এ মাসের বই (১)/ জানুয়ারি ২০১৬
মণিমহেশ/ উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়
দিল্লিতে দুটো বইয়ের দোকান আছে। একটা আমার বাড়ি থেকে পাঁচশো মিটার দূরত্বে আনন্দ-এর দোকান। দ্বিতীয় দোকানটা গোলমার্কেটের কাছে বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশনের অফিসে।
আনন্দ-এর দোকানের তুলনায় এই দোকানের দুটো সুবিধে। প্রথমত, আনন্দ ছাড়াও বিভিন্ন প্রকাশনীর বই পাওয়া যায়। দ্বিতীয়ত, প্রচুর পুরোনো বইয়ের স্টক। আর সেসব বইয়ের কী কম দাম! বাংলা বইয়ের দামের ছিরি দেখলে আনন্দ আর কষ্ট দুটোই হয়। মনে হচ্ছিল সবই কিনে ফেলি। আমরা বেশ কিছুক্ষণ জীবনানন্দের উপন্যাস সমগ্রের কাছে ঘোরাঘুরি করে অবশেষে তিনটে রোগা রোগা বই কিনে বাড়ি চলে এলাম। তাদের মধ্যে একটা হচ্ছে এই মণিমহেশ।
মণিমহেশ বইটি তিনটি রচনা দিয়ে নির্মিত। চল্লিশ পাতার ‘মণিমহেশ’, তারপর তিরিশ পাতার ‘পাহাড় পথে সিমলা থেকে চকরাতা’, শেষে আটান্ন পাতার ‘কিন্নর দেশ’।
প্রথমেই উমাপ্রসাদের অসামান্য ভাষার কথা বলি। সারা বইয়ের প্রতিটি ছত্রেই তাঁর ভাষার নমুনা ছড়ানো আছে, কিন্তু বইয়ের শুরুর দিকেই ‘মণিমহেশ’ রচনার এই কটা লাইন আমার মনে গেঁথে আছে। হয়তো বৃষ্টির বর্ণনা বলেই।
আসার পর সেই যে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে, সারারাত চলতেই থাকে। সকালে উঠে দেখা যায়, থামবার কোনই লক্ষণ নেই। চারিদিক আবছা আঁধার। প্রচণ্ড বেগে তীক্ষ্ণ তীরের মত বৃষ্টির ধাঁরা পাহাড়ের বুকে বেঁধে। কল্কল শব্দে চতুর্দিকে জলের তোড় নামে। নদীর বুকে অসংখ্য বুদবুদ ওঠে। যেন ফুটন্ত জল ছুটে চলে। ইরাবতীকে দেখে চেনবারই উপায় নেই। নীলবসনা উচ্ছল হাস্যময়ী অপরূপ সুন্দরীর মৃদু মন্দ চরণ ফেলে চলা নয়। উন্মাদিনী ভৈরবী মূর্তি! গৈরিকবসনা। সহস্র করে অগণিত শাণিত অস্ত্র। পাহাড়ের বুকে নিষ্ঠুর আঘাত হেনে কলহাস্যে ছুটে চলে। জলস্রোতেরও প্রচণ্ড বেগ। নদীর বুকে যে পাথরগুলি নিশ্চিন্তমনে আশ্রয় নিয়ে মাথা তুলে জেগে ছিল, যাদের ঘিরে ছোট ছোট ঢেউগুলি সাদা ফেনার মালা পরে খেলা করত, আজ আর সেগুলি দেখাই যায় না। জলের তোলে অদৃশ্য হয়েছে। চারিদিকে ঘূর্ণিজল। চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে চলে। ডালপালা, চেরা কাঠ, গাছের গুঁড়ি, - এমন কি ডালপালাসমেত প্রকাণ্ড গাছও জলের তোড়ে ভেসে আসে। স্রোতের ঘূর্ণির মুখে ক্ষণিক ঘুরে-ফিরে নীচে নেমে চলে- চক্ষের পলকে। যেন, খড়কে কাটি। হঠাৎ কখনো দেখা যায়, দু’একটা জীবজন্তুর মৃতদেহ। জলের টানে হাতির দলওঁ অনায়াসে