পুরোনো অবান্তরঃ মাধ্যমিক! মাধ্যমিক!
ইংরিজি হরফে লেখা
পুরোনো পোস্টগুলো সারাই করতে গিয়ে
যে ব্যাপারটা বিশেষ করে চোখে পড়ছে সেটা হচ্ছে পোস্টগুলোর দৈর্ঘ্য। এখনকার পোস্টগুলো
হেসেখেলে বারোশো তেরোশো শব্দের হয়।
দু’হাজার নয় দশ এগারোর পোস্টগুলো হত মেরেকেটে পাঁচশো কি ছ’শো।
এর দুটো কারণ থাকতে পারে। এক, আমার ‘রাইটিং মাসল’ শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। আগে
পাঁচশো শব্দ লিখে দম বেরোত, এখন বারোশো শব্দ পেরিয়ে বেরোয়। দু’নম্বর কারণটা এক
নম্বরের কারণের মতো ভালো নয় আর সেই জন্যই আমার সন্দেহ হচ্ছে সেটাই সত্যি। আমার চরিত্র/ভাবনা থেকে
ব্রেভিটি লোপ পাচ্ছে। দু’হাজার দশ সালের সাতই জানুয়ারি এই গল্পটা বলতে আমার খরচ হয়েছিল
পাঁচশো বিরাশি শব্দ, আর আজ লাগল একহাজার দশ (তাও এই গৌরচন্দ্রিকা বাদ দিয়ে)। বয়স বাড়লে কি লোকে
সত্যিই বেশি কথা বলে?
*****
‘চার্মিং’ বলতে যে
ঠিক কী বোঝায় সেটা আমি অনেকদিন বসে বসে ভেবেছি। ভেবে বার করার চেষ্টা করেছি। কী
থাকলে একটা মানুষ ‘চার্মিং’ হয়? সুন্দর চোখ? সুন্দর হাসি? সুন্দর ব্যবহার? কিন্তু
এর একটাও নেই এমন অনেক লোকের চার্মের শিকার হতে দেখেছি আমি চারপাশের লোকদের। কাউকে
দেখলেই তার সঙ্গে গিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করে কেন? কেন তার বন্ধু হতে ইচ্ছে করে?
সুজাতা যখন ক্লাস
সিক্সে আমাদের স্কুলে ভর্তি হল তখন ওকে দেখে আমাদের ক্লাসশুদ্ধু মেয়ের সেই ইচ্ছে
হল। ব্যাপারটা খুব সোজা ছিল না। যে ক’টা বদগুণের প্রকাশ মানুষের মধ্যে খুব কচি
বয়সেই ঘটে তার একটা প্রধান হচ্ছে দলবাজি। আমরা ওই স্কুলে পড়ছি ক্লাস ওয়ান, কেউ কেউ
নার্সারি থেকে। বেশ একটা দলবদ্ধতার
ভাব জেগেছে মনে। সিক্সে যারা ভর্তি হত, ‘নতুন মেয়ে’ ছাপ ঘোচাতে তাদের যারপরনাই
কাঠখড় পোড়াতে হত। অনেক সময় ঘুচতও না। ক্লাস টেনের দিদির পায়ের কাছে বসে ক্লাস
সিক্সের ‘ফ্যান’কে আমি গুণমুগ্ধ চোখে তাকিয়ে বলতে শুনেছি, ‘তুমি নতুন মেয়ে দিদি!
বোঝাই যায় না কিন্তু।’
সুজাতা আমাদের
ক্লাসে ভর্তি হওয়ার সাত দিন যেতে না যেতেই আর বোঝার কোনও উপায় ছিল না যে ও নতুন
মেয়ে। যেমন চোখ, তেমন হাসি, তেমন ব্যবহার। পড়াশোনা, দৌড়ঝাঁপ, রবীন্দ্রসংগীত –
সবেতে ভালো। টিফিন পিরিয়ড হলেই সুজাতাকে নিজেদের গোলে বসানোর জন্য, নিজেদের টিমে
খেলানোর জন্য টানাটানি শুরু হত। আমি হাঁ করে তাকিয়ে ভাবতাম, কী থাকলে লোকে এত জনপ্রিয়
হয়? এত চার্ম আসে কোত্থেকে লোকের?
