বার্লিন
বার্লিনে দু’সপ্তাহ
থাকার কথাটা শুনে স সিগারেটে টান দিয়ে বলেছিল, মোটে পনেরো দিন? আমি হলে সারাজীবন
থাকার ব্যবস্থা করে ফেলতাম।
সিরিয়াসলি?
প্যারিসের থেকেও ভালো?
প্যারিস? ধুস্।
ওয়েল, প্যারিস ঠিকঠাক। সুপারমডেল গোছের। চোখ ধাঁধিয়ে দেবে। আর বার্লিন হচ্ছে পাশের
বাড়ির প্রথম প্রেম। পনেরো বছর অদেখার পরেও মনে পড়লে বুকে চিনচিন ব্যথা করবে।
স-এর অবশ্য খানিকটা
বাড়িয়ে বলার বাতিক আছে। ভালোকে অভূতপূর্ব, চলনসইকে পাতে দেওয়ার অযোগ্য, খারাপকে
যমের অরুচি। কাজেই আমি বিশেষ কলকে দিইনি। কিন্তু তা বলে কি আর একটুও দিইনি? যেন
উত্তর না জানলেও আমার কিছু এসে যায় না, এমন ভাব করে কফি খেতে খেতে টিমোকে জিজ্ঞাসা
করেছিলাম বার্লিন ওর কেমন লাগে। টিমো পা দোলাতে দোলাতে বলেছিল, কেমন আর লাগবে। বড়
শহর যেমন হয়। বিরক্তিকর। তার থেকে আমার বন ঢের ভালো।
কাজেই শনিবার দুপুরে
যখন বাকিদের সঙ্গে বার্লিনের ট্রেনে চেপে বসলাম তখন আমার মন একেবারে কেষ্টদার
দোকানের শূন্য দাঁড়িপাল্লার মতো হয়ে ছিল। হতাশা, প্রত্যাশা কোনওটাই ছিল না। জানালা
বেছে গল্পের বই খুলে বসেছিলাম। এখানে জুনের শুরুতে একটা বেমক্কা বৃষ্টির পর
রেলব্যবস্থা সামান্য টলেছে, যেটা এখনও ঠিক হয়নি। বন থেকে বার্লিন ট্রেনে করে যেতে
এমনিতে লাগে ঘণ্টা পাঁচেক, এখন লাগছে ছয়। ছ’ঘণ্টার রাস্তায় একটা স্যান্ডউইচ, এক
প্যাকেট এম অ্যান্ড এম আর দুটো কফি খেলাম, কুকু’স কলিং শেষ করলাম, সামনের সিটের
ফ্রিৎজের সঙ্গে আলাপ করলাম (সে গল্প পরে আসছে।) সন্ধ্যে ছ’টায় বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে বার্লিন স্টেশনে নেমে
দেখলাম স্টেফানি আর শার্লটে আমাদের অপেক্ষায় হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে।
বাসে চেপে হোটেলে
আসা হল। মাথার ভেতর কথাটা ঘুরছিল অনেকক্ষণ থেকে। পাশে বসা শার্লটেকে জিজ্ঞাসা
করলাম, আচ্ছা আমাদের হোটেলটা কি ভূতপূর্ব ইস্ট না ওয়েস্ট বার্লিনে? শার্লটে বলল,
ইস্ট।
আচ্ছা।
আচ্ছা, এই যে
রাস্তাটা দিয়ে এখন যাচ্ছি এটা কোনদিকে ছিল? ইস্ট না ওয়েস্ট?
