আমা থাকালি, মজনু কা টিলা
দিল্লির যে ইন্টারেস্টিং জায়গাটায় স্রেফ দূরত্বের কারণে আমাদের যাওয়া হয় না সেটা হচ্ছে মজনু কা টিলা। প্রায় ষাট বছরের পুরোনো তিব্বতি কলোনি। দিল্লিতে অথেনটিক তিব্বতি খানার ঠিকানা। দুয়েকটা রেস্টোর্যান্ট রীতিমতো নামকরা, অনেকদিন আগে খেয়েছিলাম। সেই আমার প্রথম তিব্বতি খাবার খাওয়া। খুব একটা ভালো লাগেনি। এখন মনে হয়, কোনও দোকানের খাবার ভালো লাগার কারণ যতটা খাবারের স্বাদ, ততটাই কার বা কাদের সঙ্গে বসে খাচ্ছি সেটা। মজনু কা টিলায় যাদের সঙ্গে গিয়েছিলাম কারও সঙ্গেই বন্ধুত্ব পাতাতে ইচ্ছে করেনি। অর্চিষ্মানেরও নাকি তিব্বতি খাবার ভালো লাগে না। ও কবে কোথায় তিব্বতি খাবার খেয়েছিল আর কাদের সঙ্গে গিয়েছিল সেটা কখনও জিজ্ঞাসা করা হয়নি অবশ্য।
সে সমস্যা এবারে হবে না জানতাম। কারণ খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাহুলের সঙ্গে দেখা হত। রাহুল অর্চিষ্মানের গত তেরো বছরের এবং আমার গত ছ’বছরের বন্ধু। পছন্দের বন্ধু। রাহুল অনেকদিন ধরে বলছিল মজনু কা টিলার আমা ক্যাফের কথা। ওখানে আমা ব্র্যান্ডের ক্যাফে আছে, রেস্টোর্যান্ট আছে। রিসার্চ করে জানতে পারলাম আমা থাকালি বলেও নাকি একটা দোকান আছে এবং দেখেশুনে ওটাতেই যাওয়ার ইচ্ছে হল আমাদের।
মজনু কা টিলার গলিতে রাহুলের সঙ্গে দেখা হল। রাহুল বলল, 'ইয়ে, আমা ক্যাফেও খুব ভালো, কিন্তু খবর পাওয়া গেছে এখানে নাকি আরেকটা দোকান আছে,' এই না বলে সেই দোকানের যা ফিরিস্তি দিতে শুরু করল বোঝা গেল ও আমা থাকালির কথাই বলছে। হাই ফাইভ দিয়ে দোকানে ঢুকে পড়লাম।
তিব্বতি সেটলমেন্টের দোকান হলেও আমা থাকালি কিন্তু তিব্বতি খাবারের দোকান নয়। নেপালি খাবারের দোকান। হিমালয়ের কোল দিয়ে যাওয়া বাণিজ্যেপথের দু’পাশে বসবাস করা প্রাচীন জনজাতি এই থাকালিরা। বাণিজ্যপথের দু’পাশে ব্যবসায়ীদের জন্য ছোট ছোট সরাইখানায় থাকালি রান্না পাওয়া যেত। এখন থাকালি প্রায় সরাইখানা বা ছোট খাওয়ার জায়গা-র সঙ্গে ইন্টারচেঞ্জেবলি ব্যবহার হয়। আমাদের যেমন দাদাবৌদির হোটেল, আমা থাকালি তেমন মায়ের থাকালি।
থাকালি-র খাবার প্রধানত ‘থালি’ভিত্তিক। এই হচ্ছে নিরামিষ থালি।
আর এই হচ্ছে চিকেন থালি। এছাড়াও পাঁঠা এবং ডিমের থালিও পাওয়া যায়। সব রকম থালির কমন ব্যাপারগুলো হচ্ছে শাক, শুকনো একটা তরকারি (আমরা পেয়েছিলাম আলু বরবটি), অড়হর ডাল, আলুভাজা তিন রকমের আচার (মুলোর চাটনি, করলার চাটনি। তৃতীয়টার চেহারা এবং স্বাদ অনেকটা মোমোর কমলা চাটনির মতো)। এ ছাড়া ভেজ থালিতে ছিল পনীরের তরকারি, চিকেন থালিতে মুরগির ঝোল। আমা থাকালির ভাত আর রুটির থালি আলাদা আলাদা। হয় ওই সব থালি আপনি হয় ভাত দিয়ে নিতে পারেন নয় রুটি সহকারে। ভাত আমাদের ভাতের মতোই, রুটি একেবারেই আমাদের রুটির মতো নয়। বাজরার আটা দিয়ে বানানো, বানানোর