দু'সপ্তাহে



যদি জিজ্ঞাসা করেন গত দু’সপ্তাহ কী এমন রাজকার্যে কেটেছে যে অবান্তরে নিয়মিত পোস্ট লিখে উঠতে পারিনি, তাহলে তার উত্তর দেওয়া শক্ত হবে। মানছি কাজ ছিল, কিন্তু কাজের ফাঁকে সময়ও ছিল। সে সময়ের খানিকটা রাস্তায় ঘুরে, বইয়ের দোকান ঘেঁটে, হামবুর্গে এয়ারবাসের কারখানায় ইন্ডিগোর এরোপ্লেন তৈরি হতে দেখে, চলন্ত বাসে পাকিস্তানি সহকর্মীর সঙ্গে “যব কোই বাত বিগড় যায়ে” ডুয়েট গেয়ে, ট্রেনভর্তি সামান্য মাতাল ফুটবল ফ্যানেদের মাঝে চিঁড়েচ্যাপ্টা হয়ে বসে কেটে গেল। এত রকম ভালো জিনিসের মধ্যে আরও ভালো বাছা শক্ত, তবু তিনটে অভিজ্ঞতার প্রতি পার্শিয়ালিটি না দেখিয়ে পারলাম না।

১. অনেকদিন আগে একদিন বিকেলে কী খাই কী খাই করছিলাম, ঠাকুমা এক বাটি মুড়িবাতাসা এনে দিয়ে বলেছিলেন, “খা।” হাক্কা চাউমিন থেকে শুরু করে মোগলাই---নানারকম মাল্টিকুইজিন টিফিন খাওয়ার অভিজ্ঞতাই আমার হয়েছে তখন, কিন্তু সেদিনের সেই মুড়িবাতাসার চমকটা আজও ভুলতে পারিনি। এত সরল একটা ব্যাপার যে এত ভালো হতে পারে, সেটা কেন যেন আন্দাজই করতে পারিনি।

বছর কুড়ি আগে মুড়িবাতাসার বাটির প্রতি যে প্রতিক্রিয়াটা দেখিয়েছিলাম, গত দু’সপ্তাহে অফিসের হপ অন হপ অফ লিফট দেখে অবিকল সেই প্রতিক্রিয়াটা বেরিয়ে এল। আজকাল এই বহুতলের বাজারে অগুন্তি লিফটে চড়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে। বড়মাসির বেহালার ধুধ্‌ধুড়ে সরকারি ফ্ল্যাটের “হেঁইয়ো” বলে টেনে বন্ধ করা জং ধরা কোলাপ্‌সিব্‌ল্‌ গেটওয়ালা লিফট থেকে শুরু করে মহার্ঘ মলের কাঁচের লিফট---সারা শহরের ধুলো, ঘাম, মধ্যবিত্তপনাকে কাঁচকলা দেখিয়ে শন্‌শন্‌ করে স্বর্গের দিকে উড়ে চলেছে।

হপ অন হপ অফ লিফ্‌টের নখের যোগ্য নয় এদের একটাও।



হপ অন হপ অফ লিফটের প্রক্রিয়াটা এতই সরল যে প্রথমটা দেখলে বিশ্বাস হয় না। মনে হয় ম্যাজিক। হপ অন হপ অফের দ্বিতীয় এবং মুখ্য আকর্ষণটা রয়েছে এর উদাসীনতায়। আমি আমার মতো উঠছিনামছি, কারও ইচ্ছে হলে আমার সঙ্গে আসবে, নয়তো আসবে না। বয়েই গেল। দরজা নেই, বোতাম নেই। অফিসে লেট হয়ে গেলেও দূর থেকে গজেন্দ্রগমনে হেঁটে আসা সহকর্মীকে দেখে বিনীত হেসে লিফটের দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকার পিত্তি-জ্বালানো ভদ্রতার দায় নেই। টপ ফ্লোরে অফিস হলে লিফটে ঢুকে আমার আগের প্রতিটি ফ্লোরের বোতাম জ্বলতে দেখার হতাশা নেই। হপ অন হপ অফ কারও জন্য অপেক্ষা করে না, কারও জন্য ছোটে না।

