দ্য ওল্ড ফ্রিৎজ
প্রাশিয়ার রাজা
প্রথম ফ্রেডেরিকের ছেলে প্রথম ফ্রেডেরিক উইলিয়ামের ঘরে, সতেরশো বারো সালের চব্বিশে
জানুয়ারি যখন ছেলে জন্মাল তখন সবাই আন্দাজ করেছিল এ ছেলে মহাবীর না হয়ে যায় না।
দাদু প্রথম ফ্রেডেরিক নিজ উদ্যোগে ডিউক থেকে প্রাশিয়ার প্রথম রাজা হয়েছিলেন, আর
তাঁর ছেলে প্রথম ফ্রেডেরিক উইলিয়াম ছিলেন এককথায় যুদ্ধবাজ। তাঁর প্রধান কীর্তির
একটা ছিল সারা ইউরোপ ঢুঁড়ে লম্বা লোক খুঁজে বার করে এনে সেনাবাহিনীতে ভর্তি করা।
এই লম্বা সেনাদের বাহিনী ইতিহাসে পট্স্ডাম জায়ান্টস্ নামে বিখ্যাত হয়ে আছে। পট্স্ডাম
ছিল বংশানুক্রমিকভাবে ফ্রেডেরিকদের প্রিয় শিকারের জায়গা।
পর পর দুটি রাজপুত্র
কচি বয়সে মারা যাওয়ার পর ঘর আলো করে যখন তিন নম্বর ছেলে জন্মাল তখন সবাই অনেক
শলাপরামর্শ করে, ভেবেচিন্তে, পেনসিল চিবিয়ে সে ছেলের নাম রাখল ফ্রেডেরিক। দ্বিতীয় ফ্রেডেরিক।
পরে রাজ্যের লোকেরা ভালোবেসে এঁকেই “বুড়ো ফ্রিৎজ” নাম দিয়েছিল। দাদু প্রথম ফ্রেডেরিকের
চোখের মণি ছিল ফ্রিৎজ। বাবা প্রথম ফ্রেডেরিক উইলিয়াম ছিলেন কড়া ধাতের লোক, তিনি গোড়াতেই
ঠিক করে ফেলেছিলেন ফ্রিৎজ বড় হয়ে তাঁর থেকেও নামজাদা যুদ্ধবাজ হবে। ঠুনকো
পিতৃস্নেহ যাতে তাঁর স্বপ্নের পথে বাধা সৃষ্টি না করতে পারে সেদিকে তাঁর কড়া নজর
ছিল। ছ’বছর বয়স হতে না হতে ছোট ছেলেদের সেনাবাহিনী বানিয়ে তিনি ফ্রিৎজকে সে
সেনাবাহিনীর কম্যান্ডার জেনারেলের পদে অভিষিক্ত করেছিলেন। শুধু ছেলেখেলা নয়,
মিনিয়েচার অস্ত্রাগার পর্যন্ত ছিল সে সেনাবাহিনীর।
কিন্তু বাবা চাইলেই
তো হবে না, নিয়তি কী চায় সেটাও তো দেখতে হবে। ফ্রেডেরিক উইলিয়াম ছেলেকে ধর্মশিক্ষা
আর অস্ত্রশিক্ষায় পারঙ্গম করে তুলতে যত উঠে পড়ে লাগলেন, তত সব গোলমাল হয়ে যেতে
লাগল। ইতিহাসের অনেক বড় বড় গোলমালের মূলে প্রাইভেট টিউটরদের হাত দেখা গেছে,
ফ্রিৎজের জীবনেও সে রকম একজন টিউটরের আবির্ভাব ঘটল, তাঁর নাম জাক ডুহান। বারো বছর
ধরে সযত্নে ছাত্র পড়িয়েছিলেন জাক। আর এই বারো বছরে মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে ষড় করে
প্রায় তিন হাজার কবিতার বইয়ের এক গোপন লাইব্রেরি গড়ে তুলেছিল ফ্রিৎজ। বাবার ছক
কেটে দেওয়া সিলেবাসের বাইরে গ্রীক আর রোমান ক্ল্যাসিক সাহিত্য গুলে খেয়েছিল। ফরাসি
দর্শনশাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিল।
জাকের পর নিয়তির রূপ ধরে ফ্রিৎজের জীবনে এলেন হানস্। হানস্ ছিলেন অভিজাত সৈনিক পরিবারের সন্তান। তাঁর বাবা ফ্রিৎজের বাবার সেনাবাহিনীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সেনাধ্যক্ষ ছিলেন। পূর্বপুরুষের পদাঙ্ক অনুসরণ করে হানস্, ফ্রেঞ্চ এবং আইনপাঠ শেষ করে ফ্রেডরিখ উইলিয়ামের সেনাবাহিনীতে যোগ দিলেন।
