দোলের ছুটিতে
পার্টিতে যাওয়া না পার্টি দেওয়া, কোনটা বেশি কষ্টের সেটা নিয়ে আমরা অনেক ভেবেছি। পার্টিতে যাওয়ার আগে নিজেদের ভদ্রস্থ করতে হয় সেটা বিরক্তিকর, কিন্তু পার্টি দিলে পার্টি শুরুর আগে এবং শেষ হওয়ার পর নিজেদের সঙ্গে সঙ্গে বাড়িটাকেও ভদ্রস্থ করতে হয়। কাজেই আমরা পারতপক্ষে বাড়িতে পার্টি দিই না। কেউ পার্টি দিলে আর সে পার্টিতে আমাদের নেমন্তন্ন করলে কষ্টেসৃষ্টে অ্যাটেন্ড করে আসি।
শুধু গেলে আর লোককে না ডাকলে যা হয়, কেউ আমাদের ডাকে না। এক আমাদের বাড়িওয়ালা ছাড়া। তিনি ভাড়াটেদের নিয়ে বাড়ির ছাদে ঘন ঘন পার্টির ব্যবস্থা করেন। হোলিতে, বিজয়ায়, কোনও ভাড়াটের বিয়ে বা চাকরির খবরে, নতুন ভাড়াটেদের সঙ্গে পুরোনোদের আলাপ করাতে… পার্টির কারণের অভাব হয় না।
হোলিতে লং উইকএন্ডে অর্ধেক ভাড়াটে বাড়ি চলে গিয়েছিল। ছাদের পার্টিতে খালি ছিলাম আমরা, আরেক ভাড়াটে, বাড়িওয়ালা আর বাড়িওয়ালার বন্ধু। আর ছিল গজকি (বাঙালিরা যাকে তিলের চাক বলে), চকোলেট শোনপাপড়ি, হ্যালেপিনো সয়াচিপস, মিক্সড ফ্রুট জুস, লালসবুজ আবীর। বাড়িওয়ালা বললেন, ‘খাও খাও কুন্তলা, এ শোনপাপড়িতে ওজন বাড়বে না, এ সয়াচিপসে চোঁয়াঢেঁকুর উঠবে না। বাবা রামদেবের আশীর্বাদ আছে। তোমার সারামুখে যে রকম বদখত ব্রণর দাগ, নিয়মিত এই মন্ত্রপূত আবীর মাখলে উবেও যেতে পারে।’ বলে একথাবা আবীর আমার গালে ঘষে দিলেন।
রং মেখে, চিপস খেয়ে, ঘণ্টাখানেক হেঁ হেঁ করে ছাদ থেকে নেমে এলাম। অনেক কাজ, ফ্রিজের খুচুরখাচুর খাবার শেষ করতে হবে, ব্যাগ গোছাতে হবে, কারি গাছে বেশি করে জল দিতে হবে, সামনের দুদিন বেচারা জল পাবে না, কারণ আজ সন্ধ্যের ট্রেনে আমরা চিতোরগড় যাচ্ছি।
*****
আপনারা ভাবছেন আমাদের মাথাটা নির্ঘাত গেছে, না হলে মাসের এমাথা ওমাথা রাজস্থান ছুটছি কেন, কিন্তু আমাদের আসলে গেছে চোখ। গত মাসে উদয়পুরের রিটার্ন টিকিট কাটা হয়ে যাওয়ার পর খেয়াল হল দিল্লি টু উদয়পুর যাওয়ার টিকিট কাটা হয়েছে দোসরা ফেব্রুয়ারি আর উদয়পুর টু দিল্লি ফেরার টিকিট কাটা হয়েছে চৌঠা মার্চ।
নন রিফান্ডেবল।
অগত্যা মেওয়ার সুপারফাস্ট এক্সপ্রেসে ফেব্রুয়ারির শেষে উদয়পুর থেকে দিল্লি ফেরার একটা টিকিট আর মার্চের শুরুতে ওই মেওয়ার সুপারফাস্ট এক্সপ্রেসেই দিল্লি থেকে চিতোরগড়ের একটা টিকিট কাটতে হল। ভালোই হল, এক ভুলে দুই বেড়ানো হয়ে গেল।
