কারি গাছের পাতা
“আমার রেডিওয় আমার যা ইসসা,
তাই শুনুম। লারেলাপ্পা গান শোননের ইসসা হইলে নিজের রেডিও কিইন্যা শোন গে যাও।”
রেডিওয় যে খবর আর কীর্তন
ছাড়াও অন্যান্য অনুষ্ঠান হয় এবং সেগুলোও যে স্বাদবদলের জন্য মাঝেমধ্যে শোনা যেতে
পারে এই পরামর্শের উত্তরে ঠাকুরদার ওই প্রত্যুত্তর।
আমি নিজের কানে শুনিনি
অবশ্য। কারণ আমার তখন শোনার মতো কান ছিল না। কান কেন, আমিই তখন ছিলাম না। আমি
ছিলাম না, কম্পিউটার ছিল না, ভি এস এন এল ব্রডব্যান্ড ছিল না, এমনকি দরজা টানা
সাদাকালো অস্কার টিভিটাও তখন আমাদের বাড়িতে ছিল না। তখন আমাদের বাড়িতে বিনোদনের একমাত্র
উৎস ছিল ঠাকুরদার এইচ এম ভি রেডিও। ঢাউস এবং গম্ভীর।
প্রত্যুত্তরটা শোনার পর একদিন
সেজকাকু গটমটিয়ে গিয়ে বাজার থেকে একটা লাল রঙের ছোট রেডিও কিনে আনলেন। বাবাকে
বললেন, “তুই-ই বা বসে আছিস কেন, কিনে ফেল একখানা রেডিও। এই বাড়িতে . . .”
আমার ঠাকুরদার সঙ্গে
সেজকাকুর সর্বক্ষণ খটরমটর লেগে থাকত, কিন্তু এঁরা দুজনেই ছিলেন একে অপরের যাকে বলে
কার্বন কপি। দুজনেই রগচটা, দুজনেই ডাকাবুকো, দুজনেই সারাজীবন নিজের নিজের বাবার
একটি কথাও গ্রাহ্য করেননি। দুজনেরই মনেপ্রাণে বিশ্বাস ছিল “এই বাড়িতে” কিস্যু হবার
নয়। অথচ সাতদিন হাসপাতালে থেকে যে রাতে দাদু মারা গেলেন এই সেজকাকুই শিশুর মতো
কেঁদেছিলেন। সে সময়ের ফ্যাশনমাফিক আমাদের বাগানে দাদুর শায়িত দেহের সঙ্গে বাড়ির
সবাইকে নিয়ে তোলা একটা ছবি আছে। ঠাকুমা, ঠাকুমার চার ছেলে, দুই ছেলের বউ, এক
মেয়ে, দুই নাতনি আর রজনীগন্ধাশোভিত খাটে শোয়া ঠাকুরদা। সকলেই শান্ত, গম্ভীর,
শোকতপ্ত। কিন্তু সেজকাকুর মুখটা দেখে বোঝা যাচ্ছে কাকু একেবারে ধসে গেছেন।
আলোকচিত্রীর নির্দেশ মতো সকলেই ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে, খালি ঠাকুমা আর কাকুর
দৃষ্টি ঠাকুরদার নিষ্প্রাণ মুথ থেকে একচুলও সরেনি।
বাবা ভাইয়ের পরামর্শ নিলেন
না। খুব ইচ্ছে হলে ভাইয়ের লাল রেডিও ধার নিয়ে শুনতেন, ব্যস। তলে তলে বাবার ফন্দি
ছিল অন্য। যেই না সরকারি চাকরিখানা হস্তগত হল অমনি দাদুর ভ্রূকুটির সামনে দিয়ে
বাবা বুক ফুলিয়ে কিনে আনলেন, উঁহু, রেডিও না, একেবারে প্যানাসোনিক কোম্পানির স্টেট
অফ দ্য আর্ট টেপরেকর্ডার। ঠাকুরদার বোকা রেডিওর মতো সেটার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁটা
ঘোরাতে হয় না, একবার বোতাম টিপে দিলেই খাটুনি শেষ। ঠাকুরদার ব্যাকডেটেড রেডিওর মতো
সেটায় অধিবেশন ফুরোনোর আতংক নেই, যতক্ষণ না মন ভরে ততক্ষণ গান শুনিয়ে যাবে
টেপরেকর্ডার, শুধু কারেন্টটা থাকতে হবে।
টেপরেকর্ডারের চেহারাটাও
ছিল দেখার মতো। তন্বী, শ্যামাঙ্গী। সামনে কালো বোতাম সারি সারি সাজানো, ঠিক যেন
মিশিমাখা হাসি। একটা টিপলে গান চলে, একটা টিপলে থামে, একটা টিপলে ফরফর করে এগোয়,
একটা টিপলে করকর করে পেছোয়, একটা টিপলে অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। বাবা ততক্ষণে
চট করে সাইকেলে চেপে জহরের দোকান থেকে চিনি এনে দিতে পারেন ঠাকুমাকে। এসে বোতামখানা আবার
টিপে দেন, ‘মেরা হাম’ বলে থেমেছিলেন, ‘দম না রহা’ বলে কিশোরকুমার আবার গাইতে শুরু
করেন।
কিন্তু সবথেকে ভালো যে
বোতামটা ছিল সেটার ওপর ছিল সিঁদুরের টিপের মতো একখানা ফুটকি আর ওপরে গোটা গোটা
অক্ষরে লেখা ছিল ‘রেকর্ডিং’। একটা ফাঁকা ক্যাসেট পুরে এই বোতামটা টিপে দিলেই টেপরেকর্ডার
আশেপাশের আওয়াজ কণ্ঠস্থ করতে শুরু করে দিত।
বাবা রেকর্ড করতে শুরু করলেন। নিজের গান, ঠাকুমার হাসি, দাদুর গর্জন, চড়াইশালিকের কিচিরমিচির, কুকুরের ঝগড়া, গরুর হাম্বা। শেষটা অবস্থা এমন হল যে বাবাকে যন্ত্র হাতে আসতে দেখলেই সবাই “ওরে বাবারে কত বেলা হয়ে গেল এখনও চান হল না” বলে গামছাটামছা না নিয়েই বাথরুমে ঢুকে পড়ত।
এই যখন পরিস্থিতি, তখন আমি
বোকার মতো দৃশ্যে আবির্ভূত হলাম। টাইমিং জ্ঞান আমার এখন যা, তখনও তেমনই ছিল বোঝা
যাচ্ছে। বাড়ির লোকের অসহযোগে বাবার রেকর্ডিং-এর উৎসাহের আঁচ যাও বা নিবুনিবু
হয়েছিল, এই ঘটনায় তাতে আবার নতুন করে ঘি পড়ল। আমার অযৌক্তিক কান্না, অকারণ হাসি,
অবোধ্য চিৎকার সব বাবা রেকর্ড করে রাখতে শুরু করলেন।
তারপর যেই না বুলি একটুখানি
ফুটল আমার অধৈর্য মা অমনি আমাকে পড়াতে শুরু করলেন। পড়া অতি সামান্য। এক থেকে দশ,
ওয়ান থেকে টেন, এ থেকে জেড, অ থেকে ঔ আর ক থেকে চন্দ্রবিন্দু। ব্যস। সেটা আমাকে
রোজ সকালসন্ধ্যে, দুপুরবিকেল, রোদ উঠলে বা মেঘ করলে, বাড়িতে অতিথি এলে বা না এলে
তোতাপাখির মতো আবৃত্তি করতে হত।
বান্টি মুখে আতংকের ভাব
ফুটিয়ে বলল, “উফ, কী অ্যাবিউস! সাইজে ছোট বলে কি মানুষ না? চাইল্ড রিয়ারিং বিষয়ে
আমাদের দেশ যে কতখানি ব্যাকওয়ার্ড ছিল সেটা এই সব শুনলে বোঝা যায়। অবশ্য ছিল কেন
বলছি, এখনও আছে। এই তো সেদিন আমার ভাইপোকে . . .”
