সাপ্তাহিকী



The hierarchy of disagreement  


The scholar's greatest weakness: calling procrastination research.
                                              --- Stephen King

১। সেদিন গুগল ম্যাপস হাতে বাগিয়ে ধরে শাহপুরজাটের গলিতে ঘুরতে ঘুরতেই কথাটা মাথায় এসেছিল।  ম্যাপ দেখে যথাস্থানে পৌঁছে (শেষমুহূর্তে পানের দোকানে জিজ্ঞাসা করতে হয়েছিল, তবে ওটা আমাদের বুরবকি। দোকান খোঁজার জন্য আমার আগেপিছে ডায়েবাঁয়ে, পুবপশ্চিম উত্তরদক্ষিণ ঈশানঅগ্নি নৈঋতবায়ু সব দিকে ঘাড় ঘুরিয়েছিলাম, বাদ রেখেছিলাম খালি ঊর্ধ্ব আর অধঃ। ঊর্ধ্বপানে তাকালেই মাথার ওপর ঝুলন্ত জং ধরা বোর্ডে চোখে পড়ত, অধোপানে চাইলেই পায়ের শাহপুরজাট ভিলেজের জমা জলের পুকুরে আমরা সে বোর্ডের ছায়া দেখতে পেতাম)। যাই হোক, পানওয়ালা ভাইসাবের দেখানো সিঁড়ি বেয়ে আমরা যখন দোকানে উঠে এলাম আর ঠাসাঠাসি দোকানে একখানা বিতিকিচ্ছিরি টেবিল আমাদের কপালে জুটল, তখন চেয়ারে তশরিফ রেখেই প্রথম যে কথাটা আমি বলেছিলাম সেটা হচ্ছে, “গুগল ম্যাপ কিন্তু রাস্তা চেনানোর জন্য ভালো, তাই না?” আর বলেই আমার মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেল।

মনখারাপ হল বাবার কথা ভেবে। আমার বাবা যে কোনও শহরে সকালবেলা ঢুকে বিকেলবেলা বেড়াতে বেরিয়ে অটো/ট্যাক্সিওয়ালাকে বলতে পারেন, “ভাইসাব, স্টেটব্যাংক এ টি এম কা বগলকা রাস্তা লিজিয়ে। জলদি হোগা।” এবং অনেক ক্ষেত্রেই বাবার এই ব্যাপারটা করার পেছনে একটা শার্লক হোমসোচিত উদ্দেশ্য থাকে। শার্লক হোমস যেমন ওয়াটসনকে চমকে দেওয়ার জন্য ওয়াটসনের চিন্তাসূত্র ধরে দিয়ে ওয়াটসনকে চমকে দিতেন, বাবাও তেমনি আমাদের চমকে দিতে চান। আবার অবাক হয়ে ওয়াটসন শার্লক হোমসকে যখন এই চমৎকার ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করতে বলেন তখন হোমস যেমন চোখ ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেন যে এই ডিডাকশনের গোটা রাস্তাটা ওয়াটসনের চোখের সামনেই ছিল সর্বক্ষণ, তেমনি আমার বাবাও (চোখ না ঘুরিয়ে) বলেন, “আরে এই রাস্তাটা দিয়েই তো সকালবেলা গেলাম, মনে নেই?”

আমার মনখারাপ হল এই ভেবে যে আমার বাবার এই চমকে দেওয়ার নিরীহ খেলাটা আর কিছুদিনের মধ্যে লুপ্ত হয়ে যাবে। কেউ আর বাবার রাস্তা চেনার ক্ষমতা দেখে চমকাবে না, হয়তো নিজেদের মধ্যে বলবে, “লোকে কিছু আবোলতাবোল জিনিস মনে রেখে মস্তিষ্কের র‍্যাম খরচ করতেও পারে, বস্‌স্‌”। আমার বাবা সিধুজ্যাঠার মতো অবান্তর হয়ে যাবেন।

তেমনি লন্ডনের ট্যাক্সিওয়ালারাও কি হারিয়ে যেতে বসেছেন? বাড়িঘর, দোকানপাট, ব্যাংকপোস্টঅফিস শুদ্ধু লন্ডনের পঁচিশহাজার রাস্তা অলিগলি নখাগ্রে রাখা ক্যাবিরা?    

