আসাম ৬/ আউনি আটি সত্র
মাজুলিতে সত্র-সংস্কৃতি বেশ প্রবল। পনেরোশো শতাব্দীতে মাজুলির প্রসিদ্ধ সাধু শংকরদেব ও তাঁর শিষ্য মাধবদেবের উদ্যোগে নববৈষ্ণব ধর্মের প্রচলন হয়। সেই সুযোগে মাজুলিতে বেশ কয়েকটি সত্র স্থাপনা হয়েছিল। আউনি আটি সত্র এদের মধ্যে বেশ পুরোনো। আউনি হল একধরণের পান, আর আটি হল উঁচু জায়গা, বা ঢিপি গোছের। অর্থাৎ ব্রহ্মপুত্রের মাঝে জেগে ওঠা উঁচু ভূমিখণ্ড মাজুলি, যেখানে প্রচুর আউনি পান ফলে, সেখানে প্রতিষ্ঠিত সত্রের নাম হয়েছে আউনি আটি সত্র। আউনি আটি সত্রের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন অহোম রাজা সুতামলা, যিনি বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ করে জয়ধ্বজ সিংহ নামে পরিচিত হন। শিবসাগর ঘুরতে গিয়ে এই ব্যাপারটায় আমার বার বার ধাঁধা লেগে যাচ্ছিল। এই দেখছি মন্দির বানিয়েছেন শিবসিংহ, পুকুর কেটেছেন জয়সিংহ, আবার চরাইদেও-এ অহোম রাজাদের সমাধি দেখতে গিয়ে দেখছি সেখানে ঢিপির তলায় শুয়ে আছেন সুকাফা, সুবিংফা, সুদংফা-রা। একই বংশের লোকের নাম একাধারে সুকাফা, সুবিংফা আর শিবসিংহ, রুদ্রসিংহ হয় কী করে ভেবে ভেবে আমার মাথা গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল। তারপর এই পোস্ট লেখার সময় ইন্টারনেট ঘাঁটতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম সব গোলযোগের হোতা এই জয়ধ্বজ। জয়ধ্বজের বাবা সুতিংফা ছেলের নাম রেখেছিলেন সুতামলা, কিন্তু বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ করে সুতামলা নিজের নাম রাখলেন জয়ধ্বজ সিংহ। আর তার পর থেকেই অহোম রাজাদের দু’দুখানা করে নাম রাখার চল হল। যেমন শিবসাগর খ্যাত শিবসিংহের আরেকটি নাম সুতাংফা, আর জয়সাগরওয়ালা রুদ্রসিংহ হলেন সুখরুংফা।
সত্রের মুল মন্দির বা নামঘরটি ভারি সুন্দর। পুরী থেকে আনা গোবিন্দের মূর্তি পুজো হয় এখানে। ভেতর থেকে গম্ভীর সুরে মন্ত্রধ্বনি আসছিল। বুঝছিলাম প্রার্থনা/ পুজো চলছে। অর্চিষ্মানের কৌতূহল বেশি, ও বলছিল চল ভেতরে গিয়ে দেখি। আমার একটু বাধো বাধো ঠেকছিল। পাশ দিয়ে যাওয়া এক ভদ্রলোককে পাকড়াও করে জিজ্ঞাসা করলাম, ভেতরে যাওয়া যাবে? তাতে তিনি ভীষণ ভাঙা হিন্দিতে হাত পা নেড়ে যেটা জিজ্ঞাসা করলেন, আন্দাজে বুঝলাম সেটা বাংলা করলে হয়, “দীক্ষা নেওয়া হয়েছে কি?” আমরা সত্যিটা স্বীকার করলাম। তাতে তিনি আবার হাত পা নেড়ে বুঝিয়ে দিলেন, তাহলে ভেতরে না যাওয়াই ভালো। অর্চিষ্মানের মুখ দেখে মনে হল ও ভাবছে জিজ্ঞাসা না করে গটগট করে ঢুকে গেলেই হত, কিন্তু আমার অত সাহস হয় না।
