ঝালমুড়ি আর চাঁদ



ঝালমুড়ি খাওয়া আর এমন কী শক্ত ব্যাপার, বলবেন আপনারা। যাও, অর্ডার দাও। দাম জিজ্ঞাসা করতেও পার, আবার দাম নিয়ে মাথা একেবারে না-ই ঘামাতে পার কারণ প্রোহিবিটিভ দাম হওয়ার জন্য ঝালমুড়ি না খেতে পেয়ে ফিরে আসতে হবে, সে রকম হওয়ার সম্ভাবনা কম। 

প্রোহিবিটিভ দাম হলেও যে সব ক্ষেত্রে ফিরে আসা যায় এমন নয়।  সি আর পার্কের মোটামুটি সব তরিতরকারিওয়ালাই ডাকাত, কিন্তু একজন আছেন ডাকাতদলের সর্দার। তাঁর দাম শুনে কেউ অবাক হলে তিনি আরও অবাক হয়ে বলেন, “এ কি দিল্লির পচা মাল পাইসেন নাকি? আমার কাছে যা দ্যাখতাসেন সব কলকাতার।” এই সর্দারের কাছ থেকে আমি পঁচাত্তর টাকা দিয়ে একবার একখানা ফুলকপি কিনেছিলাম। আমারই দোষ হয়েছে, দাম জিজ্ঞাসা না করে ফুলকপি দিতে বলেছি। আরও কী সব নিয়েছিলাম সঙ্গে, আলু পটল লালশাক। টোটাল শুনে চোখ কপালে তোলাতে ডাকাতসর্দার হেসে হেসে বললেন, “কপিটাই তো পঁচাত্তর।” আমি মুখ বুজে ফুলকপি নিয়ে বাড়ি চলে এলাম, আর পরদিন আলু দিয়ে তরকারি রাঁধার সময় ভাবতে লাগলাম, কপিটা দেখতে কিন্তু ভালো, ফটফটে ফর্সা, ঠিক বিগ বাজারের অ্যাডের মতো। সস্তা কপি হলে হয়তো দাগটাগ থাকত। খেতে বসে ক্রমাগত বলে চললাম, “কপিটার টেস্ট কিন্তু ভালো, বল? ধাপার মাঠের রিয়েল ফুলকপির মতো খেতে। তাই না? তাই না?” বলতে বলতে প্রায় যখন গলা বুজে এসেছে, চোখে জল আসে আসে, অর্চিষ্মান বলল, “ওরে বাবা কুন্তলা, কিছু ক্ষতি হয়নি পঁচাত্তর টাকার ফুলকপি কিনে। এখন শান্তিতে খাও তো।” 

(“শান্তিতে খেতে দাও তো” বলেনি কিন্তু, ও রকম করে কখনও বলে না অর্চিষ্মান, ভীষণ ভদ্র ছেলে।)

অত গায়ে লাগলে ব্যাগ থেকে কপি বার করে বাড়ি চলে আসাই উচিত ছিল, সাধ্যে না কুলোলে বা অযৌক্তিক খরচ মনে হলে হাত তুলে চলে আসাই আমার নীতি, কিন্তু আমি ডাকাতসর্দারের ক্ষেত্রে সেই নীতি কখনও প্রয়োগ করে উঠতে পারিনি। এঁর পার্সোন্যালিটিই আলাদা। আরেকদিন টোটাল দাম শুনে ঢোঁক গিলে জিজ্ঞাসা করেছি, “এই যে করলা, থুড়ি, কলকাতার করলাগুলো নিলাম, দাম কত?” সর্দার টং থেকে ভুরু কুঁচকে গর্জন করলেন, “এহন জিগায়া কী হবে? দিয়া দিসি তো।” আমি নার্ভাস হয়ে গিয়ে বললাম, “না না, এমনিই জিগাচ্ছি আরকি।”