উত্তর পেতে দেরি হল
না। একদিন স্কুলবাস না আসায় সুজাতা মায়ের সঙ্গে স্কুলে এল। ছোট্টখাট্টো কাকিমা,
মেয়ের জলের বোতল কাঁধে ঝুলিয়ে হেঁটে হেঁটে সবুজ মাঠ পেরিয়ে এলেন, মেয়ের শয়েশয়ে
সহপাঠী, জুনিয়র, সিনিয়র অনুরাগীরা কাকিমাকে ছেঁকে ধরল, কাকিমা হেসে তাদের সবার
সঙ্গে আলাপ করলেন।
আর সেই ভিড়ের মধ্যে
দাঁড়িয়ে আমি বুঝে গেলাম চার্ম কোত্থেকে আসে। বংশপরম্পরায়।
অদ্ভুত ভাবে,
সুজাতার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব গভীর হল স্কুল ছাড়ার পর। ছোটবেলার স্কুলে ক্লাস টেন
পর্যন্ত গিয়ে ফুরিয়ে গেল, আমরা দুজনেই ইলেভেন টুয়েলভে একটা নতুন স্কুলে গিয়ে ভর্তি
হলাম। সে স্কুলে আমরা সবাই নতুন মেয়ে, তাই পুরোনো স্কুল থেকে আসা বন্ধুরা গা
ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকতাম। তার ওপর ইংরিজি টিউশন নেব বলে দুজনে ভর্তি হলাম। সাইকেল
করে স্যারের বাড়ি থেকে সুজাতার বাড়ি যেতে লাগত ঠিক সাড়ে চার মিনিট। কোচিং-এ ভর্তি
হওয়ার পর সুজাতার বাড়ি যাওয়া আর কাকিমার আদর খাওয়ার পরিমাণ দুটোই আমার বলার মতো
বৃদ্ধি পেল।
ইংরিজি পড়তে পড়তে,
স্যারের বকুনি খেতে খেতে, খাতায় মুখ চেপে অবিরাম হাহাহিহি করতে করতে সুজাতার সঙ্গে
আমার বন্ধুত্ব গভীর থেকে গভীরতর হতে লাগল। বন্ধুত্বের সঙ্গে ফাউ হিসেবে পেলাম
কাকিমার স্নেহ। কাকিমা ঠিক মায়ের মতোই ছিলেন। দারুণ রান্না করতেন, ‘আর খেলে পেট
ফেটে যাবে কাকিমা’ বলার পর আরও চারটে লুচি ফেলে দিতেন প্লেটের ওপর, ফেব্রুয়ারির
ভোরে সুজাতাকে ডেকে নিয়ে স্যারের বাড়ি যাওয়ার সময় আমার মায়ের চাপিয়ে দেওয়া মাফলার
আর একবার ভালো করে মুখের চারপাশে জড়িয়ে দিতেন। স্কুলের ছুটি চলাকালীন যখন কোচিং
শেষে নিজের বাড়ি ফেরার আগে সুজাতার বাড়িতে স্টপেজ দিতাম তখন আমাদের সাইকেলের পথ
চেয়ে হাসিমুখে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতেন।
কাকিমাকে ভালোলাগার
কারণের আমার অভাব ছিল না। কিন্তু কাকিমাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছিলাম এই গল্পটা শোনার
পর।
আমাদের মাধ্যমিকের
সিট পড়েছিল হিন্দমোটরের একটা স্কুলে। আমি রিষড়া থেকে ট্রেনে উঠতাম, সুজাতা উঠত তার
পরের স্টেশন কোন্নগর থেকে, তারপরেই চলে আসত হিন্দমোটর। আমরা সাধারণত একই ট্রেনে
চেপে পরীক্ষা দিতে যেতাম। সেই ট্রেনে গেলে পরীক্ষার হলে পৌঁছে, সিট বেছে, পরীক্ষার
প্রিপারেশন নিয়ে উত্তেজিত আলোচনা করে, একে অপরকে টেনশন দিয়ে ও নিয়েও হাতে যথেষ্ট
সময় থাকত। কাজেই সেই ট্রেনটাতে চেপেই আমরা পরীক্ষা দিতে যেতাম। আমরা, অন্যান্য যে
সব স্কুলের ছেলেমেয়েদের ওই তল্লাটে সিট পড়েছে তারা। সবাই।
মা হিসেবে কাকিমা ছিলেন
ফার্স্টক্লাস। মেয়ের ব্যাপারে কাকিমা কোনও ফাঁকিবাজি, কোনও আপোস কোনওদিন করেননি। মেয়ে
জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা দিচ্ছে, কাকিমাও কি দিচ্ছেন না? সেদিন সকালে উঠে কাকিমা
অন্য পরীক্ষার দিনগুলোর মতোই নিজে তৈরি হলেন, মেয়েকে তৈরি করলেন, পেনপেনসিল
অ্যাডমিট কার্ড ইত্যাদি ব্যাগে গুছিয়ে নিলেন। তারপর ঠাকুর প্রণাম করে স্টেশনের
দিকে হাঁটা দিলেন।
গোটা ঘটনাটা অন্য
দিনের থেকে একটু আগেই হয়ে গেল। বিফোর টাইম। কাকিমা খুশি হলেন। কিন্তু একটা সমস্যাও
দেখা দিল। স্টেশনে পৌঁছে কাকিমা দেখলেন প্ল্যাটফর্মে একটা ট্রেন দাঁড়িয়ে রয়েছে। যে
ট্রেনটায় তাঁদের যাওয়ার কথা তার আগের ট্রেনটা।
রিকশাকে ভাড়া দিতে
দিতে কাকিমার মাথা দ্রুত চলতে লাগল। দৌড়বেন? হাতে যথেষ্ট সময় আছে। পরের ট্রেনটাতে
ধীরেসুস্থে গেলেও হয়। অবশ্য যদি পরের ট্রেন আসে। কী হবে যদি এই ট্রেনটা ছেড়ে চলার
পরই ওভারহেড তারের বিদ্যুৎসংযোগ ছিন্ন হয়? ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়? লরি উল্টে
গিয়ে জি. টি. রোড জ্যাম হয়ে যায়?