আমি অবশ্য ব্যাপারটাকে
অ্যাবিউস মনে করি না। কারণ আমার মনের গভীরে একটা সন্দেহ আছে যে ওটা করতে আমার আসলে
ভালোই লাগত। হাততালি পাওয়ার প্রতি আমার এখন যে রকম অবিশ্বাস্য লোভ, সেটার
অঙ্কুরোদ্গম তখনই হয়েছিল বলে আমার বিশ্বাস। পাঁচমাস বয়সে শিশু প্রথম হিংসে অনুভব
করতে শেখে শুনেছি, তারপর ভালোবাসা, সহমর্মিতা, দয়ামায়া, করুণা ইত্যাদি। আমার ঘোর
বিশ্বাস আমার ক্ষেত্রে হিংসের পিছুপিছুই হাততালি পাওয়ার বাসনা জেগেছিল। তারপর বাকি
সব।
বলাই বাহুল্য, নিজের
সন্তানের মুখস্থবিদ্যার এমন নমুনা বাবা রেকর্ড করতে ভোলেননি। সেই প্লাস্টিকের
খাপের তলায় রুলটানা মলাট দেওয়া ক্যাসেটটা
এখনও আছে আমাদের বাড়িতে। ওপরে বাবার হাতে লেখা ‘সোনা’ আর ভেতরে সোনার
বিদ্যের প্রমাণ। এক থেকে দশ, ওয়ান থেকে টেন, এ থেকে জেড, অ থেকে ঔ আর ক থেকে
চন্দ্রবিন্দু। এইটুকু শুনে অবশ্য বাড়ির লোকের মন ভরত না। বর্ণমালার যে ক’টা অক্ষর
বলতে আমার কচিকচি দাঁত প্রায় ভাঙোভাঙো হয়েছে, সেগুলো আবার বলানো হত। সে সবও
ক্যাসেটে ধরা আছে। সেজকাকু বলছেন, “আচ্ছা, এবার ব-এ শূন্য র টা আর একবার বল দেখি
সোনামণি।” সোনামণি আদেশ পালন করলেন। তারপর পিসির অনুরোধে ড-এ শূন্য ড়, অন্ত্যস্থ য
আর চন্দ্রবিন্দুও আর এক বার করে বলতে হল। দিনে অন্তত পাঁচশোবার শোনার পরও “শন্নবিন্নু”
শুনে একদল প্রাপ্তবয়স্ক লোকের অত হাসি কী করে পেত সেটা একটা রহস্য।
আমার উরুশ্চারণ নিয়ে
যথাসম্ভব হাসিঠাট্টা করে হাঁফ ধরে গেলে ফরমায়েশ আসত সেই গল্পটা বলার। গল্পে মোটে
চারটে চরিত্র। সোনা, পিসি, পেয়ারাগাছ আর টিয়াপাখি। পেয়ারাগাছে টিয়াপাখি এসে বসেছে
আর পিসি তাকে “হুশ হুশ” করে তাড়া দিয়ে বলছে, “অ্যাই টিয়াপাখি, তুই পেয়ারা খাবি না,
পেয়ারা আমাদের সোনা খাবে।” ব্যস, গল্প শেষ এবং পুরস্কার হিসেবে কথকের এন্তার আদর,
গালটিপুনি ও হাততালি প্রাপ্তি।
সেই গল্পের চরিত্রদের মধ্যে এখন শুধু আমি আছি। উনিশশো অষ্টাশি নাগাদ সিঁড়ি আর নতুনঘর হওয়ার সময় পেয়ারা গাছ চলে গেল, দু’হাজার একে কিডনির রোগে ভুগে পিসি চলে গেলেন। অবাধ্য পাজি টিয়াপাখিগুলো কখন গেল সেটা আমার মনেই নেই।
আর সেটাই আশ্চর্যের
ব্যাপার। জ্ঞান হওয়া ইস্তক আমি আমার চারপাশে সবুজ দেখেছি। ভোরবেলা চোখ মেলে দেখেছি
জানালার বাইরে ফলের ভারে নুয়ে পড়েছে পেঁপে গাছ, স্কুলে বেরোনোর সময় দেখেছি একটা
লোক কোমরে গামছা বেঁধে রেডি হচ্ছে নারকেল আর সুপুরি গাছে চড়বে বলে। ওই
নারকেলগাছটার বয়স আমার থেকে ঠিক তিনদিন কম। বাড়ি ফিরেই নাকে এসেছে গুড় দিয়ে নারকেল
পাকের সুঘ্রাণ। ঠাকূমার ঘরে ঢুকে দেখেছি একদিকে বড় বড় তিনচারটে ঝুড়িভর্তি বাদামি
রঙের পিংপং বলের মতো সুপুরি। চন্দনামাসির কাছে ঠাকুমা বাজারে সুপুরির দর জানতে
চাইছেন, পাছে নিজে বিক্রি করে ঠকে না যান। প্রতিবছর কালবৈশাখীতে আমাদের দরজার