ভাসিয়ে নিতে পারে, বেশ বোঝা যায়। নদীর জল ক্রমশ বেড়ে ওঠে চোখের সামনে, - দুই পাড়ের পাথর ও পাহাড়ের গা তারই সাক্ষ্য দেয়। পাহাড়ের মাথা থেকে ও গা বেয়ে অনবরত জলধারা নামে, নদীতে মেশে। যেদিকেই টাকাই, -জলপ্রপাত। কোথাও বা প্রচণ্ড শব্দ তুলে পাহাড়ের অংশ ভেঙে পড়ে। গোলাগুলির মতো অসংখ্য পাথর কেবলি গড়িয়ে আসে উপর থেকে, ছিটকে নদীর বুকে পড়ে, জলের মধ্যে যেন বিস্ফোরণ হয়।
তবে ভাষাটাই শেষ কথা নয়। এমনকি আমার মতে মূল কথাও নয়। উমাপ্রসাদের লেখার সবথেকে নজর কাড়া ব্যাপার হচ্ছে আমাদের বেড়ানোর সঙ্গে তাঁর বেড়ানোর তফাৎটা। আমাদের বেড়ানোটা যেন রোজকার জীবন থেকে পালানোর জন্য। এই যে আসাম গেলাম, বা আগেও যে যে জায়গায় গেছি, পরেও যেখানে যেখানে যাব, প্রথমেই একখানা হোটেলের ব্যবস্থা দেখব। সত্যি বলছি, কোনও জায়গায় গিয়ে আমার যদি কিছুই দেখা না হয়, যদি শুধু হোটেলের ঘরে বসে টিভি দেখেই সারাবেলা কাটে, তাহলেও আমার কোনও আপত্তিই নেই, বরং সোৎসাহ সম্মতি আছে। অর্থাৎ আমি আদতে ঘরকুনো। দিল্লির ঘরে থাকলে নানারকম দায়িত্বকর্তব্যের ঝুটঝামেলা আছে, সেই জন্য এই ঘর থেকে পালিয়ে দূরের কোনও ঘরে গিয়ে ক’দিনের জন্য গা ঢাকা দেওয়াটাই আমার ভ্রমণবিলাস। উমাপ্রসাদ সেরকম নন। উনি চলেছেন শুধু চলার আনন্দেই। হিমালয়ের যতখানি কাছে কাছে থাকা যায়। সঙ্গী হয়েছেন হিমাদ্রী। তরুণ, রোজগেরে। সে বেচারাকে ছুটি শেষে এসে অফিসে জয়েন করতে হবে, তার কেবলই তাড়াহুড়ো করে লক্ষ্যে পৌঁছনোর মতলব। হিমাদ্রীর দাবিতে যুক্তি আছে, যত তাড়াতাড়ি গন্তব্যে পৌঁছনো যাবে, তত ভালো করে সেইখানটা “দেখা” যাবে। ঠিক যে যুক্তি খাটিয়ে একগাদা টাকা খরচ করে ট্রেনের বদলে প্লেনে আসাম গেলামএলাম। সে কোনও এক জায়গায় পৌঁছেই পরবর্তী পয়েন্টে পৌঁছনোর ব্যবস্থা করতে ছোটে। গাড়িভাড়া কত, খচ্চর কোথায় পাওয়া যাবে। উমাপ্রসাদের সে রকম কোনও তাড়া নেই। কিন্তু আবার হিমাদ্রীর বিরোধিতা যে করবেন, তেমন চরিত্রও নয় তাঁর। চুপ করে থাকেন। জিপভাড়া অন্যায় রকম বেশি চাওয়াতে মনে মনে জয়গুরু বলে হাঁপ ছাড়েন। যাক বাবা, হেঁটে যাওয়া যাবে। পায়ে হেঁটে চলার আশায় তাঁর “মন আনচান করে।”