আর শুরু হল এক অসাধারণ
বন্ধুত্বের। ফ্রিৎজ আর হানস একসঙ্গে অংক শিখতেন, কবিতা পড়তেন, বাঁশি বাজাতেন। আট বছরের বড়
বন্ধুর প্রতি অসম্ভব গুণমুগ্ধতা ছিল ফ্রিৎজের। আর সেই জন্যই বোধহয় তিনি হানস্কে
মনের কথা খুলে বলেছিলেন, যে তিনি পালাতে চান। রাজত্ব, যুদ্ধ, প্রথম ফ্রেডেরিক উইলিয়ামের নাগাল থেকে
অনেক দূরে। হানস্ প্রথমটা মত দেননি। কিন্তু
কোতোয়ালপুত্রের কথা কবেই বা কোন রাজপুত্র শুনেছে? সতেরশো
তিরিশ সালের পাঁচই অগস্ট, ফ্রেডেরিক উইলিয়ামের সেনাবাহিনী যখন রাইনউপত্যকায় যুদ্ধজয়ের ফিকিরে ঘুরছে, ফ্রিৎজ পালালেন। পালিয়ে বেশিদূর যেতে পারলেন না, চিঠি দেখে ফ্রিৎজ আর হানস্ দুজনকেই ধরে ফেললেন ফ্রেডেরিক উইলিয়াম। যুদ্ধপলাতক
হিসেবে দুজনেরই কোর্টমার্শাল হল। হানস্ আজীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলেন। ফ্রেডেরিক উইলিয়াম যত রগচটাই হোন বোকা ছিলেন না। ছেলের রোগের আসল উৎসটা চিহ্নিত করতে ভুল হয়নি
তাঁর। কোর্টের আদেশ ডিঙিয়ে হানসের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিলেন তিনি। ফ্রিৎজও
একেবারে পার পেলেন না। তার শাস্তি হল ঘটনাস্থলে উপস্থিত
থেকে হানসের
শিরচ্ছেদ স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করা।
মানুষের জীবনকে স্পষ্ট বিফোর আফটার কম্পার্টমেন্টে ভাগ করা যায় কি না সে নিয়ে
আমার সন্দেহ আছে। বীজ চিরদিনই বুকের ভেতর গোপন থাকে, নাকি হঠাৎ একদিন সকালবেলা ঘুম
থেকে উঠে আপাদমস্তক নিরীহ, শান্তিপ্রিয়, রাস্তায় ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়ানো ফইজল
খান, বাপ কা দাদা কা সবকা বদলা নিতে খোলা তলোয়ার হাতে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে?
হানসের মৃত্যুদণ্ডটাই আঠেরো বছরের ফ্রিৎজকে রাতারাতি বদলে দিয়েছিল কি না, সেটা
জানার এখন আর কোনও উপায় নেই। কিন্তু বদল যে ঘটেছিল সে নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
হানসের মৃত্যুর দশ বছর পর, সতেরশো চল্লিশ সালে ফ্রেডেরিক উইলিয়াম পরলোকগত হলে
প্রাশিয়ার রাজার সিংহাসনে আঠাশ বছরের তরুণ রাজা দ্বিতীয় ফ্রেডরিখের রাজ্যাভিষেক
হল।
কিন্তু রাজত্ব নামেই রাজত্ব, প্রাশিয়া তখন পশ্চিম ইউরোপ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা খণ্ডখণ্ড জমিজায়গির ছাড়া আর কিছু নয়। দ্বিতীয় ফ্রেডেরিকের মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়াল তাঁর এই ছত্রাকার রাজত্বকে সংগঠিত করা।