সামনের আমগাছের তলায় দুষ্টু ছেলেদের ভিড় দেখেছি আমি। গল্প শুনেছি বারান্দায় ইজিচেয়ারে
বসে থাকতেন দাদু আর দাদুর পাশে ছোট একটা টেবিলে রাখা থাকত রকমারি আম। ফজলি,
হিমসাগর, ল্যাংড়া। দাদু একটা একটা করে আম খেতেন আর খাওয়া হয়ে গেলে আঁটিগুলো ছুঁড়ে
ছুঁড়ে বাগানের এদিকসেদিক ফেলতেন। তারা একে একে সব বড় হয়ে গাছ হবে সেই আশায়। দাদুর
আশা পূর্ণ করেছিল গেটের মুখে গিয়ে পড়া আঁটিটা।
এইরকম গাছসর্বস্ব পরিবেশে
বড় হয়ে আমার মধ্যে গাছপালার প্রতি প্রতি প্রীতি কেন জন্মায়নি সেটা একটা ভাববার মতো
বিষয়। আমার ধারণা উত্তরটা লুকিয়ে আছে ওই ছবিটার মধ্যে। আমার দাদু বারান্দায়
ইজিচেয়ারে বসে ঠাকুরদা আম খাচ্ছেন, আঁটি নিক্ষিপ্ত হচ্ছে বাগানের চতুর্দিকে।
আমাদের বাগানটা দেখলে আপনি
বুঝবেন শুধু আম নয়, গোটা বাগানটাই তৈরি হয়েছে ওই কায়দায়। যে যেখানে পেয়েছে সেখানে
একটা করে গাছ পুঁতে দিয়েছে। আম কাঁঠাল নারকেল সুপুরি পেয়ারা। গাছেদেরও কি ছিরি।
কলা পেঁপে নিম চালকুমড়ো। গল্পের বইয়ের দৌলতে আমার তখন ভদ্রসভ্য বাগানদের সঙ্গে
আলাপ হয়েছে, সে সব বাগানের মোরাম বেছানো রাস্তার দুপাশে কেয়ারি করা ইঁটের পাঁচিল।
পাঁচিলের ওধারে বসরাই গোলাপের বেডের পাশে পাতাবাহারের ছাঁটা ঝোপ। বাড়ির দেওয়াল
বেয়ে লতিয়ে উঠেছে মাধবীলতা।
কিছু বলতে গেলেই ঠাকুমা
বলতেন, “ক্যান, আমাগো বাগানেও তো ফুলের অভাব নাই।” তা নাই, কিন্তু সেগুলোকে ফুল
বলতে আমার রুচিতে বাধত। পাঁচরকম জবা, সাতরকম নয়নতারা, টগর, গাঁদা, গন্ধরাজ, কাঠগোলাপ,
কলকে। আমার শোয়ার ঘরের জানালার শিকের ভেতর নাক গলিয়ে সেধে আলাপ করতে আসা একটা
কাঞ্চন, গেটের পাশে একটা কূটকুটে সবুজ রঙের কামিনী গাছের ঝাড়। বাগানের কোণে একটা
অষ্টাবক্র স্থলপদ্ম গাছ, বছরে তিনটে ফুল ফুটবে বলে মহাদরে রেখে দেওয়া হয়েছে।
গোলাপ পোঁতার প্রস্তাব
দিয়েছিলাম আমি একবার। পোঁতার মতো ফাঁকা জায়গাও দেখিয়ে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম কাউকে
কিছু করতে হবে না, সব দায়িত্ব আমার। উত্তর এল, “গোলাপ পুঁতে কী হবে, পুজোয় তো
লাগবে না।” পরের সপ্তাহে দেখলাম সেই ফাঁকা জায়গাটা জুড়ে গাঁদাল পাতার বন গজিয়েছে
একটা। বাড়ির লোকের পেটখারাপ হলে কাজে লাগবে।
এই সব ব্যাপারস্যাপার দেখে
বাগানটাগান থেকে আমার মনটাই কেমন উঠে গিয়েছিল। খালি কাজ আর কাজ, কাজের বাইরেও যে জীবনের
একটা অ্যাসথেটক দিক (অ্যাসথেটিক কথাটা আমি তখন নতুন শিখেছিলাম আর কেবলই চতুর্দিকে
তার অভাব চোখে পড়ছিল) আছে, সেটাই যারা বোঝে না, তাদের বাড়িতে কিছু হবার নয়।
বাবার টেপরেকর্ডারের মতো
ফাস্ট ফরওয়ার্ড করে কুড়িটা বছর এগিয়ে আসা যাক। এই বাগান সেই বাগানই আছে, এই আমি
সেই আমিই আছি, খালি আমার হাততালির ক্ষিদে আর চশমার পাওয়ার বেড়েছে অনেকটা।