শার্লটের কপাল ভালো
যে আমাদের হোটেলটা বার্লিন হপ্টবানহফ থেকে বেশি দূরে নয়। চেক ইন করে, হাত-পা ধুয়ে
বাবামাকে (আর আপনাদেরও) দেখাব বলে, ঝটপট কয়েকটা ছবি তুলে ফেললাম। বার্লিনের অফিসের
লোকেরা আদর করে ডিনারে নিয়ে গেল। টুনফিশওয়ালা পিৎজা অর্ডার করেছিলাম আমি, আর লাইট
কোলা। খেয়ে এসে কোনওমতে জামাকাপড় ছেড়ে সেই যে শয্যা নিলাম, ঘুম ভাঙল রবিবার সকাল
সাতটায়।
হোটেলে ব্রেকফাস্ট
করে শহরদর্শনে বেরোনো হল। আড়াইঘণ্টার ঝটিকাসফর। কাজেই একটা ছোট্ট ডিসক্লেমার দিয়ে
রাখি। যা দেখেছি, সব চলন্ত বাসের ভেতর থেকে। দেখলেই বুঝতে পারবেন বেশিরভাগ ছবিও
বাসের জানালার এপার থেকে তোলা। সামনের উইকএন্ডে কিছু কিছু জায়গায় সময় নিয়ে একা
যাওয়ার ইচ্ছে আছে। দেখা যাক সুযোগ হয় কি না।
বার্লিনে
শনিবার সন্ধ্যেবেলা নেমেই যেটা চোখে পড়েছিল সেটা হচ্ছে ক্রেন। আকাশ জুড়ে হলুদ
ক্রেনের ছড়াছড়ি। বার্লিন এখনও তৈরি হচ্ছে। বার্লিন এখনও জুড়ছে, বাড়ছে, সারছে।
ক্ষমতার সঙ্গে পরিচয়
বার্লিনের আজকের নয়। সতেরশো সাল থেকে শুরু করে এই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়া
পর্যন্ত বার্লিন ছিল বিভিন্ন শাসকের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। প্রাশিয়া, জার্মান,
তৃতীয় রাইখ। যে রাজাই এ অঞ্চলে রাজত্ব করেছেন, রাজধানী বসানোর জন্য বার্লিনের থেকে
ভালো শহরের কথা তাঁর আর মাথায় আসেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর বার্লিনের
এতশত বছরের রাজধানীর গরিমা ছোঁ মেরে নিয়ে গেল বন। বন, ফ্রাংকফুর্ট,
কোলোন---ফুলেফেঁপে উঠল। জনসংখ্যা বাড়ল। রিয়েল এস্টেটের দাম হুহু করে বাড়ল। বহুতল
উঠল। ইউ এন এসে অফিস খুলে বসল। আর এদিকে দু’আধখানা হওয়া বার্লিন বসে রইল যুদ্ধের
ধ্বংসস্তুপ বুকে নিয়ে।
আমাদের বাস ভূতপূর্ব ইস্ট বার্লিনের রাস্তা ধরে এঁকেবেঁকে চলল। রাস্তার পাশে পাশে ধূসর অট্টালিকার সারি, ইস্ট বার্লিনের রংহীনতার নীতির সাক্ষ্য দিচ্ছিল। গাইড তো ছিলেনই, তাছাড়াও পাশে বসে আমার লক্ষলক্ষ প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত অ্যামবাসাডর হের ওয়েস্টডিকেনবার্গ। পঁয়ত্রিশ বছর ধরে, প্রথমে পশ্চিম জার্মানি পরে যুক্ত জার্মানির বিদেশমন্ত্রকে কাজ করেছেন। হেরের সঙ্গে আমার আলাপ বন থেকেই জমে উঠেছিল। তার কারণ এই নয় যে জার্মানির বিদেশনীতি নিয়ে আমার খুব গভীর কিছু বলার আছে। তার কারণ হচ্ছে আমাদের দুজনের পদবীর দৈর্ঘ্যজনিত মিল। বনে প্রথম মিটিং-এর প্রথম কফিব্রেকেই টেবিলের মাথা থেকে উঠে এসে আমার সামনে রাখা BANDYOPADHYAY ট্যাগের দিকে আঙুল দেখিয়ে হের ওয়েস্টডিকেনবার্গ জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “হাউ ডু ইউ সে দ্যাট?”