শুরু হল যুদ্ধ। অস্ট্রিয়া, রাশিয়া, ফ্রান্স, স্যাক্সনি, সুইডেন---সকলের
বিরুদ্ধে হইহই করে যুদ্ধযাত্রা করল পুঁচকে প্রাশিয়া। একমাত্র গ্রেট ব্রিটেন আর
হ্যানোভার ছিল দ্বিতীয় ফ্রেডেরিকের মিত্রপক্ষ। আগত পঁচিশ
বছর ধরে একের পর এক যুদ্ধে মগ্ন হয়ে রইলেন দ্বিতীয় ফ্রেডেরিক।অগুন্তি লোক মরল,
রাজ্যের পর রাজ্য ছারখার হল, অর্থনীতি ধসে পড়ল। দ্বিতীয় ফ্রেডেরিক রাজত্ব শুরু
করেছিলেন দুই মিলিয়ন প্রজা আর ১২০,০০০ বর্গ কিলোমিটারের ছিন্নভিন্ন স্বভূমি দিয়ে, চোখ
বুজেছিলেন যখন তখন প্রাশিয়া ১৯৫,০০০ বর্গ কিলোমিটার আর ছয় মিলিয়ন প্রজা সম্বলিত
ইউরোপের অন্যতম শক্তিশালী দেশ।
দ্বিতীয় ফ্রেডেরিকের বীরত্ব নিয়ে অনেকরকম লিজেন্ড প্রচলিত আছে। শত অনিচ্ছেতেই হোক আর বাবার চাপে পড়েই হোক, যুদ্ধটা করতে তিনি শিখেছিলেন। ফ্রেডেরিক সর্বদা নিজে সামনে থেকে সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিতেন। কথিত আছে যুদ্ধ চলাকালীন ফ্রেডেরিককে পিঠে নেওয়া অবস্থায় ছ’ছটি ঘোড়া গুলি খেয়ে মরেছিল। আবার অন্য রকম সাক্ষ্যও আছে। ইতিহাস বলে যুদ্ধে হেরে যাওয়ার পর একাধিকবার সেনাদল ছেড়ে চলে গেছেন ফ্রেডেরিক। ঘণ্টার পর ঘণ্টা মৌন হয়ে বসে কঞ্চি দিয়ে মাটিতে আঁক কেটেছেন। এখন আমরা একে পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস বলে বাবাবাছা করি, তখন একজন রাজার পক্ষে এর থেকে বড় কাপুরুষতার পরিচয় আর কিছু হত না।
ইউরোপের ক্ষমতার লড়াইয়ে ক্রমাগত পিছিয়ে পড়া
প্রাশিয়াকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক দিক থেকে প্রধান শক্তির ভূমিকায় এনে
দাঁড় করানোর পেছনে দ্বিতীয় ফ্রেডেরিকের অবদান অবিশ্বাস্য। চল্লিশ বছরের রাজত্বের
গোড়ার দিকটা যুদ্ধবিগ্রহে কাটিয়ে শেষাংশ প্রাশিয়ার পুনর্গঠনে ব্যয় করেছিলেন তিনি। কৃষি,
শিল্প, বাণিজ্য, আইনব্যবস্থা---সবেতে দ্বিতীয় ফ্রেডেরিকের সুদক্ষ পরিচালনার ছাপ
পড়েছিল। ট্যাক্সব্যবস্থা সংশোধন করেছিলেন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষার কথা
দিয়েছিলেন এবং সে কথা রেখেছিলেন, দেশ জুড়ে খাল কেটেছিলেন, শস্যের দাম কড়া হাতে
নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন, শস্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন যাতে ফসল খারাপ হলে চাষিদের
অন্নসংস্থানের অভাব না হয়।
একা হাতে প্রাশিয়ার ভোল পালটে দিয়েছিলেন দ্বিতীয়
ফ্রেডেরিক---ফ্রেডেরিক দ্য গ্রেট। রাজ্যশাসনকে প্রজা এবং রাজার মধ্যে একটা চুক্তি
