পরী



উৎস গুগল ইমেজেস

গাট ফিলিং-এ আপনি বিশ্বাস করেন? আমি করি না। কারণ আমার গাট আমাকে নিয়মিত ভুল পথে চালিত করে। প্রেম, কেরিয়ার, আরও কত বিষয়ে কত বার যে আমার গাট আমাকে ঘোল খাইয়েছে একটা সময়ের পর আমি ক্লান্ত হয়ে গোনা ছেড়ে দিয়েছি। 

গাট ফিলিং বলছিল পরী আমার খারাপ লাগবে। প্রথমত, ভূতের সিনেমা ছোট পর্দাতে দেখতেই ভয় লাগে, বড় পর্দায় শখ করে সে ভয়ের ভিক্টিম নিজেকে বানানোর কোনও যুক্তি নেই। দুই, রিভিউ খারাপ। আমি যাঁদের রিভিউতে মোটামুটি বিশ্বাস রাখি, সিনেমা না দেখলেও যাঁদের করা সিনেমার রিভিউ দেখি, যেমন রাজীব মসন্দ, তিনি বলেছিলেন শুরুটা স্ট্রং, শেষটা সিলি। তবু পরী দেখতে গেলাম কারণ এক, অর্চিষ্মানের ঝুলোঝুলি, দুই, জি কে টু-র ডিটি হলে, যেটা আমাদের বাড়ি থেকে হেঁটে যাওয়াআসা যায়, মাত্র দেড়শো টাকায় সুবিধেজনক সময়ে টিকিট পাওয়া যাচ্ছিল। অফিস থেকে ফিরে এমনিতে ফ্রিজ থেকে খাবার বার করে মাইক্রোওয়েভে ঢোকাতেও নতুন করে উচ্চমাধ্যমিকে বসার ফিলিং হয়, কিন্তু বৃহস্পতিবার আমরা ব্যাগ রেখে বেরিয়ে ধোপাভাইসাবকে কাপড় দিলাম, ঝালমুড়ি আর রোল খেলাম, তারপর হেঁটে হেঁটে হলে চলে গেলাম সিনেমা হলে। প্রতিটি মুহূর্ত আমার গাট আমাকে বলতে লাগল, যা করছি ঠিক হচ্ছে না। পরী আমার মারাত্মক খারাপ লাগবে।

পরী আমার মারাত্মক ভালো লেগেছে। এত ভালো লেগেছে যে পরীর ন্যায্য এবং যুক্তিপূর্ণ কিছু খারাপলাগা অংশ আমি অগ্রাহ্য করতে রাজি আছি। কেন আমার পরী ভালো লেগেছে সেটা আপনাদের গুছিয়ে বলার চেষ্টা করছি। 

১। গল্পঃ গল্পের প্রশংসা করার আগে গল্পটা কী সেটা বলা দরকার। অর্ণব (পরমব্রত) একজন বিবাহযোগ্য ব্যাচেলর। বাবামা বিয়ে খুঁজছেন। মেয়ে দেখে ফেরার পথে অর্ণবের বাবার গাড়িতে এক বোরখা পরা মহিলা চাপা পড়ে মারা যান। মহিলার বাড়িতে গিয়ে শিকল বাঁধা রুকসানা (অনুষ্কা) নামের একটি মেয়ের খোঁজ পাওয়া যায়। তারপর তালেগোলে রুকসানা অর্ণবের জীবনে জড়িয়ে যায়। এদিকে একজন রহস্যজনক ডাক্তার কাশেম আলি (রজত কাপুর) রুকসানাকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। এর মধ্যে মধ্যে অতি ডিস্টার্বিং কিছু ফ্ল্যাশব্যাক দেখানো হয়। অলাতচক্র এবং ইফরিত জাতীয় রহস্যজনক কিছু শব্দ ঘুরে ফিরে আসে। সাতক্ষীরার কাছে বাচ্চাদের কাটামুণ্ডু খুঁজে পাওয়ার খবর আসে।

কীভাবে বলব না, স্পয়লার হয়ে যাবে, কিন্তু ভূতের গল্পের যে চেনা ছাঁদ আছে, চেনা অপরাধী, চেনা ভিকটিম, সেগুলোকে অন্য দৃষ্টি থেকে দেখেছেন লেখকরা (আমিল মল্লিক, অভিষেক ব্যানার্জী) এবং পরিচালক। কে খারাপ কে ভালো সেটা বোঝা সোজা নয়। 

