লখনৌ/ শেষ পর্ব
অচেনা ঘরের অচেনা বিছানায় ঘুম ভাঙার খারাপ দিকটা হচ্ছে ঘুম ভেঙে আমি কোথায়, আমার
গায়ে এই বোম্বেটে কম্বলটা কার, আমি কি স্বেচ্ছায় এই ঘরে এসেছি নাকি আমাকে কেউ
অপহরণ করে এনেছে, আনলে কত টাকা মুক্তিপণ দাবি করবে, করলে সে টাকা অর্চিষ্মান দিতে
রাজি হবে কি না ইত্যাদি গুরুতর ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়, আর ভালো দিকটা হচ্ছে ধোঁয়াশা
কাটার পর বেশ কিছুক্ষণ শুয়ে শুয়েই ফাইন্ড দ্য ডিফারেন্সেস খেলা যায়।
পরদিন সকালে ঘুম ভেঙে ওইসব ভয়ানক দুশ্চিন্তা কেটে গিয়ে যখন মনে পড়ল ‘ও হরি,
এটা তো একটা হোটেল আর হোটেলের বাইরের শহরটার নাম তো লখনৌ’ তখন নিশ্চিন্ত হয়ে আমি
খেলাটা শুরু করলাম। এই ঘরটার সঙ্গে আমার দিল্লির ঘরটার তফাৎ খুঁজে বার করার খেলা।
প্রথমেই আয়নাটার দিকে চোখ পড়ল। চকচকে, গাঢ় বাদামি রঙের হাতিঘোড়া খোদাই করা
ফ্রেমওয়ালা বড় আয়নাটা। বিছানার এইখানটায় শুয়ে শুয়ে আয়নাটা দেখা যাচ্ছে ঠিকই,
কিন্তু ঘরের দরজা দিয়ে ঢুকে দেখা যায় না। আমিও দেখতে পাইনি। দ্রুত বাথরুম আর গিজার
আর লেপতোষক আর ফোনের ডায়ালটোন আর টিভির রিমোটের হিসেব নিয়ে “বহোৎ আচ্ছা” বলে
ভাইসাবকে বিদায় করে যখন ঘর পেরিয়ে এই জানালাটার কাছে এসে দাঁড়ালাম তখন চোখে পড়ল। ও মা, দেওয়ালটাকে
একটুখানি এগিয়ে এনে কী সুন্দর একটা খোপ বানিয়েছে এরা! সেই খোপের দেওয়ালে আবার কী
সুন্দর একখানা বাহারি আয়না! আয়নার ফ্রেমের নিচের অংশটা এগিয়ে এসে আবার একটা টেবিল
হয়ে গেছে। টেবিলটার চারপায়ার জায়গায় চারটে থাবা। সেই থাবার ঘেরাটোপে নাক ঢুকিয়ে
দাঁড়িয়ে আছে জমকালো গদিআঁটা একটা সাহসী চেয়ার। চেয়ারেরও রং গাঢ় মেহগনি, চেয়ারেরও
পায়ার জায়গায় চারচারটে থাবা।
আমাদের বাড়ির আয়নাটার কথা মনে করলাম। এই আয়নাখানার মতো তার
বাহার নেই বটে, তা বলে তার কাজে কেউ খুঁত ধরতে পারবে না। সামনে দাঁড়ানো মাত্র আমার
মাথার প্রতিটি পাকাচুল থেকে শুরু করে আমার মুখের প্রতিটি পাহাড়পর্বত প্রতিটি
খানাখন্দ, আমার খ্যাঁদা নাক, আমার মুলোর মতো দাঁত আর কুলোর মতো কান, আমার ঘোলাটে
কুৎকুতে ছাগলচোখ, সব সে একেবারে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। সে আমি দেখতে চাই আর
না চাই। দু’নম্বর ফারাক হচ্ছে সেটার সামনে এটার মতো কোনও চেয়ার নেই। খানিকক্ষণ
ভেবে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, নেই যে ভালোই হয়েছে, থাকলেই বরং অসুবিধে হত। আমার
স্পষ্টবক্তা আয়নার সামনে দিনে তিরিশ সেকেন্ড করে দাঁড়াতেই আমার বুক কাঁপে, চেয়ারে
বসে তার সঙ্গে খোশগল্প জোড়ার আমার কোনও সাধ নেই। তাছাড়া চেয়ার না থাকায় যেটুকু
জায়গা বেঁচেছে তাতে আমি আর অর্চিষ্মান দুজনে দিব্যি ফিট করে যাচ্ছি। অফিস বেরোনোর আগে আমরা
দুজনেই একসঙ্গে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি। আমার মাথা, আর আমার
মাথার একহাত ওপরে অর্চিষ্মানের মাথা দিব্যি আয়নায় এঁটে যায়। আমরা গম্ভীর মুখে চুল
আঁচড়াই। স্পষ্ট কথা বলার প্রতিশোধ হিসেবে ব্যাটাকে দিয়ে মাল্টিটাস্কিং করিয়ে নিই।
তারপর ধরা যাক ঘরটার আসবাবপত্রের অবস্থান। এই ঘরের লে আউট যাকে বলে একেবারে
ফেং শুইয়ের ঠাকুরদাদা। বিছানার দু’ধারে সমান ফাঁকা জায়গা, যমজ সাইডটেবিল, যমজ রিডিং
লাইট, যমজ ফুলদানিতে যমজ নকল ফুল। অর্থাৎ কি না সম্পর্কের পাওয়ার ইকুয়েশন একেবারে
নিক্তি মেপে সমান সমান।
দুজনের হাতে সমান সুতো, দুজনের আস্তিনে সমান তাস। আমার বাড়ির খাটবিছানার অবস্থানের
কথা মনে পড়ল। সে দেখলে ফেংশুইওয়ালারা না জানি কী করবেন। বুক চাপড়ে কাঁদবেন নির্ঘাত
টানা তিনরাত তিনদিন। আর নিজের পকেট থেকে টাকা বার করে দিয়ে বলবেন, “দোহাই বাবা,
এইবেলা থেরাপিস্টের কাছে গিয়ে সম্পর্কটার একটা ফুল বডি চেকআপ করিয়ে এস।”
এইরকম শাস্ত্রসম্মত ঘরে থেকে, এক রাতেই না জানি আমাদের সম্পর্ক না জানি কত
শক্তপোক্ত হয়ে গেল ভেবে আমি খুশি হয়ে উঠলাম আর অমনি তিন নম্বর ফারাকটার কথা মনে
পড়ে গেল। আমাদের বাড়ি হলে এখন আমাকে উঠে শীতে কাঁপতে কাঁপতে রান্নাঘরে চা করতে
যেতে হত আর এখানে . . .