কষ্ট করাতেই যেন উমাপ্রসাদের আনন্দ। হিমালয়ভ্রমণ যেন একটা গভীর আধ্যাত্মিক সাধনা, সে সাধনায় কৃচ্ছ্রের ভাগ যত বেশি হয় তত যেন ভালো। “শারীরিক ক্লেশভোগেরও আনন্দ আছে।” একটা পাহাড়ের মাথায় উঠে রাত্রিবাসের ব্যবস্থা হয়েছে। সারি সারি তক্তা পাশাপাশি রেখে বানানো কাঠের দোতলা ধর্মশালা। তক্তার ফাঁক দিয়ে হুহ করে হাওয়া ঢোকে। মাঝরাতে আগুন নিবে যাওয়ার পর প্রচণ্ড শীতে উমাপ্রসাদের ঘুম ভেঙে গেছে। গরম গেঞ্জি, পুলওভার, মোজা টুপি দস্তানা সব পরে স্লিপিং ব্যাগে শুয়ে শুয়েও ঠাণ্ডায় হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে তক্তার ফাঁক দিয়ে আকাশ দেখছেন উমাপ্রসাদ। “... গাঢ় নীল আকাশ, অযুত তারার হীরক-হাসি, তুষার-শিখরের রহস্যময় হাতছানি।” এর কাছে ঠাণ্ডা কোথায় লাগে?
উমাপ্রসাদের লেখার আরও একটা চমৎকার ব্যাপার হচ্ছে তাঁর নিরহংকার ভঙ্গি। ঘটনার সময়েই উমাপ্রসাদ একজন সেলিব্রিটি। বেড়াতে যাওয়ার খবর যাঁরা রাখেন তাঁরা সকলেই উমাপ্রসাদের নাম শুনলে চিনতে পারেন। তাই তিনি চেষ্টা করেন কাউকে নিজের নাম না বলতে। আমরা তো শনিরবিবার সাউথ দিল্লি ছেড়ে নর্থ দিল্লিতে বেড়াতে গেলে মনে একটা “কেমন দিলুম” ভাব জাগে। আর উনি পায়ে হেঁটে কোথায় কোথায় চলে যাচ্ছেন অথচ সে নিয়ে ঢাক পেটানোর তাগিদ নেই, যারা টুরিস্ট তাদেরকে ছোট করার বিন্দুমাত্র চেষ্টা নেই। ভ্রমণটা সত্যিকারের কাজে লেগেছে বোঝা যায়।
মণিমহেশ পড়ে আরেকটা তথ্য জানতে পেরে আমার খুব ভালো লেগেছে। ভারতবর্ষের আনাচেকানাচে আমরা যাই টু গো লিস্টে টিক দিতে, উমাপ্রসাদরা যান না গিয়ে থাকতে পারেন না বলে, আর কিছু লোক যান পেটের দায়ে। সেই আমলে হিমালয়ের কোন কোণাঘুঁজিতে বাঙালি ডাক্তাররা ঢুকে বসে থাকতেন, কেউ একা, কেউ স্ত্রীপুত্র সহযোগে, ভাবলে বেশ একটা সম্ভ্রম জাগে।
ক্ষুদে শয়তানের রাজত্ব/ দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
দিল্লির দ্বিতীয় বইয়ের দোকানের কাউন্টারে দাম দেওয়ার সময় দেখি অর্চিষ্মানের হাতে ধরা বইয়ের থাকের মধ্যে একটা ভীষণ সরু বই উঁকি মারছে। তার অলরেডি বেশ কাহিল অবস্থা। ভেতরের পাতাগুলো ঠিকই আছে, কিন্তু মলাটের কোণগুলো দুমড়ে ছিঁড়ে গেছে। দাম দিয়ে বেরিয়ে এসে প্যাকেট থেকে বার করে বইটার নাম দেখলাম। ক্ষুদে শয়তানের রাজত্ব। অর্চিষ্মান বলল, এই বইটা নাকি নাকতলার বাড়িতে আছে।
“কামাক্ষীপ্রসাদ?” অর্চিষ্মান প্রশ্ন করল।
“হ্যাঁ হ্যাঁ।”
“কামাক্ষীপ্রসাদের ভাই এই দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়।”
বিখ্যাত লোকেদের ভাইদের লেখা বই ভালো হয় সে আমি আগেও দেখেছি। সুনীলের 'আমার জীবনানন্দ আবিষ্কার ও অন্যান্য' বইয়ে বিবেকানন্দর ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্তের লেখারও বেজায় প্রশংসা আছে। কাজেই কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ভাই দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের বই যে ভালো হবে সে নিয়ে আমার কোনও সন্দেহ ছিল না। কিন্তু কত যে ভালো সেটা বুঝলাম একদিন ডাক্তারখানায় গিয়ে অপেক্ষা করার সময়।
