হেডফোন
অবান্তরের ‘টু রাইট’ ফোল্ডারে একটা ফাইল দেখছি, নাম হেডফোন। ভেতরে কিছু লেখা নেই। হেডফোন নিয়ে কিছু একটা লেখার কথা মাথায় এসেছিল, কী এসেছিল সেটা সম্পূর্ণ ভুলে গেছি। অবান্তরে এর আগেও হেডফোন নিয়ে লিখেছি সম্ভবতঃ। সেদিন সায়ন জিজ্ঞাসা করলেন লিরিক্যালের রসনাস্মৃতির বাসনাদেশ প্রথম খণ্ডে বাংলাদেশের স্মৃতি এবং খাওয়াদাওয়া নিয়ে আমার যে লেখাটা বেরিয়েছে সেটা অবান্তরে আগে পড়েছেন কি না। আমি বললাম, ওই আকারে পড়েননি হয়তো কিন্তু ওই লেখায় উঠে আসা খুচরোখাচরা গল্প নিশ্চয় পড়েছেন। ন’বছর ধরে অবান্তরে গল্প ফাঁদতে ফাঁদতে সব গল্পই এক বা একাধিকবার বলা হয়ে গেছে। হেডফোনের মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস প্রসঙ্গে কিছু বলিনি হতেই পারে না। কী বলেছি তা এখন মনেও নেই, খুঁজতে বসার ইচ্ছেও নেই। এক নম্বর, খোঁজা শক্ত, দু’নম্বর, খুঁজে পেলে নিজের পুরোনো লেখার মুখোমুখি পড়তে হবে। তার থেকে বসে বসে নিজের গায়ে চিমটি কাটাও ভালো।
ফোল্ডারটা বেশিদিন আগেও বানানো না। ছাব্বিশে ফেব্রুয়ারি। ছাব্বিশে ফেব্রুয়ারি বা তার আশেপাশে নিশ্চয় হেডফোন সংক্রান্ত কিছু একটা বলার মতো ঘটনা ঘটেছিল। কী ঘটেছিল মনে পড়ল না। অর্চিষ্মানকে জিজ্ঞাসা করলাম, মনে আছে গো?
কী?
এই ছাব্বিশে ফেব্রুয়ারি নাগাদ হেডফোন সংক্রান্ত কিছু ঘটেছিল কি না যা নিয়ে অবান্তরে পোস্ট লেখা যায়?
পাগল না মাথাখারাপ?
তারপর যোগ করল, তাছাড়া তোমার হেডফোন, তোমার গল্প, আমি মনে রাখতে যাব কোন দুঃখে?
সব সম্পর্কেরই দুর্যোধনের ঊরু থাকে। সুখের মুহূর্ত দিয়ে যতই ঠ্যাকনা দিয়ে রাখি না কেন, যখনতখন ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ে যায়।
আমার-অর্চিষ্মানের সম্পর্কের সেই ঊরু হল হেডফোন।
আমি আমার হেডফোন নিয়ে পজেসিভ। শুধু হেডফোন নয়, আমার প্রতিটি জিনিস নিয়েই আমার অধিকারবোধ নির্লজ্জরকম। নিজের এই খারাপ দিকটা আমি জানি আর খোলামুখে স্বীকার করি। বলি, আমি লোকটাই খারাপ, স্বার্থপরের বাসা। আর যাঁরা আমাকে পছন্দ করেন, আঘাত দিতে চান না, তাঁরা বলেন, আহা দোষ তোমার নয়, এক সন্তানরা ও রকমই হয়ে থাকে। বাবামাকেই কোনওদিন কারও সঙ্গে ভাগ করেনি, হেডফোন করবে কি?