আর তাছাড়া ভেতর দেখে হবেই বা কী, বাইরেটাই যখন এত সুন্দর। জুতো মোজা সব সাইকেলের কাছে খুলে রেখে আসতে হয়েছিল, খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে আমরা সত্র ঘুরে দেখলাম। মোড়ে মোড়ে পুকুর, পুকুরের ধারে ধারে একটা দুটো বাড়ি, বাড়ির গায়ে উজ্জ্বল হলুদ রং করা। একেকটা বাড়ির দেওয়ালে আবার বিস্তর কারুকার্যও আছে। কারুকার্য সবই বাঁশের। বাঁশের তৈরি একরকম গোল ঢালের মতো জিনিস এখানে গৃহসজ্জার জন্য খুব ব্যবহার হয়, সত্রের বাড়ির দেওয়ালেও সে জিনিস আছে দেখলাম। আরেকটা বাড়ির দেওয়ালে দেখলাম একটা প্রায় অর্চিষ্মানের দৈর্ঘ্যের মাছ, বাঁশের তৈরি, শুইয়ে রাখা। সত্রের অনেকগুলো ঘরের মধ্যে দুটো ঘরে আমরা ঢুকেছিলাম। একটা হল ছবি আর্কাইভ। সত্রের সব পূর্বতন সত্রাধিকারী, আসামের বিখ্যাত লোকজনের (যেমন ভূপেন হাজারিকা) ছবিতে ঘরের মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত ঠাসা।
দ্বিতীয় ইন্টারেস্টিং ঘরটা হচ্ছে সত্রের মিউজিয়াম। দশ টাকা টিকিট, প্রদর্শিত জিনিসপত্রে হাত দেওয়া এবং ছবি তোলা নিষেধ। নানারকম দিশি বাজনা, নাটকের কাপড়চোপড়, অস্ত্রশস্ত্র, পুতুল, জীবজন্তুর মূর্তি, আরও যা যা একটা মিউজিয়ামে থাকা সম্ভব সবই আছে আউনি আটির ছোট্ট একঘরের মিউজিয়ামে। কিন্তু আমার সবথেকে ভালো লেগেছে যে জিনিসটা দেখে সেটা হচ্ছে একটা লাল শালুতে মোড়া ম্যানুস্ক্রিপ্ট। নাম গজেন্দ্রচিন্তামণি। সতেরশো বাইশ সালে শিবসিংহের দ্বিতীয় স্ত্রী অম্বিকারানীর অনুরোধে শম্ভুনাথ ওঝা বইটি লিখেছিলেন। নাম দেখে মনে হতে পারে হাতিদের মনস্তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এই বইতে, কিন্তু আসলে বইখানায় লেখা আছে হাতিদের সম্ভাব্য রোগ ও তার নিরাময় সম্পর্কে আলোচনা।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি এগারোটা বেজে গেছে। আমাদের মাজুলি ছাড়ার সময় দ্রুত এগিয়ে আসছে। দেড়টার ফেরি ধরে আমরা জোড়হাট যাব। সত্রের দরজার সামনের ধুলোতে থেবড়ে বসে মোজাজুতো পরে, জিনসের ধুলো ঝেড়ে সাইকেলে উঠে পড়লাম। সামনের মেঠো পথ পেরিয়ে এসে ডানদিকে বাঁক নিয়ে পিচরাস্তা। কিছুটা পথ যেতে না যেতেই অনভ্যসের ফোঁটা চড়চড় করে উঠল। লা মাইসন দে আনন্দ থেকে কমলাবাড়ি চারিয়ালি (চৌরাস্তা) তিন কিলোমিটার, কমলাবাড়ি চারিয়ালি থেকে আউনি আটি সত্র পাঁচ কিলোমিটার। অর্থাৎ যাওয়ার সময় আমরা আট কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে গেছি, ফেরার সময় আবার আট কিলোমিটার চালিয়ে ফিরব। এক্সারসাইজহীন শরীরে হঠাৎ ষোলো কিলোমিটার সাইকেল