আড্ডার নাম স্টামটিশ
আড্ডা মারার
নেশাটা ফণা তুলতে শুরু করেছিল স্কুলের শেষদিক থেকে। স্বাতী ছিল আমার পার্টনার ইন
ক্রাইম। সারাদিন স্কুলে গায়ে গা ঠেকিয়ে বসে থাকার পরও ফোনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যেত।
মা ব্যপারটা রেগুলেট করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পারেননি। টিনএজের খপ্পরে পড়ে মায়ের অমন
শান্ত, বাধ্য, মুখচোরা মেয়েও বদলে যেতে শুরু করেছিল। সেটা মাকে কষ্ট দিত নিশ্চয়।
একদিন আড়াল থেকে শুনে ফেলেছিলাম। মা গানের মাস্টারমশাইকে বলছেন, “ভীষণ আড্ডাবাজ
হয়ে যাচ্ছে।” মায়ের গলা শুকনো। মাস্টারমশাই বলছেন, “চিন্তা করবেন না, ঠিক হয়ে যাবে।
বয়সের ব্যাপার।”
ঠিক হয়নি। স্কুল
পেরিয়ে কলেজ, কলেজ পেরিয়ে ইউনিভার্সিটি। আড্ডার নেশা ততদিনে মগজের সীমানা ছাড়িয়ে আমার
দেহের প্রতিটি রক্তবিন্দুতে মিশে গেছে। গোদাবরী ধাবার গাছের তলার বাঁধানো সিঁড়িতে
প্রায় শিকড় গজিয়ে ফেলেছি। সারাদিন বসে থাকি। আড্ডা দেওয়ার লোকের অভাব নেই, আড্ডার
বিষয়েরও না। রাজনীতি, সিনেমা, ক্যাম্পাস প্রেম। মূলত ক্যাম্পাস প্রেম।
মা টের পেতেন
নিশ্চয়। কিন্তু ফোনের ওপারে বসে চুপ করে দেখা ছাড়া তাঁর আর কিছু করার ছিল না।
হাতের কাছে থাকতেই এ বিষ ঝাড়াতে পারেননি, আর তখন তো আমি শতমাইল দূরের বাঁধনছেঁড়া
গরু।
মা না থাকলেও
আরেকটা জিনিস পাহারায় থাকে অবশ্য। কর্মফল। জীবনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বেশ ধরে এসে
সে মোক্ষম কামড় বসায়। স্বাস্থ্য, প্রেম, সি জি পি এ।
তবে কামড় খেলেই
যে শিক্ষা হবে এ কথা তো কোনও শাস্ত্রে লেখেনি। সবই আধারের ওপর নির্ভর করে। কেউ
শুনে শেখে, কেউ ঠেকেও শেখে না। আমি বরাবর এই সেকেন্ড গ্রুপের লোক। জে এন ইউ ছাড়ার
পরেও দেদার আড্ডা মেরে দেদার খারাপ রেজাল্ট করেছি। একটাই তফাৎ হয়েছিল বোধহয়। আড্ডা
মারতাম, কিন্তু আড্ডার মোহটা ঘুচে গিয়েছিল। গোল হয়ে বসে ইজরায়েল-নন্দীগ্রাম-শাহরুখখান
নিয়ে চেঁচিয়ে দেশোদ্ধার যে কিছু করছি না, সেটা নিয়ে আর কোনও সন্দেহ ছিল না।
আমার বন্ধুরা
অনেকেই অবশ্য আমার মত মানতেন না। আড্ডা থেকে যে মহৎ সৃষ্টি হতে পারে, সে নিয়ে
তাঁরা আশাবাদী ছিলেন। কেউ কেউ আবার আরেকধাপ এগিয়ে গিয়ে বলত, আড্ডা না দিলেই বরং
বিপদ। আড্ডা দেওয়া ভুলেছে বলেই বাঙালির আজ এই চেহারা। আড্ডা দেওয়া ভালো না খারাপ
সেই নিয়ে আড্ডা দিয়েছি আমরা দিনের পর দিন। কফিহাউসের আড্ডার উদাহরণ উঠে আসত
বারংবার।
আরে বেশি দূর যাওয়ার দরকার নেই কুন্তলা। আমাদের সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কথাই ধরা যাক না। কফিহাউসে বসে বছরের পর বছর আড্ডা না মারলে উনি সুনীল হয়ে উঠতে পারতেন বলে তোমার বিশ্বাস? কলম থেকে সেই সময় বেরোত?