এইসব অপেক্ষাটপেক্ষা করার সময়ের জন্য আদর্শ বই ক্ষুদে শয়তানের রাজত্ব। চৌষট্টি পাতার লিকপিকে বই। গল্প শুরু হওয়ার আগেই নানারকম ভালো ভালো জিনিস চোখে পড়ে। প্রথম হল উৎসর্গ। লেখক লিখছেন, “এই নতুন সংস্করণ আমার ছোটো মেয়ে অতসী ওরফে ডংকাকে উপহার দিলাম’। যার নাম অতসী, তারই নাম ডংকা। বাঙালিদেড় ডাকনাম দেওয়ার প্রতিভাটা চিরকালীন। আরেকটা ভালো জিনিসটা হচ্ছে বইয়ের নতুন সংস্করণের ভূমিকা।
“... “রংমশাল” বলে কিশোর পাঠ্য যে মাসিক পত্রিকা আমার দাদা কামাক্ষীপ্রসাদের সঙ্গে বের করতাম তারই ১৩৫২ সালে ধারাবাহিকভাবে আমার এই লেখা বেরিয়েছিলো। ...
কেন লিখেছিলাম? কেননা তখন শিশুসাহিত্য বলে যা বাজার মাৎ করে রেখেছিলো তার অনেকটাই আমার বিচারে মোটেই সুস্থ মন গড়ে তুলতে সাহায্য করেনা। অনেকটাই তার অন্ধকার আর সে অন্ধকারে রকমারি দৈত্য দানা ওৎ পেতে আছে। হয়তো কিশোর পাঠকদের কাছে ও সব লেখা রুচিকর। কিন্তু স্বাস্থ্যকর মোটেই নয়।
দাদাকে বোঝালাম এর বিরুদ্ধে কলম ধরতে হবে। নইলে পত্রিকা প্রকাশের দায়িত্ব অসমাপ্ত থাকবে। দাদা আর তখন যিনি রংমশালের দপ্তর ছাড়তেন না প্রেমেন মিত্র দুজনেই সোৎসাহে রাজি।”
গল্পের গৌণ চরিত্ররা হল জগু, ঘোঁতন, পান্নালাল আর কালো কুৎকুতে চেহারার, গোলগোল চোখ, বড় বড় কান আর হেঁড়ে গলাওয়ালা এক ভদ্দরলোক, যিনি পার্কের ভেতর একটা চেয়ারের ওপর দাঁড়িয়ে হাত পা নেড়ে বক্তৃতা দেন। ভদ্দরলোকের চেহারাই যে অদ্ভুত তাই নয়, আরও অদ্ভুত তাঁর বক্তৃতা।
“আমাদের চারপাশে দিনরাত অসংখ্য এক রকম ক্ষুদে শয়তান কিলবিল করছে। পা ফেলতে গেলে এক গাদাকে মাড়িয়ে দিতে হয়, নিশ্বেস নিতে গেলে একদল হুড়মুড় করে নাকে ঢুকে পড়ে। জল না খেলে তেষ্টায় গোলা চাঁ চাঁ করে খাবার না খেলে মন-মেজাজ বিগড়ে যায়; অথচ জল গিলতে গেলে, খাবার খেতে গেলে, লক্ষ লক্ষ ক্ষুদে শয়তান সটান আমাদের পেটের মধ্যে চলে যায়।”
আর মুখ্য চরিত্ররা হল ওইসব ক্ষুদে শয়তানেরা। যাদের বড়রা জীবাণু, ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদি বোরিং নামে ডাকে।
