আসাম ৩/ বাঁশের মাচায়
অসমিয়া ভাষায় আমার দৌড়
ছুটকোছাটকা দুয়েকটা শব্দ। সে দিয়ে স্থানীয় লোকদের কথোপকথনের মানে উদ্ধার করা যায়
না। তবে ইদানীং ভারতের সব কথ্য ভাষাতেই ইংরিজি ঢুকে গিয়ে খানিকটা সুবিধে হয়েছে। কান খাড়া রাখলে
কথোপকথনের কনটেক্সটটা অন্তত
আঁচ করা যায়। পঁয়তাল্লিশ
মিনিটের ফেরি থেকে নেমে আমরা যে ট্রেকারটায় উঠেছিলাম সেখানে অলরেডি কয়েকজন অল্পবয়স্ক ছেলেমেয়ে উঠে বসে ছিল। বোঝা গেল এরা
পড়াশোনা করে মেনল্যান্ডের কোথাও, বড়দিনের ছুটিতে মাজুলিতে ফিরছে। আরও বুঝলাম যে
গাড়ির চালক 'গুপ্তদা' এদের সবারই পরিচিত। চোখ দুটোকে জানালার বাইরে আর কানদুটোকে
গাড়ির ভেতরে স্থির রেখে আরও কিছু কিছু জিনিস উদ্ধার করা গেল। যেমন আমার ঠিক সামনে
যে মেয়েটি বসে আছে, যার কপাল ঘিরে কুচি কুচি চুল, পরিচর্যা করা ভুরুর নিচে বড় বড়
চোখ, কথা বলতে গেলে কিংবা হাসতে গেলেই যার ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে গজদাঁত বেরিয়ে পড়ে, তার
সামনের অগাস্ট মাস থেকে এয়ার হোস্টেস কোর্স শুরু হবে। এইসব শুনছি এমন সময় গুপ্তদা
গাড়ি ছেড়ে দিলেন।
আর ছাড়া মাত্র প্রবল ধুলো
এসে আমাদের গা মাথা ঢেকে ফেলল। আশ্চর্য কিছু নয়, কারণ যতদূর চোখ যাচ্ছে দেখছি সাদা
বালির চর। বালির ওপর খড় ফেলে একটা পথের মতো করা হয়েছে, সেই পথের ওপর দিয়ে
বীরবিক্রমে চলেছে ট্রেলার, মোটরবাইক, এস ইউ ভি। তাদের চাকার ধাক্কায় বালি উড়ে উড়ে
চারদিক ছেয়ে ফেলেছে। আমাদের গাড়ির সকলেই, বিশেষ করে যে মেয়েটির ছ'মাস বাদে
এয়ারহোস্টেস ট্রেনিং শুরু হবে, দ্রুত রুমাল ওড়না স্কার্ফ দিয়ে নাক মুখ চুল মাথা সব ঢেকে নিল,
কিন্তু আমরা টুরিস্টের হদ্দ, মাজুলির ধুলো অমৃতসমান মনে করে বুক ফুলিয়ে চললাম।
প্রথমদর্শনে মাজুলিকে
দেখে আমার বেশ চমকই লেগেছিল। মাজুলি সম্পর্কে আমার যেটুকু জানা ছিল সেটা হচ্ছে এটা
পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ (কেউ কেউ বৃহত্তমও বলে থাকেন) নদী-দ্বীপ। উপর্যুপরি ভূমিকম্প এবং তার পরিণতি হিসেবে এক
ভয়ানক বন্যার ফলে সতেরোশো পঞ্চাশ সাল নাগাদ ব্রহ্মপুত্র ভেঙে দুভাগ হয়ে মাঝে জেগে
ওঠে মাজুলি চর। এইটুকু শুনলে মনে হয় না যে একদিন বিকেলে মাজুলির এদিক থেকে হাঁটতে