চোখ খুলে দেখলাম নাকতলার
বাড়িতে আমি শুয়ে আছি। ঢাকের শব্দ কানে এল। মনে পড়ল আজ সপ্তমী। কাল মাঝরাতে আমরা
এসেছি। উঠে চোখ কচলাতে কচলাতে বাথরুমের দিকে যেতে গিয়ে দেখলাম মায়ের চা করা সারা।
চা-টা খেয়ে বিছানায় এসে এলিয়ে পড়ে জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর সঙ্গে সুনীল
গঙ্গোপাধ্যায়ের কথোপকথন পড়তে লাগলাম। রান্নাঘর থেকে ছ্যাঁকছোঁক শব্দ আর সুঘ্রাণ
ভেসে আসতে লাগল। ভালো কিছু জলখাবার হচ্ছে মনে হয়।
কথা নেই বার্তা নেই ঠিক এই
সময় আমার বিবেক জেগে উঠে আমাকে মোক্ষম কামড় দিল। কামড় খেয়ে আমি দৌড়ে রান্নাঘরে উপস্থিত
হয়ে “আমি কিছু করি আমি কিছু করি” বলে মাকে
উত্যক্ত করতে লাগলাম। মা আমাকে নিরস্ত করার প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলেন, আমি রণে
ভঙ্গ দিয়ে ভেতর ঘরে ফিরে আসতে লাগলাম, কিন্তু আসামাত্র বিবেক আবার কামড় দিচ্ছিল
এবং আমি আবার দৌড়ে গিয়ে “কিছু করি কিছু করি” লাফালাফি শুরু করছিলাম।
অবশেষে মায়ের মাথায় বুদ্ধি
খেলল। কাজও দেওয়া হবে আবার আমার হাত থেকে মুক্তিও মিলবে এই না ভেবে মা বললেন, “কিছু
যদি করতেই চাও তাহলে ছাদ থেকে কয়েকটা কারিপাতা তুলে আনো দেখি।”
আমি হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।
এর থেকে যদি মা যদি গোটা বাড়ির রান্নাটাই আমাকে করতে বলতেন, কিংবা বলতেন বাড়ির
সবার জামা কেচে দিতে, কিংবা হাতে ভরা তেলের বাটি নিয়ে সারা বাড়িটা যদি দুবার পাক
খেয়ে আসতে, তাহলেও ভালো ছিল। কারণ সত্যিটা হচ্ছে, আমি কারিপাতা চিনি না।
কারিপাতা কাকে বলে জানি,
খেয়েছি, রান্নায় দেওয়া হয়েছে কি না বলতে পারব, কিন্তু সেটা হাতে নিয়ে দেখিনি কখনও।
এতদিন পর আমাদের দুঃখী বাগানের কথা আমার মনে পড়ল। মনে পড়ল শনিরবিবারের সকালের কথা।
দশটা বেজে গেছে, বাড়ির সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সদস্যের পেট খিদেয় পেট চুঁইচুঁই করছে
অথচ সেদিকে কারও দৃকপাত নেই কেন খোঁজ নিতে দুমদুমিয়ে রান্নাঘরে গিয়েছি, দেখি মা
বাগান থেকে উঠে আসছেন। হাতে একগোছা ঘাসপাতা। দরজার মুখে রাখা পাপোশে জোরে জোরে
হাওয়াই চটি ঘষছেন পাছে বাগানের কাদামাটি ঘরে চলে আসে। মায়ের মুখ সর্বদাই যেমন থাকে,
হাসিমাখা। হেসে হেসে মা বলছেন, “খুব খিদে পেয়ে গেছে সোনামা-র? এই তো কারিপাতা তুলে
এনেছি, এবার সাড়ে তিনমিনিটে চিঁড়ের পোলাও হয়ে যাবে।” আমি দ্রুত মায়ের মুখ থেকে
দৃষ্টি সরিয়ে হাতের পাতাগুলোর ওপর ফোকাস করার চেষ্টা করলাম। বিশ্রী একটা
খ্যারখ্যার আওয়াজ করে ক্যামেরা বার বার তার অপারগতা জানান দিতে লাগল।
হাল ছেড়ে দিয়ে আমি আমাদের
জঙ্গুলে বাগানের ম্যাপটা মাথার মধ্যে মেলে ধরলাম। কোথায় কারিগাছ, কোথায় সে গাছের