আমি হার মানতাম। আধারের কথাটা কেন যে সবাই ভুলে যায় কে
জানে। সুনীলের দ্বারা যা হয়েছে, আর পাঁচটা হরেদরে বাঙালি দু’বেলা সুনীলের ফর্মুলা
গুলে খেলেও যে সেটা হবে না, সেটা কে বোঝাবে। (আর তাছাড়া সুনীল কাদের সঙ্গে আড্ডা
দিতেন সেটাও তো দেখতে হবে? এই যুক্তিটা অবশ্য মুখ ফুটে বলিনি কখনও। প্রাণের মায়া
আমার বরাবরই বেশি।)
আড্ডাকে আমি ভালো
চোখে দেখি না আর। আড্ডা দিয়ে সময় নষ্ট করার থেকে পড়ে পড়ে ঘুমোনো ভালো। হাটে বসে আড্ডা
মেরে আত্মার যা উন্নতি হবে, তার থেকে অনেক বেশি হবে একলা ঘরের নির্জনতায়। নিজের
সঙ্গে সময় কাটিয়ে। নিজেকে চিনে জেনে খুঁজে বুঝে।
তাই টিমো যখন
বলল, চল তোমাদের একদিন স্টামটিশে নিয়ে যাই, আর সেই শুনে আমরা যখন বললাম, সেটা আবার
কী? খায় না মাথায় দেয়? আর তার উত্তরে টিমো যখন বলল, সেকি স্টামটিশের নাম শোনোনি? এ
হল গিয়ে অথেনটিক জার্মান আড্ডা, তখন আমার উৎসাহে ঠাণ্ডা জল পড়ে গেল। সারাদিন লেকচার শুনে আর প্রেজেন্টেশন শুনে
সন্ধ্যেবেলা যদি শহর উজিয়ে আড্ডা মারতে যেতে হয়, তাহলে রাগ ধরে কি না বলুন?
কেউ সত্যিটা মানতে রাজি হল না। চেপে ধরল, কারণ বলতে হবে। তখন অবান্তরের কথা ফাঁস করলাম। বললাম এ সব ছবি আমি আমার ব্লগে ছাপাই কি না, তাই প্রাইভেসির মুখ চেয়ে তোমাদের মুখ এড়িয়ে চলি।
স্টাম মানে
অরিজিন, টিশ হল টেবিল। স্টামটিশ মানে হল টেবিলের চারদিকে বসে অরিজিন্যাল আড্ডা।
তবে জার্মান আড্ডা বলে কথা, তারও নিয়মকানুন আছে। একই দলকে, একই জায়গায়, সপ্তাহের
একই দিনে, অফিসকাছারির পর একজোট হয়ে আড্ডা মারতে হবে। দিনটা শনিরবিফ্রাইডেনাইট হলে
চলবে না। সপ্তাহের মাঝখানে কোনও একটা দিন হওয়া চাই। আড্ডা মারতে গিয়ে গাঁকগাঁক করে
খেলে হবে না। যে যার বাড়ি থেকে ডিনার করে আসবে। টেবিলে থাকবে শুধু বিয়ারের বোতল,
সিগারেটের ছাইজমা অ্যাশট্রে, আর তাসের প্যাকেট। বিয়ারের মৌতাত অল্প অল্প জমে আসবে,
বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া পড়বে। আর অমনি মাথা যাবে খুলে। দর্শন, সাহিত্য, ইতিহাস,
রাষ্ট্রনীতি। গলা চড়বে, সিগারেট পুড়বে, উত্তেজিত হাতের ধাক্কায় বিয়ারের বোতল যাবে
উল্টে। সময় কোথা থেকে উড়ে যাবে কেউ টেরই পাবে না। শহরের চারদিকে রাত নামবে ঘন হয়ে।
ওহ্ হ্যাঁ, আরেকটা অলিখিত নিয়ম আছে। স্টামটিশের
টেবিলে মহিলা না থাকলেই ভালো। ওরা শাড়িগয়না ছাড়া আর কিছু নিয়ে কথা বলতে শেখেনি।
বোকার হদ্দ। এই নিয়মটা অবশ্য এখন প্রকাশ্যে চালাতে গেলে বিপদ আছে। সংবিধানে
লিখে দিয়েছে সমান অধিকার। মনে যাই থাক না কেন, মুখে স্টামটিশের টেবিলে সরে
গিয়ে জায়গা ছেড়ে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই।
সবাইকে জোগাড় করা
গেল না। বৃহস্পতিবার রাতে আড্ডা মারার কথা শুনে বেশিরভাগই উল্টোমুখে হাঁটল। আরে
বাবা, আড্ডাও মারবে আবার পরিশ্রমও করবে না, এটা একটু বাড়াবাড়ি আবদার হল না কি?