ভদ্রলোক সেই সব শয়তানদের গল্প শুরু করলেন। শুরু করতে হলে তাদের প্রথমে দেখতে পাওয়া চাই। কাজেই শুরু হল সপ্তদশ শতাব্দীর ডাচ বিজ্ঞানী লিউয়েনহুক-কে দিয়ে। যিনি মাইক্রোবায়োলজির পিতা। তিনি প্রথম অণুবীক্ষণ নামের এক বিদঘুটে যন্ত্র দিয়ে এই সব শয়তানদের চোখে দেখলেন। “কারুর চেহারা সরু সুতোর মতো লম্বা, কেউ কেউ ঠিক ফুলের মতো গোল, এমন কি মাঝখানে যেন পাপড়ির দাগ। কারুর গা লোমে ভর্তি, কারুর মাথায় একমাথা ঝাঁকড়া চুল, কারুর মাথায় শুধু একটা ঝুঁটি। আবার কেউ কেউ একেবারে বেয়াড়া রকমের তেকোনা, কারুর বা দু-দিকে দুটো লেজ। কেউ কেউ থাকে দঙ্গল পাকিয়ে, একজোট হয়ে; কেউ কেউ অ্যার পরস্পরের লেজ আঁকড়ে ধরে সরু চেনের মতো ঝোলে।” এই সব শয়তানরা কেমন করে জন্মায়, কেমন করে বংশবিস্তার করে, কেমন করে ধ্বংস হয়, কেমন করে নিজেদের থেকে লক্ষকোটি গুণ বড় মানুষ আর পশুপ্রাণীদের রোগের বীজ ছড়িয়ে তাদের পাড়া কে পাড়া নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে। সেই রোগের প্রসঙ্গেই গল্পে এলেন লুই পাস্তুর আর রবার্ট কক। বিস্মৃত হয়েছিলাম, এ বই পড়ে আবার উপলব্ধি হল, পাস্তুরের গল্প পৃথিবীর যে কোনও সেরা থ্রিলারের কান মূলে দিতে পারে। হ্যাঁ, পাস্তুরের পরীক্ষাপদ্ধতি পড়লে শিউরে উঠতে হয়, কত গরু, কুকুর, ইঁদুরকে যে তিনি নির্দ্বিধায় নিকেশ করেছেন, সে কথা ভেবে বিবেক মাথা নাড়ে। তারপরই মনে পড়ে যায়, শরীরে একগাদা প্রতিষেধক নিয়ে বসে পাস্তুরকে জাজ করা অন্তত আমার পক্ষে সাজে না।
বইয়ের চ্যাপ্টারের নামগুলো চমৎকার। পাস্তুরের টিকা আবিষ্কারের চ্যাপ্টারের নাম “কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা”, আর শেষের চ্যাপ্টারের নাম “গরু মেরে জুতো দান”। এতক্ষণ ধরে ক্ষুদে শয়তানদের পাড়াছাড়া করার ফন্দি বাতলিয়ে এবার ভদ্রলোক বলছেন, কেন ক্ষুদে শয়তানরা না থাকলে এই পৃথিবীটাই আর থাকত না। যেখানে তারা আমাদের অসুবিধে ঘটাবে সেখানে আমরা প্রাণ দিয়ে তাদের সঙ্গে লড়বে, কিন্তু বাকি সব জায়গায় তাদের ঘাঁটাব না।
কিন্তু বইয়ের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কথাটা লেখা আছে এই সব ভালো ভালো কথা শুরু হওয়ারও আগে। যখন সবে জগু, ঘোঁতন, পান্নার সঙ্গে ভদ্রলোকের দেখা হয়েছে। আর ভদ্রলোক তাঁর বক্তৃতা ভুলে তিন বন্ধুকে নিয়ে মেতে উঠেছেন। আর তাঁর বক্তৃতা শুনতে আসা বড়দের দল ক্ষেপে উঠেছে। স্বাস্থ্যপ্রচারণী সভার খবরের কাগজে দেওয়া নোটিস দেখে দরকারি কাজ ফেলে রেখে জীবাণু সংক্রান্ত বক্তৃতা শুনতে এসেছেন তাঁরা, এখন যদি বক্তা “ফচকেদের সঙ্গে গল্পগুজব” চালাতে শুরু করেন তাহলে তাঁদের আঁতে ঘা লাগে বইকি। তখন বড়দের উত্তরে সেই ভদ্রলোক যা বলেছিলেন, আমার মতে সেইটাই হচ্ছে এ বইয়ের সবথেকে দরকারি কথা।