শুরু করলে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ওদিকে পৌঁছে যাওয়া যাবে? হ্যাঁ, 'বৃহত্তম'
শব্দটা নামের আগে জোড়া আছে বটে আর ব্রহ্মপুত্রও যথেষ্ট
বড় নদী, কিন্তু তবু নদী তো? তাছাড়া এর আগে আমি জীবনে
একটিও নদী-দ্বীপও দেখিনি, কাজেই 'বৃহত্তম' শব্দটা বিশেষ সাহায্য করেনি।
মাজুলি কত বড় সে ধারণা পরে পেয়েছি, কিন্তু শুরুর দশমিনিটে তার কিছুই আঁচ করতে
পারিনি।
চমকের বিষয়টা ছিল
অন্য। বর্ণনা শুনে আমি ভেবেছিলাম মাজুলি হবে আমার সারাজীবনে দেখা সবুজতম প্রকৃতির
কোলে, স্নিগ্ধতম নদীর বুকে জেগে ওঠা একটি দ্বীপ। যার দিগন্তরেখা জুড়ে সুপুরি
কলাগাছের সারি আর চরে ছোট ছোট নৌকো উল্টো করে বাঁধা। সে জায়গায় দেখলাম যতদূর
চোখ যায় ততদূর সাদা বালির শুকনো চর। ঘাটের মুখটা চা পান বিড়ির দোকান, যাত্রী, অটো,
ট্রেকারে কিলবিল করছে। মনটা আমার একটু দমেই গিয়েছিল।
যাই হোক, ধুলোর চরের মধ্য
দিয়ে গুপ্তদা ট্রেকার ছুটিয়ে চললেন। খানিকক্ষণ চলার পর চরের বুকে লম্বা লম্বা ঘাসের বন শুরু হল। সবুজের চিহ্ন নেই তাদের সারাগায়ে। সে
বিবর্ণ ঘাসের বনের ওপারে ততক্ষণে টকটকে লালরঙের সূর্য ডুবতে শুরু করেছে। ঘাড় ঘুরিয়ে ডানদিকে তাকিয়ে দেখি আকাশের বুকে অলরেডি
চাঁদ ফুটে উঠেছে।
আর ঠিক তক্ষুনি চাঁদের
নিচে দৃষ্টিসীমায় একটা সবুজ রেখা জেগে উঠল। একটা খাড়া ঢালুজমি পার হয়ে, একটা ছোট্ট ঝাঁকুনি দিয়ে আমাদের ট্রেকার মাজুলির মূল ভূখণ্ডে
উঠে পড়ল। আর আমি দেখলাম আমি
যেমনটি ভেবেছিলাম মাজুলি ঠিক তেমনই। সবুজ, শান্ত, স্নিগ্ধ।
ঝকঝকে পরিষ্কার পাকা
রাস্তা ধরে গাড়ি চলল।
রাস্তার পাশে পাশে মিশিং উপজাতির মানুষদের বাঁশের বাড়ি, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল,
জল, জলের ওপরে ব্রিজ, ব্রিজ পেরিয়ে থানা,
থানা পেরিয়ে
কমলাবাড়ির গমগমে মোড়।
অনেকক্ষণ আগে থেকেই ভিড় পাতলা হতে শুরু করেছিল। মোড়ে পৌঁছে আমরা দুজন ছাড়া গাড়ির
শেষ যাত্রীটিও নেমে গেল।
আমরা যাব লা মাইসন দা আনন্দ-এ। মাজুলিতে থাকার জায়গার অপশন বেশ কম। বৈষ্ণব অবৈষ্ণব কিছু সত্র আর মূলত বিদেশীদের উদ্যোগে বানানো কিছু গেস্ট হাউস। লা মাইসন
দে আনন্দ তাদের মধ্যে অন্যতম। কিন্তু পিক সিজনে তার
চাহিদা প্রচুর। বুকিং পাওয়া মুশকিল। এতসব কথা ভেবেই বাবা আমাদের মাজুলিতে রাত
কাটাতে নিরুৎসাহ করেছিলেন। বলেছিলেন, জোড়হাটে রাত কাটিয়ে মাজুলি ঘুরে দেখে আয়,