টিমোর পিছু পিছু লাইন দিয়ে আমরা আল্টস্টাডে পৌঁছলাম।
আল্টস্টাড হল পুরোনো শহর। কলকাতার যেটা বাগবাজার-শোভাবাজার, দিল্লির যেটা চাঁদনি
চক। সাউথ সিটি মলের সিসিডি যতই ঝিং চ্যাক হোক না কেন, এলিট আড্ডাবাজ হতে হলে আপনার কফি হাউস কিংবা বসন্ত কেবিনে যাওয়া ছাড়া গতি নেই। আল্টস্টাডের পাথর বাঁধানো
রাস্তার ধারে, গাছের ছায়ায় বসে আমাদের আড্ডা শুরু হল। আশপাশের টেবিল থেকে
উচ্চকণ্ঠে জার্মান হাসি ভেসে আসছিল, বাচ্চারা সাইকেল নিয়ে পাক খাচ্ছিল, আর অদূরে
একজন পাগলাটে লোক গিটার হাতে বসে মাঝে মাঝেই হুংকার দিয়ে উঠছিল।
সবাই যখন আড্ডা
দিচ্ছিল, আমি ক্যামেরা নিয়ে কায়দা করে বেড়াচ্ছিলাম। খচাখচ কনুই আর আঙুলের ছবি
তুলছিলাম। একটু পরে হেবা হঠাৎ বলে বসল, আচ্ছা কুন্তলা, তুমি কখনও আমাদের মুখের ছবি
তোল না কেন বলত? এতই কি খারাপ দেখতে আমরা? আমি আকাশ থেকে পড়ে বললাম, এ মা ছি ছি তা
কেন? এমনিই তুলি না আরকি।
কেউ সত্যিটা মানতে রাজি হল না। চেপে ধরল, কারণ বলতে হবে। তখন অবান্তরের কথা ফাঁস করলাম। বললাম এ সব ছবি আমি আমার ব্লগে ছাপাই কি না, তাই প্রাইভেসির মুখ চেয়ে তোমাদের মুখ এড়িয়ে চলি।
সকলে চেঁচিয়ে উঠে বলল, কি মুশকিল! আমরা তো চাই তোমার
পাঠকরা আমাদের দেখুক। আমি বললাম, অ্যাঁ, এ আবার কেউ চায় নাকি? সবাই আরও জোরে
চেঁচিয়ে বলল, চাই চাই চাই। শুধু বললই না, লাফ দিয়ে এসে ক্যামেরার সামনে পোজ দিয়ে
দাঁড়াল। ঠিক এমনি করে।
কোসি,
থিয়াগো, হেবা, আনিন্দি, ইয়াও, টিমো আর সিয়া---সবাই আপনাদের হ্যালো আর গুটেন টাগ
বলেছে।
are bbah! sabbai ki mishti dekhte!