*****
দোলের বিকেলের থেকে বিষণ্ণতর ব্যাপার আমি আর কমই দেখেছি। রাস্তা, ফ্লাইওভার খাঁ খাঁ, যুদ্ধক্লান্ত, রঙে চোবানো কিছু সৈনিক ইতিউতি চলেফিরে বেড়াচ্ছে। সময়ের অনেক আগে পৌঁছে ফাঁকা স্টেশনে দাঁড়িয়ে রামকৃষ্ণ মিশনের বুকস্টল আর মা কুকুরের পেটের কাছে গোল পাকিয়ে শুয়ে থাকা ছানা কুকুর দেখে টাইমপাস করছি আর ভাবছি, বাঁচা গেছে, এই দোলের বাজারে যারা যেখানে যাওয়ার চলে গেছে নিশ্চয়, আমাদের বিরক্ত করতে বেশি কেউ আসবে না, অমনি ওভারব্রিজ বেয়ে লক্ষ লক্ষ লোক লটবহর নিয়ে নেমে এল। সবার চুলের ফাঁকে, কানের লতিতে, গলার ভাঁজে লাল কমলা সবুজ হলুদ। কিছু লোক হোলি খেলে বাড়ি ফিরছে, আর তার থেকেও বেশি লোক হোলি খেলে উইকএন্ডে বেড়াতে যাচ্ছে। রাজস্থানীরা সংখ্যায় বেশি, কিন্তু গলার জোরে মাত দিয়েছে পাঞ্জাবীরা। ভয়ানক হট্টগোল শুরু হল, ঘুম ভেঙে মা কুকুর ছানাকে নিয়ে বিরক্তমুখে হাঁটা দিল আর ভিড়ের মাথা ছাপিয়ে ইঞ্জিনের কালো মাথা দেখা গেল। আমরা দেখেশুনেই দাঁড়িয়েছিলাম, কিন্তু গড়াতে গড়াতে আমাদের কোচ দেখি এগোচ্ছে তো এগোচ্ছেই। আমি ব্যাগ কাঁধে পিছুপিছু দৌড় দিলাম।
সামান্য রানিং থাকতেই কোচে উঠে সিট নম্বর খুঁজে বসে আছি, পাঁচ মিনিট বাদে অর্চিষ্মান হাঁপাতে হাঁপাতে এল। আমি রসিকতা করে ওর রিজার্ভড সিটে চাপড় মেরে বললাম, ‘দেখ তোমার জন্য কেমন সিট রেখেছি,’ অর্চিষ্মান হাসল তো না-ই উল্টে ভুরু কুঁচকে বলল, ‘কোনও দরকার ছিল?’
হাঁ করে রইলাম। কী দরকার? কীসের দরকার? তারপর মাথায় ঢুকল। অর্চিষ্মান জানতে চাইছে ট্রেনের পেছন পেছন দৌড়োনোর আর রানিং-এ ওঠার কোনও দরকার ছিল কি না। বাকিদের মতো ধীরেসুস্থে হেঁটে হেঁটে উঠলেই তো হত। আমি ওকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম।
প্রশ্নটা দরকার অদরকারের নয়। এটা ট্রেনলাইনে জন্মানোর নেগেটিভ এক্সটারনালিটি। ফাঁকা ট্রেন নাকের ডগা দিয়ে চলে যাচ্ছে দেখলে নিজেকে সামলাতে না পারা।
মেওয়ার এক্সপ্রেস নিজামুদ্দিন থেকে ছাড়ে সন্ধ্যে সাতটায়। বল্লভগড়, মথুরা, ভরতপুর, কোটা, বুন্দি, সওয়াই মাধোপুর, চান্দেরিয়া ইত্যাদি ভালো ভালো স্টেশন পেরিয়ে চিতোরগড় পৌঁছোয় ভোর প’নে পাঁচটায়। শখ করে আমি রোজই ওই সময় ঘুম থেকে উঠি, কিন্তু যেহেতু সেদিন ঘুম ভাঙাটা শখ নয়, প্রয়োজন এবং ঘুম না ভাঙলে বিপদ, আমি অলমোস্ট শিওর ছিলাম যে সেদিন আমার ঘুম ভাঙবে না। বহুদিন আগে বাবামায়ের সঙ্গে কোথায় যেন যাচ্ছিলাম, টনকপুর স্টেশনে শেষরাতে নামার ছিল। স্টপ ছিল মোটে দু’মিনিটের। ভোঁ দিয়ে ট্রেন ছেড়ে দেওয়ার পর সবার ঘুম ভেঙেছিল এবং হুড়োহুড়ি করে হাতের কাছে যা আছে সঙ্গে নিয়ে নামার পর আবিষ্কার হয়েছিল যে ট্রেনের একটা বালিশও সঙ্গে নেমে এসেছে। রীতিমত স্পিড তুলে ফেলা ট্রেনের সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে কোনওমতে দরজা দিয়ে ছুঁড়ে সে বালিশ ফেরত দেওয়া হয়েছিল। সে ঘটনা আমার গোটা বেড়ানোর থেকে বেশি মনে আছে।