২। এই বিষয়ে চরিত্রায়নের কথা বলতে হবে। সবক’টি চরিত্র, বিশেষ করে পরমব্রত, অনুষ্কা, এবং রজত কাপুর, তিনটি চরিত্র অসম্ভব ভালো করে লেখা হয়েছে। বাস্তবে লোক যেমন হয়, একটু ভালো একটু কালো, এই ছবির তিনটে মূল চরিত্রই সেই রকম, রক্তমাংসের। মাত্র দু’ঘণ্টার মধ্যে প্রতিটি চরিত্রের সিদ্ধান্ত, অ্যাকশনকে দর্শকের কাছে যুক্তিযুক্ত প্রমাণ করা অসম্ভব শক্ত কাজ, পরী সেটা পেরেছে। 

৩। তিন নম্বর ভালো লেগেছে গল্প বলা। বোঝাই যাচ্ছে, এ গল্পে ব্যাকস্টোরির ভূমিকা প্রচুর। বর্তমানে অর্ণব আর রুকসানার ঘটনা দেখানোর সঙ্গে সঙ্গে স্থান এবং কাল অনেকটা পিছিয়ে গিয়ে গল্প বুনতে হয়েছে। এই বোনাটা মসৃণ না হলে গল্প খাপছাড়া লাগে, গল্পের সুতো পাঠক/দর্শকের হাতছাড়া হয়ে যায়। যেটা পরীতে একবারও হয়নি।

৪। অভিনয়ঃ অনুষ্কার আমি ফ্যান হয়ে গেছি। কী ভালো যে লেগেছে আমার। সিনেমা হল থেকে বেরোনোর পরেও বিভিন্ন দৃশ্যে ওঁর মুখ মনে পড়ে যাচ্ছিল। পরমব্রতর এই মুহূর্ত থেকে আলোকপ্রাপ্ত, চালাক-কথা-বলা বাঙালির রোলে অভিনয় করা বন্ধ করা উচিত। এই রকম সুস্থস্বাভাবিক বাঙালির রোলে পর পর পাঁচবার অভিনয় করলেই আমি ওঁকে পছন্দ করতে শুরু করব, প্রমিস। রজত কাপুরকে আমি অলরেডি যথেষ্ট পছন্দ করি, এই সিনেমা দেখার পর সে পছন্দ গভীরতর হয়েছে। আর মর্গ কর্মী কানহাই সাহুর রোলে দিব্যেন্দু ভট্টাচার্যকে অনেকদিন মনে থাকবে।

৫। সিনেমাটা দেখতেশুনতেও খুব ভালো। ভয় পাওয়ানোয় শব্দের গুরুত্ব তো সবাই জানে, আমি অত বুঝি না, তবে সাউন্ডট্র্যাক শুনে বুক গুড়গুড় করছিল। তার থেকেও ভালো লেগেছে বর্ষা। গোটা সিনেমা জুড়ে অবিরাম বর্ষা। পিচের ওপর, পাতার ওপর, বৃষ্টি থামার পর ভেজা ছাদ, মেঘলা আকাশ এমন সুন্দর বহুদিন দেখিনি। সিনেমায় যদিও গা ছমছমে ভাব জাগানোর জন্যই বর্ষার ব্যবহার করা হয়েছে নিশ্চয়, কিন্তু দেখেশুনে আমার বাড়ির বৃষ্টির জন্য মন কেমন করছিল।

৬। সব শেষে থাকে ভয়ের কথা। আমার মতে আসল কথা। ভূতের সিনেমা কতটা ভয় পাওয়াতে পারল। আমার আবার এই নিয়ে একটা চিরকালীন গাজ্বলুনি আছে, সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়ে। ভৌতিক, গোয়েন্দা, থ্রিলার এ সব জনর সিনেমা বা সাহিত্যে একটা ব্যাপার থাকে, এই বইমেলার বাজারে নতুন করে চোখে পড়ল। আমার সিনেমাটা ভূতের বলে আন্ডারমাইন করবেন না, অরিজিন্যাল রিসার্চ করে বাংলার সমাজতাত্ত্বিক, অর্থনৈতিক রেফারেন্স কত দিয়েছি দেখুন একবার। থ্রিলার লিখেছি কিন্তু থ্রিলের থেকে অনেক বেশি জোর দিয়েছি নরনারীর সম্পর্কের ওপর। তাতে থ্রিল কিছু কম পড়েছে বটে, হু কেয়ারস। 