২। একটা স্বীকারোক্তি। এই লিংকটা আমি নিজে পড়িনি। কারণ এই রোদঝলমল রবিবারের সকাল (এবং আগামীকালের প্রজাতন্ত্রের ছুটি) মাটি করার আমার কোনও ইচ্ছে নেই। তবে আপনার যদি কলজের জোর থাকে, বিষণ্ণতা যদি আপনাকে কাবু না করতে পারে তাহলে আপনি পড়তে পারেন।

৩। ক’টা বাজে? ঘড়ি দেখতে না জানলেও উত্তরটা এবার থেকে দেওয়া যাবে। 

৪। লিখতে লিখতে থেমে ইউটিউব দেখেন? উইকিপিডিয়া পড়েন? নিজের আইকিউ কাল সন্ধ্যের থেকে কতটা বাড়ল জানতে কুইজ খেলেন? তাহলে আপনার চাই-ই চাই হেমিংরাইট। 


৬। দিল্লিতে বার্গার কিং খুলেছে। লাইন পড়ছে এ পাড়া ছাড়িয়ে ও পাড়া পর্যন্ত। কৌতূহল দমন না করতে পেরে সেদিন অফিসের পর গিয়েছিলাম। দশ টাকার ঝালমুড়ির বদলে পাঁচশো টাকার চিকেন হুপার, চিকেন তন্দুরি গ্রিল। মিলের অংশ হিসেবে কোল্ড ড্রিংকস আর আলুভাজা। আলুভাজার চেহারা দেখে প্রথমে বেশ উৎসাহ জেগেছিল। সোনালি সোনালি, মোটা মোটা। মুখে দিয়েও ভালো লাগাটা বজায় ছিল, কিন্তু আলুবাজার বাক্স যত খালি হতে থাকল তত অন্য একটা আলুভাজার কথা আমার আর অর্চিষ্মান, দুজনের মনেই উঁকি দিতে লাগল। ম্যাকডোনাল্ডসের। এ দোকানের মতো ষণ্ডা নয়, কিন্তু এর থেকে ভালো খেতে। সত্যি বলতে কি, ম্যাকডির থেকে ভালো ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আমি খুব কম খেয়েছি। এই ভিডিওটা দেখলে সে আলুভাজার রহস্য খানিকটা উদ্ধার হতে পারে।

৭। অফিস করেন? সঙ্গে সঙ্গে প্যারাগ্লাইডিং শিখতে চান? প্যারাগ্লাইডিং করেন? পাশাপাশি একটা উপন্যাস লিখতে চান? উপন্যাস লেখেন? সাইডে সিনেমায় নামতে চান? চিন্তার কোনও কারণ নেই। রিচার্ড ব্র্যানসন উপায় বাতলে দিচ্ছেন। 

৮। কলেজের সময় এক স্যারের কাছে পড়তে যেতাম। গ্রীষ্মের দুপুরে তিনি ছেলেদের ফ্যানের তলা থেকে তুলে দিয়ে বলতেন, “মেয়েরা নরম, মেয়েরা লাবণ্যময়ী, মেয়েদের গরমে বেশি কষ্ট হয়।” এই বলে ছেলেদের ফ্যানের তলা থেকে তুলে দিয়ে আমাদের বসতে দিতেন। ছোটবেলায় এক আত্মীয়র বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম। সে বাড়ির কলেজে পড়া ছেলে যেচে সবার জন্য চা বানাতে উঠলে, প্রশংসায় সারা বাড়ি কলরব করে উঠেছিল। বলেছিল, এই ছেলেকে যে মেয়ে বিয়ে করবে, তার মতো ভাগ্যবতী আর দুনিয়ায় দুটো হবে না। তখন বুঝিনি এগুলো কী। এগুলো হচ্ছে Benevolent sexism.