প্রোহিবিটিভ দামের জন্য একেবারেই যে কিছু ব্যাগ থেকে বার করাইনি তা নয়। ওই সর্দারের দোকানেই করেছি। সর্দার ছিলেন না, তাঁর চ্যালা ছিল। আমিও নরম মাটি পেয়ে আঁচড়ালাম। কাঁচা আমের সিজন ছিল। বেশ কিছুদিন ধরে অর্চিষ্মানের কাঁচা আমের চাটনির কথা মনে পড়ছিল। সর্দারের দোকানের ঝুড়িতে ঢিবি করে কাঁচা আম রাখা ছিল। তাদের সবুজ রঙে সর্দারের দোকানের টিউবলাইটের আলো পিছলে যাচ্ছিল। টাকা দিয়ে চলে আসার আগে কী মনে হল, আম দু’খানার দাম জিজ্ঞাসা করলাম। একশো তিরিশ বা তার কাছাকাছি কিছু একটা। আমি চ্যালাকে দিয়ে ওই জোড়া কাঁচা আম ব্যাগ থেকে বার করিয়ে টাকা ফেরত নিয়েছিলাম। তারপর সফল-এ এসে একজোড়া আম কিনেছিলাম আঠেরো টাকায়। একশো আঠেরো নয়, জাস্ট আঠেরো। হ্যাঁ, সবুজ অত সতেজ ছিল না, চামড়া কুঁচকেও গিয়েছিল জায়গায় জায়গায়। কিন্তু চাটনি বানানোর পর কিচ্ছু টের পাইনি। 

ঝালমুড়ির ক্ষেত্রে এমন হওয়াটা একটু শক্ত। কত আর বেশি দাম হবে। দশের জায়গায় পনেরো। শুনে হয় আপনি চুপ করে থাকবেন বা তেমন স্মার্ট হলে সঙ্গীকে বা সঙ্গীর অভাবে দোকানদারকেই বলবেন, “আমাদের ছোটবেলায় এসব দু’টাকায় খেয়েছি। ঠোঙার সাইজও ছিল ডবল।” আর কেউ কেউ থাকবেন বলবেন, “এগুলো আর বাড়িতে বানাতে কী, মুড়ি নাও, সর্ষের তেল নাও, চাট মশলা, ভাজা মশলা, একটু সেদ্ধ ছোলা আর কাবলি, সেদ্ধ আলু, ব্যস হয়ে গেল, ঝালমুড়ি। হ্যাঁ, কাঁচালংকাগুলো একটু মিহি করে কুচোতে হবে। ব্যস। বাঙালি ডি আই ওয়াই করবে না, খালি দাম দাম বলে চেঁচালে হবে?”

আমি অলমোস্ট গ্যারান্টি দিতে পারি এই শেষ দলের লোকেরা জীবনে দু’বারের বেশি রান্নাঘরে ঢোকেননি। চোখে দেখে কাবলি ছোলা আর অড়হর ডালের তফাৎ বলতে পারবেন না। 

চেনা ঝালমুড়িওয়ালা হলে তো আরওই মজা। দাঁড়িয়ে অর্ডার দেওয়ারও দরকার নেই, যেতে যেতে বলে যাও, “দুটো প্যাক করে রাখুন দাদা প্লিজ, আমি ফুলকপি কিনে আসছি।”  দুটো মুড়ির একটায় যে ঝালনুন নর্ম্যাল, আরেকটায় যে দুটোই অ্যাবনর্ম্যালি বেশি আর নারকেল বাদ, এসব ওঁদের মুখস্থ হয়ে গেছে। 

তাই যখন দেখলাম দাদা নারকেল ফালি তুলেছেন হাতে, অবাক হলাম। দাদার মুখটা যেন কেমন উদাস উদাস। সারাদিন অন্যত্র যে কাজে যান দাদা, হয়তো সেখানে কোনও মনোমালিন্য হয়েছে। হয়তো কেউ কড়া গলায় কথা বলেছে। হয়তো ছেলেমেয়ের রেজাল্ট ভালো হয়নি। হয়তো পুজোয় কিনে দেওয়া নতুন জুতো অলরেডি ছিঁড়ে ফেলেছে। হয়তো স্ত্রীর কাশিটা যাচ্ছে না। হয়তো দেনা জমে গেছে অনেক, খাতক তাগাদা দিচ্ছে। হয়তো মায়ের ক্যান… 

স্টপ। জাস্ট স্টপ। নিজের কল্পনাকে জোর ধমক দিলাম। তারপর আস্তে করে বললাম, “নারকেল লাগবে না দাদা।” 

দাদা আমার মুখের দিকে তাকালেন। গোঁফের ফাঁকে হাসি ফুটল। “ওহ। লবণ একটু বেশি যাবে তো?” 