থাকতে যাস না।
কিন্তু আমাদের মাজুলিতেই
থাকার ইচ্ছে। কাজিরাঙ্গা বুক হয়ে যাওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমি ফোন করেছিলাম লা
মাইসন দে আনন্দ-এর পরিচালক মনজিত রিসাং-কে। তাঁর সঙ্গে কথা বলে জেনেছিলাম লা
মাইসন-এর দুটি কটেজ, একটি পাকা, একটি বাঁশের। পাকাটি বুক হয়ে গেছে, বাঁশেরটি খালি। আমি ফোনের এপারে লাফাতে লাফাতে বলেছিলাম, তাই তো চাই, তাই তো চাই। তেইশ তারিখ রাতে
আমাদের জন্য বাঁশের কটেজ বুক করে রাখুন। আমরা আসছি।
এই কথাটা আমি দিল্লি
ছাড়ার আগে ফোন করে মনজিৎকে মনে করিয়েছি। এমনকি কাজিরাঙ্গা থেকে রওনা দেওয়ার আগেও
ফোন করে বলেছি, আমরা আসছি, সব ঠিক আছে তো? মনজিৎ বলেছেন, এভরিথিং ইজ ফাইন।
তেইশ তারিখ সন্ধ্যেবেলা
লা মাইসন দে আনন্দ-এর গেটের সামনে গুপ্তদার গাড়ি গিয়ে থামল যখন তখন আশপাশ থেকে
দুয়েকটা মুখ একগাদা প্রশ্ন নিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে এল। আপলোগো কা বুকিং হ্যায়
কেয়া? আলবত। কাজিরাঙ্গা সে আজ সুবেহ ভি ফোন কিয়া থা। উত্তর শুনে তাঁরা আরও থতমত
খেয়ে গেলেন। কাজিরাঙ্গার পার্টি তো অলরেডি এসে ঘরে ঢুকে গেছে। আমাদের মুখের ভাব
দেখে তাঁদের বোধহয় দয়া হল, তাড়াতাড়ি বললেন, আপনারা একটু বসুন, মনজিৎ আপাতত দোকানে
গেছেন, উনি এলে কিছু একটা ব্যবস্থা হলেও হতে পারে।
অন্য কোনও জায়গা হলে
আমাদের প্রতিক্রিয়া কী হত জানি না, কিন্তু গত আটচল্লিশ ঘণ্টায় আসামের জলহাওয়া
আমাদের ওপর করিশমা দেখাতে শুরু করেছে, আমরা চুপ করে বসে রইলাম।
মনজিৎ এলেন। ফোনে শোনা
গলার সঙ্গে মানানসই ভদ্র, শান্ত চেহারা। খুব নরম গলায় জানালেন, একটা গোলমাল হয়ে গেছে। কটেজ আর খালি নেই। কিন্তু কটেজ ছাড়াও লা মাইসনে চারপাঁচটা ঘর আছে। উইথ
অ্যাটাচ বাথরুম। আমরা চাইলে সে রকম একটা ঘরে থেকে যেতে পারি। ভাড়াও কটেজের হাফ।
সত্যি বলতে কি, ভাড়া
কটেজের দ্বিগুণ হলেও আমরা রাজি হয়ে যেতাম। জোড়হাটে ফেরার শেষ ফেরি ছেড়ে গেছে বিকেল
চারটেয়। চারদিক ঘোর অন্ধকার হয়ে এসেছে। ওই অন্ধকারে সত্রে সত্রে ঘুরে থাকার জায়গা
খুঁজতে দুজনের একজনও তৈরি ছিলাম না।
আমরা ঘরে থাকার সম্মতি
প্রকাশ করাতে মনজিৎ আমাদের নিয়ে নিজের বাড়িতে গেলেন। মনজিতের বাড়ির রান্নাঘরই
হচ্ছে লা মাইসন দে আনন্দ-এর রান্নাঘর। মিশিংদের