‘পিউ! ট্রেন!’ আর্তনাদ
করে কাকিমা ছুটতে শুরু করলেন।
সুজাতা ছুটতে শুরু
করল। ছোটার ইচ্ছে না থাকলেও। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো ট্রেন ভোঁ দিল।
এইবার কাকিমা সত্যি
সত্যি ভয় পেয়ে গেলেন। ভয় পাওয়ার কারণও ছিল। কাকিমারা ছুটে আসছিলেন ট্রেনের ল্যাজের
প্রান্ত থেকে। অর্থাৎ ড্রাইভারকাকু তাঁদের দেখতে পাচ্ছেন না। হাওড়া স্টেশনের মেন
লাইনের ড্রাইভারকাকুরা অত্যন্ত ভদ্রলোক হন। কেউ ছুটে আসছে দেখলে, বিশেষ করে শিশু
মহিলা বৃদ্ধ ছুটে আসছে দেখলে তাঁরা দাঁড়িয়ে থাকেন। আমার সঙ্গে বহুবার ঘটেছে এ
ঘটনা। একবার উত্তরপাড়া প্ল্যাটফর্মে ছুটন্ত আমার ব্যাগের মুখ খুলে পেনসিলবক্স
ছিটকে পড়ে পেনপেনসিল ইরেজার পেনসিল কাটার কল সব ছত্রাকার হয়েছিল। আমি ছুটে ছুটে সব
এদিকওদিক থেকে কুড়িয়ে আনছিলাম আর ড্রাইভার কাকু জালি দেওয়া কাঁচের জানালার ভেতর
হাত দেখিয়ে আশ্বাস দিচ্ছিলেন যে তিনি আমাকে ফেলে যাবেন না। যানওনি।
কাকিমা স্পিড
বাড়ালেন। ভোঁ থামিয়ে ট্রেন ঝাঁকুনি দিল। কাকিমার গলা থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল, ‘বেঁধে
বেঁধে! রোককে!’
চিলতে কামরার দরজায়
ঝুলন্ত গার্ডকাকু ফিরে তাকালেন। কাকিমার প্রাণে বল এল। ‘বেঁধে বেঁধে! রোককে!’
গার্ডকাকু হাতের
ইশারায় বোঝালেন এক্ষুনি আর একটা ট্রেন আছে, তাঁরা যেন সেটায় আসেন। সুজাতা ছুটতে ছুটতে
হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘মা পরেরটায় গেলেই তো হয়।’
ট্রেন গড়াতে শুরু
করল।
কাকিমার স্পিড কমল
না। হাত ছিটকে আকাশের দিকে উঠে গেল। শরীরে যত জোর ছিল সবটুকু গলায় ঢেলে দিয়ে
কাকিমা চিৎকার করে উঠলেন, ‘মাধ্যমিক! মাধ্যমিক!’
একটা শব্দ। অথচ তার
মধ্যে পোরা কত কিছু। বাঙালির হৃতগৌরব উদ্ধারের আশা, ভবিষ্যতের সোনালি স্বপ্ন। আকাশ
থেকে যেন বজ্রনির্ঘোষ নেমে এল। সে নির্ঘোষ উপেক্ষা করেন এমন সাধ্য কি গার্ডকাকুর?