হিসেবে দেখতেন তিনি। নিজেকে বলতেন, ফার্স্ট সারভেন্ট অফ দ্য স্টেট। ফ্রেডেরিক দ্য
গ্রেটের হাত ধরে প্রাশিয়ার এই উত্থানের মধ্যেই বিংশ শতাব্দীর জার্মান ইতিহাসের বীজ
লুকোনো ছিল বলে অনেকের ধারণা। ফাদারল্যান্ডের প্রতি ফ্রেডেরিকের একনিষ্ঠতা,
প্রাশিয়াকে ইউরোপের সেরা শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার তাঁর এই অদম্য বাসনার
প্রতিফলন পড়েছিল হিটলার, বিসমার্ক জাতীয় নেতাদের ভাবনাচিন্তায়। হিটলারের ব্যক্তিগত
হিরো ছিলেন ফ্রেডেরিক দ্য গ্রেট। তাঁর ঘরের দেওয়ালে ফ্রেডেরিকের ছবি সসম্মানে টাঙানো
থাকত। তবে একলব্যের ছিরি দেখে দ্রোণাচার্যের বিচার করতে যাওয়াটা আমার মতে অন্যায়
হবে। হিটলার শুধু ফ্রেডেরিক দ্য গ্রেটের জাত্যাভিমানটাই দেখেছিলেন, রাজ্যশাসনে তাঁর
সহনশীলতা, প্রজামনস্কতার দিকটা অন্ধের মতো এড়িয়ে গিয়েছিলেন। ভুলে গিয়েছিলেন,
ব্যক্তিগত বিশ্বাসে নাস্তিক হলেও ধর্মের প্রতি সহনশীলতা ছিল ফ্রেডেরিক দ্য গ্রেটের
মূল নীতি। ইহুদিদের প্রতি ফ্রেডেরিক যে খুব সদয় ছিলেন তা নয়, কিন্তু সমকালীন
শিক্ষায়, বিজ্ঞানে, বাণিজ্যে ইহুদিদের অবদানটাও তাঁর স্মরণে ছিল। পোল্যান্ড
ইত্যাদি দেশের সীমানায় বসবাসকারী বণিক ইহুদিরা ফ্রেডেরিক দ্য গ্রেটের উৎসাহ এবং
সুরক্ষা দুই-ই পেয়েছিল। একদিক থেকে দেখতে গেলে “জার্মান শ্রেষ্ঠত্বের” বোধ
হিটলারের থেকে কোটিগুণ বেশি ছিল ফ্রেডেরিকের মধ্যে। জার্মানিকে (তৎকালীন প্রাশিয়া)
বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যা যা করার দরকার, যাদের যাদের সঙ্গে হাত
মেলানো দরকার---সব করতে রাজি ছিলেন ফ্রেডেরিক দ্য গ্রেট। তাদের ধর্ম, জাতি, গায়ের
রং ইত্যাদি নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় ছিল না তাঁর।
পৃথিবীতে মিলিটারি জিনিয়াসদের নিয়ে যে কটা টপ টেন লিস্ট তৈরি হবে, তাতে
ফ্রেডেরিক দ্য গ্রেটের নাম জ্বলজ্বল করবে আরও অনেকদিন। ফ্রেডেরিকের পক্ষ-বিপক্ষ
নিয়ে আরও অনেকদিন ইতিহাস লড়ে যাবে। ফ্রেডরিকের চরিত্রের বিভিন্ন দিক নিয়ে ফরেনসিক
কাটাছেঁড়া চলবে, আসলে তিনি কী? জার্মান সুপ্রিমেসির প্রবক্তা, যুদ্ধবাজ সম্রাট, নাকি
প্রজাবৎসল দক্ষ শাসক?
কিন্তু সব কাটাছেঁড়া পেরিয়েও যে প্রশ্নটা জ্বলজ্বল করবে তা হল, ফ্রিৎজ নামের সেই ছেলেটার কী হল। সেই কবিতা পড়া, বাঁশি বাজানো ছেলেটা? রাজার ঘরে জন্মেও যে নিজে একটাও যুদ্ধ করতে চায়নি, সমস্ত রাজনীতি, কূটনীতির ঘোলাজল এড়িয়ে যে হানসের সঙ্গে অনেক দূরে পালিয়ে যেতে চেয়েছিল, সেই ছেলেটার কানাকড়িও কি বেঁচে ছিল পরমপ্রতাপশালী সম্রাট ফ্রেডেরিক দ্য গ্রেটের মধ্যে?