বাড়ি যেমন হয়, বাঁশের ওপর টাঙানো বাঁশের বাড়ি। সিঁড়ি বেয়ে উঠে আমরা রান্নাঘরে ঢুকলাম। বিস্তৃত ঘর। ঘরের একপাশে
বাঁশের শক্তপোক্ত আয়তাকার টেবিল, বসার জন্য কুশনআঁটা খাটো মোড়া ছড়িয়েছিটিয়ে রাখা।
ঘরের অন্যদিকে রান্নার কাজ চলছে। মাটির বেদীর ওপর কাঠকুটো জড়ো করে আগুন জ্বালছেন
একজন পাতলা চেহারার ভদ্রমহিলা। উনি মনজিতের স্ত্রী। মনজিৎ আমাদের নিয়ে টেবিলে
বসলেন। খানিকক্ষণ পরেই আরও দুজন ভারতীয় (এঁরাও কাজিরাঙ্গা থেকে এসেছেন, আসার আগে
সকালে ফোনও করেছেন। মনজিৎ ভেবেছিলেন এঁরাই আমরা।) চা এল। চা খেতে খেতে সবাই মিলে
নানারকম কথাবার্তা হতে লাগল। গোড়ার দিকে আমরা একটু আড়ষ্ট হয়েই ছিলাম, একে ক্লান্তি
তার ওপর এতদিন আগে থেকে এত তোড়জোড় করা সত্ত্বেও সাধের কটেজ হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার
চাপা রাগও ছিল। কিন্তু ওই বাঁশের টেবিলে বসে চায়ে চুমুক দিতে দিতে টের পাচ্ছিলাম
রাগটা মিলিয়ে যাচ্ছে। খানিকক্ষণ পর মনজিৎ বললেন,
এতক্ষণে নিশ্চয় ঘর
পরিষ্কার হয়ে গেছে। আপনারা গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিতে পারেন। গরম জল
চাইলে বলবেন, আমরা দিয়ে আসব। আর হ্যাঁ, কী খাবেন রাত্তিরে? আমরা বললাম কী কী পাওয়া যাবে?
বললেন, ভেজ, ননভেজ দুইই পাওয়া যাবে। সব রান্নাই করবেন মনজিতের স্ত্রী। ট্রাইব্যাল
খাবারেরও একটা অর্ডার আছে, কাজেই আজ সে রান্নাও হচ্ছে। আমরা চাইলে . . . বলা মাত্র
আমরা লাফিয়ে উঠে বললাম, চাই চাই। ট্রাইব্যাল ট্রাইব্যাল। মনজিৎ বললেন, বহোৎ আচ্ছা।
তারপর খুব লজ্জিত একটা হাসি হেসে জানালেন, তিনি নাকি ভেবেছিলেন আমরা ওঁকে গালি দিয়ে ধুইয়ে দেব।
এরকম ভুল নাকি ওঁর হামেশাই
হয়ে থাকে।
তারপর নিজের দিকে দেখিয়ে বললেন, আসলে অফিস
বলে তো কিছু নেই, আমিই হচ্ছি আমার স্ট্যান্ডিং অফিস। বুকিংটুকিং সবই নাকি হয় তাঁর মাথার ভেতর। হেসে হেসে মনজিৎ বললেন, লা মাইসন দেখাশোনা করা ছাড়াও উনি একটা পর্ক খামারে কাজ
করেন, অনেক সময় সেখানেও ফোনটোন ধরতে হয়। ম্যায় তো হাঁ হাঁ বোল দেতা হুঁ, লেকিন ঘর
আকে সব ভুল যাতা হুঁ।
আমরাও মাথা হেলিয়ে হেসেটেসে বললাম, আরে কোনও ব্যাপার না, এ
রকম ভুল তো হতেই পারে। তাছাড়া বাইরে
বেড়াতেটেড়াতে এলে অ্যাডজাস্টমেন্ট তো একটু করতেই হয় . . .