ঘুরতে ঘুরতে বাস এসে থামল ব্রান্ডেনবুর্গ তোরণের
সামনে। আমাদের যেমন অকটারলোনি, দিল্লির যেমন ইন্ডিয়া গেট, বার্লিনের তেমন
ব্রান্ডেনবুর্গ। ছুটির দিন বলেই কি না জানি না, জায়গাটা মেলার মতো চেহারা নিয়েছিল।
টুরিস্ট আর ডি এস এল আরের ভিড়ের চোটে হাঁটাচলা করা মুশকিল। তার মধ্যে ঘোড়ার গাড়ি,
হিপহপ নাচিয়ের দল, সাইকেলে চাপা ব্রেজেল-বিক্রেতা, সব মিলিয়ে হইহই কাণ্ড রইরই
ব্যাপার। পাঁচমিনিটের বেশি মনখারাপ করে থাকা যায় না। প্রচুর ছবি তুলে এবং তুলিয়ে
আমরা আবার বাসে চেপে বসলাম। ঘড়ি ঘোড়ার মতো ছুটেছে, বাকি বার্লিনও ঘুরে দেখতে হবে
তো।
বাস চলল। বাসের ভেতর বসে বার্লিনের গল্প শুনতে শুনতে
আমরা চললাম। বার্লিনের ভেতর এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে গেলে বিশ্বাস করা শক্ত হবে
যে এটা প্রায় সাড়ে তিন মিলিয়ন লোক বসবাস করা একটা শহর। শহরের এক-তৃতীয়াংশ জুড়ে আছে
দু’হাজারেরও বেশি সবুজ পার্ক, জঙ্গল, মাঠ, লেক। সব মিলিয়ে বার্লিন সত্যিই
চ্যাম্পিয়ন শহর। (কুইজ নম্বর একঃ সব মিলিয়ে আর কোন্ শহর চ্যাম্পিয়ন বলুন দেখি?)
এই হচ্ছে জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেলের বাড়ি আর বাড়ির সামনের রাস্তা। রোজ সকালে দু'টো পুলিশের গাড়ি এসে ফ্রাউ মার্কেলকে অফিসে নিয়ে যায়।
এইটা হচ্ছে জার্মানির পার্লামেন্ট, রাইখস্টাগ। বাড়িটা প্রথম বানানো শুরু হয়েছিল আঠেরোশো একাত্তর সাল
নাগাদ। তখন ছোটছোট রাজ্য মিলে ‘জার্মানি’ বলে একটা দেশ সবে তৈরি হয়েছে। বাড়ির
ডিজাইন ঠিক করতে প্রায় একশো স্থপতিকে কমপিটিশনে নামতে বলা হল। তাতেও সমাধান হল না।
জমি কেনা, ডিজাইন ঠিক করা ইত্যাদি নিয়ে ঝগড়া করতে করতে কেটে গেল আরও দশটা বছর।
ঝগড়া মিটলে আবার স্থপতিদের কমপিটিশন। এবার একশোর বদলে দুশো প্রতিযোগী। উনিশশো
বাইশে বাড়ি বানানো শেষ হল। বাড়ির মাথায় বড় বড় করে “ডেম ডয়েশেন ভোল্কে” (To German People) লিখে পার্লামেন্টের কাজ
শুরু হয়ে গেল।
কিন্তু বেশিদিন গেল না, উনিশশো তেত্রিশ সালে এক ভয়ংকর আগুন লাগল রাইখস্টাগে।
সে আগুনে বাড়ি তো পুড়লই, জার্মানির ভাগ্যও পুড়তে শুরু করল বলাটাও খুব নাটকীয় হবে
না। নাৎজিরা দাবি করল, এ সব কমিউনিস্টদের চক্রান্ত, কাজেই তাদের গণশাস্তি
দেওয়া হোক। হলও। হাজার হাজার কমিউনিস্টদের ধরে ধরে জেলে পোরা হল। রাইখস্টাগ ফায়ার
ডিক্রি জারি হল। আর শুরু হল জাতীয় নিরাপত্তার ধুয়ো তুলে সিভিল রাইট্সের একে একে
হাপিস হয়ে যাওয়া।
তারপর বাধল যুদ্ধ। আগুন খানিকটা ক্ষতি করেছিল, বাকিটা করল এরোপ্লেন থেকে উড়ে
আসা বোমা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ার রেড আর্মির ফেভারিট টার্গেট ছিল রাইখস্টাগ।
রাইখস্টাগ ফায়ারের সময় আমাদের সঙ্গে কী করেছিলে মনে আছে? এবার দেখ আমরা কী করি।