ছিল। এত যুদ্ধের পরেও দ্বিতীয় ফ্রেডেরিক বাঁশি বাজাতে ভোলেননি।
প্রায় একশোখানা সোনাটা রচনা করেছিলেন তিনি আর চারখানা সিম্ফনি। বাখ ছিলেন ফ্রেডেরিকের
সভাকবিদের অন্যতম। রোমান সম্রাট মার্কাস অরেলিয়াসের মতো দার্শনিক-সম্রাট হওয়ার
স্বপ্ন ছিল তাঁর। এনলাইটেন্ড্ অ্যাবসলিউটিজম্ মার্কা জলদগম্ভীর বিষয় নিয়ে ভলতেয়ারের
সঙ্গে দ্বিতীয় ফ্রেডেরিকের চিঠিপত্রে নিয়মিত আলোচনা, ঝগড়াঝাঁটি চলত। জার্মান ছাড়াও ইংরিজি, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ, পর্তুগিজ, ইত্যালিয়ান ইত্যাদি ভাষা বলতে পারতেন
তিনি।
কবিতা, সংগীত, দর্শন এসব ছাড়াও রাজা আরেকটি জিনিসকে মন দিয়ে ভালোবাসতেন---নিজের
জন্মের শহর বার্লিনকে। দাদু প্রথম ফ্রেডেরিকের প্রতিষ্ঠা করা প্রাশিয়ান অ্যাকাডেমি
অফ সায়েন্সেস (বার্লিন অ্যাকাডেমি) তখন লন্ডন, প্যারিসের নতুন নতুন গজিয়ে ওঠা অ্যাকাডেমির
ছটায় ম্লান হয়ে গেছে। দ্বিতীয় ফ্রেডেরিক কোমর বেঁধে নামলেন বার্লিন অ্যাকাডেমির
হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য। ফ্রেঞ্চদের সঙ্গে আজীবন যুদ্ধ করলে কী হবে, ফ্রেঞ্চ
ভাষা না শিখলে যে সমসাময়িক দর্শন-বিজ্ঞান-ধর্ম ইত্যাদি অধরা রয়ে যাবে সে বুদ্ধি
তাঁর মাথায় খেলেছিল। ফ্রেঞ্চকে অ্যাকাডেমির অফিশিয়াল ভাষা ঘোষণা করা হল, আর দর্শন
হয়ে উঠল অ্যাকাডেমির গবেষণার প্রধান থিম। ইম্যানুয়েল কান্টের মতো দার্শনিক অ্যাকাডেমির
সদস্য ছিলেন।
রাজত্বকালে বার্লিনের সৌন্দর্যবৃদ্ধির খাতিরে অনেকগুলো প্রাসাদ তৈরি করেছিলেন ফ্রেডেরিক দ্য গ্রেট। তাদের মধ্যে কিছু কিছু, যেমন বার্লিন স্টেট অপেরা, রয়্যাল লাইব্রেরি, সেন্ট হেজউইগ’স ক্যাথিড্র্যাল ইত্যাদি এখনও স্বমহিমায় বর্তমান। কিন্তু নিজের মনের মতো প্রাসাদটা রাজা বানিয়েছিলেন শহরের বাইরে, পট্স্ডামে।
পট্স্ডামের কথা মনে আছে, সেই যেখানে ফ্রিৎজের পূর্বপুরুষরা শিকারশিকার খেলতে
যেতেন? ফ্রিৎজের বাজখাঁই বাবা ফ্রেডেরিক উইলিয়াম সেখানে নিজের থাকার জন্য ছোট একটা
বাড়িও বানিয়েছিলেন। ফ্রিৎজ রাজা হয়ে সেখানে নিজের সামার প্যালেস বানাল। ফ্রান্সের
ভার্সাই প্যালেস আছে, জার্মানিরই বা কেন থাকবে না? সতেরশো চুয়াল্লিশ সালে, বাল্ড্
মাউন্টেন নামের স্থানীয় এক ছোট পাহাড়ের গায়ে এক ভাইনইয়ার্ড বপনের আদেশ দিলেন ফ্রেডেরিক
দ্য গ্রেট। সেই ভাইনইয়ার্ডের বিস্তৃত নির্জনতার মধ্যে তৈরি হল সাঁ-সুসি (Sans-souci: Sans অর্থ ‘শূন্য’ বা ‘হীন’
আর Souci
অর্থ
দুশ্চিন্তা, দুর্ভাবনা। দুইয়ে মিলিয়ে দুশ্চিন্তাহীন, দুর্ভাবনাহীন) প্রাসাদ। সামারের
ক’টা দিন রাজকার্যের সমস্ত ভাবনাচিন্তামুক্ত হয়ে এই প্রাসাদে এসে কাটাবেন, এই
স্বপ্ন ছিল ফ্রেডেরিকের।