ভদ্রলোক বললেন, “বলেন কি আপনারা? ছোটরা হেলাফেলার জিনিস হল নাকি? ছোটরাই তো হল আসল, ছোটদের বোঝানোই তো আসল বোঝানো। এতদিন ধরে প্রাণপাত করছি স্বাস্থ্যপ্রচারণী সভার জন্যে, পাড়ায়-পাড়ায় পার্কে-পার্কে বক্তৃতা দিতে দিতে জিভ একেবারে ক্ষয়ে গিয়েছে। কিন্তু ফল হয়েছে কতটুক? কত লোকই তো আসে, কিন্তু আসে শুধু সময় কাটাবার জন্যে। অথচ, যদি অন্তত দুয়েকটি ছোট ছেলেকে আমি পাই, যদি তাদের শেখাতে পারি একেবারে মনের মতো করে, তাহলে-তাহলে কত আশ্চর্য হওতে পারে তার ফল! তাদের সামনে পড়ে রয়েছে সমস্ত জীবন, তাদের জন্যে প্রতীক্ষা করে আছে একটা পুরো পৃথিবী। আজকে যে কিশোর কাল সে বড় হয়ে উঠবে-কত বড় হবে কে বলতে পারে? সে হয়ত বদলে দেবে দুনিয়ার চেহারা, সে হয়ত পৃথিবীতে আনবে নতুন পৃথিবী।”
সাদা বেড়াল কালো বেড়াল/ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
আগের মাসের বইপত্রের লিস্টে শীর্ষেন্দুর দুখানা বই দেখে অরিজিত আমাকে উৎসাহিত করলেন ‘সাদা বেড়াল কালো বেড়াল’ পড়তে। গল্পের শুরু মনোজ আর রোজমারির অ্যালয় তৈরির কারখানায়। রোমের এক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির রসায়ানাগারে এই অ্যালয়ের এক নতুন এবং বিস্ময়কর প্রয়োগের সম্ভাবনা আবিষ্কার করে ফেলার পরই রোজমারি আর মনোজের আপাতশান্ত জীবন ও কারখানায় ঝড় ওঠে। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির গুণ্ডারা আর ভিকিজ মব নামের এক কুখ্যাত আন্তর্জাতিক গুণ্ডাচক্র সেই ফরমুলা হাসিল করতে উঠে পড়ে লাগে। গোলমালের কেন্দ্রে পড়ে যায় গোপীনাথ বসু নামের এক বিজ্ঞানী, আবিষ্কারের কাণ্ডারি না হলেও অনেকটাই যার জানা। আর এর মধ্যে বার বার ঘুরে ঘুরে আসছেন রহস্যময় সুধাকর দত্ত, যিনি মাফিয়াদলের নেতা না ইন্টারপোলের এজেন্ট, কেউ জানে না।
থ্রিলার ব্যাপারটা আমার খুব একটা পছন্দ নয়, কারণ রহস্যসমাধানে মগজাস্ত্রের ব্যবহার আমার পছন্দ, আর থ্রিলারে শারীরিক কসরতের ব্যাপারটাই বেশি। তবে সেকথা মাথায় রেখেই, ‘সাদা বেড়াল কালো বেড়াল’ চমৎকার। গোপীনাথ বসু যখন রোমের ঘিঞ্জি পাড়ার ছাদ টপকে পালাচ্ছেন, বা জানালার কাঁচ ফুটো করে উড়ে আসা গুলির মধ্যে বুকে হেঁটে গিয়ে ভাড়াটে গুণ্ডাকে ধাক্কা মেরে তার ভবলীলা সাঙ্গ করছেন তখন কল্পনা করতে কষ্ট হয় যে এই গল্প ফেঁদেছেন একজন ডালভাত খাওয়া বাঙালি সাহিত্যিক।