প্রক্রিয়া দোসার মতো। আর দেখতে মোটা আপ্পামের মতো। খেতেও অনেকটা ওই রকমই নরম এবং ফোঁপরা। রাহুল ভীষণ ভালো ছেলে, কিছুই মনে করত না হয়তো কিন্তু ও ভালো বলে আমি অসহ্য হব কেন ভেবে আমি ওর প্লেটের ওপর হুমড়ি খেয়ে রুটির ছবি তুলিনি। চিকেন থালির চিকেন আর ভেজ থালির মেন ভেজ পদ বাদ দিয়ে বাকি সব পদ যত চাই তত খাই। বার বার খাবারের পাত্র নিয়ে আসেন সুভদ্র পরিবেশকরা।
তিব্বতি খাবারের প্রতি আমাদের দুজনের যে উদাসীনতা নেপালি খাবারের প্রতি ঠিক তার উল্টো। নেপালি খাবার আমি প্রথম খেয়েছিলাম আমার বন্ধু শ্রুতির বাড়িতে। কাঠমান্ডুর মেয়ে। যেমন ভালো ব্যবহার তেমন ভালো রান্না। শ্রুতির হাতের নেপালি রান্না সেই যে ভালো লেগেছিল, তারপর যত জায়গায় খেয়েছি কোথাও হতাশ হইনি। অর্চিষ্মানেরও নেপালি খাবার পছন্দ। (তাতে অবশ্য আশ্চর্যের কিছু নেই, ও যার সঙ্গে প্রথম নেপালি খাবার খেয়েছিল খারাপ লাগার অবকাশই ছিল না।)
এই আলু সদেকো হচ্ছে বেসিক্যালি সর্ষের তেলে ফোড়ন দেওয়া ফার্স্ট ক্লাস কাবলিছোলা বিহীন আলুকাবলি। আমাকে যদি রোজ বাড়িতে আলুকাবলি দিয়ে ভাত খেতে দেওয়া হয়, আমার অন্তত কোনও আপত্তি থাকবে না। শাক, তরকারি, আলুভাজা ইত্যাদি তো ভালোই, এমনকি পনীর যে পনীর, সেটাও খেতে শুরু করলে থামা যায় না। টকটক, ঝালঝাল। চটপটা বলতে যা বোঝায়, সে স্বাদে নেপালিদের জুড়ি নেই। আমার একমাত্র চলনসই লেগেছে ডালটা। একটু জোলো।
অর্চিষ্মান আর আমি একসঙ্গে প্রথম নেপালি খাবার খাই এই দিল্লিতেই, ইয়েতি দ্য হিমালয়ান কিচেন-এ। ইয়েতি দিল্লির বিখ্যাত হিমালয়ান রান্নার দোকানের চেন, একসময় আমাদের মারাত্মক প্রিয় ছিল। আলু সদেকো, ওয়াই ওয়াই সদেকো, ভুটে কো চানা এই সব নেপালি মুখরোচক খাদ্য আমি ইয়েতিতেই প্রথম খাই এবং খেয়ে একেবারে মুগ্ধ, বাকরুদ্ধ হই। ইয়েতির প্রসঙ্গ এখানে আনলাম কারণ অবান্তরের দিল্লিবাসী পাঠকদের কেউ কেউ ইয়েতিতে খেয়ে থাকতে পারেন এবং আমা থাকালিতে না খেয়ে থাকতে পারেন। ইয়েতি যদি জেম হয় আমা থাকালি হচ্ছে হিডেন জেম। রান্না ধরে ধরে যদি বিচার করি তাহলে দুটো ব্যাপার পরিস্ফুট হয়। এক, ইয়েতির থেকে আমা-র দাম অনেক কম। ইয়েতিতে দুজনের খেতে পড়ে তেরোশো টাকা, আমা থাকালিতে সে জায়গায় চারশো। ইয়েতি আর আমা-র দ্বিতীয় তফাৎটা হচ্ছে রান্নার স্বাদে। ছ’নম্বর বালিগঞ্জ প্লেসের সোনামুগের ডাল আর বাড়ির মুগের ডালের কথা ভাবুন। দুটোই ভীষণ ভালো খেতে, দুটোরই মূল উপকরণ এক কিন্তু দুটো রান্না কোনও অবস্থাতেই একটা অন্যটার বিকল্প নয়। ইয়েতির সদেকো দারুণ খেতে, দারুণ সূক্ষ্ম, সব এলিমেন্ট একেবারে মাপমতো গ্রাম আউন্স মেপে দেওয়া, দারুণ প্লেটে আসে। আমা-র সদেকো থেকে সর্ষের তেলের ঝাঁজ আসে এবং শুরু করলে থামা যায় না।