অর্চিষ্মান আমার থেকে ঢের কম স্বার্থপর, আমার মতো সংসারের সব জিনিস নিয়ে আমার-তোমার নেই ওর। অর্চিষ্মান নির্বিবাদে আমার কাপে চা খায়, আমার তোয়ালে কাঁধে ফেলে স্নানে যায়, আমার চিরুনি দিয়ে রেগুলার চুল আঁচড়ায়, নিজেরটা খুঁজে না পেলে আমার ডিওডোরেন্ট মেখে অফিস চলে যায়, একদিন ঘুমচোখে আমার ব্রাশ দিয়ে দাঁতও মেজে ফেলেছিল।
সেই অর্চিষ্মানও আমার হেডফোনকে কখনও নিজের বলে ভুল করে না। এবং ভুলেও ওর হেডফোনকে আমাকে নিজের মনে করতে দেয় না। এ ব্যাপারে আমরা দুজনেই সমান। নিজের হেডফোন না পেলে আমরা একে অপরের ব্যাগে নির্মম তল্লাশি চালাই, কপালদোষে যদি এর হেডফোন ওর ব্যাগ থেকে বেরিয়ে পড়ে এবং দোষী ব্যক্তি নিজের মরা পূর্বপুরুষের নামে দিব্যি কেটেও বলে যে ভুলটা নিতান্তই অনিচ্ছাকৃত, ঝাড়া দেড় মিনিটের সাইলেন্ট ট্রিটমেন্ট প্রয়োগ করি, আর যদি কারও হেডফোন খারাপ হয়ে যায় বা ছিঁড়ে যায় বা হারিয়ে যায়, ‘আমারটার দিকে তাকাবেও না খবরদার, যত্ন করে রাখোনি কেন?’ বলে মুখ ঘুরিয়ে নিই।
নেব না-ই বা কেন? সহকর্মীদের ভনভন, যাত্রাপথে ট্যাক্সির রেডিওতে ভজন কিংবা র্যাপ কিংবা ফোন কানে সহযাত্রীর নাছোড়বান্দা ‘অওর বতাও” - একটা নিজস্ব হেডফোন ছাড়া? কল্পনা করতে পারছেন? আমি পারছি না। চাইছিও না। আমার হেডফোন সারাদিনের যুদ্ধক্ষেত্রে আমার একমাত্র কবচকুণ্ডল।
সেই হেডফোন নিয়ে অবান্তরে একাধিক পোস্ট লেখাই যায়। কিন্তু কী লিখব যদি মনেই না পড়ে কী লিখতে চেয়েছিলাম?
দুহাতে মাথা রেখে শেষবারের মতো মনঃসংযোগ করলাম। মনে পড়ল না। সে জায়গায় অর্চিষ্মানের একটা গল্প মনে পড়ে গেল।
নাকতলার বাড়িতে সোনি কোম্পানির একটি মহার্ঘ হেডফোন ছিল। ধ্রুপদী হেডফোন, উত্তল ডাণ্ডার দুপাশে দু’খানা চাকতি। অর্চিষ্মানের সে হেডফোন পছন্দ ছিল না। চরম বোকা বোকা, মাথার ওপর রামধনুর মতো ফুটে থাকে। অর্চিষ্মানের তখন ভীষণ শখ একটা কুল, মিনিম্যালিস্ট হেডফোনের যার মাথার ওপর কিছু নেই, বাডদুটো কানের ভেতর ঢুকে থাকে আর দুটো তার ঝুলতে ঝুলতে অদৃশ্য হয়ে যায় প্যান্টের পকেটে। কিন্তু অর্চিষ্মান জানত যে ‘এইরকম আনকুল হেডফোন চলবে না, কুল হেডফোন দাও’ বললে বাড়িতে চিঁড়ে ভিজবে না। কুল হেডফোনের দাম আনকুলের থেকে নিশ্চয় বেশি হবে মনে করে অর্চিষ্মান কোমর বেঁধে টাকা জমাতে শুরু করল। অটোর বদলে হেঁটে, রোলের বদলে মুড়ি খেয়ে। অবশেষে ওর মনে হল, যথেষ্ট টাকা জমেছে। দোকানে গিয়ে অবশ্য চমক। কুল হেডফোনের দাম বাড়ির গামবাট হেডফোনের তিন ভাগের এক ভাগ। গুণগত মান তারও বেশি অনুপাতে কম। অর্চিষ্মান জীবনে সেই প্রথমবার জানল, কুল হলেই কুলীন হয় না।