অ্যালার্ম দিয়ে ফোন কানের কাছে নিয়ে শুয়েও আমার টেনশন গেল না। একবার চোখ লেগে এসেছিল, পরীক্ষা এসে গেছে, আমার সিলেবাস শেষ হয়নি, বাকি সবার শেষ হয়ে গেছে, এই সব স্বপ্ন দেখে তন্দ্রা ছুটে গেল। তখন আমি আপার বার্থ থেকে ঝুঁকে পড়ে জলের বোতলটা দিয়ে মিডল বার্থে অর্চিষ্মানকে খোঁচা মেরে পরীক্ষা করলাম ও ঘুমিয়েছে কি না। ঘুমোয়নি। অর্চিষ্মান বলল, ওরও নাকি মাঝে মাঝে নাকি ঘুম এসেছিল কিন্তু যতবারই ঘুম এসেছে ও স্বপ্ন দেখেছে যে একটা প্রকাণ্ড অন্ধকার হল, আলো এসে পড়েছে খালি স্টেজের ওপর আর সে স্টেজের ওপর অর্চিষ্মান একা দাঁড়িয়ে, সামনে একটা মাইক। হল ভর্তি লোক চুপ করে অপেক্ষা করে আছে কখন অর্চিষ্মান বক্তৃতা শুরু করবে।
সাড়ে চারটেয় উঠে পড়ে দাঁতটাত মেজে আমরা লোয়ার বার্থের কোণে কোনওমতে তশরিফ ঠেকিয়ে বসে রইলাম। প’নে পাঁচটায় ট্রেন চিতোরগড় ঢুকে গেল। আমরা ট্রেন থেকে নেমেই দেখলাম স্টেশনের দেওয়ালে রঙচঙে ঝকমকে সব ছবি আর আমাদের ঠিক সামনের ছবিতে লাল জামা, হলুদ পাজামা, মুক্তো বসানো পাগড়ি-পরা জয়মল কল্লা রাঠোর, হাতি নয়, ঘোড়া নয়, আক্ষরিক অর্থেই আরেকজন মানুষের ঘাড়ে চড়ে দুই হাতে তরবারি ঘুরিয়ে বিপক্ষদলের শত্রুদের কল্লা নামাচ্ছেন।
চিতোরের আর টি ডি সি-র হোটেল পান্নাতে আমাদের ঘর বুক করা আছে দুপুর বারোটা থেকে। বাড়িতে বুকের ওপর ল্যাপটপ নিয়ে ফ্যানের তলায় শুয়ে শুয়ে যখন বেড়ানোর প্ল্যানিং করেছিলাম তখন এটা যে একটা সমস্যা হতে পারে সেটা মাথাতেই আসেনি, মনে হয়েছিল ট্রেন থেকে নেমে আলো ফোটা পর্যন্ত স্টেশনে বসে থাকব, চা-টা খাব, তারপর দুর্গ দেখতে বেরিয়ে যাব। দেখেটেখে এসে হোটেলে চেক ইন করে রেস্ট নেব। বিকেলে আবার বেরোনো যাবে।
সারারাত না ঘুমিয়ে, শেষরাতে প্ল্যাটফর্মে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকা লোকেদের মধ্যে দাঁড়িয়ে সুনামির ঢেউয়ের মতো বড় বড় হাই চাপতে চাপতে বাড়ির এনার্জির কণামাত্র খুঁজে পাচ্ছিলাম না। চারপাশ থেকে দু’চারজন চাওয়ালা চেঁচিয়ে লোক ডাকছিলেন, এক কাপ চা খেয়ে দেখলাম ঘুম যায় কি না। গেল না। স্টেশনের বাইরে দুয়েকটা টেম্পো দাঁড়িয়ে ছিল, একটাতে চড়ে বললাম, 'পান্না চলিয়ে।' হোটেলে গিয়ে বলব যে আমাদের বেলা বারোটা থেকে বুকিং আছে, যদি ঘর ফাঁকা থাকে একটাতে আমাদের থাকতে দিন প্লিজ, আমরা একদিনের এক্সট্রা ভাড়া দিয়ে দেব। একটুও ঝামেলা করব না।