গত দু’সপ্তাহে প্রাণ ভরে হপ অন হপ অফ চড়ে নিয়েছি। পাঁচতলা সাততলা উঠতে নামতে তো বটেই, মাঝে মাঝে কফি ব্রেকে এসে এমনি এমনিও চড়েছি। আমাদের জার্মান সহকর্মীরা প্রথমটা এ ব্যাপারে আমাদের উৎসাহ দেখে থতমত খেয়ে গিয়েছিলেন। এমন জিনিস হাতের সামনে থাকতে তাঁরা দু’বেলা মুখব্যাজার করে পাশের আধুনিক লিফট ব্যবহার করছেন। আমাদের পাল্লায় পড়ে বহুদিন বাদে ক্রিশ্চিয়ান হপ অন হপ অফে চড়ল। আর স্বীকার করল যদিও ও তলিয়ে ভেবে দেখেনি অনেকদিন, তবে ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে ফান্‌। গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না বোধহয় একেই বলে।  

২. হামবুর্গের পোর্ট দেখতে বেরিয়ে লঞ্চের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে প্রাণ ভরে নদীর হাওয়া খাচ্ছি, এমন সময় ইন্দোনেশিয়ার কুসুমওয়র্ধনে এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “কুন্তলা, সিং উইথ মি।”

মিষ্টি হেসে, “আমার তো কোনও ইন্দোনেশিয়ান সং জানা নেই ভাই” বলতে যাব, অমনি দেখি দুই হাত শরীরের দু’পাশে ছড়িয়ে দিয়ে চোখ বুজে সে গান ধরেছে।

“তুম পাস আয়ে, ইয়ুঁ মুসকুরায়ে/ তুম নে না জানে কেয়া সপনে দিখায়ে/ অব তো মেরা দিল, লা লা লা লা লা, কেয়া করুঁ হায়-এ-এ/ কুছ কুছ হোতা হ্যায়।”

ফেলুময়রার দশটাকা পিস রসগোল্লা একবারে মুখে পোরার উপযুক্ত হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আমার আর কিছু করার ছিল না। শকের অবশ্য সেই সবে শুরু। ততক্ষণে গানের আওয়াজ পেয়ে কুসুমওয়র্ধনের দেশোয়ালি ভাইবোনেরা ডেকের এদিকওদিক থেকে ছুটে এসেছে। “তুম পাস আয়ে” শেষ করে সদলবলে তারা “কোই মিল গয়া” গেয়ে এবং নেচে দেখাল। ততক্ষণে ডেক উপচে পড়ছে দর্শকের ভিড়ে। নাচ শেষ হতে কানফাটানো হাততালি, মুখের কাছে দুই হাত জড়ো করে কেউ কেউ চেঁচাল, “বলিউড...বলিউড...শাহরুখ খান...”

আর কোনওদিন শাহরুখ খানকে নিয়ে হাসব না। আমি তো শুধু হেসেই খালাস, এদিকে ভদ্রলোক যে বিশ্বের দরবারে দেশের নাম কী পরিমাণ রোশন করেছেন সে খবর কে রাখে।

নাচাগানাহল্লাহাটি শেষ হতে আবার নদীর দিকে মুখ ফিরিয়ে ঢেউ গুনছি, এমন সময় শুনি একটু দূরে গুণমুগ্ধ জটলার মধ্যে দাঁড়িয়ে কুসুমওয়র্ধনে ভয়ানক সিরিয়াস মুখ করে বলছে, “ইন্ডিয়ান পিপ্‌ল্‌ লা-আ-আ-আ-আ-ভ সিংগিং অ্যান্ড ড্যান্‌সিং।”


উৎস গুগল ইমেজেস

৩. দেশের বাইরে মজার অর্ধেক গল্পই দেশসংক্রান্ত। তিননম্বর গল্পটাও দেশ নিয়ে, আর এই গল্পটাই আমার ফেভারিট। সারাদিনের পাড়াবেড়ানো শেষ করে হা-ক্লান্ত পায়ে হেঁটে হেঁটে হোটেলে ফিরছি, এমন সময় চিনের গং পেছন থেকে ছুটে এসে আমার কাঁধ টেনে ধরে রাস্তার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, “ও মাই গড, আই নো দেম।”

ভীষণ ঘাবড়ে গিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি গং-এর তর্জনী আমার পায়ের দিকে তাক করা।

“আই হ্যাভ দোজ্‌ এক্স্যাক্ট শুস্‌!!!...”

এবার আমার লাফিয়ে ওঠার পালা।

“বাটা শুস্‌? হাউ?!”

শুনি মহিলা সাড়ে তিনবছর নতুনদিল্লির চিনা এমব্যাসিতে কাটিয়েছেন, অজন্তাইলোরা ভ্রমণ করে মন্ত্রমুগ্ধ হয়েছেন, পনেরোই আগস্টে শাড়ি পরে সকলের হাততালি কুড়িয়েছেন এবং কনট প্লেস থেকে নিয়মিত বাটার জুতো কিনে পরেছেন।

আমি আর গং মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে বাটা বন্দনা করতে লাগলাম।

“ইজ ইট অ্যান ইন্ডিয়ান কোম্পানি?”