আমার মা অবশ্য জানতেন। মা আবার একধাপ এগিয়ে বিশ্বাস করতেন, কুল হতে চাওয়া আর রসাতলে যাওয়ার মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। কাজেই আমার চুইংগাম চিবোনো বারণ ছিল আর হেডফোনের ত্রিসীমানায় ঘেঁষার পারমিশন ছিল না। অর্থাৎ হেডফোনসংক্রান্ত আমার ছোটবেলার কোনও গল্প নেই। ছাব্বিশে ফেব্রুয়ারির গল্পটাও যেহেতু মনে পড়ছে না, সেহেতু এই মুহূর্তে হেডফোন নিয়ে আপনাদের বলার মতো আমার কোনও গল্পই নেই।
*****
পোস্ট লেখার আশা ত্যাগ দিয়ে কাল রাতে খাওয়াদাওয়া শেষ করে বিছানায় আধশোয়া হয়েছি, বুকে ল্যাপটপ, কানে হেডফোন, ব্রেনে কারফিউ। মাউসের ওপর ডানহাতের তর্জনীর ডগার নিয়মিত ওঠাপড়া না থাকলে বোঝা শক্ত হত বেঁচে আছি না মরে গেছি।
কখন অর্চিষ্মান পাশ থেকে উঠেছে, বাথরুমে যেতে কিংবা ফ্রিজ খুলে চকোলেট খেতে, খেয়াল করিনি। করলাম যখন কাঁধে টোকা পড়ল।
আমাদের সম্পর্কের স্বাস্থ্যের জন্য ওই সময়টুকু যে যার বুদবুদের ভেতর একলা কাটানো কতখানি অপরিহার্য আমরা দুজনেই জানি। তা সত্ত্বেও টোকা মারছে যখন নিশ্চয় কিছু এমারজেন্সি ঘটেছে। কান থেকে হেডফোন খুলে তাকালাম। গ্যাস লিক করছে? ট্যাংকের জল ফুরিয়ে গেছে? দাঁতে ব্যথা?
অর্চিষ্মানের মুখেচোখে যন্ত্রণা বা বিরক্তির কোনও ছাপ নেই। তবে কি চোখে দেখা যায় না এমন কিছু? মন খারাপ?
একবার বাইরে এসো।
কেন?
এসোই না।
দীর্ঘশ্বাস চেপে কান থেকে হেডফোন খুলে গেলাম পিছু পিছু। বারান্দার দরজাটা খোলারও আগে ঝরঝর শব্দটা কানে এল। দরজা খুলতেই ঝাপট দিল ঠাণ্ডা হাওয়া। বৃষ্টি! অসময়ে!
টের পেলে কী করে?
পাইনি তো। হেডফোন খুলে চকোলেট খেতে এ ঘরে এলাম, তখন শব্দ পেয়ে দরজা খুলে দেখি এই কাণ্ড।
মিনিটদশেক রেলিঙে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ভেজা কংক্রিটের গন্ধ শুঁকে আর কারিগাছের বাড়ানো পাতায় বারান্দার সানসেট থেকে জলের ফোঁটার টুপটাপ দেখে ঘরে ফিরে এলাম। জানালা খুলে পর্দা সরিয়ে দিলাম। ঝরঝর আওয়াজটা বাড়ল, কমল। আবার বাড়ল, আবার কমল। বইমেলা থেকে কেনা দু’খানা বই নিয়ে যে যার বুদবুদে ঢুকে গেলাম আবার। খুলে রাখা হেডফোনদুটো আমার-তোমার ভুলে জড়াজড়ি করে টেবিলের ওপর শুয়ে রইল।
Lekhata pore khanikhon chup Kore shob feel korlam. Ashonmoyer brishti, shomporko, shomporker budbud, aar tarpor oi amaar tomaar bhule jawa..