পাতা। গাঁদালবনের পাশে? সুপুরিগাছের ছায়ায়? কোথাও তাকে খুঁজে পেলাম না। হঠাৎ আমার বাঁ পা-টা
ধাঁই করে গদার মতো পড়ল আর সেই বিতিকিচ্ছিরি ঝটকায় চোখের সামনে থেকে মা, বাগান,
কারিপাতা সব উধাও হয়ে গেল, আমি চমকে উঠে দেখলাম সিঁড়ির ধাপ শেষ হয়ে গেছে এক ধাপ
আগেই, আমি নাকতলার ছাদের মুখে দাঁড়িয়ে আছি। ছাদের রেলিং জুড়ে আমার শাশুড়িমায়ের
বাগান। পাতিলেবু থেকে শুরু করে পিটুনিয়া থেকে শুরু করে রক্তকরবী, কী নেই সে
বাগানে।
কিন্ত এখন বাগান
অ্যাপ্রিশিয়েট করার সময় নয়। এখন কারিপাতা খুঁজে বার করে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময়। স্কুলে
সাহানা একবার আমাকে অজানা প্রশ্ন দেখে না ঘাবড়ানোর টোটকা শিখিয়েছিল। ধরা যাক
প্রশ্ন এসেছে সালোকসংশ্লেষ কাকে বলে। এদিকে আমার কোনও আইডিয়াই নেই যে সালোকসংশ্লেষ
খায় না মাথায় দেয়, খালি মনে পড়ছে মাখনদাদুদের দোতলায় একটা বিশ্বপাকা ছেলে ভাড়া
এসেছে, আশ্রমে পড়ে, নাম সালোক দাশগুপ্ত। এ রকম পরিস্থিতিতে সাহানার বক্তব্য ছিল,
মাথা থেকে সালোক দাশগুপ্তকে বার করে সালোকসংশ্লেষের ওপর মনঃসংযোগ করতে। প্রথমেই
শব্দটাকে ছোট করে ফেলতে হবে। সালোক আর সংশ্লেষ। সালোক মানে স-আলো, আর সংশ্লেষ
মানে, ওয়েল, সংশ্লেষ। অর্থাৎ আলো দিয়ে কোনও কিছুর সংশ্লেষ। এবার পরীক্ষাটা যেহেতু
জীবনবিজ্ঞানের সেহেতু সংশ্লেষটা ঘটছে নিশ্চয় কোনও একটা জীবনের মধ্যে। মানুষ,
কুকুর, গাছ, অ্যামিবা।
সাহানার বক্তব্য ছিল এইভাবে
ভাবলে যে কোনও প্রশ্নের উত্তরের কাছাকাছি পৌঁছনো যায় এবং এই ভাবনার প্রক্রিয়াটা
খাতায় লিখে আসলে ‘প্রচেষ্টা’র খাতিরে ‘রা’দিদিভাই নম্বরও দেন। অন্তত দেওয়া উচিত।
আমি কারিপাতা নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম। কারিপাতা সম্পর্কে কী কী জানি আমি? এক, এ
পাতা কারিতে দেওয়া হয়। দুই, আমার একটা আবছা ধারণা আছে যে কারি গাছ কলাগাছের মতো বড়
নয় আবার ধনেপাতার মতো বেঁটেও নয়। তিন, নাকের কাছে তুলে ধরে শুঁকলে কারিপাতা
কারিপাতা গন্ধ বেরোতে পারে। তাকিয়ে দেখলাম, ছাদের তিন রেলিং জুড়ে কোটি কোটি গাছ। এত
গাছের এত পাতা শুঁকে শুঁকে পরীক্ষা করতে গেলেই হয়েছে। রান্নাঘরে মায়ের চেহারাটা
একবার মনে পড়ল। “ছাদের এই দিকে আছে, দেখবে।” বলে একটা অনির্দিষ্ট হাত ঘুরিয়েছিলেন।
আমি মনে মনে সেই দিকটা আন্দাজ করে এগিয়ে গেলাম।
সর্বনাশ। এদিকের সবক’টা গাছই দেখছি মনে মনে আমি কারিপাতার গাছকে যেমন কল্পনা করেছি সেরকম দেখতে। হাঁটুর সমান উঁচু, রোগা কেঠো ডাল, ছোট ছোট সবুজ পাতা। নিচু হয়ে শুঁকলাম। গন্ধ . . . গন্ধ . . . এইটায় একটু আছে মনে হচ্ছে? যা থাকে কপালে বলে আমি পটাপট কুড়ি পঁচিশটা পাতা ছিঁড়ে ফেললাম। গাছটা প্রায় হাফ ন্যাড়া হয়ে গেল।
মা দেখে বললেন, “ওমা, এগুলো
কী পাতা এনেছ?”