“উঁহু, বাটা আসলে এম এন সি। ইন ফ্যাক্ট বাটা এ তল্লাটেরই জিনিস। কিন্তু ইন্ডিয়ার লোকেরা ভুলেই গেছে যে এটা আসলে বিলিতি ব্র্যান্ড।”

আমার সব ক্লান্তি নিমেষে ধুয়েমুছে গেল। সিংগিং অ্যান্ড ড্যানসিং-এর কথা জানি না, কিন্তু ইন্ডিয়ান পিপ্‌ল্‌ রিয়েলি লাভ বাটা। অন্তত আমি তো বটেই। হাঁটা মানে বাটা।


Comments

  1. প্রতিটা অভিজ্ঞতাই দারুণ, কিন্তু শাহরুখ খানকে নিয়ে অভিজ্ঞতাটা টেরিফিক। ভদ্রলোক ডেফিনিটলি সবচেয়ে বিখ্যাত ভারতীয়... ইয়েস, মহাত্মা গান্ধীকে হিসেবে রেখেই বলছি। আর আমার খুব কান্না পেয়েছিল এই দেখে যে টেগোরের নাম কেউ জানে না... মানে, কেউই জানে না। আপনার মত অভিজ্ঞতা আমার প্রচুর হয়েছে, এই মিস্টার খানকে নিয়েই।
    কিন্তু খুব দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে যে অন্য অনেক ব্যাপারের মতই আমি এই ব্যাপারেও ভারতের নামে কলঙ্ক... আমি চেন্নাই এক্সপ্রেস দেখিনি, দেখার ইচ্ছেও নেই। ইনফ্যাক্ট, যে থিয়েটারে চেন্নাই এক্সপ্রেস দেখানো হচ্ছে, আমি তার একশো মিটারের মধ্যে যাচ্ছি না।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমার আবার অমিতাভ বচ্চনের প্রতি খানিকটা পক্ষপাতিত্ব আছে, তাই অপেক্ষাকৃত বয়স্ক একজন সহকর্মীর মুখে বচ্চন নামটা শুনে খুশি হয়ে গেছি। তবে মুশকিল হচ্ছে, অমিতাভ গ্লোবালাইজেশনের আগের যুগের অভিনেতা, শাহরুখ খান এই জায়গাটাতে অমিতাভকে বেকায়দায় ফেলেছেন।

      Delete
  2. স্প্যামিং করা উদ্দেশ্য নয়, কিন্তু গূগ্ল ক্রোম জিজ্ঞেস করল এটা আমি ইংরিজিতে চাই কিনা। এইর'ম এল (প্রথম অনুচ্ছেদটা) -

    Two weeks

    If you ask for the last two weeks of the regular abantare rajakarye spent that could lead to write the post, then it will be difficult to answer. Manachi work, but the work was besides. The short period of time in the streets, bookstores seekers, hamaburge Airbus factory to be built in indigora Intense, moving the bus with colleagues "barley koi arthritis bigara yaye" duet singing, trenabharti slightly drunk football fans have been cimrecyapta it was cut. It is difficult to sort out the good things in the better, but the experience of three parsiyaliti did not show.

    ReplyDelete
    Replies
    1. উদ্দেশ্য না থাকলেও, বিধেয় হিসেবেই চমৎকার স্প্যামিং হয়েছে। Google-এর বাংলা অনুবাদ অনেক সময়ই বেশ অ্যান্টি ডিপ্রেসেন্ট-এর কাজ করে।

      Delete
  3. প্রশ্নঃ উদাহরণ সহিতে প্রকাশ কর, গুগলের গুগলি বলিতে কি বোঝায়?

    উত্তরঃ

    যব=Barley
    বাত=Arthritis

    এখানে যব কোই বাত বিগড় যায়ে কে অনুবাদ করা হচ্ছে, "Barley Koi Arthritis Bigara Yaye"। বানানভুলের প্রতি লেখিকার কিঞ্চিৎ প্রশ্রয় আছে, তাই শেষের দুটো শব্দের বানান নিয়ে পরীক্ষার্থী মৌন।

    ReplyDelete
    Replies
    1. পুরো ঘটনাটাই খুব হাসির, তবে বানানের ব্যাপারটা বুঝিনি। আর বানান ভুলের ব্যাপারে আমার প্রশ্রয় বাকিদের থেকে এক্সট্রা কিছু বেশি নেই। প্রশ্রয়ের ভান করে থাকি, যাতে মাঝেসাঝে ভুল হয়ে গেলে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে গলা টিপে না ধরতে পারে।

      Delete
  4. হপ্‌ অন লিফ্‌টে অনেক বেশি বিদ্যুৎক্ষয় হচ্ছে না?