ভার্সাইয়ের অনুকরণে সাঁ-সুসি বানানোর কথা মুখে বলেছিলেন বটে ফ্রেডেরিক, কিন্তু হাড়েমজ্জায় সাঁ-সুসি ভার্সাইয়ের থেকে যতখানি আলাদা হওয়া সম্ভব ততখানিই আলাদা। ভার্সাই বিলাসের প্রতীক, সাঁ-সুসি নির্জনতার; ভার্সাইয়ে ঘরের সংখ্যা দু’হাজার একশো তিপ্পান্ন, সাঁ-সুসির ঝাড়াঝাপটা একতলা কাঠামোর দুদিকে পাঁচ-পাঁচ করে মোটে দশটা ঘর; ভার্সাইয়ের চোখধাঁধানো বারক স্টাইল স্থাপত্যের বদলে সাঁ-সুসির শান্ত, ভাবুক রোকোকো। যদিও প্রাসাদ বানানোর সময় নামজাদা স্থপতিদের কাজে লাগিয়েছিলেন ফ্রেডেরিক দ্য গ্রেট, কিন্তু প্রাসাদের বিন্যাস আর সজ্জায় সম্রাটের ব্যক্তিগত পছন্দঅপছন্দ এতখানিই প্রভাব বিস্তার করেছিল যে সাঁ-সুসি প্রাসাদের স্থাপত্যকে ‘রোকোকো’ না বলে ‘ফ্রেডেরিকিয়ান রোকোকো’ বলেই ডাকে সবাই।
সাঁ-সুসি ছিল ফ্রেডেরিক দ্য গ্রেটের আত্মার মুক্তি,
প্রাণের আরাম। রাজকার্য থেকে ছুটি পেলেই ফ্রেডেরিক সেখানে গিয়ে দর্শনচর্চা করতেন
আর বাঁশি বাজাতেন। রাজার সামার প্যালেস হিসেবে সাঁ-সুসি যে খুব একটা
প্র্যাকটিক্যাল হয়নি সেটা অচিরেই বোঝা যেতে লাগল। সকলেই বলল এবার প্রাসাদের কিছু
পরিমার্জন করা হোক, ঘরের সংখ্যা বাড়ানো হোক, বাইরের দেওয়ালের পলেস্তারা চটে যাচ্ছে—সেগুলো
সারানো হোক, ফ্রেডেরিক কোনও কথায় কান দিলেন না। বললেন, কোনও দরকার নেই। সাঁ-সুসি
আমি আমার জন্য বানিয়েছি, আমার সঙ্গে সঙ্গেই ও-ও মরবে।
রাজা ফ্রেডেরিক কবেই মরে ভূত হয়ে গেছেন, সাঁ-সুসি
এখনও বহাল তবিয়তে বর্তমান আছে। তাঁর ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে রাজপরিবারের বংশধরেরা
সাঁ-সুসিকে সাজিয়েছে গুছিয়েছে, যত্ন করেছে। তারই ফলে আজ সাঁ-সুসি ইউনেসকোর বিশ্ব
হেরিটেজ সাইটের অন্যতম। বছরের একটা দিন সাঁ-সুসির গেট খুলে দেওয়া হয় সাধারণের
জন্য, প্রাসাদকে আলোয় আলোয় সাজিয়ে তোলা হয়, ছেলেবুড়োনারীপুরুষ সবাই বারক আমলের মত
ধড়াচূড়া পরে পার্কে ঘোরাঘুরি করে। এ’বছরের সাঁ-সুসি নাইটের সময় কপালগুণে আমরা
বার্লিনে ছিলাম, তাই আমাদেরও সাঁ-সুসি দর্শনের সৌভাগ্য হয়েছিল। ঘণ্টা চারেক ধরে
বিরাট বাগানের নুড়ি বেছানো পথে হেঁটে হেঁটে, আপাদমস্তক অচেনা লোকেদের ছবি তুলে
(তাঁরা একটুও আপত্তি করছিলেন না, বরং থেমে পোজ দিচ্ছিলেন), ব্রাটউয়র্স্ট, নিউটেলা
ক্রেপ (আসল কথাটা অবশ্য ক্রেপ নয়, “খেপ”) আর কাগজের তিনকোণা ঠোঙায় করে আলুভাজা
খেয়ে বেড়ালাম।
রাজা বেঁচে থাকতেই তার যত কেরামতি, মরে গেলে সে আমার আপনার মতোই নিড়বিড়ে,
অসহায়। সতেরশো ছিয়াশি সালের সতেরই অগস্ট, সাঁ-সুসি প্রাসাদের স্টাডির আরামকেদারায়
বসে, চুয়াত্তর বছর বয়সে নিঃসঙ্গ, নিঃসন্তান সম্রাট ফ্রেডরিক দ্য গ্রেট শেষনিঃশ্বাস
ত্যাগ করলেন, আর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সমস্ত দাপট হাওয়ার মত উবে গেল। সারাজীবন কাজের
ফাঁকে ফাঁকে নিজের মৃত্যু নিয়ে অনেক ভেবেছিলেন ফ্রেডেরিক দ্য গ্রেট। স্পষ্ট কথায় নিজের ইচ্ছে
প্রকাশ করে গিয়েছিলেন, মৃত্যুর পর যেন তাঁকে সাঁ-সুসির মাটিতে কবর দেওয়া হয়, তাঁর
প্রিয় গ্রেহাউন্ডের কবরের ঠিক পাশে। উইদআউট পম্প, উইদআউট স্প্লেন্ড্র, অ্যাট
নাইটফল। সম্রাটের সে ইচ্ছেকে কাঁচকলা দেখিয়ে তাঁর ভাইপো, নতুন রাজা দ্বিতীয় ফ্রেডেরিক
উইলিয়াম আদেশ দিলেন রাজকীয় মর্যাদায় সম্রাটকে পট্স্ডামের গ্যারিসন চার্চের