স্টেশন হোটেল পান্না মোটে ছ’শো মিটার, আরেকটু কম ঘুম পেলে হেঁটেই যাওয়া যেত। ল্যাম্পপোস্টের ঘোলাটে সাদা আলো বিরাট কম্পাউন্ডের অতি অল্প জায়গাতেই পৌঁছেছে, ছাপ বাঁধা অন্ধকারের অংশই বেশি। টেম্পো এসে সিঁড়ির সামনে থামল। চওড়া দরজা পাটে পাটে বন্ধ। অর্চিষ্মান টেম্পো থেকে নেমে গেল দরজায় ধাক্কা দিতে। তিনবারের বার দরজা খুলে উঁকি মারল একটা মুখ। মাংকিক্যাপ ছাড়া সে মুখের আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। অর্চিষ্মান ভেতরে ঢুকে গেল।
আমি কান খাড়া করে বসে রইলাম টেম্পোর ভেতর, খুব আস্তে গুনগুন শুনতে পাচ্ছি হোটেলের ভেতর থেকে, কী কথা হচ্ছে বোঝা অসম্ভব। টেম্পো ভাইসাব আমাকে সান্ত্বনা দিলেন, ‘চিন্তা মৎ কিজিয়ে, রুম মিল যায়েগা।’ আড়াই মিনিটের মাথায় অর্চিষ্মান বেরিয়ে এল। হাঁটার সতেজ ভঙ্গি দেখেই বুঝে গেলাম, খবর ভালো।
রেজিস্টারে নামঠিকানা সই করে, প্যান কার্ড জমা রেখে, ঘরে ঢুকে ধপধপে চাদর পাতা চওড়া বিছানাটা দেখে কী যে আনন্দ হল। কোনওমতে জামাজুতো ছেড়ে বিছানায় বডি ফেললাম, উঠলাম বেলা আটটা চল্লিশে।
(চলবে)
Abar amar favourite topic :)
ReplyDeleteহাহা, আমারও, ঊর্মি।
DeleteChittorgarh! Amar hebby hingshe hocche eibar. tomra dujone ja sob sopno dekhecho Freud to pash fire shoben koborer modhye.
ReplyDeleteহাহা, যা বলেছ, কুহেলি।
DeleteBaah bhalo laglo porte. 20 bochhor age gechhilam. Bhalo legechhilo.
ReplyDeleteআমিও কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে গিয়েছিলাম, সুস্মিতা। চিতোর সেবারও ভালো লেগেছিল, এবারও ভালো লেগেছে।
DeleteCoincidentally amar o college er first year chhilo sebar.
Deleteহাই ফাইভ, সুস্মিতা।
DeleteHi five....
Deleteআমরাও মোটামুটি গুছিয়ে বসলাম পরের পার্টের জন্য।
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ, ঋজু।
Deleteki bhalo lekhen apni Kuntala...
ReplyDeleteR ager lekhata pore ami satyi-i zomato te giye review check korechilam :) Dyotona.
আরে থ্যাংক ইউ, দ্যোতনা।
Deletetomar sathe amar bhari mil. ami ghorta khub nongra ar ogochhalo hole barite party di. Lokjon asbe sei chape bari porishkar hoye jay.
ReplyDeleteসত্যি চুপকথা, বাড়ি পরিষ্কারের জন্য লোক আসার থেকে বেটার মোটিভেশন পাওয়া কঠিন।
Deletebah bah!!! -tinni
ReplyDeleteচমৎকার লাগলো যথারীতি ^_^ ...পরেরটায় যাই
ReplyDeleteআরে তুমি সব পোস্ট ধরে ধরে পড়ছ দেখি, থ্যাংক ইউ, প্রদীপ্ত।
Deleteআরে আমি এখানের নিয়মিত পাঠক , গত এক মাসে কিছুই পড়া হয়নি।
Delete