পার্লামেন্টের ভেতরের করিডরের একটা অংশে এখনও রাশিয়ান সেনাদের হাতে লেখা
দেওয়াললিখন আছে। আগুনে ঝলসানো দেওয়ালে কালো কালিতে কেউ নিজের নাম লিখেছে, কেউ
লেনিনগ্রাদের কথা, কেউ প্রতিশোধের শপথ। কেউ প্রেমিকাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছে, কোনও
চিন্তা নেই, সে শিগগিরি বাড়ি ফিরে আসবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন শেষ হল তখন রাইখস্টাগ শুধু একটা ধ্বংসস্তুপ ছাড়া আর
কিছু না। সারানোর টাকা কোথায়? সত্যি বলতে সেটাকে সারানোর দরকারও ছিল না আর কারণ
পার্লামেন্ট ততদিনে বার্লিন ছেড়ে বনে রওনা দিয়েছে। রাইখস্টাগ তার প্রকাণ্ড ঝলসানো
শরীর নিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। কবে বুলডোজার নিয়ে লোক আসে। জার্মান বাড়ি বলে কথা,
সহ্যশক্তির অভাব আছে এ কথা শত্রুতেও বলতে পারবে না।
অপেক্ষা বৃথা গেল না। কখনওই যায় কি? উনিশশো ছাপান্ন সালে কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত
নিলেন, ভাঙার দরকার নেই বরং রাইখস্টাগ সারানো হোক। আবার স্থপতিদের কমপিটিশন ডাকা
হল। আবার কাজ শুরু হল। আবার থামল। আবার সবাই বলল, কেন মিছে এই জঞ্জালের ওপর পয়সা
খরচ করা। বার্লিন দেওয়াল উঠল। দেওয়াল ভাঙল। উনিশশো নব্বই সালে যখন বিভক্ত জার্মানি
এক হল আর এত কষ্টের রিইউনিফিকেশন সেরিমনি পালন করার উপযুক্ত ভেনু খুঁজে বার করার
কথা উঠল, তখন সবার মনে পড়ে গেল। কেন, আমাদের রাইখস্টাগ আছে তো।
উনিশশো নব্বইয়ের তেশরা অক্টোবর, প্রবল ঘটা করে, বার্লিনের অন্ধকার আকাশ বাজির
আলোয় ঝলসে দিয়ে রিইউনিফিকেশন হল। একদিনের জন্য বার্লিন আবার জার্মানির রাণী,
রাইখস্টাগ আবার জার্মানির পার্লামেন্ট। সে রাতের শোভা দেখেই সকলের মন ঘুরেছিল
বোধহয়। অনেক আলোচনা আর বাদানুবাদের পর উনিশশো একানব্বইয়ের বিশে জুন, যৌথ জার্মানির
বুন্ডেস্টাগ (পার্লামেন্টের লোয়ার হাউস) সিদ্ধান্ত নিল, অনেক হয়েছে। এবার ঘরের
ছেলে ঘরে ফিরে চল।
ঘর, বার্লিন ছাড়া আর কোথায়।
ঘর, বার্লিন ছাড়া আর কোথায়।
বার্লিনের সমস্যার অন্ত নেই। অনেকটা আমাদের দিল্লির মতোই, বার্লিন একাধারে শহর
এবং স্টেট। বার্লিন স্টেটের পাবলিক ডেটের পরিমাণ বাকি স্টেটদের তুলনায় আকাশছোঁয়া।
হবেই তো, এত লোক আসছে কাজের খোঁজে, এত অফিসকাছারি দোকানপাট, একটা গোটা শহরের একটা গোটা দিক নতুন
করে বানানো কি কম খরচের কাজ? তবুও বার্লিনে প্রতিটি লোকের জন্য ইউনিভার্সাল
হেলথকেয়ারের ব্যবস্থা আছে। গৃহহীনদের জন্যও।