    ReplyDelete
    Replies
    1. সে হচ্ছে বোধহয়।

      Delete
  5. :-D, darun laglo. শাহরুখ খান ar 'Kuchh kuchh..." er eto fan dekhe obak holam. Ar 'Bata' r fan dekhe mugdho holam :-D.

    ReplyDelete
    Replies
    1. শাহরুখ খানের ফ্যানেদের কথা আর বলবেন না ইচ্ছাডানা। জলেস্থলেঅন্তরীক্ষে সর্বত্র তারা বিরাজমান। আর বাটা নিয়ে কোনও কথা হবে না, বলুন?

      Delete
  6. thik thik.....sara prithibi jure ekhon bollywood er rom-roma. africa te deklam hall e chine bhashay dub kore ra-one release hoyechey!

    ReplyDelete
    Replies
    1. সেই শম্পা। বলিউড এখন ইন।

      Delete
  7. কুন্তলে, কেন জানিনা এই লেখাটা পড়ে পরম পুলকিত হয়ে পড়লাম। তোমাকে একটা ভার্চ্যুয়াল উচ্চ-পাঁচ। যদি কোনদিন চাকরী-বাকরী ছেড়ে পুরোপুরি লেখার দিকে মন দাও, তাহলে আমি সর্বান্তকরণে সমর্থন করব, এবং তোমার বই বেরোলে লাইন দিয়ে কিনব।

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ কৌশিক। মন ভালো করে দিলে।

      Delete
  8. haha ami first jedin janlam mt titlis er opor seriously dilwale dulhaniya r bishal cutout ache ar oi jonyei ota ato famous tourist spot, anicha sotteo bhodroloker khomota ke shradhha na kore parini.. ekhane ese amaro ek i rokom experience hoyechilo, ak jon to aisharya rai er ritimoto fan chilo! tobe eta te dukkher o lage, bideshira bharot sommondhe ja akkhan picture paay--amar ak bondhu k akjon jigesh korechilo bharotiyo ra sob somoy rastay neche thake kina! er cheye bata r golpo ta beshi anonder :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. সিরিয়াসলি স্বাগতা। সবাই ভাবে আমরা বোধহয় চান্স পেলেই কাজকর্ম ছেড়ে গাছের ডাল ধরে নাচানাচি করি। কী সাংঘাতিক ভাবো দেখি।

      Delete
  9. Kuntala darun lekha. kono katha habe na.

    Abhishek Mukherjee-r jonno: Google Translation ba in general Machine Translation ekhana shoishab katiye othe ni thik-i kintu shurur dingulo mone korle dekhben unnati kichuta koreche hayto.
    Artificially Machine-ke intelligent kara-ta ekta bara challenge. r shei challenge ta swikar kore AI sampraday kromagato ceshta korche jate bhashar byabadhan katiye, ingreji-r dapat ke takkar diye shab rakamer khabarakhabar nij nij bhasha-te internet-e choriye dite :). uddessho mahan kintu kothin. ami jehetu ei shampraday-e abasthan kori tai uttor kara-r lobh shamlate parlam na :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ দেবশ্রী। আরে লোভ সামলাবার কোনও দরকারই নেই। যা প্রাণে চায় বলবে।

      Delete
  10. হপ অন হপ অফ লিফটের কন্সেপ্টটা বেশ অন্যরকম লাগলো। এ কি দিল্লির বাসের মতন? মানে স্টপেজে না থামিয়েই ওঠানামা করতে হয়? কেউ উঠতে গিয়ে ফোকর গলে পড়ে যাবার চান্স থাকেনা? কেউ না থাকলেও লিফট টা কি ওঠানামা করতেই থাকে? আর লিফট সেই তলায় না থাকলে কি শাফট টা খোলা থাকে?

    বাঙালির মন তো, সব মিলিয়ে বেশ ভয়ের ব্যাপার মনে হচ্ছে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. সরি আপনার ভিডিওটা প্রথমে আসেনি ঠিকঠাক বোধহয়। আরেকবার পেজ রিলোড করে ওটা দেখে আমার সব প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেছি।

      Delete
  11. hnata maney bata - oshadharon laglo pore.. :)

    ReplyDelete

Post a Comment