ReplyDeleteওই ভোলাটা না থাকলে যে কী হত, অর্পণ।
Deleteমন খারাপ, মন ভালো আর মন কেমন তিনটে একসাথে হলো।
ReplyDeleteআমার অবশ্য আপনার মন্তব্য পড়ে মন ভালোই শুধু হল, বৈজয়ন্তী। থ্যাংক ইউ।
DeleteBah
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, তিন্নি।
Deleteমিনিটদশেক রেলিঙে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ভেজা কংক্রিটের গন্ধ শুঁকে আর কারিগাছের বাড়ানো পাতায় বারান্দার সানসেট থেকে জলের ফোঁটার টুপটাপ দেখে ঘরে ফিরে এলাম। জানালা খুলে পর্দা সরিয়ে দিলাম। ঝরঝর আওয়াজটা বাড়ল, কমল। আবার বাড়ল, আবার কমল। বইমেলা থেকে কেনা দু’খানা বই নিয়ে যে যার বুদবুদে ঢুকে গেলাম আবার। খুলে রাখা হেডফোনদুটো আমার-তোমার ভুলে জড়াজড়ি করে টেবিলের ওপর শুয়ে রইল।
ReplyDeleteAha, aha.....ki likhechhen ei parata, Kuntala. :) :)
Kurnish!
হাহা, থ্যাংক ইউ, অরিজিত।
DeleteKi asambhab bhalo lekha!! Sesh linegulo boro monkemon kora... Headphone niye emon chomtkar golpo toiri holo. Ar tate bristir elomelo fNotao porlo...
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, সায়ন। হেডফোন যা জরুরি আর ভালো জিনিস, তাকে নিয়ে গল্প না হওয়াই অসম্ভব।
DeleteKhub odbhut byapar. Delhi te brishti holeo Gurgaon te hoyna :(
ReplyDeleteEktu sedin jhoro hawa dilo..byas.
আরে আমাদেরও ওই ছিটেফোঁটাই পড়েছে, রণদীপ। সেদিন রাতে হল, তারপর আর নামগন্ধ নেই। তবে মেঘলা হচ্ছে মাঝেমধ্যেই।
DeleteBah ager ta bhule giye notun romantic golpo hoye gelo..
ReplyDeleteযা বলেছিস, ঊর্মি।
Deleteআপনার একটা হেডফোনিক গল্প আমার মনে আছে। খুব সম্ভব আপনি তখন মার্কিন মুলুকে থাকতেন , ক্লিভল্যান্ড বা ওরকম কোনো জায়গায়। তো হয়েছে কি, যথারীতি কোনো এক সকালে আপনি আপনার প্রাণাধিক হেডফোন খুঁজে পাচ্ছেন না। ব্যাকপ্যাক, ক্লোসেট, পার্স, সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে ফেললেন, হেডফোন মিললো না। দুর্ধর্ষ রেগে গেলেন নিজের উপর, এদিকে পুরো ধড়াচূড়ো না পরে বাইরে বেরোতেও পারছেন না, কারণ ক্লিভল্যান্ডের শীত হেলাফেলার বস্তু নয়। অতএব অনন্যোপায় হয়ে কোনোমতে জামাজুতো গলিয়ে রাগে গনগন করতে করতে খানিকদূরের বেস্ট বাই বা রেডিওশ্যাক গোছের কোনো এক দোকান থেকে নতুন হেডফোন কিনে আনতে বাধ্য হন ।
ReplyDeleteপুঃ :- জনশ্রুতি আছে যে তার পর সে মরসুমে নাকি ক্লিভল্যান্ডের শীত আর তেমন বাড়াবাড়ি করতে সাহস পায়নি।
এই সব লিখেছিলাম বুঝি? এত গল্প আছে আসলে আমার হেডফোনিক যে কোনটা কবে ঘটেছিল মনেও নেই।
Deleteএই অবান্তরেই লিখেছিলেন। সে বিস্তর দিন আগে।
ReplyDeleteওহ, আপনার মনে আছে দেখে ভালো লাগলো, সন্ময়।
Deleteআহা বড় ভালো লাগলো , চুপ করে পড়ার লেখা , মন্তব্য করে বোঝাতে পারা যাবে না।
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, প্রদীপ্ত।
Delete