গাইড বললেন, চল তোমাদের বার্লিনের আরেক রূপ দেখাই এবার। এ বার্লিনে ক্ষমতার লড়াই নেই, যুদ্ধের ছাপ এতও দগদগে হয়ে ফুটে নেই। এখানে আছে রংচঙে ছবি আঁকা দেওয়ালের সারি, অভিবাসীদের ভিড়, স্ট্রাগলিং শিল্পী কবি সাহিত্যিকদের আড্ডার ঠেক। এখানে রাস্তা অত ঝকঝকে নয়। এখানে ছুঁড়ে ফেললে কলার খোসা যে সবসময় ট্র্যাশক্যানে গিয়েই পড়বে সে রকম কোনও গ্যারান্টি নেই। কিন্তু তাই বলে বাড়ির দাম এখানে কম এ’কথা ভাবলে মস্ত ভুল হবে। বার্লিনের যত কুল ক্রাউড, তারা এই রকম অপরিচ্ছন্ন, অবিন্যস্ত আবহাওয়াই পছন্দ করে। তাদের প্রকোপে বাকি বার্লিনের থেকে এ তল্লাটে বাড়ির দাম অন্তত দেড়গুণ বেশি। আমি লাফিয়ে পড়ে বললাম, জানি জানি এ’রকম হয়। আমাদেরও আছে। হজ খাস ভিলেজ, শাহপুর জাট। আঁকাবাঁকা উঁচুনিচু গলিঘুঁজির ভেতর আধোঅন্ধকার হুক্কাবার আর কফির দোকান। ভিলেজের বাইরে বি এম ডবলিউ পার্ক করে এসে লোকজন সেসব দোকানের দড়ির খাটিয়ায় শুয়ে শুয়ে কাফকা-কুন্দেরা পড়ে।
গাইড বললেন, চল তোমাদের বার্লিনের আরেক রূপ দেখাই এবার। এ বার্লিনে ক্ষমতার লড়াই নেই, যুদ্ধের ছাপ এতও দগদগে হয়ে ফুটে নেই। এখানে আছে রংচঙে ছবি আঁকা দেওয়ালের সারি, অভিবাসীদের ভিড়, স্ট্রাগলিং শিল্পী কবি সাহিত্যিকদের আড্ডার ঠেক। এখানে রাস্তা অত ঝকঝকে নয়। এখানে ছুঁড়ে ফেললে কলার খোসা যে সবসময় ট্র্যাশক্যানে গিয়েই পড়বে সে রকম কোনও গ্যারান্টি নেই। কিন্তু তাই বলে বাড়ির দাম এখানে কম এ’কথা ভাবলে মস্ত ভুল হবে। বার্লিনের যত কুল ক্রাউড, তারা এই রকম অপরিচ্ছন্ন, অবিন্যস্ত আবহাওয়াই পছন্দ করে। তাদের প্রকোপে বাকি বার্লিনের থেকে এ তল্লাটে বাড়ির দাম অন্তত দেড়গুণ বেশি। আমি লাফিয়ে পড়ে বললাম, জানি জানি এ’রকম হয়। আমাদেরও আছে। হজ খাস ভিলেজ, শাহপুর জাট। আঁকাবাঁকা উঁচুনিচু গলিঘুঁজির ভেতর আধোঅন্ধকার হুক্কাবার আর কফির দোকান। ভিলেজের বাইরে বি এম ডবলিউ পার্ক করে এসে লোকজন সেসব দোকানের দড়ির খাটিয়ায় শুয়ে শুয়ে কাফকা-কুন্দেরা পড়ে।
ভিলেজের গা ঘেঁষে বাস চলল। পথের মাঝে সিগন্যালে অপেক্ষায় বর্ণময় জটলা। কারও
মাথায় জটা, কারও মাথায় টিকি, কারও ঘাড়ে গিটার। মাঝে মাঝে একটা দুটো ছোট্ট দরজার
দিকে আঙুল দেখিয়ে গাইড বলছিলেন, শুক্রশনিবার রাতে নাকি এই দরজাগুলোর সামনে সাপের
মতো লম্বা লাইন পড়ে। লোকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মুখ বুজে দাঁড়িয়ে থাকে ভেতরে যাবে বলে।
ভেতরে গিয়ে কানফাটানো বাজনার সঙ্গে উদ্দাম নেচে সারা সপ্তাহের ক্লান্তি লাঘব করবে
বলে। নাচানাচির কথায় বারঘাইন ক্লাবের কথা উঠল। বার্লিনের সেরা ক্লাব তাতে সন্দেহ
নেই, কেউ কেউ বলে পৃথিবীর মধ্যেও শ্রেষ্ঠত্বে প্রথম তিনে থাকবে এই ক্লাব। ঢুকতে
গেলে লাইনে তিনঘণ্টা মিনিমাম দাঁড়াতে হয়। বারঘাইন নাম শুনতেই বাসের ভেতর হইহই রব
উঠেছিল। আমাদের দলে কিছু পাব-হপিং, ইনস্টাগ্রামিং, হোয়াস্সাপিং তরুণতরুণী আছে,
পৃথিবীর প্রথম দশখানা ডান্সক্লাবের নাড়িনক্ষত্র তাদের নখদর্পণে। জার্মান বন্ধুরা
বললেন, সে যেতে পার কিন্তু যাওয়ার আগে ছদ্মবেশ নিতে হবে।
অ্যাঁ, সে কী, কেন?