পরীও যেহেতু চেনা ভূতের গল্পের ছকের বাইরে গিয়ে গল্প বলা হয়েছে, সেই বিপদ ঘটার একটা চান্স ছিল, ঘটেনি। ভয় যথেষ্ট ছিল। ফার্স্ট হাফের অধিকাংশ হয় আমি চোখ বুজে নয় অনামিকা আর কড়ে আঙুলের আধইঞ্চি ফাঁক দিয়ে দেখেছি। আমি না হয় একটু বেশি ভয় পাই, সাহসীরাও ভয় পেয়েছেন, কানে এসেছে আমার। 

***** 

আমার আবার খারাপ লাগলে সবই খারাপ লাগার আর ভালো লাগলে সবই ভালো লাগার একটা ব্যাপার আছে। আমি আমার এই বদগুণের ব্যাপারে সচেতন, তাই পরী কেন লোকের খারাপ লেগেছে বা লাগতে পারে সে বিষয়েও সচেতন। 

অর্চিষ্মান যেমন বেরিয়ে মাথা নেড়ে বলল, শেষের পনেরো মিনিট যদি না বানাত। রিভিউয়াররাও সেই কথাই বলেছেন। বলেছেন, শেষটা একেবারে সিলি, ননসেন্স ইত্যাদি ইত্যাদি। ভূতের গল্প শেষ করা কঠিন ব্যাপার, কারণ ভূতের গল্পের প্রধান আকর্ষণ যে ভয় পাওয়া বা গা ছমছম করাটা, সেটার ব্যাখ্যা দিতে গেলে যে আনন্দ মাটি হবেই। তাছাড়া ভূতের সিনেমা দেখে ভয় যারা পায় তারা বেশিরভাগই বিশ্বাস করে ভূত বলে আদৌ কিছু নেই। যতক্ষণ সিনেমা/গল্প চলে, ভয় লাগে ততক্ষণ সে বিজ্ঞানমনস্কতাকে ভুলে থাকা যায়, যেই গল্প শেষ হয়ে ভূতের উপস্থিতির পক্ষে যুক্তি দেওয়া হয় অমনি সবাই বলে, যত্ত গাঁজাখুরি। পরীতেও গল্প ঘুরিয়ে এনে বৃত্ত সম্পূর্ণ করতে গিয়ে বা চরিত্রদের ক্লোজার দিতে গিয়ে সে গাঁজাখুরির আশ্রয় নিতে হয়েছে। অর্চিষ্মান দাবি করছে ক্লোজার দেওয়ার কোনও দরকার ছিল না। আমি অতটাও নিশ্চিত নই, গল্প/সিনেমা ওপেন এন্ডেড রাখাটা থিওরিতে শুনতে যত ভালো লাগে, বাস্তবে পাঠক/দর্শকের আরাম তাতে কম পড়ে বলেই আমার বিশ্বাস। তবে এটা আমার জোর করে পরীর খামতি অগ্রাহ্য করার কুযুক্তি হতে পারে। পরিচালক প্রথমদিকে দর্শককে বুঝিয়ে দেওয়ার প্রলোভন যেমন সফলভাবে এড়িয়ে গেছেন, শেষে গিয়ে সেই সংযমে সামান্য চিড় ধরেছে, আমিও মানছি।

আপনারা কেউ পরী দেখলেন? কেমন লাগল?