চালালে যা যা উপসর্গ দেখা দেওয়া সম্ভব সবই আমাদের তখন একটু একটু করে ফুটে বেরোচ্ছে। রাস্তার মাঝে কালভার্টগুলো, যেগুলো যাওয়ার সময় অবলীলায় পেরিয়ে গিয়েছিলাম, ফেরার পথে সেগুলোর চড়াই অংশটুকু উঠতে আমার দম বেরিয়ে যাচ্ছিল। শেষ কালভার্টটায় ওঠার সময় তো আর পারা গেল না, নেমে সাইকেল ঠেলতে হল। কষ্ট কমাতে মাঝে মাঝেই প্রকৃতি দেখার ছুতো করে আমরা থামছিলাম। রাস্তার পাশে খাল মতো কাটা, তার ওপাশে বসে একজন সাদা ধুতি পরা লোক উবু হয়ে বসে আছেন, তাঁর হাত থেকে একটা বাঁকা কঞ্চি বেরিয়ে এসে সামনের নদীতে ডুব দিয়েছে। ভদ্রলোকের পাশে একটা উনুনের ওপর কড়াই চাপানো, সেই কড়াইয়ের মধ্যে একজন ছোকরা খুব হাতা নাড়ছে। একটু বাদেই আরেকজন লোক এল, তাকে প্রথম ভদ্রলোক ঝুড়ি থেকে তুলে একটা ব্যাগে পুরে কী সব দিলেন, নতুন লোকটি ব্যাগটা নিয়ে ভদ্রলোকের হাতে কী সব দিলেন। অর্থাৎ একই জায়গায় বসে মাছ ধরা হচ্ছে, রান্না হচ্ছে, বিক্রিবাটাও হচ্ছে।
আসামের কোটি কোটি স্কুলের কথা বলেছি কি আপনাদের? যে কোনও রাস্তায় হাঁটুন, সাইকেল চালিয়ে কিংবা বাসে চেপে যান, রাস্তার ধারে দু'তিন কিলোমিটার অন্তর অন্তর দেখবেন স্কুল। বুনিয়াদি, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, বালক, বালিকা। আউনি আটি সত্রের ঠিক উল্টোদিকেই ছিল আউনি আটি হাইস্কুল। মাঝরাস্তায় আরও গোটা চারেক স্কুল পড়ল, তাদের মধ্যে একটা বালক বিদ্যালয়ের মাঠে দেখি ফুটবল খেলা খুব জমেছে। অমনি খেলা দেখার ছুতোয় দম নিতে আমরা সাইকেল থেকে নেমে পড়লাম। নীল প্যান্টের ওপর সাদা শার্ট পরা বাচ্চা ছেলেরা মাঠে ছুটে ছুটে খেলছে, দর্শকদেরও ওই একই পোশাক, তবে তাদের কেউ কেউ শার্টের ওপর নীল সোয়েটার পরে আছে। আরেকজনকে আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম না, শুধু শুনতে পাচ্ছিলাম, যিনি - মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে ধরে নেওয়া যায় - স্কুলের কোনও একজন ক্রীড়ামোদী মাস্টারমশাই। একটা অত্যন্ত খারাপ কোয়ালিটির মাইকে তিনি চেঁচিয়ে ইংরিজিতে খেলার ধারাবিবরণী দিচ্ছিলেন। বলটল আমরা অত দূর থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম না, হঠাৎ একটা হইহই শব্দ কানে এল, আর দেখলাম মাঠে ছড়িয়ে থাকা সাদানীল ছোপেদের কতগুলো একসঙ্গে হয়ে জড়ামড়ি করতে লাগল। বুঝলাম গুরুতর কিছু ঘটেছে। মাস্টারমশাই আমাদের কৌতূহল নিরসন করলেন। ক্লাস সেভেনের দেবাশিস বহুপ্রতীক্ষিত গোল দিয়ে খেলায় সমতা ফিরিয়েছে।