দাদা কবজি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মুড়ি মাখতে লাগলেন। চারপাশে অন্যান্য দিনের থেকে বেশি ভিড়। তবে কালকের থেকে কম। নাড়ু, ফুলের মালা, মঠ, কদমা, নারকেলের আজ ভাঙা হাট। আজ কিনছে যারা অগোছালো, কোনও কিছুই সময়ে করে উঠতে পারে না, কিংবা ভাঙা হাটে কম দামে জিনিস পেলে যাদের সুবিধে হয়। অনেক বাড়িতে হয়তো পুজো হয়েও গেছে। রিষড়াতেই টুকাইদা পুজোতে বসে গেছে খবর পেয়েছি। একটু বাদে ঘণ্টা নেড়ে উঠে পড়লেই নাড়ু, নিমকি, মঠ, কদমা, চালমাখা, ডালমাখা, সন্দেশ নিয়ে আপ্যায়নে নামবেন মা আর বিজলিদি। আর আমি তখন নাপতোল চালিয়ে ঝালমুড়ি চিবোব। 

আমার মুখটাও দাদার মতো উদাস হয়ে গেল। দাদা মুড়ি মাখতে মাখতে মাঝে মাঝে মুখ তুলে সামনের আকাশের দিকে তাকাচ্ছেন। অন্যদিন যেমন সম্পূর্ণ মনোযোগ স্টিলের ক্যানের স্থাপিত করে স্টিলের হাতা ঘুরিয়ে মুড়িতে ঝড় তোলেন, আজ দাদার তেমন মনোযোগ নেই।

একজন আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। ছ’ফুট লম্বা, দেড়ফুট চওড়া। এঁকে আমি চিনি, মানে দেখেছি। রোগা হওয়ার চেষ্টা করছেন বোধহয়। দাদার কাছ থেকে স্প্রাউট চাট নিয়ে এগরোলের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে করুণ মুখে খান। দাদার মুড়ি বানানো শেষ। ঠোঙাদুটোর মুখ যত্ন করে মুড়ে ঘুগনির ডেকচির ঢাকনার ওপর রেখে স্প্রাউটের বাটির গামছাঢাকা সরিয়ে অঙ্কুরিত ছোলা তুলবেন বলে দাদা হাত মুঠো করলেন, আমি ঠোঙাদুটো ব্যাগে পুরে পেছন ফিরে ব্যাগের চেন টানতে টানতে মুখ তুললাম, বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। 

ওটা কী? কৃষ্ণা এস্টেটের ব্যানারের ওপারের ঝাঁকড়া গাছটার মাথার মারাত্মক কাছে, আকাশের গায়ে ওটা কী? আমাদের চেনা চাঁদ? এত গোল? এত বড়? এত জ্যান্ত যেন অল্প অল্প দুলছে?

চাঁদটা দেখতে দেখতে হাঁটব বলে বাঁদিকের শর্ট রাস্তায় না গিয়ে সোজা রাস্তা ধরলাম। চাঁদও তাকিয়ে রইল আমার দিকে। আর আমার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা দাদার দিকেও। চাঁদের চোখে চোখ রেখে হাঁটতে হাঁটতে আমি মনে মনে প্রার্থনা করলাম, রোগ নয়, শোক নয়, দুঃখ নয়, কষ্ট নয়, দাদার অমনোযোগের জন্য একমাত্র দায়ী যেন হয় কোজাগরীর চাঁদ। 


Comments

  1. Aha, Aha.....sesher duto paragraph puro, mane, ki r bolbo....:)
    Baki ta niyeo kichhu bolar nei. "Orebaba Kuntala..." - ta just onobodyo.

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, থ্যাংক ইউ, অরিজিত। ওরে বাবা-র প্রকোপ আমাদের বাড়িতে তো জানেনই।

      Delete
  2. Ekdom thik likhechen. Oi chand tai joto gondogol er mul.