ব্যস। হয়ে গেল। আমি নিশ্চিত
হয়ে গেলাম এ গাছ অতি বিরল, স্পেশাল অর্ডার দিয়ে আনানো। এ গাছে নিশ্চয় পাঁচবছর পর পর
মাঘ মাসের শুক্লা ত্রয়োদশী তিথিতে ফুল ধরে। এ বছরই নির্ঘাত সেই পবিত্র বছর। আর এ
বছরেই আমি অর্ধেক পাতা ছিঁড়ে গাছটাকে মেরে ফেললাম। বিয়ের সই সেরে উঠে প্রণাম করার
পর ঠাকুমার আশীর্বাদের কথাটা মনে পড়ল। “শাশুড়িরে ভালোবাইসো, শাশুড়ির ভালোবাসা পাইও।”
আশীর্বাদের সেকেন্ড পার্টটা আর এ জীবনে ফলল না মনে হচ্ছে।
আবার ছাদে গেলাম। এবার দিক
ভালো করে জেনে নিয়ে গেলাম। গিয়ে যে গাছটাকে দেখে সন্দেহ হল সেটার পাতার কাছে নাক
নিয়ে যেতেই নির্ভুল কারিপাতার গন্ধ নাকে এল। পাতা মায়ের কাছে পৌঁছে দিয়ে ঘরে এসে
গোটা ঘটনাটা অর্চিষ্মানকে বলাতে ও এমন জোরে হাসতে লাগল যে ভয় হতে লাগল এক্ষুনি না
দম আটকে যায়।
সেই থেকে মনে মনে
রেখেছিলাম, গত সপ্তাহে কাজে করে ফেলেছি। অনলাইন অর্ডার করে জীবনের প্রথম গাছ কিনে
ফেলেছি আমি। কী গাছ আন্দাজ করার জন্য কোনও প্রাইজ নেই। তবু যদি হিন্ট চান তা হলে
বলব এ গাছের পাতা কারিতে দেওয়া হয়, এ গাছের পাতা ধনেপাতার থেকে বড় কিন্তু কলাপাতার
থেকে ছোট আর এ পাতা নাকের কাছে নিয়ে শুঁকলে একটা বিশেষ গন্ধ পাওয়া যায়, যে গন্ধটা
আপনাদের সবার চেনা।
তোমাদের নারকেল গাছটার মতো আমাদের বাড়িতেও একটা স্বর্ণচাঁপা গাছ ছিল, আমার বয়সী। আরও অনেক গাছ ছিল। এখনও আছে।
ReplyDeleteআমিও কবে থেকে ভাবছি কয়েকটা গাছ লাগাই টবে। কোথায় রাখব, বাবার মতো সময়, ধৈর্য নিয়ে গাছেদের সামলাতে পারব কি পারব না এইসব ভেবে আর কিছু করা হয়ে ওঠে না :(
-সায়নী
লাগিয়ে ফেল, সায়নী। বাবারা, ঠাকুমারা যে ভাবে করেছেন, আমরা সে রকম ভালো করে পারব না, আমাদের মতো করেই করব।
Deleteস্মৃতিচারণটা বেশ মন ছুঁয়ে গেল।
ReplyDeleteধন্যবাদ, তথাগত।
Deleteশেষ প্যারাটা পড়ার পরঃ শেষ পর্যন্ত কাজটা করলে, তার জন্য সাবাস্, ব্রেভো এবং পিঠ চাপড়িয়ে আরো যা যা কিছু বলা যায়, স--------ব।
ReplyDeleteঠাকুমার আশীর্বাদটা দারুণ ও স্মৃতিমেদুর। এইরকম আশীর্বাদ আজকাল আর কেউ দেয় না। আজকাল খালি 'আমার' মেয়ে আর জামাই। আশীর্বাদের সেকেন্ড পার্টটা আশাকরি ফলে গেছে। আর মনে হয় না, তোমার শাশুড়ী এত কৃপণ হবেন যে, বউএর কাজের নিরিখে ভালবাসা বিলাবার জন্য অপেক্ষা করবেন। বাঙাল যে, তাই তাঁদের কাছে পোলার বউ মানেই আদরের ধন। এটা আমার অভিজ্ঞতা।
থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ মালবিকা।
Deleteঠাকুমা শাশুড়ি-বউয়ের সম্পর্কটাকে দারুণ গুরুত্ব দেন, মালবিকা। আমাকে সর্বদা তো বলেনই, মাকেও বলেন, "মাইয়াটারে ভালোবাইসো।" আমার ধারণা ঠাকুমার আশীর্বাদটা পুরোটাই ফলেছে।
O ma kenbar ki dorkar chilo? Bari theke dal ene matite bosiye dilei gachh hoye jay toh. Amader bari te ekta karipata'r gachh ache, r ashepashe karo barite nei, tai parar dosa-idli wala amader gachh theke pata tule niye jay. Ebong seta niye keno kijani amar ekta prochhonno gorbo ache. :D
ReplyDelete-Ramyani.