দেবাশিসের পিঠ মনে মনে চাপড়ে দিয়ে আমরা সাইকেলে উঠে পড়লাম। কমলাবাড়ির মোড় এসে গেল মিনিট দশেক পরই। আমাদের দুজনেরই চায়ের আশু দরকার হয়ে পড়েছে। ঘড়িতে প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে, দিল্লিতে থাকলে এতক্ষণে আমার চার নম্বর চা খাওয়া হয়ে যেত। মোড়ের যেখানটায় আমরা দাঁড়িয়ে আছি, সেখানে একটা আকাশী রঙের দোতলা বাড়ি। দোতলায় ভারতীয় জনতা পার্টির অফিসে গেরুয়া আর সবুজ রঙের বিস্ফোরণ। বিরাট ব্যানারে নেতার হাসি হাসি চকচকে মুখের পাশে ভালো ভালো কথা ছাপা। বাড়ির একতলার দেওয়ালে খয়েরি রং দিয়ে আঁকাবাঁকা অক্ষরে লেখা আছে 'ইয়াত চাহ পোরা যায়'।
এখানে চা খাওয়াই যায়, কিন্তু চা খেতে গেলে বাড়ির ভেতরে পাতা চেয়ারটেবিলে গিয়ে বসতে হবে। ওই ঝকঝকে মিষ্টি রোদ্দুর ছেড়ে আমাদের কারওরই ঘরের ভেতরে যাওয়ার ইচ্ছে হল না। এদিকওদিক তাকিয়ে দেখি চৌমাথার উল্টো কোণায় একটা প্রকাণ্ড গাছ। গাছের তলায় একটা চকচকে অ্যালুমিনিয়ামের ডেকচি, ডেকচির ওপরে ঢাকা দেওয়া অ্যালুমিনিয়ামের প্লেট মাঝে মাঝে কেঁপে উঠে তার নিচ থেকে সাদা রঙের ধোঁয়া বেরিয়ে আসছে। সাইকেল হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে রাস্তা পার করে এপাশে এসে গাছের ছায়ার নিচে রাখা কাঠের নড়বড়ে বেঞ্চিটায় বসলাম। পাশ থেকে একটা হাত এগিয়ে এসে আমার হাতে একটা স্টিলের গ্লাস গুঁজে দিল। চুমুক দিলাম। তপ্ত বাদামি সঞ্জীবনীসুধা রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ল। ক্লান্তিতে দেহেমনে কেমন একটা ঘোরের মতো লেগেছিল। সেটা কেটে গেল। মায়ের অনেক স্বভাবের মধ্যে একটা আমি পেয়েছি, টা ছাড়া আমার মুখে চা রোচে না। বেশি চাই না, আধখানা মারি বিস্কুট হলেই যথেষ্ট, তবু চিবোনোর জন্য কিছু একটা চাই। এখানে দেখলাম মোটা কাচের বয়ামের ভেতর শোনপাপড়ি আর সুজির লাড্ডু রাখা। সে দুটোও একটা করে চেখে দেখা হল।
যখন বেড়াতে যাই, ট্রেন বাস গাড়ির জানালা দিয়ে মুণ্ডু বার করে সব কিছু গোগ্রাসে দেখি। কত নতুন জিনিস, বা একই জিনিস, আমার চোখে নতুন লাগে। নতুন ধাঁচের বাড়ির নতুন রকম ছাদ, স্কুলের ইউনিফর্মের রং, দোকানের নাম, হাটের নাম। শুক্রবার জোড়হাট থেকে শিবসাগর যাচ্ছিলাম বাসে চেপে। ওসব দিকে ওটাই বোধহয় হাটবার, রাস্তার পাশে চটের বস্তার ওপর ঢিপি করা গাজরের উজ্জ্বল কমলা গায়ে সবুজ রঙের ঝুঁটি, সেদিকে তাকিয়ে রোদে চার পা পেটের নিচে মুড়ে বসে থাকা গম্ভীর গরুর চোখে হঠাৎ বাসের জানালায় বসে থাকা আমার চোখাচোখি হয়ে গেল, আর গরুটা কী অসীম তাচ্ছিল্য সহকারে চোখ সরিয়ে নিল ভাবা যায় না। কিন্তু সবথেকে অভাবনীয় রকম সুন্দর হচ্ছে