ঘ্যাঁচ করে ট্রেন থেমে গেল। লোকজন সব কামরা থেকে নেমে এসে এদিকওদিক তাকিয়ে বিস্ময়
প্রকাশ করতে লাগল, সিগন্যালটিগন্যাল তো সব ঠিকই আছে, তবে? কাকিমা বুলেটের মতো ছুটে
এসে লাস্ট কামরায় উঠে পড়লেন। ধরণী দ্বিধা হও জপতে জপতে সুজাতাও মায়ের পেছন পেছন
ছুটে এসে ট্রেনে উঠে পড়ল। গার্ডকাকুর সিগন্যাল ক্লিয়ার হয়ে গেল, ট্রেন চলতে শুরু
করল।
কাকিমার সঙ্গে বহু,
বহুদিন দেখা হয় না। সুজাতার সঙ্গেও না। সুজাতা কেমন আছে আমি জানি না। তবে আমার এক
চিৎকারে ট্রেন থামিয়ে দেওয়া সাহসী কাকিমা যে ভালোই থাকবেন সে নিয়ে আমার কোনও
সন্দেহ নেই।
মাইরি বলছি, অন্য কেউ এই গল্পটা শোনালে শিওর বলতাম ঢপ দিচ্ছে, নেহাত বেশ খানিকটা নুনমরিচ মিশিয়েছে।
ReplyDeleteকিন্তু অবান্তরের গল্প কিনা, ফাঁকির অংশটা কমই হবে। খুব উৎকৃষ্ট, উপাদেয় হয়েছে গল্পটা। আজ সিআর পার্কে আনন্দমেলা, কোন প্যান্ডেলে যাবেন?
এই আমি মা সরস্বতীর পায়ে হাত রেখে বলছি, দেবাশিস, নিখাদ সত্যি ঘটনা এটা। আপনার ভালো লেগেছে জেনে খুব খুশি হলাম। আমরা ডি ব্লকের মেলায় গিয়েছিলাম। কিন্তু স্যাডলি পেট ভর্তি ছিল, কিচ্ছু খেতে পারিনি। তবে গিয়ে চেনা লোকদের দেখলাম পাটিসাপটা খাচ্ছে। শুনলাম তার আগে মাছের চপ খাওয়া হয়েছে, এর পর আর কী হতে পারে সেই ভাবনা ভাবা চলছে। আপনি পকেট ফর্টিতে কবে আসছেন?
Deleteহা হা হা .... দারুন গল্প.. ঠিক বলেছ .. আমাদের মেন লাইন এর ড্রাইভার আর গার্ড কাকু রা খুব ভালো.. আমার মা বহুদিন হাত দেখিয়ে ট্রেন কে লেট করিয়েছে.... অনেক ড্রাইভার কাকু না বলতেও দাঁড়িয়ে থাকেন। . অনেক লোকজন কে একটু দাঁড়ান দাদা বলতে শুনেছি... তবে ‘মাধ্যমিক! মাধ্যমিক!’ টা অসাধারণ ... :)
ReplyDeleteতবেই বল ঊর্মি? মেন লাইনের জবাব নেই। তোমার গল্পটা ভালো লেগেছে জেনে খুশি হলাম। থ্যাংক ইউ।
DeleteDurdanto.. osadharon.. onobodyo.. apurbo.. khuuuuuub bhalo laglo
ReplyDeleteIniya
থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ, ইনিয়া।
DeleteHaha khub major - tinni
ReplyDeleteএটা আমার জীবনে শোনা অন্যতম শ্রেষ্ঠ মজার সত্যি ঘটনা, তিন্নি।
DeleteAsole chokher samner train chere dewa khub i shokto. Swayong goutom buddho o parten na bole amar biswas.
ReplyDeleteমানুষের মনের এই জটিল দিকটা আপনি একদম ঠিক ঠিক ধরেছেন, ঘনাদা। চোখের সামনে ট্রেন ছেড়ে দেওয়া আর সেমিনারের ফ্রি লাঞ্চ না খাওয়া - দুটোই অসম্ভব।
DeleteSujata aaj sobcheye shukhe ache...kina janina...lakhpoti swami kina janina...eta jaani aami je sundor college taay kichu bochor poriyechi sekhane sujata khub jonopriyo didimoni. Kakima r kotha mone porlo. Sujata ekhon barrackpore rashtraguru surendranath college e assistant professor . hasimukhi ekhono omni hasimukhi I ache.
ReplyDeleteসুজাতার হাসি কোনওদিন মেলাবার নয়, সাহানা।
Delete