বাইশজন
বিভিন্ন রকম দেখতে লোক একসঙ্গে লাইনে দাঁড়িয়ে খালি ইংরিজিতে কথা বলে যাচ্ছে দেখলে
বাউন্সার সোজা কান ধরে বার করে দেবে। বলবে, জায়গা নেই। জেনানা কাম্রা হ্যায়। (কুইজ নম্বর দুইঃ গল্পের
নাম কী?) টুরিস্টদের এরা মোটে ভালো চোখে দেখে না। আমরা দমলাম না। বললাম কুছ পরোয়া
নেই। জার্মান শেখা তো চলছেই। শিখেই একেবারে আসব’খন।
রাইখস্টাগের গল্প শুনে সেই ক্ষীরের পুতুলের সুয়োরানী দুওরানীর গল্প মনে পড়ে গেল। খুব ভালো হয়েছে লেখা এবং ছবি দুইই। কুইজের উত্তর লখনৌ আর সোনার কেল্লা কি? অবশ্য আমি প্রথম প্রশ্নটাকে ফেলুদার সঙ্গে রিলেট করবার চেষ্টা করে আন্দাজে ঢিল ছুড়লাম একটা, যদি বহু লোকের ভিড় আর সবুজ পার্ক নিয়ে বলেন তাহলে নিউ ইয়র্ক ও হতে পারে। আর আপনি তো মশাই আজব মানুষ! বহুতল ভালবাসেননা কিন্তু নিউ ইয়র্ক ভালবাসেন? ব্যাপারটা কেমন অদ্ভুত হয়ে গেল না?
ReplyDeleteসেটা আমিও ভাবছিলাম জানেন, যে আকাশই যদি দেখতে ভালোলাগে তাহলে নিউ ইয়র্ক সিটি এত টেনেছিল কেন। হয়ত নিউ ইয়র্কের প্রতি ভালোবাসার কারণটা আকাশ নয়, অন্য কিছু। তবে এন ওয়াই সি এখনও প্রথম তিনেই আছে। আমার ধারণা থাকবেও।
Deleteছবি ভালো হয়েছে বলার জন্য থ্যাংক ইউ।
অবশেষে। দীর্ঘ উপবাসের পর দারুণ সুন্দর কিছু ছবি আর এক গঙ্গা জার্মানির ইতিহাস লিখে আমাদের পেট, থুড়ি, মন ভরিয়ে দেবার মতলব, না? জার্মানির এত সুলিখিত ইতিহাস আর পড়িনি। সব রকমের তথ্য-সংবলিত অথচ সংক্ষিপ্ত সুপাঠ্য ইতিহাস জার্মানরাও লেখেনি বোধহয়।
ReplyDeleteFacebook style-e ei comment Tate ekta like!
Deleteআরে মালবিকা, কী যে বলেন। এত কথা বলতে পারছিলাম না বলে দু'দিন যা অস্বস্তিতে ছিলাম সে কী আর বলব।
Deleteরুচিরা, থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ।
ওয়াও! বেশ রিসার্চ করেছেন বুঝতে পারছি... নিখুঁত কাজ করার চেষ্টা যারা করে, তাদের আমি সবসময়ই একটু বেশি পছন্দ করি।
ReplyDeleteকুইজ নম্বর একঃ পাহাড় আর সমুদ্র মিলিয়ে বোম্বে একেবারে চ্যাম্পিয়ন শহর (জটায়ু উবাচ, বোম্বাইয়ের বোম্বেটে)
কুইজ নম্বর দুইঃ রিজার্ভ কামরা হ্যায়, জেনানা কামরা হ্যায় (এটাও জটায়ু উবাচ, সোনার কেল্লা)
কুইজে দুইয়ে দুই দেবাশিস। লেখা ভালো লেগেছে বললেন বলে থ্যাংক ইউ।
Deletekhub bhalo laglo post ta. amar purono bashhothan kina tai khub nostalgic lagchey :) victot tower e chorle naki. kachei ekta museum achey okhane anek indian artist der kaaj on display thake.