সে সব হাটের নাম। সব আমি ঠোঁট নেড়ে নিঃশব্দ উচ্চারণে মুখস্থ করে নিয়েছিলাম, এখন দেখছি একটাও মনে নেই। জানালা দিয়ে দেখেছিলাম চা বাগানের পাতার ওপর কেমন সুন্দর এসে পড়েছিল, ভেবেছিলাম সকালবেলা অটো চড়ে অফিস যাওয়ার সময় সে রোদ্দুরের কথা মনে করতে করতে চলে যাব, দিল্লির বিষাক্ত কুয়াশা নাকে ঢুকলেও মনে ঢুকতে পারবে না। কোথায় কী। সে রোদ্দুরের স্মৃতি, বাঁশবনে হাওয়ার শব্দ, খোনা মাইকে মাস্টারমশাইয়ের চিৎকার ফিকে হতে হতে প্রায় মিলিয়ে গেছে। কেটেছে মোটে একটা মাস, অথচ কোথায় কোথায় গিয়েছিলাম, কী কী খেয়েছিলাম, কী কী দেখেছিলাম, সব কতদিনের কথা মনে হয়। আক্ষরিক অর্থেই দিনগুলো স্রেফ ছবি হয়ে গেছে।
শুধু ওই দুপুরটা এখনও জ্বলজ্বল করছে বুকের ভেতর। ওই যে কমলাবাড়ির মোড়ে বসে সুজির লাড্ডু দিয়ে আসামের অসামান্য চায়ে চুমুক দিচ্ছি, নাম না জানা শান্ত আর প্রকাণ্ড গাছটার পাতার ছায়া আমার গ্লাসের চায়ের ওপর কাঁপছে, পাশে দুটো সাইকেল স্ট্যান্ডের ওপর হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আর আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে অর্চিষ্মান। ডানপাটা সামান্য সামনের দিকে ছড়ানো, বাঁ হাতটা কোমরে ভর দেওয়া। গোটানো শার্টের হাতা থেকে পাতলা কবজি বেরিয়ে আছে। চায়ে চুমুক দিতে দিতে আমার মাথার ওপর দিয়ে কিছু একটার দিকে তাকিয়ে আছে অর্চিষ্মান। বিজেপির পোস্টারগুলো পড়ছে বোধহয়। এর সঙ্গে এত দিন ঘুরছিফিরছি উঠছিবসছি, এরই সাইকেল চালানো নিয়ে সন্দেহ করে এরই সামনে ঘণ্টাখানেক আগে নিজে সাইকেল থেকে পাঁচবার আছাড় খেয়েছি, সব স্মৃতি যেন ধুয়েমুছে সাফ, ভিড়ের মধ্যে এই যেন ওকে আমি প্রথম দেখছি।
কী খেলাম, কী দেখলাম, কীসের পিঠে চড়লাম - সব আবোলতাবোল খুঁটিনাটির খোলস ছাড়িয়ে নিয়ে দেখছি আসাম বেড়ানোর শাঁস বলতে পড়ে আছে ওই দুপুরটা। যাওয়াআসার মাঝখানে থেমে রোদে পিঠ দিয়ে অর্চিষ্মানের সঙ্গে দুদণ্ড বসে চা খাওয়ার দুপুর। তাতে আফসোসের কিছু নেই। শুধু আসাম কেন, আমার গোটা জীবনটার মোদ্দা কথা এটাই হলে আমার থেকে খুশি আর কেউ হবে না।
*****
ভেবেছিলাম গায়ে ব্যথাটা ভোগাবে। হয়তো ভোগাতোও, কিন্তু ফেরার পথে ফেরিতে একটা ঘটনা ঘটল। দেড়টার মাজুলি টু জোড়হাট ফেরিতে আমাদের সঙ্গে বেংগলুরুর দম্পতিও ছিলেন। মাজুলি কেমন সুন্দর কাটল, এরপর আপনারা কোথায় কোথায় যাবেন ইত্যাদি কথাবার্তা হচ্ছিল। তখনই সকালের সাইকেল ভ্রমণের কথা উঠল। ওরা জিজ্ঞাসা করলেন আমরা কোথায় গিয়েছিলাম। বললাম। ওঁরা বললেন, ও হ্যাঁ, ওই সত্রটার কথা শুনেছিলাম বটে কিন্তু আমরা অমুকটায় গিয়েছিয়াম, দ্য লার্জেস্ট ওয়ান ইন মাজুলি।