ওইখানে দাঁড়িয়ে বলা
কথাগুলো কতখানি আন্তরিকতা ছিল জানি না, কিন্তু যেটুকু যা ক্ষোভ ছিল, রুমে ঢুকে হাওয়া হয়ে গেল। আপাদমস্তক বাঁশ দিয়ে বানানো একটা বাড়ির একটা ঘরে আমরা
থাকব।
বাড়ি বলতে সেই মিশিং স্টাইলে, বাঁশের রণপার
ওপর বানানো বাঁশের বাড়ি, সারি সারি
কয়েকটা ঘর। আমাদের ঘরটা বাড়িতে ঢোকার বাঁশের গেটের একদম সামনেই, ঘরের নাম চম্পা।
আশেপাশের ঘরগুলোরও ফুলের নামে নাম। লাল টুকটুকে পর্দা ঢাকা একটা শক্তপোক্ত কাঠের
দরজা খুলে আমরা ঘরে ঢুকলাম।
ঢুকে দেখলাম দশ ফুট বাই দশ ফুট ঘরে বাঁশের দেওয়াল, দরজার ওপর দেওয়ালের গায়ে কাটাকুটি ডিজাইনের বাঁশের ঘুলঘুলি, বাঁশের সিলিং, বাঁশের মেঝে। সে মেঝের বুনুনির ছোট ছোট ফোকর দিয়ে নিচের মাটি আবছা দেখা যাচ্ছে। একটাই জানালা, জানালাতে দরজার সঙ্গে ম্যাচিং করা লাল কালো মোটা কাপড়ের পর্দা। জানালার পাশে একটা বাঁশের গায়ে সুইচবোর্ডে দুটো সুইচ। একটা টিপলে সাদারঙের একটা সি এফ এল বাল্ব জ্বলে ওঠে, অন্যটা প্লাগপয়েন্টের। দরজার ঠিক উল্টোদিকে আরেকটা দরজা, এটা কাঠের নয়, বাঁশের, সেটা ঠেলতেই বাথরুম বেরিয়ে পড়ল। বাথরুমের দেওয়াল বাঁশের, কিন্তু মেঝে সিমেন্টের। একটা ইউরোপিয়ান স্টাইলের টয়লেট, কিন্তু বেসিন নেই। দরজার গায়ে একটা বাঁশের খিল ঝুলছে, সেটা তুলে দেওয়ালের গায়ে লাগানো একটা বাঁশের খোপের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেই টোটাল প্রাইভেসি। বাথরুমের ছাদ থেকে দড়ি দিয়ে ঝুলছে একটা বাঁশের ঝুড়ি। সেখানে আপনি তেল সাবান, গামছা, স্নানের আগে ছাড়া কাপড়, স্নান সেরে উঠে পরার কাপড় রাখতে পারেন। আমি বেরিয়ে এসে অর্চিষ্মানকে আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলাম। আমাদের কাল্পনিক বাড়ির বাথরুমে এইরকম ঝুলন্ত ঝুড়ির তাক থাকবে। অর্চিষ্মান চোখ ঘুরিয়ে বলল, আচ্ছা আচ্ছা, থাকবে থাকবে। এখন তাড়াতাড়ি চল, গিয়ে আগুনের ধারে বসি। আরেককাপ চা খাওয়া যাক।
ঢোকার সময়ও দেখেছিলাম, তখনও দেখলাম। আমাদের পাশের ঘরের বারান্দার সোফায় শুয়ে বুকের ওপর রাখা একটা এমারজেন্সি লাইটের আলোতে এক ভদ্রলোক কাগজ পড়ছেন। সেন্টিনেল।
হেঁটে হেঁটে মনজিতের
রান্নাঘরে এসে পৌঁছলাম আবার। রান্না তখন জমে উঠেছে। দুটো লোহার খাঁচার তলায়
কাঠকুটো গুঁজে আগুন জ্বালানো হয়েছে। তাতে রান্না জমেছে খুব। লোহার একটা গোল রিং, তিনটে পায়াওয়ালা লোহার একটা গোল রিং-এর ওপর দুটো কালো
লোহার কড়াই চাপানো। আর আগুনের পাশে পাশে বাঁশের কঞ্চিতে গেঁথে মাংসের টুকরো আর
চারাপোনা সাইজের মাছ গেঁথে আগুনের চারপাশ ঘিরে মাটিতে গাঁথা। সে কাঠগুলো পুড়ে পুড়ে
যে ছাইগুলো বেরোচ্ছে, সেই ধিকিধিকি জ্বলা ছাইয়ের তলায় কলাপাতায় মোড়া মাংস। একই
আগুনে যে এত রকম রান্না হতে পারে দেখে তাক লেগে গেল।
একটু পরেই আমাদের সঙ্গে
এসে যোগ দিলেন নরওয়ের আর্নি আর ফ্রান্সের এরিক। এই এরিকই আমাদের পাশের ঘরের