আমা-র বেস্ট ব্যাপারটা অবশ্য পরিবেশ। এত সুন্দর, এত ঘরোয়া, এত আরামদায়ক কোনও দোকানে অনেকদিন পর খেলাম। আমা আমাদের আরও একটা সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করেছে। যদি কোনওদিন ডাইনিং টেবিল রাখার মতো জায়গাওয়ালা বাড়িতে থাকার সৌভাগ্য হয়, তাহলে ডেফিনিটলি সে টেবিল মাটিতে পাতব। তার জন্য যদি আজ থেকে সকালসন্ধ্যে হাঁটুর ব্যায়াম শুরু করতে হয়, তাতেও দমব না।
আহ! কুন্তলাদি, বহুদিন পর ফুড রিভিউ দিলে।
ReplyDeleteজানো, তোমার ফুড রিভিউয়ের জন্য আমি লিটারেলি বসে থাকি।
নওশীন, ঢাকা, বাংলাদেশ
থ্যাংক ইউ, নওশীন।
DeleteDSE-te porakalin majnua ka tilla jetaam prayei, tar karon tibboti khabar preetir thekeo chhilo budget. Potala bole ekta restaurant chhilo. Ekhon bodhoy jayegatar anek poriborton hoyechhe
ReplyDeleteতুমি ডি এস ই? মজনু কা টিলার পরিবর্তন হয়েছে ঠিকই। তবে ভালোর দিকেই মনে হল। আগেরবার নোংরা নোংরা ঠেকেছিল যতদূর মনে পড়ছে, এখন ঝকঝক করছে।
DeleteHya DSE. Tobe tomaader campuse maajhe maajhe weekende jetaam, beraate.
ReplyDeleteহাহা, আমাদের ক্যাম্পাসটা বেড়াতে যাওয়ার মতোই কিন্তু, তাই না?
Deletekhidhe paye gelo...
ReplyDeleteভেরি গুড, ঘনাদা।
DeleteAloo sodeko ta ekbaar try korte icche korche. Recipe khuje ekbaar baniyefeli ... ki bolo Kuntala :-)
ReplyDeleteঅ্যাবসলিউটলি, শর্মিলা। আমারও চেষ্টা করার ইচ্ছে আছে।
Deleteফয়সলা অন-দ্য-স্পট।
ReplyDeleteদিল্লিতে নেক্সট ট্রিপ: আমা থাকালি, টাইম লাগুক, ভিড় থাকুক, খেতে হবে থালি।
অন দ্য স্পট ছড়াখানাও চমৎকার হয়েছে, ঋজু। আমা থাকালি-তে সুযোগ হলে অবশ্য খাবেন, ঠকবেন না।
Deleteমাঝে মাঝে খাওয়া দাওয়া নিয়ে কথা না বললে দমবন্ধ লাগে । 😁
ReplyDeleteতা ঠিক, হংসরাজ।
DeleteBaah bhalo laglo anekdin por food review pore. Khabargulo amai aakristo kore tader bornonar karone. Apnar lekha porte sabsomoy i bhalo laage.
ReplyDeleteTibboti khabar prothome shune mone holo boli je aamra prai Tibboter kachakachhi chole gechhi. Din ponero aage lotbohor somet Philippines theke Beijing paari dilam. Foloto koekdin Abantor miss hoye gechhe pora.
আরে, নতুন দেশ! দারুণ মজা তো। আপনাদের বেজিংবাস সুখের হোক, সুস্মিতা। সত্যি সত্যিই তিব্বতের অনেক কাছে পৌঁছে গেছেন।
DeleteKokhono jodi Beijing aasa hoi tahole contact korle khub khushi hobo.
Deleteনিশ্চয়, সুস্মিতা।
Deleteরেস্তোরাঁ ভিজিট গুলো পড়তে ভাল্লাগে কিন্তু আমার যাওয়া হয় না খুব বেশী কোনো রেস্তোরাঁতেই , এক তো একা একা ঘুরতে বেড়াতে ভালো লাগে কিন্তু খেতে এতে না আর দুই আমি খুব বেশী খেতে পারিও না একসাথে , বন্ধুদের সাথে গেলে এতো আওয়াজ খাই লজ্জা লাগে।
ReplyDeleteকম খাওয়াই ভালো, প্রদীপ্ত।
Delete