন, বন্দুকটা হাতের কাছে নামিয়ে রেখেছিস তো?” তিনি আর সেই ঠাকুমা নেই। বা বলা উচিত ঠাকুমার নশ্বর শরীরখানা আমার সত্যিকারের ঠাকুমার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেনি। “যথেষ্ট হল, এবার ছাড়ান দাও ভাই” বলে শয্যা নিয়েছে। হাঁটাচলা তো অনেকদিনই চুকেছে, এবার গিয়ে দেখলাম কথাও প্রায় বন্ধ। ঘাড় নেড়ে সারেন। আমরা কিছুক্ষণ ঠাকুমাকে ঘিরে বসে আসর জমালাম, তারপর বাকি সবাই উঠে চলে গেল যে যার কাজে। কাঁহাতক আর মুখ বুজে বসে থাকা যায়, তাই আমি ঠাকুমার বালিশটা একটুখানি টেনে নিয়ে ঠাকুমার পাশে বডি ফেলে দিলাম। শুয়ে শুয়ে মোবাইলে ইন্টারনেট সার্ফ করতে লাগলাম, অবান্তরে পাহারা চালু রাখলাম। ঠাকুমা তাঁর রোগা হাতখানা দিয়ে আমাকে ছুঁয়ে রইলেন।
আমাদের দুজনের দুজনকে যা বলার বলা হয়ে গেল, যা বোঝার বোঝা হয়ে গেল।
নরম দেখে, ছাপা পাড়ের একটা নীল পাড় সাদা শাড়ি আমাদের নাম করে কিনে রেখেছিলেন মা, ষষ্ঠীর দিন সকালে ব্যায়াম, স্নান হয়ে যাওয়ার পর সেটা জড়িয়ে ঠাকুমাকে বসিয়ে দেওয়া হল। ঠাকুমা এমনি বসতে চান না মোটে আজকাল, সেদিন বসে রইলেন। চা বিস্কুট খেলেন। খানিকক্ষণ পর গরম লাগছে কি না, শাড়ি বদলে দেওয়া হবে কি না জিজ্ঞাসা করতে ঘাড় নেড়ে জানালেন, না। একটু পরে বাবা পাশে এসে বসে জিজ্ঞাসা করলেন, "নতুন শাড়ি?" ঠাকুমার ঘাড় ওপর নিচে নড়ল।
“কে দিয়েছে?”
উত্তর নেই। বাবা আশাও করেননি। এ সব প্রশ্ন স্রেফ করার জন্য করা। স্বাভাবিক কথোপকথনের ভঙ্গি করার জন্য। ঠাকুমাকে বুঝিয়ে দেওয়া যে তাঁর উত্তর ফুরোলেও, আমাদের অনেক প্রশ্ন বাকি রয়ে গেছে এখনও।
একটু বাদে ঠাকুমার গলা দিয়ে একটা ঘরঘর শব্দ বেরোলো। বাবা ঠাকুমার দিকে তাকালেন, আর বাবার চোখে চোখ রেখে ঠাকুমা স্পষ্ট গলায় বলে উঠলেন, “সোনা দিসে।”
শুনে থেকে সব ফেলে ঠাকুমাকে দেখতে চলে যেতে ইচ্ছে করছে।
শেষ লাইনটা। স্রেফ এই শেষ লাইনটার জন্যই লেখাটার সারা গায়ে শিউলির গন্ধ, বিজয়ার সিঁদুর, আর ভাসানের বিষাদ লেগে গেল।
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, ঋজু। বিজয়ার শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা নেবেন।
DeleteAmar thakuma k icche korleo dekhar upay nei 1.5 bochor holo... Tomar thakuma sosthir din sokaler Moto Khusi thakun Sara jibon ... Aj to doshomi.. Berate kothay cholle?
ReplyDeleteকোথাও যাইনি রে, ঊর্মি। চট করে যাওয়া হবে মনে হচ্ছে না। দেখি বছরের শেষের দিকে কিছু প্ল্যান করা যায় কি না। আমার বিজয়ার অনেক শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা নিস।
DeleteThakumar golpo shunlei amar protyek bar kanna kano paye kano paye.
ReplyDeleteBijoyar pronam nio tomra sobai Kuntala di. Onek bhalobasa Ira'r jonno.
তুমিও আমার বিজয়ার অনেক শুভেচ্ছা, ভালোবাসা আর কোলাকুলি নিয়ো, কুহেলি। ইরার তরফ থেকেও হাই ফাইভ রইল।
DeleteKichhu kaj ektuo fele rakhte nei...amar nijer exp ...
ReplyDeleteএটা একদম খাঁটি কথা বলেছেন, শিবেন্দু। দেখি...
DeleteThakuma-ra thaake na :(
ReplyDeleteসত্যি, অর্পণ। আর এই না থাকাটা যে কী খারাপ।
Deleteআমাদের দুজনের দুজনকে যা বলার বলা হয়ে গেল, যা বোঝার বোঝা হয়ে গেল। -- বড় ভালো লাগলো ।
ReplyDeleteএকটা অযাচিত সাজেশন , ঘুরেই এসো পারলে একবার...
না না, ঠিকই তো বলেছ প্রদীপ্ত। দেখি, চেষ্টা করে...
Deletemon udas kora lekha..bhalo bhalo..
ReplyDeleteprosenjit
থ্যাংক ইউ, প্রসেনজিৎ।
Deletemon ta kharap holo kintu lekha ta boro bhalo- Bratati.
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, ব্রততী।
Delete