বারান্দায় শুয়ে শুয়ে সেন্টিনেল পড়ছিলেন। তখন দেখতে পাইনি, এখন দেখলাম এরিকের চশমা
হ্যারি পটারের মতো আর দাড়ি ডাম্বলডোরের মতো। সেই দাড়ি নেড়ে নেড়ে তিনি কেবলই বলেন,
ইনক্রেডিবোল, ইনক্রেডিবোল। আমরা দিল্লিতে থাকি
শুনে বললেন, ডু ইউ নো পাহাড়গঞ্জ? ইট ইজ আ ক্রেজি প্লেস, ইনক্রেডিবোল প্লেস। আমরা সর্বান্তকরণে সায় দিলাম। গল্প জমে উঠল। নরওয়ের আর্নি, ফ্রান্সের এরিক, ভারতের
আমরা আর ওই ব্যাঙ্গালুরুর দম্পতি। বেশিরভাগ বেড়ানোর গল্পই হচ্ছিল। দেখা গেল আমাদের থেকে সাহেব দুজন বেশি ভারতবর্ষ
দেখেছেন। এঁদের ঘোরার কায়দাও আমাদের থেকে আলাদা। ছ'মাসের ভিসা নিয়ে ঢোকেন, একেকবারে একেকটা অঞ্চল বেছে নেন আর তারপর ছ'মাস ধরে সেখানেই ঘোরাঘুরি করতে থাকেন।
পরের বছরের ছ'মাসের ভিসায় আবার অন্য একটা অঞ্চল। বলাই বাহুল্য, দুজনেই
অবসরপ্রাপ্ত। নরওয়ের ভদ্রলোক ভারতের বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছেন, ফ্রেঞ্চসাহেবের
যা বুঝলাম স্পেশাল পেপার নর্থ ইস্ট ইন্ডিয়া। এই মাজুলিতেই তিনি আসছেন
সেই দুহাজার পাঁচ সাল থেকে।
মনজিতের স্ত্রী আর মীনা
বলে একটি মেয়ে তেড়েফুঁড়ে রান্না করছিলেন। আমরা ভাবছিলাম এত ব্যস্ততার মধ্যে চা
চাওয়াটা উচিত হবে কি না, এমন সময় মনজিৎ দুহাতে দুখানা প্লাস্টিকের জলের জগ হাতে
নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। ঘরে বানানো রাইস বিয়ার। সবাইকে গ্লাসে ঢেলে ঢেলে দিতে লাগলেন।
আমিও উৎসাহভরে একগ্লাস নিয়েছিলাম, কিন্তু নাকের কাছে এনে বুঝলাম, দেশী হোক, বিদেশী
হোক, হোমমেড হোক, বাজার থেকে কেনা হোক, উৎকট গন্ধটা সবারই কমন। কাজেই আমি চায়ে সেটল করলাম।
রান্না হয়ে গেল।
ট্রাইব্যাল মেনুর অংশ হিসেবে আমরা খেলাম কলাপাতায় মোড়া চটচটে ভাত, বাঁধাকপির
তরকারি, মাছের ঝোল, বাঁশের কঞ্চিতে গেঁথে পোড়ানো মাছ ও মাংস, আর কলাপাতায় মোড়া
স্মোকড মাংস। রাতে যখন খেয়েদেয়ে ঘরে এলাম তখন ঠাণ্ডায় গায়ে কাঁপুনি দিচ্ছে। আলো
নেভানো মাত্র দরজার ওপরের বাঁশের জাফরি দিয়ে উল্টোদিকের দেওয়ালে কাটাকুটি
আল্পনার মতো চাঁদের আলো এসে পড়ল। দুজনে দুখানা করে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। খানিকক্ষণ পর আওয়াজ শুনে বুঝলাম আমাদের ফ্রেঞ্চ
প্রতিবেশী ঘরে ফিরেছেন। বাঁশের ওপর তাঁর পায়ের মচমচ শব্দ শুনতে শুনতে কখন যে
ঘুমিয়ে পড়লাম কে জানে।
*****
যে কটেজে আমাদের থাকার কথা ছিল
যে বাড়িতে আমরা ছিলাম
এই আমাদের ঘর। আমাদের কাল্পনিক বাড়ির বারান্দায় ওই রকম একটা বাঁশের সোফাও থাকবে।
মনজিৎ রিসাং-এর বাড়ির রান্নাঘর।
(চলবে)
চম্পার দরজার পর্দাটা চম্পার শাড়ি কেটে বানানো না? পাড়টা বেশ সুন্দর কিন্তু।
ReplyDeleteআর আপনার ডেসক্রিপশন যথারীতি টেরিফিক হয়েছে।
#Majuli #TreeHouse #TribalFood #RiceBeer #FeelingHappy
হাহা, থ্যাংক ইউ,দেবাশিস।
Deleteওফফ ... এই এক্সপিরিয়েন্স এর তুলনা নেই .. ছবিগুলো ঠিক সিনেমার মত ... পাতা মোড়া মাংসটা কেমন ছিল গো .. জিভে জল ..