লার্জেস্ট হতে পারে, কিন্তু ফার্দেস্ট নয়। ফেরির জানালায় ঝোলানো টায়ারের ফোকর দিয়ে বাইরে ব্রহ্মপুত্রের ইলিশমাছের পিঠের মতো রঙের জল দেখতে দেখতে মনজিতের রান্নাঘরের দেওয়ালে ঝোলানো মাজুলির ম্যাপটার কথা মনে করলাম। ফার্দেস্টটায় গিয়েছিলাম আমরা। আছাড় খেয়ে, কালশিটে ফেলে, অপমানের একশেষ হয়ে। কথাটা মনে হওয়ার পর থেকে সেই যে ব্যথা কমা শুরু হল, ঘণ্টাখানেক পর ফেরি যখন জোড়হাটের নিমাতি ঘাটে এসে ভিড়ল, আর আমরা ওঁদের টা টা করে অটোয় উঠে বসলাম, ততক্ষণে সে বিলকুল উধাও হয়েছে।
Kuntala di tumi ebar upanyas lekho.. ekhono porjonto sob beranor lekhar modhye Assam amar best lagche..
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ, ঊর্মি। এই লিখতে গিয়েই প্রাণ বেরোচ্ছে, উপন্যাস লিখতে গেলে যে কী হবে ভগবানই জানেন।
Deletesotyi chhobir moton bheshe uthlo puro jaygata chokher samne
ReplyDeleteধন্যবাদ, চুপকথা।
Delete"আসাম বেড়ানোর শাঁস বলতে পড়ে আছে ওই দুপুরটা। যাওয়াআসার মাঝখানে থেমে রোদে পিঠ দিয়ে অর্চিষ্মানের সঙ্গে দুদণ্ড বসে চা খাওয়ার দুপুর। তাতে আফসোসের কিছু নেই। শুধু আসাম কেন, আমার গোটা জীবনটার মোদ্দা কথা এটাই হলে আমার থেকে খুশি আর কেউ হবে না।"
ReplyDeleteআপনাদের জীবনে এমন অনেক অনেক একসঙ্গে কাটানোর দুপুর আসুক| খুব ভালো লাগল এই কটা লাইন|
থ্যাংক ইউ, অন্বেষা। এই শুভেচ্ছাটা খুব জরুরি।
Deletebhishon bhishon mishti ar bhalo lekha, tarun boyesher ei prem dirghajibi hok!
ReplyDeleteঅ্যাঁ,তরুণ কাকে দেখলে, কাকলি? মানে অর্চিষ্মান তরুণ হতে পারে, কিন্তু যে প্রেমের কথা ফলাও করে ছাপছে সে তরুণ নয় কোনওমতেই।
Deletesob i relative, Kuntala :) :)
Deletekhub bhalo laglo oi dupurer bornona. tomar post e "gajendrachintamani" dekhe indira goswami'r datal haatir unde khawa howdah boi tar katha mone pore gyalo. otao sattra'r jibon niye lekha. amar khub bhalo legechilo.
ReplyDeleteবাঃ, নাম শুনেই ইন্টারেস্টিং বোধ হচ্ছে। যদি জোগাড় করতে পারি, বইটা নিশ্চয় পড়ব। থ্যাংক ইউ, শম্পা।
DeleteEi lekhata darun laglo :) gajendea chintamoni er ekta copy jogar korechis ki?
ReplyDeleteনাঃ, জোগাড় আর করতে পারলাম কই।
DeleteKuntala tumi khub lekho eta jani, tai somoy na thakleo mon bhalo korar jonyo jor kore somoy kore Abantor pori..bhromon kahini tomar ekta speciality...