আরে, রম্যাণি, বাড়ি থেকে আনলে আমাকে টব জোগাড় করতে হত, টবের মাটি জোগাড় করতে হত, গাছ পুঁততে হত। অত কাজ করতে গেলে আমার আর গাছ পোঁতা হত না, বিশ্বাস কর। আর এঁরা আমাকে টবশুদ্ধু ইয়াব্বড় গাছ দিয়ে গেছে। আমি শুধু মনে করে দু'বেলা জল ঢালছি। তোমার গর্ব অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত।
Deletehahaha ..durdanto laglo :) :)choto belay je gaachguloke dekhe naak sintkotam,akhon sesab gach ghera akta bagan jadi keu banie day..haate bodhay swargo pabo !!
ReplyDeleteekebare amar mone katha likhechho...aamio bhabchilam ishh emon chaad bhora patilebu, petunia, raktakorobi jodi keu amay dito :)
Deleteতিন্নি, শম্পা, দুজনকেই হাই ফাইভ।
Deletehahahahahaha.... ohh sei... prochur hesechhi ..
ReplyDeleteগুড, হীরক।
DeleteApnake boye sunno ro, chondrobindu etosob bolte bolto, kintu keu ki pet kata mordhenno sho bolte bolto na???
ReplyDeleteনিশ্চয় বলত, অর্ণব, ছেড়ে কি আর দিত?
DeleteTomar lekhate forward-backward transition ta just asadharon. Prothom gaachh kenar abhinandan. R han, oi dorja jukto black and white oscar tv ta amader o chilo. - Bratati.
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, ব্রততী। চিচিংফাঁক অস্কার টিভি হাই ফাইভ।
Deleteamader barir bagan tao tomader moton e ...agochhalo, elomelo chhilo. Tobe tate ektuo osubidhe hoto na. Totodine sob adventure er golpo porchhi.. Tai konodin okhane mati khunre treasure hunt, abar kono din tarzan er sathe adventure, abar kono din amgachher dal theke dolnay dola..'promoter er dapote barita bikri kore deoya hoyechhey recently.. r amar chhotobelar bagan ta ekhon gutishuti mere moner modhye dhuke dhuke gechhey.
ReplyDeleteআমাদের বাড়িটারও কোনদিন ওই পরিণতি হবে সেই ভয়ে ভয়ে আছি। একসময় ভাবতাম, কিছুতেই হতে দেব না। কেউ না থাকে আমি থাকব আমাদের বাড়িটায়। এখন বাস্তববুদ্ধি গজিয়েছে, বুঝতে পেরেছি সে ক্ষমতা আমার হবে না। তবে বাগান যে মনের ভেতর ঢুকে গেছে সেটা ঠিক।
Deletebhalo laglo! boithoki adda r mejaje lekha jeta tomar sob lekhatei paoa jae.
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ, তপোব্রত।
DeleteHahaha. Samanno kari/curry pata niyeo je ato bhalo akta post hoye jaye seta ke janto. Ami ranna related je kono bepare akath murkho. Tomar thakumar ashirbad ta khub unique. Erom to keu bolei na. Ulte sasurir sathe juddho korar gameplan sorboraho kore. Haha.
ReplyDeleteOnline e gach kinte pawa jaye ei prothom janlam. :-O
আমি নিশ্চিত, কুহেলি, খুঁজতে জানলে অনলাইনে বাঘের দুধও পাওয়া যাবে আজকাল। কারি পাতার গল্প পড়তে তোমার ভালো লেগেছে জেনে শান্তি পেলাম। থ্যাংক ইউ।
DeleteKhub haschilam... Ar barite ekjon ami pagol hoye gechi bhebe bhuru kuchke amai dekhchilo...
ReplyDeleteগুড, ভট্টা।
Deleteএম্মা কারিপাতা চেনে না!
ReplyDeleteভাল লাগল
মিঠু
ধন্যবাদ, মিঠু।
Deletekhub bhalo khub bhalo laglo.. amader makhlar barite ekta boro size karipata gach chilo.. maa lagiyechilo.. ekhon uttarparay ekta ache mahesh er mela theke kena.. :) ekhane amar karipata gach ta amader bari(sosurbari) ar pasher barir border e hoyechilo... chupi chupi tule ene tob e pute niyechi .... hahahaha.. :)
ReplyDeleteবাঃ, তুই বেশি করিৎকর্মা মেয়ে বোঝা যাচ্ছে, ঊর্মি।
Delete