তবে থ্রিলের মাঝে মাঝে চেনা শীর্ষেন্দুও আছেন। দুশো আঠাশ পাতা জুড়ে প্রচুর চরিত্র, তাদের নিজেদের মধ্যে প্রেম, পরকীয়ার ঘনঘটা আছে। আর আছে সংলাপ। প্রায় শুধু সংলাপের ঘাড়ে ভর দিয়ে কী করে গল্প বাড়াতে হয় সে জিনিস শীর্ষেন্দুর কাছ থেকে শেখার। সেটা যে সবসময় খুব আরামদায়ক হয় তেমন নয়। খানিকটা বর্ণনা থাকলে দুচারমিনিট দম নেওয়ার সময় পাওয়া যায়, পারিপার্শ্বিকের দিকে তাকিয়ে জিরোনো যায়। সংলাপের ক্ষেত্রে সেটা করা যায় না। সঙ্গে সঙ্গে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়তে হয়। তবে থ্রিলারের ক্ষেত্রে এই সংলাপবাহুল্য বেশ মানানসই হয়েছে।
ei boiglo amay ke upohar debe ?!
ReplyDeleteহাহা।
Deletedwitio boi ta khujte hochche to.darun laglo boitar barnona.
ReplyDeletetritiyo ta pora,oi je shirshendur rahasyao samagro....ote ache.
otar chaite mojadar holo bikeler mrityu,ek e rakam hadly chase type,tobe mojar ghatona o songlap onek besi.
prosenjit
এই বইটা জোগাড় করতে হবে।
Deleteaamaar chai prothom boita.. kothai je bangla boi pai mumbai e.. dekhi..
ReplyDeletekhub bhalo laglo tomar lekha pore.. aaro boi recommend korte thako please.
Indrani
বাংলার বাইরে পছন্দসই বাংলা বই পাওয়া মহা ঝামেলা, ইন্দ্রাণী। আমি তো আমার ভালোলাগার বইয়ের কথা বলবই, আপনারাও আপনাদের ভালোলাগার বইয়ের কথা বলবেন কিন্তু।
Deletetomar ei boi niye lekha gulo besh informative hay. r bhabi kato kam porechi ami. prothom r dwitiyo boita amar list-eo tuke rakhlam.
ReplyDeleteami aajkaal amar boier shathe UpendraKishore er Tuntuni-r galpo porchi Riddhir shathe. or to khub maja lagche- iri miri kiri bandhon, sheyaler nana phondi baghke nakal karar, ei shab nana kichu. roj rate boi para r schoole jaoyar pathe baghke r o kibhabe nakani chobani khaoyano jay dujon mile tar plan ata.
tomar kach theke r o boi-er apekkhay roilam. বাঙালিদেড় ei typo ta thik kore dio.
চমৎকার সব বই পড়ছ তো তোমরা, দেবশ্রী। খুব হিংসে হচ্ছে আমার। ওগুলো আমারও আরেকবার করে পড়ার সময় এসে গেছে। অনেকদিন হল।
Deleteha ha ha. haan go poro abar...chotobela pherat pabe...
DeleteUmaprosad r lekhar bhongi amar o bhishon priyo. onar lekha album boita pele poro..mone hoi bhaloi lagbe..amar to bhishon bhalo lagbe
ReplyDeleteনিশ্চয় পড়ব, সঙ্গীতা। অনেক ধন্যবাদ।
DeleteSada beral kalo beral ta mone hoy porechi. Khub jodi na bhul hoy ota Robibasoriyo te dharabahik hisebe beroto. Tobe seta bohu ager kotha. Jokhon abp pichhiye na porar desperate chokkore quality r barota bajayeni.