Comments

  1. আমি গাট নয়, গাঁটে বিশ্বাসী। রামগোপাল ভার্মা'র "রাত", এবং কিছুটা "ভূত"-এর পর থেকে দেখা(র চেষ্টা করা) প্রতিটি তথাকথিত ভয়ের বা ভূতের হিন্দি সিনেমা আমার হাস্যকর লেগেছে বলে ভেবেছিলাম, এটা একটা গাঁট হয়ে গেছে। কিন্তু আপনার লেখা পড়ে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি "পরী" দেখব, এবং বড়ো পর্দাতেই দেখব। দেখে কেমন লাগল, তাও জানাব।

    ReplyDelete
    Replies
    1. দেখে আসুন, ঋজু। কেমন লাগল জানাবেন। খুব খারাপ লাগলে আমার ওপর রাগ করবেন না, এইটাই অনুরোধ।

      Delete
    2. https://m.dailyhunt.in/news/india/bangla/banglalive-epaper-banliv/pari+bideshi+chabir+plat+ebhabe+jhede+phonk+kara+yay+bujhi-newsid-83003722

      পড়বেন আশা করি

      Delete
    3. নিশ্চয় পড়ব। লিংক পাঠানোর জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

      Delete
  2. ami jacchi dekhte for sure. emnite anushka ar parambrata ke dekhle amar mukh automatically beke jaye but review ato bhalo likhecho je dekhte hocche.

    ReplyDelete
    Replies
    1. দেখে কেমন লাগলো জানিয়ো কুহেলি। আর তোমাকেও বলছি, খারাপ লাগলে রাগ কোরো না।

      Delete
  3. Nago Kuntala di bhuter cinema review bhalo holeo dekhi na.. sarakhon oi bhoy peye bhalo lagena.. jotoi bhalo acting hok.. :(

    ReplyDelete
    Replies
    1. এ ব্যাপারে তাহলে তুই আমার মায়ের মতো, ঊর্মি। মা অন প্রিন্সিপল ভয়ের সিনেমা দেখে না।

      Delete
  4. Aami Pari dekhini..kintu kayekdin holo ekta cinema dekhe Parombroto r fan hoye gechi.Apur PaNchali dekhechen ki?Cinema ta ki je bhalo legeche bole bojhate parbona.Anek din dhore aneke bola sottweo dekhini oi Parombrato r proti birokti r karone..Kintu dekhe sotyi e mone hochhce eto din na dekhe bhul e korechi ebong Parombrata sambondheo nijer dharona paltate badhyo hochchi.

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওহ, এই সিনেমাটার কথা শুনেছি, কথাকলি, দেখা হয়নি। দেখবো নিশ্চিয় এবার, থ্যাংক ইউ।

      Delete
  5. ওরে বাবা,রিভিউ পড়েই আমার যথেষ্ট ভয় লেগেছে। আমি খুবই ভুতের ভয় পাই। তাই আরও ভয় পেতে এই সিনেমাটা (বা অন্য ভুতের সিনেমা)দেখতে যেতে চাই না।

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, নো প্রবলেম, ময়ূরী।

      Delete
  6. আমি সাধারণতঃ ভূতের সিনেমা দেখিনা। কেন জানিনা সিনেমাটা দেখার সময় বড্ড ভয় করে কিন্তু সিনেমা শেষ হলেই ভয়টা বেমালুম উবে যায়। গল্পের বইতে যেহেতু নিজেই বৰ্ণানর সাথে খানিকটা কল্পনা করে সাপ্লাই দি ভয়টা সেজন্য অনেক বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয়। বললে হাসবে, অন্ধকার রাতে এখনো ক্লাস ফাইভে পড়া কাউন্ট ড্রাকুলার কথা মনে পড়লে গা ছমছম করে। তবে তুমি বলছো যখন পরী দেখবো। তোমার রিভিউতে বই পড়ে যখন ঠকিনি, এটাও মনে হয় ভালোই লাগবে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ, শেষের পনেরো মিনিট যদি খারাপ লাগেও, বাকিটুকু মনে হয় খারাপ লাগবে না, চুপকথা। গল্পের বইয়ের ভয় দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার ফ্যাক্ট এবং তার পেছনের কারণটা একদম ঠিক বলেছ।

      Delete
  7. নাহ দেখিনি , ধুস মার্চ ফেব্রিয়ারির মাঝ থেকেই সময়টা তালুর মধ্যে দেখাও যাচ্ছেনা।
    রিভিউটা চমৎকার।

    ReplyDelete
    Replies
    1. চেষ্টা কোর, যদি দেখার সুযোগ পাও, প্রদীপ্ত।

      Delete

Post a Comment