ReplyDeletetabe ei nirjon dupur er bornona asadharon. amii nostalgic hoe jachhilam...
erokom aro asonkhyo dupur tomader jibone asuk... :) - Bratati.
থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ, ব্রততী। আমি জানি ব্লগ পড়া বেশ বোরিং ব্যাপার, কিন্তু তবু যে তুমি এবং অবান্তরের বাকি সবাই নিয়মিত অবান্তর পড়েন, এটা সত্যিই আমার সৌভাগ্য। থ্যাংক ইউ।
Deletearo emon koti koti dupur asuk . bhalo theko dujonei -PB
ReplyDeleteহাহা, থ্যাংক ইউ, প্রদীপ্ত।
Deleteএর সঙ্গে এত দিন ঘুরছিফিরছি উঠছিবসছি, এরই সাইকেল চালানো নিয়ে সন্দেহ করে এরই সামনে ঘণ্টাখানেক আগে নিজে সাইকেল থেকে পাঁচবার আছাড় খেয়েছি, সব স্মৃতি যেন ধুয়েমুছে সাফ, ভিড়ের মধ্যে এই যেন ওকে আমি প্রথম দেখছি।
ReplyDeletegaye Kanta diye uthlo,ki likhecho go,fantastic kuntala di.
tahole porer bar ekta prem er gappo pachchi to?ghorar barnona noy,ekdum proper gappo chai.
bhalo theko tomra,best wishes.
prosenjit
তোমরাও খুব ভালো থেকো, এই কামনা করি, প্রসেনজিৎ।
Deleteএমনিই হয়? এমনি? আমি ভাবতুম আমার একার এই রোগ আছে,গড়িয়াহাটের মোড়ে এক পাল লোকের ভিড় স্রেফ ফেড আউট হয়ে গেল সামনে তাকে দেখতে পেয়ে, কিংবা বালি হল্ট স্টেশনের ওভারব্রিজ আর কালো পাঞ্জাবী পরা সে, ব্যস!!! তারপর বা তার আগে কি ঘটেছিল,সব যত্ন সহকারে মেমোরি থেকে ডিলিট হয়ে গেছে। কুন্তলা দি,এটা লেখার জন্য এই অ্যাত্তো অ্যাত্তো আদর!! আর হ্যাঁ, রান্নাবান্নার পোস্ট পাচ্ছিনা কেন অনেকদিন? তুমি জানো তোমার লেখা দেখে দেখে কত্তগুলো রান্না আমি করে ফেলেছি আর কত্ত প্রশংসাও পেয়েছি??
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, শাল্মলী। আরে আমিও ভাবছিলাম একটু রান্নাবান্নার কথা পাড়লে হয় অবান্তরে, দেখা যাক।
Deleteঅসম্ভব সুন্দর লেখা। বিশেষ করে এই জায়গাটা এত ভালো লিখেছেন, "কী খেলাম, কী দেখলাম, কীসের পিঠে চড়লাম - সব আবোলতাবোল খুঁটিনাটির খোলসছাড়িয়ে নিয়ে দেখছি আসাম বেড়ানোর শাঁস বলতে পড়ে আছে ওই দুপুরটা।যাওয়াআসার মাঝখানে থেমে রোদে পিঠ দিয়ে অর্চিষ্মানের সঙ্গে দুদণ্ড বসে চা খাওয়ার দুপুর। তাতে আফসোসের কিছু নেই।"
ReplyDeleteএই একই উপলব্ধি আমারও হয়েছিল একটা বিশেষ সময়ে গতবার বেড়াতে গিয়ে, কিন্তু আমি কি আর এরকম লিখতে পারি? আপনার লেখাতে পড়ে ভালো লাগল।
থ্যাংক ইউ, সুগত। তবে লেখার ব্যাপারটায় একমত হলাম না। আমি অবান্তর নিয়ে যে পরিমাণ ঘষটাই, সেরকম করলে (সবটাই প্রায়োরিটির ব্যাপার, আমি নিশ্চিত আপনি আপনার সময় অন্য অনেক কাজে ব্যয় করেন) আপনি আমার থেকে অনেক ভালো লিখতেন এ নিয়ে আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই।
Delete