ReplyDeleteমাংস খুবই ভালো ছিল, ঊর্মি। মাংস যখন পাতায় মোড়া হচ্ছিল তখন আমরা উপস্থিত ছিলাম। যে দড়িগুলো দিয়ে মোড়কগুলো বাঁধা হয়েছিল সেগুলো কলাগাছের পাতার মাঝখানে যে ডাঁটিটা থাকে সেটা ছুলে ছুলে বার করা। আমি দেখছিলাম আর ভাবছিলাম এঁদের তুলনায় আমার 'স্কিল সেট' কী হাস্যকর।
Deleteমাংস তো খুব ভালোই ছিল কিন্তু বেস্ট ছিল চা-টা। এই ক'দিনের বেড়ানোয় আমার লাইফলং দার্জিলিং চা-আনুগত্য বেশ টাল খেয়ে গেছে। বাড়িতে, হোটেলে, রাস্তার মোড়ে --- একটিও পচা চা খাইনি। ইনক্রেডিবোল।
sotti jibhe jol ana khabar dabar. "মাজুলি" te thaka r obhignata to darun mone hochhe chhobi dekhe ar lekha pore.
ReplyDeleteযান যান, মাজুলি ঘুরে আসুন, ইচ্ছাডানা। আপনার ভালো লাগবেই, গ্যারান্টি।
DeleteAmi majuli jete chai, pora mach mangsho khete chai..lekhata ki bhalo!!!
ReplyDeleteশিগগিরি যা, তিন্নি। ভাঙতে ভাঙতে মাজুলি যে রেটে ছোট হচ্ছে, লোকে বলছে আর নাকি টেনেটুনে বছর কুড়ি। তারপরেই সব ব্রহ্মপুত্রের গর্ভে।
Deletecottage ar barir tofat ki holo :O , mane dutoi akirokom mone hochhe to dekhe . bodhhoy cottage e oi julonto taak ta nei :) ...chomotkar hochhe , majuli jetei hobe dekhchi
ReplyDeleteতফাৎটা মনে হয় আয়তনে, প্রদীপ্তা। কটেজের ঘর বড়, তাছাড়া বারান্দাটারান্দাও আছে প্রমাণ সাইজের। মানে রাতে শুয়ে প্রতিবেশীর পায়ের শব্দ শুনতে হবে না। তাতে অবশ্য আমাদের অসুবিধে কিছু হয়নি।
Deleteমাজুলি যাওয়ার মতোই জায়গা। দেশে এলে প্ল্যান করে চলে যেও।
kolapatay mora mangso,bhabtei gaye kata dichche,eto lobh hochche...
ReplyDeletebesh korecho rice beer khao ni,ami roxy bole ekti local drink kheye baro bipod e porechilam,berate giye na khawa best,
ei rakam ghor ke dormar ghor e bole na?bansher konchi diye banana,khub sundor chobigulo...
asam e acho jakhan,hidol/shidol mach er bhorta ta obbossoi kheye eso,shutki jemon sun dried,hidol holo semi fermented preserved puti mach,
আমি তো এখন আর আসামে নেই, প্রসেনজিৎ। দিল্লি চলে এসেছি। পরের বার নিশ্চয় মাছের ভর্তা খেয়ে আসব। থ্যাংক ইউ।
Deleteamar ekhuni pora mangsho and maachh kolapatay mure bansher toiri barite boshe khete ichhe korchhe.
ReplyDeleteTomar future barir ei idea ta khub bhalo. ami churi korlam :)
Bratati.
সে সন্ধ্যেটা সত্যিই খুব ভালো কেটেছিল, ব্রততী।
Deleteযেমন সুন্দর লেখা, তেমনই সুন্দর ছবি। আর বাঁশের বাড়িটা তো দেখেই থাকতে ইচ্ছে করছে।
ReplyDeleteধন্যবাদ, সুগত।
Delete