ReplyDeleteK. tumi reichstag er trip ta niyo kintu. otar janne anek lomba line porey tai ektu deri kore jeo....working day te jeo....by 7 PM line ta kome jabe.
ReplyDeleteআমিও ভাবছিলাম জান, শম্পা নির্ঘাত বার্লিনেই থাকত। আমার অনুমান মিলল জেনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। আমি রাইখস্টাগের ট্রিপ নিয়েছি শম্পা। নিয়েছি মানে অফিস থেকে নিইয়েছে। কিন্তু বিপদ হয়েছে কি, নিয়ে গিয়েছিল সোমবার কাজের পর, যখন আমার কাছে ক্যামেরা ছিল না। ব্লগারদের কথা যদি কেউ একটু ভাবত। কাজেই কোনও ছবি তুলতে পারিনি। ডোমে চড়েছিলাম যখন, ঝরঝর করে বৃষ্টি নেমেছিল। কী যে ভালো লাগছিল, তুমি আন্দাজ করতে পারবে নিশ্চয়। আরও একটা কথা প্রমাণ হয়ে গেল, আমার প্রিয় শহরের সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার দিন সেখানে বৃষ্টি হতেই হবে। দিল্লিতে হয়েছিল, এন ওয়াই সি-তে হয়েছিল, বার্লিনে হল। কে বলে দৈব বলে কিছু নেই?
Deletedoibo achey boiki....na holey agatha porte porte tumi o shei berlin giye pouchole :)
Deletetomake ebong abantor pathok-gan ke janai bharat er 66 tomo swadhinotar anek shubechha.
তোমাকেও স্বাধীনতা দিবসের অনেক শুভেচ্ছা জানাই শম্পা।
Deleteকুন্তলা, পাহাড় সাগর মিলিয়ে চট্টগ্রামের কক্সবাজার শহরটা কি তোমার তুলনায় আসে?
ReplyDeleteআরে আপনি কক্সবাজার দেখেছেন বুঝি মালবিকা? আমার যে ওখানে কী যাওয়ার ইচ্ছে। শুনেছি ভীষণ সুন্দর। নাঃ, এবার প্ল্যান করে ফেলতেই হচ্ছে।
Deletelekhata jake bole durdanto hoyeche ar chabigulo o :-)
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ তিন্নি।
Deleteবার্লিনে প্রথম দেখা যে ইওরোপেও মানুষ খেতে পায় না। ওপেন রেস্টুরেন্টের বাইরে বসে পিৎজা খাচ্ছি। একটি অসম্ভব সুন্দরী তরুণী এসে ভদ্রভাবে জিজ্ঞেস করলো, তোমার কি কোকাকোলা খাওয়া হয়ে গেছে। ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরিজীতে। স্বভাবসিদ্ধ বাঙ্গালী মানসিকতা জেগে উঠল, এ বাবা বেশী সময় নিয়ে খাচ্ছি বলে কেস দিচ্ছে নিশ্চয়ই। ঘন ঘন মাথা নেড়ে বিপুল উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়লাম।
ReplyDeleteকোকাকোলার পাঁচশো এম এল তাও শেষ হল না। বিল মিটিয়ে দিয়ে একটু হেঁটে গিয়ে দেখি সেই মেয়েটি একটা ট্র্যাশ বিনের মধ্যে কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতল হাঁটকাচ্ছে। রাস্তার ওপারে তার পুরো পরিবার দাঁড়িয়ে। বাবা, মা, ভাই।
তোমার এই লেখাটা কিরকম হয়েছে বলবো? দু'দিনে আগে রান্না করা পাঁঠার ঝোল, ফ্রিজ থেকে বার করে মাইক্রোতে কম আঁচে, এই ধর ২৮০ ডিগ্রীতে দশ মিনিট গরম করার পরে যে সুবাস পাওয়া যায়, সেরকম।
ইস্, খিদে পেয়ে গেল। থ্যাংক ইউ অনির্বাণ। তোমার প্রশংসাটা আমার লেখার থেকে এককোটিগুণ সুন্দর হয়েছে।
DeleteThank you Kuntala, darun ghurlam ar chhobi dekhlam. :-)
ReplyDeleteহাহা, থ্যাংক ইউ ইচ্ছাডানা।
Deleteবড় ভাল লাগল
ReplyDeleteমিঠু
ধন্যবাদ মিঠু।
Delete