মাটিতে কবর দেওয়া হোক, প্রথম ফ্রেডেরিক উইলিয়ামের কবরের ঠিক পাশে।
প্রথম
ফ্রেডেরিক উইলিয়াম, অর্থাৎ ফ্রিৎজের বাবা। যে বাবার হাত থেকে আজীবন পালিয়ে বাঁচতে
চেয়েছে ফ্রিৎজ, আর বারবার ব্যর্থ হয়েছে। মৃত্যুর পরে সেই বাবার কাছে এসেই কি না
আত্মসমর্পণ করতে হল?
গল্প এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত, কিন্তু নিয়তির কথা ভুলে গেলে চলবে না। যখন মনে
হচ্ছে এইবার অভিনয় শেষ, দর্শকেরা উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছে, স্টেজের দু’দিক থেকে
পর্দা এগোতে শুরু করেছে, ঠিক তক্ষুনি নিয়তি উইং-এর পাশ থেকে, “আবার সে এসেছে
ফিরিয়া” বলে একগাল হেসে বেরিয়ে আসবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে মিত্রপক্ষের বোমার হাত থেকে গৌরবময় জার্মান
ইতিহাসকে বাঁচাতে হিটলার আদেশ দিলেন বাবা ছেলে দু’জনের কফিনকেই গ্যারিসন চার্চ
থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে বার্লিনের কাছের এক আন্ডারগ্রাউন্ড বাংকারে রাখতে। উনিশশো পঁয়তাল্লিশের
সাতাশে এপ্রিল অ্যামেরিকান আর্মি সে কফিন খুঁজে পেল। আরও পাঁচটা নাৎসি ট্রেজারের
সঙ্গে তারা সেটা সযত্নে তুলে এনে রাখল মারবুর্গ প্রাসাদের বেসমেন্টে। সেখান থেকে
দুই রাজার কফিনই ফের স্থানান্তরিত হল স্টুটগার্টের কাছে বুর্গ হোহেনজোলেন নামের দুর্গে। এই
হোহেনজোলেনই হচ্ছে ফ্রেডেরিকদের আদি বংশ। যেখান থেকে ফ্রিৎজের দাদু প্রথম
ফ্রেডেরিকের উত্থান শুরু হয়েছিল। পিতৃপুরুষের ভিটেয় বাবা আর ছেলের কংকাল পাশাপাশি
চুপ করে শুয়ে রইল।
রাইন দিয়ে কত জল বয়ে গেল, দেওয়াল উঠল, দেওয়াল ভাঙল। উনিশশো নব্বই সালে জার্মানি
এক হল। যুদ্ধের ক্ষত তখন মিলিয়ে এসেছে, অবিভক্ত জার্মানি আবার বিশ্বের দরবারে মাথা
উঁচু করে দাঁড়ানোর জন্য তৈরি। এমন সময় আর কে জার্মানির রোলমডেল হতে পারেন,
ফ্রেডেরিক দ্য গ্রেট ছাড়া? উনিশশো একানব্বই সালের সতেরোই অগস্ট, মৃত্যুর দু’শো পাঁচ
বছর পরে ফ্রেডরিক দ্য গ্রেটের কফিনকে হোহেনজোলেনের বিস্মৃত কবর থেকে তুলে এনে, ডানামেলা
ঈগলের ছবি আঁকা প্রাশিয়ান পতাকায় মুড়ে, সসম্মানে শায়িত করা হল সাঁ-সুসির মাটিতে।
ফ্রিৎজ বলেছিল, “Quand je serai là, je serai sans souci”, Once I am here, I shall be carefree. ওর একটা ইচ্ছে অন্তত পূর্ণ হয়েছে।
*****
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ গুগ্ল্
চমৎকার কুন্তলা। এত সুন্দর ইতিকথা পড়ে আর চুপ করে থাকা যায় না। ইতিহাস তো গল্পকথাই। শুধু কি কাটাকাটি, মারামারি, বা রাজনীতির কচ্কচি? অন্তঃসলিলা ফল্গুর মত মানুষের ভাবনা, তার রুচির পরিচয়, তার জীবন - এটাও তো ইতিহাসই। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে অতীতের এই ধারাকে চিনে নেবার চোখকে, সেই সুবাসে বর্তমানের আমাদেরকে সুবাসিত করার মনটাকে অনেক ধন্যবাদ।
ReplyDeleteখাবার ছবিগুলো বরাবরই বেশ লোভনীয়।
ধন্যবাদ মালবিকা।
Deleteঅসাধারণ!