৯। পৃথিবীতে কত রকমের প্রতিযোগিতা হয় সত্যি ভাবা যায় না।  এই হচ্ছে সে রকম একটা প্রতিযোগিতার ছবি।

১০। রুল অফ থাম্ব কথাটা জানতাম, কথাটার ব্যবহার জানতাম, কিন্তু কথাটা কোথা থেকে এসেছে সেটা জানতাম না।

১১। পঁয়তাল্লিশ মিনিট। ছত্রিশটি প্রশ্ন। প্রশ্নের শেষে মৌনমুখর চারটি মিনিট। ব্যস। প্রেম হতে এর থেকে বেশি কিছু লাগে না। স অবশ্য মানবে না। স ছিল মার্স্টার্স করাকালীন আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। স বলত প্রেম করা যায় না, প্রেম হয়ে যায়। করতেই যদি হল তাহলে আর প্রেমের সঙ্গে ক্যালকুলাসের তফাৎ রইল কী সে? আমি আবার চিরকালের “চেষ্টায় কি না হয়” নীতিতে বিশ্বাসী। চেষ্টায় প্রেম হয় না এটা আমি তখনও বিশ্বাস করতে পারতাম না, এখনও পারি না। কিন্তু আমি সবসময়েই তর্কে হারতাম (কারণ বহু চেষ্টাতেও তর্কটা আমার হয়নি)। হারতাম না, যদি আমার সাধারণ জ্ঞানের দৌড়টা আর একটু বেশি হত। যদি আমি নিউ ইয়র্কের স্টোনি ব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শ্রী আর্থার অ্যারনের নাম জানতাম।

উনিশশো সাতানব্বই সালে, Personality and Social Psychology Bulletin-এ The Experimental Generation of Interpersonal Closeness নামে ডঃ আর্থার অ্যারনের একটি পেপার বেরিয়েছিল। সেই পেপারেই ছিল ওই ছত্রিশটি প্রশ্নসম্বলিত একটি প্রশ্নপত্র। তিনি দাবি করলেন, সেই প্রশ্নপত্রটি নিজেদের মধ্যে আলোচনা করলে যে কোনও দুজন মানুষ একে অপরের প্রেমে পড়তে বাধ্য।
A heterosexual man and woman enter the lab through separate doors. They sit face to face and answer a series of increasingly personal questions. Then they stare silently into each other’s eyes for four minutes. The most tantalizing detail: Six months later, two participants were married. They invited the entire lab to the ceremony.
আমার অবশ্য দাবির সত্যমিথ্যে যাচাইয়ের উপায় নেই। অর্চিষ্মানের সঙ্গে খেলাটা খেললে চিটিং করা হবে, আর অর্চিষ্মান ছাড়া কারও সঙ্গে খেলতে বসাটা, ওয়েল, রিস্কি। সত্যি বলতে কি আমার প্রেমে পড়াপড়ি নিয়ে অত বেশি উৎসাহ নেই। দুটো লোক কী করলে একে অপরের প্রেম থেকে বেরিয়ে যেতে পারে সেই খেলাটা নিয়েও না। অন্তত এখন তো না-ই। বছর সাতেক আগে এই খেলাটার সন্ধান পেলে কী যে উপকার হত।

১২। সব শেষে প্রেমে পড়াপড়ি নিয়ে একটা গান হয়ে যাক।


Comments

  1. Benevolent sexism ar London cabby: duto podei bejai bhalo laglo ar besh kichhuta chintar khorak-o paoa gyalo. Kaal shokal bela uthhe kaaj kora bishesh proyojon, kintu shobkichhu fele shaptahiki podar lobh shamlano gyalo na!!!

    Onek dhonyobad
    iti
    Shuteertho

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনাকে ধন্যবাদ, সুতীর্থ। সাপ্তাহিকীকে আপনি পছন্দ করেন দেখে আমার সত্যি মন ভালো হয়ে যায়।

      Delete
  2. uribbas. premey porar proshno-potro.

    ReplyDelete
    Replies
    1. সিরিয়াসলি তন্ময়, প্রেমটাকেও এরা ছাড়েনি, পরীক্ষায় পরিণত করেছে।

      Delete
  3. ei compilation ta darun, especially benevolent sexism. -Bratati.

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমারও ওটা ভালো লেগেছে, ব্রততী।

      Delete

Post a Comment