ReplyDeleteঠিক বলেছ মনস্বিতা।
Deleteএত সুন্দর খুসিভরা মুখগুলি, খুব ভাল লাগল। ভাগ্যিস ওরা জোর করেছিল, নইলে তুমি তো তোমার এতগুলি সুন্দর প্রাণোচ্ছল নতুন বন্ধুদের সঙ্গে আমাদের পরিচয়ই করাতে না। বিভিন্ন দেশের এতগুলো ছেলেমেয়ে একসঙ্গে হয়ে ভালবাসার বন্ধন তৈরী করেছে, এটা দেখতে কি যে ভাল লাগল। তোমার এই ব্লগ মারফৎ আমিও ওদের হ্যালো বললাম। বিশ্বমৈত্রী-টৈত্রী আর বললাম না।
ReplyDeleteসেই মালবিকা, আমার বন্ধুরা দেখা যাচ্ছে আমার থেকে একশো গুণ স্মার্ট। একজন তো বলছিল ফেসবুকে আপলোড করে দিতে। সে উপায় নেই জেনে দুঃখ পেয়ে গেল। আমরা সত্যি খুব মজা করছি সবাই মিলে।
Deleteআমরা ওদের দেখে খুব খুশি হলাম
ReplyDeleteজানিয়ে দিও।
মিঠু
দেব মিঠু। আমার কেমন মনে হচ্ছে দুই তরফের বন্ধুদের মধ্যে আলাপ করাচ্ছি। দারুণ ভালো লাগছে।
Deletearre bbah! :-) ki sundor bandhura
ReplyDeleteএকমত তিন্নি। যেমন সুন্দর দেখতে, তেমন সুন্দর মানুষগুলো।
Deleteবাঙালির আড্ডা নিয়ে কথা উঠলেই আমার এটা মনে পড়ে যায় ...
ReplyDeletehttp://www.youtube.com/watch?feature=player_detailpage&v=NQW8SCe6ET4&t=2879
বাঙালির আড্ডার এর থেকে ভালো রিপ্রেসেন্টেশন খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সেই জন্যই তোমার মনে পড়ে পিয়াস।
Deleteসত্যি কি খাঁটি কথা না?
Delete"কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে যা হয়, মানে আমাদের সময় যা হত - এখন তো সবই নিম্নগামী - তাকে অন্তঃসারশূন্য twaddle ছাড়া কিচ্ছু বলা যায়না।"
তাই আপনার এই কথাটার সাথেও ১০০% সহমত না হয়ে উপায় নেই।
"হাটে বসে আড্ডা মেরে আত্মার যা উন্নতি হবে, তার থেকে অনেক বেশি হবে একলা ঘরের নির্জনতায়। নিজের সঙ্গে সময় কাটিয়ে। নিজেকে চিনে জেনে খুঁজে বুঝে।"
অন্তঃসারশূন্য twaddlle-ই বটে পিয়াস।
Deletekhub khub bhalo laglo ei ujjal haasimukh gulo dekhte. bhaggish ora jor kore tuliyechey chobi gulo!
ReplyDeleteসিরিয়াসলি। আমি অবাক হয়ে গেছি লোকজনের খোলামনস্কতা দেখে শম্পা।
Deleteore kuntala re..............koto koto din baade tor lekha porchi....khub khub valo lagche....sob sob lekha ekdine ekhkhuni pore felte ichche korche.........
ReplyDeleteবোঝো ব্যাপার। কেমন আছিস? ভীষণ চমকে গেছি কিন্তু তোর কমেন্ট পড়ে সাহানা। অবান্তর ভালো লাগছে জেনে আরও ভালো লাগল।
Deletekuntala, tor lekha eto saboleel...eto swavabik...aar sobcheye borokotha tor "dekha" tor "onuvuti" tui emon sundor noirbyaktikotar sathe likhte paris.... porar nesha hoye jachche. :) aar sudhui valolagche.....valo legei choleche....
Deletevalo achi re. nijer sathe theke valo achi. :)
এই রে, অচেনা লোক প্রশংসা করলে ভালো লাগে, কিন্তু ক্লাস টু-এর বন্ধু প্রশংসা করলে আরও বেশি ভালো লাগে।
Deleteতুই আরও অনেক ভালো থাক সেই কামনা করি।
Darun jhok jhok e sob bondhura. tomader adda r galpo pore darun laglo Kuntala :-) .
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ ইচ্ছাডানা। বন্ধুদের সম্পর্কে আমি আপনার সঙ্গে একমত।
Delete