ReplyDeleteঅধিকাংশ বঙ্গসন্তান, সে লেখক হোক কিংবা ব্লগার, ভাবেন ফাঁকতালে একটা কিছু লিখে ফেললেই হল। নামী পোর্টেলে একটা আর্টিকল, কিংবা কলেজ স্ট্রিটের পাবলিশার থেকে একটা বই বেরিয়ে গেলেই ভাবেন যে রবি ঠাকুর আর সৌরভ গাঙ্গুলির পর তিনিই আজ থেকে বঙ্গের ত্রাতা বলে ঘোষিত হলেন।
আপনি আগেও জার্মানির ইতিহাস নিয়ে কিছু একটা লিখেছিলেন, তখন বলেছিলাম যে রিসার্চ করে লেখা আমার খুব পছন্দ। এবার বলছি, লিখতে থাকুন। একটু সিরিয়াস হয়ে লিখতে থাকুন।
থ্যাংক ইউ দেবাশিস, উৎসাহ দেওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
DeleteKhub sundor hoyechhe lekhata. :) Ar sausage ta ki boro, baap re!
ReplyDeleteতাও এই সসেজটা ক্লাইনে, বিম্ববতী। অর্থাৎ কি না ছোট সাইজের। এর থেকেও বড় একটা বিক্রি হচ্ছিল।
Deleteঅত্যন্ত ভালো লেগেছে ।
ReplyDeleteমিঠু
Thank you, Mithu.
Deleteদেবাশীষের সঙ্গে একমত। এই লেখাটা যেন একটা দলিল হয়ে থাকে। খুবই চমৎকার হয়েছে।
ReplyDeleteজনান্তিকেঃ "খেপ" -সঠিক উচ্চারণ- দেখে পরম পরিতৃপ্ত হলাম। আমার সেই খোঁয়াসঁ-র কথা মনে পড়ে গেল। :)
থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ কৌশিক।
Deletekhub shundor lekha. aneker-i itihash bhalo lage na...amar byaktigato dharona holo sheta lekhar shoili-r jonno. itihash-ke shahaj sharol galper mato kore bolle keno bhalo lagbe na, balo to? Ramyani Bikkho tar ekta udaharan.
ReplyDeletetomar kintu seriously bhaba uchit...eto shundor lekho. mon bhore gelo.
bhalo theko
আরে দেবশ্রী, থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ। উৎসাহ দিলে যে তাতে খুব খুশি হলাম।
Deleteei lekhata asambhab bhalo kuntala..:-) darun darun laglo pore .
ReplyDelete... onek dhonyobad Kuntala. chhobigulo-O daruun laglo.
ReplyDeleteতিন্নি, ইচ্ছাডানা, অনেক অনেক ধন্যবাদ।
ReplyDeleteপটসডামের নাম এতদিন শুধু ওই তিন মাতব্বরের কনফারেন্সের কথাতেই জানতাম, তার এত চমৎকার ইতিহাসটাই জানতাম না। লেখাটা দারুণ হয়েছে। আপনার গপ্পো বলার ঢঙটা আমার অনেকটা নারায়ণ সান্যালের মত লাগে, ভীষণ তথ্যবহুল অথচ ক্লান্তিকর নয়।
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ পিয়াস। সক্কালসক্কাল মন ভালো হয়ে গেল। আজ দিনটা নির্ঘাত ভালো কাটবে।
Deletegalpota pore khub e bhalo laglo .. :)
ReplyDelete