ReplyDeleteUmaprasad Mukhopadhyay to bangla bhromon kahini'r duniya te celebrity naam. Darun lekha. Amio jodi orom vagabond er moto ghurte partam.. Life e ar kichu chaitam na. Tobe tumi Debotatma Himalay tao poro, jodi na pore thako. Otar Amarnath jatra r bornona porte porte mone hoy okhanei chole gechi.
Second boi ta jake bole akdom quirky. Kamakkhiprosad er lekha mone hoy porechi. Mouchak e onar lekha beroto.
আমিও উমাপ্রসাদের মতো ঘুরতে পাড়লে খুশি হতাম, কিন্তু এ জীবনে হবে না।
Deletebah bah.. bhraman er golpo khub bhalo lage amar.. second boi ta pele hoy.. khub interesting mone hocche.. ami bhraman kahini ekta porechi kichudin age.. mane ota kahini noy.. Dipankar Ghosh bole ekjon porbotarohi achen.. everest, kanchenjungha esob uthechen.. amader okhankar e.. bally-belanagar e bari... onar lekha ekta boi ache.. "kanchenjungha-antaranga shringer mukhomukhi" bole.. ota diary lekhar moto.. sahityo temon nei.. tar sathe onar nijer tola osadharon onek photo.. kibhabe eisob jaygay otha hoy seta ekdom poriskar chokher samne dekhar moto lagche porle... ar desi bideshi manusher somporkeo onek jana hoy... bangali bole feeling gulo bujhte khub subidha hoy.. janina kolkatar baire pawa jay kina..
ReplyDeleteওহ, বইটা খুঁজে দেখব তো, ঊর্মি। খোঁজ দেওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
Deleteওহ ডাকনাম নিয়ে একটা কথা মনে পড়ল - আমার এক আত্মীয়ের দুটো ডাকনাম - ১. টুংকা ২.নাংকু .. বোঝো কান্ড ..মানে প্রতিভা ..
Deleteবাবামার বিরুদ্ধে মামলা করা উচিত এসব ক্ষেত্রে।
Delete"বাঙালিদেড় ডাকনাম দেওয়ার প্রতিভাটা চিরকালীন।" এটা একটু বদলে "বাঙালিদের ডাকনাম দেওয়ার প্রতিভাটা চিরকালীন।" ক'রে দেবেন?
ReplyDeleteনিশ্চয়, কৌশিক।
Deleteদ্বিতীয় বইটা পড়া নেই। জোগাড় করে পড়তে হবে।
ReplyDeleteএই বিভাগটা দুর্দান্ত লাগছে কুন্তলা, অনেক নতুন নতুন বইয়ের খবর জানতে পারছি। এটাকে বন্ধ করবেন না প্লিজ। :)
ReplyDeleteআরে অরিজিত, হাফ কৃতিত্ব তো আপনার। আপনার পোস্ট পড়েই তো আমার কল্পনা বাস্তব হল। আপনিও আমাকে ভালো ভালো বইয়ের রেকো দেওয়াটা বন্ধ করবেন না কিন্তু।
Deletehain ei bibhag ta darun lagche , notun boi er khobor pawar thekeo sei boi gulor bornona emon chomotkar hocche tatei agroho barche . sesh duto pora, prothomta porar list e tuke rakhlam.
ReplyDeleteei debiprasad chottopadhay bhodrolok chotoder moto kore information dite paren . Onar lekha prithibir itihas pore amar prothom manush ki kore elo , se byapare somyok dharona hoy . boita porechilam sombhoboto class 5 e, sei boyese porte o bujhte etotuku osubidhe hoyni , rather school e khub gyan diye hero hoyechilam , karon Darwin class 9 er age asto na porar boi e.
ওহ, দেবীপ্রসাদের এই বইটাও তো মারাত্মক ইন্টারেস্টিং হবে মনে হচ্ছে। থ্যাংক ইউ, প্রদীপ্ত।
Deleteক্ষুদে শয়তানের বইটা আমাদের বাড়িতে আছে। বাকি দুটো পড়ার ইচ্ছে রইল।
ReplyDelete