    ReplyDelete
  3. eto bhalo choto galpo onek din por pelam.oshadharon hoeche.

    prosenjit

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, প্রসেনজিৎ।

      Delete
  4. আপনি না, মানে, ডেঞ্জারাস লোক! লেখাটা পড়ার ফাঁকে আমিও প্রাণপণে ভেবে চলেছি, কী হতে পারে যা দিল্লির দোর্দণ্ডপ্রতাপ দাদা-র দিল-কে দোদুল্যমান করেছে। তখন অমন দুম করে চন্দ্রাহত করে দিলেন!
    লেখাটায় কিন্তু, বেশ একটা, জলপাইয়ে ঝালনুন এফেক্ট এসেছে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. "জলপাইয়ে ঝালনুন" উপমাটা দারুণ তো! টুকে নিলাম। থ্যাংক ইউ, ঋজু।

      Delete
  5. Lakshmipujo special....sesher koekta line bhari bhalo laaglo.

    Tabe bakitao sundar specially sabjiwalar jaigata...

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ, সুস্মিতা।

      Delete
  6. Darun darun..
    aksho tirish takaye duto aam shune jhotka khelam ektu

    ReplyDelete
    Replies
    1. বাড়িয়ে লিখিনি কিন্তু কুহেলি, ওইরকমই করেন এঁরা।

      Delete
  7. Climax e chomok ta kojagori chaand er motoi sundor hoyeche.. Dakat doler sordar ta chaand dekhe udas hoye daam komak sei Asha Kori..

    ReplyDelete
    Replies
    1. চাঁদের অত ক্ষমতা নেই, ঊর্মি।

      Delete
  8. pujobarshiki desh ar anandabajar er oti akhyadyo golpo gulo porar por mukhta charlo .. thank you!

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, থ্যাংক ইউ, কাকলি।

      Delete
  9. “এহন জিগায়া কী 'হবে' ?" কি ভেজাল বাঙাল রে বাবা ! আমি অবশ্য ঝালমুড়ি, ফুচকা, চুড়মুড় ইত্যাদি জাতীয় খাদ্য খাই না ( শতেক গঞ্জনা সত্ত্বেও খাই না ) । একটা দুর্দম প্রপঞ্চময় চাঁদের আশায় পরশু হাপিত্যেশ ক'রে বসেছিলাম, ততোধিক দুর্দম একঝাঁক মেঘ তা'তে গ্যামাক্সিন ঢেলে দিয়েছে । :-/

    ReplyDelete
    Replies
    1. ভেজালত্বের দায় আমি নিচ্ছি, সন্ময়। আমার ভাষাজ্ঞান খুবই খারাপ। ভুল ধরিয়ে দেওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।

      গঞ্জনার সামনে মাথা না নোওয়ানোর জন্য অভিনন্দন।

      Delete
  10. ঢাকাইয়া হ'লে সর্দার "কী হইবো" বলতেন। কাউকে কাউকে "কী অইবো " বলতেও শুনেছি। কিন্তু এই সর্দারেরা এইরকম দাম কেন হাঁকেন সেটাই বোধগম্য হচ্ছে না। কেউ এনাদের কিছু বলে না?

    ReplyDelete
  11. আহা, বড় ভাল লিখেছ। 😊

    সি আর পার্কের ডাকাতদল সাঙ্ঘাতিক। একবার হাজার টাকা দিয়ে কাজলী মাছ কিনেছিলাম। তারপর নাকে কানে খৎ দিয়েছি, সব্জিপাতি সব আমাদের পাড়া থেকেই কিনি। (তোমার মত আমারই ভুল। নেওয়ার আগে দাম জিগ্যেস করিনি)।

    ReplyDelete
    Replies
    1. সিরিয়াসলি, বিম্ববতী। সি আর পার্কের ডাকাতদের কথা যত কম বলা যায় ততই ভালো।

      Delete
  12. ebar to jhalmuri khete ichhe korchhe. kal banale hoy ...
    chand diye seshtuku khub bhalo laglo.
    Bratati.

    ReplyDelete
    Replies
    1. বানিয়ে ফেলো, ব্রততী। শনিবার স্পেশাল।

      Delete

Post a Comment