ফোন তুলে গলা মোটা করে বললাম, “অ্যাই, কোই হ্যায়? জলদি চায় লাও। তুরন্ত। চায়
গরম হোনা চাহিয়ে, নেহি তো . . .”
হুমকিটা হাওয়ায় ভাসিয়ে রেখে ফোন কেটে দিলাম।
চায়ের কাপ হাতে নিয়ে জানালার পর্দা সরিয়ে দেখি বৃষ্টি নেমেছে। কী আশ্চর্য!
লখনৌয়ের আবহাওয়া দেখছি পূর্বাভাস মেনে চলে। ভাগ্যিস পূর্বাভাসকে যথাযথ সম্মান দিয়ে
দু’খানা ছাতা দিল্লি থেকে বয়ে বয়ে এনেছিলাম। আমরা সবাইকে ফোন করে এই আশ্চর্য খবরটা
দিলাম। ফোন করতে করতে আর চায়ে চুমুক দিতে দিতেই বৃষ্টি ঝমঝম থেকে টিপটিপ হয়ে শেষটা
একেবারে থেমেই গেল। আমরা বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের গন্তব্য রেসিডেন্সি।
রেসিডেন্সি হচ্ছে লখনৌ শহরের ঠিক মাঝখানে প্রায় তেত্রিশ একর জমির ওপর
বানানো একটি কম্পাউন্ডের ভেতর কতগুলো বাড়ি। আঠেরোশো সাতান্ন সালের পয়লা জুলাই থেকে
সতেরই নভেম্বর পর্যন্ত এই কম্পাউন্ডে ইংরেজ বাসিন্দাদের ঘেরাও করে রেখেছিল দেশীয়
সৈনিকরা। প্রবল যুদ্ধ হয়েছিল, কম্পাউন্ডের ভেতর শিশুবৃদ্ধ নির্বিচারে প্রায়
আড়াই হাজার লোক মারা গিয়েছিল। সে যুদ্ধের প্রমাণ গায়ে মেখে কতগুলো ভাঙা বাড়ি,
মসজিদ, কুয়ো, কবরখানা, এখনও রেসিডেন্সির ভেতর দাঁড়িয়ে আছে।
এইটুকু বললে রেসিডেন্সির মূল কথাটা বলা হয়ে যায় বটে কিন্তু দেশী গৃহহীন
ভিখিরির অভাব না থাকলেও গুটিকয়েক ইংরিজি বাসিন্দার জন্য লখনৌ শহরের প্রাণকেন্দ্রে
এত বড় একখানা ক্যাম্পাস সতেরোশো চুয়াত্তর থেকে শুরু করে আঠেরোশো সাল, দীর্ঘ
ছাব্বিশ বছর ধরে কেন আদৌ বানানো হয়েছিল, সেই কথাগুলো কিছুই বলা হয় না। সেই আসল
কথাগুলো বলতে গেলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে সিপাহী
বিদ্রোহের অন্তত একশো বছর আগে। লখনৌ যখন লখনৌ হয়নি, অয্যোধ্যার রাজধানী যখন ফৈজাবাদ, আর
ফৈজাবাদের সিংহাসনে যখন বসে আছেন নবাব সুজাউদ্দৌল্লা।
সুজাউদ্দৌল্লাকে মনে আছে তো? তিনি ছিলেন খুরাসানি নবাব সাদাত আলি, যাঁকে
দিল্লির সম্রাট খুশি হয়ে অযোধ্যার নাজিম বানিয়েছিলেন, সেই খুরাসানি লড়াইবাজ সাদাত
আলির নাতি। সুজাউদ্দৌল্লা খানদানি নবাব ছিলেন না, কিন্তু তাঁর মধ্যে বেশ একটা নবাবিয়ানা
ছিল। ভারতের ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া বেশ কয়েকটা যুদ্ধে নবাব সুজাউদ্দৌল্লা
গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা নিয়েছিলেন। যেমন তৃতীয় পানিপত এবং বক্সার। বক্সারের যুদ্ধ
হয়েছিল বাংলার নবাব মীর কাশিম, অয্যোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌল্লা আর দিল্লির নবাব
দ্বিতীয় শাহ আলমের মিলিত বাহিনীর সঙ্গে হেনরি মুনরোর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির
সেনাবাহিনীর। তিন নবাব যুদ্ধ হারলেন আর শাহ আলমকে এলাহাবাদ চুক্তিতে সই করতে হল।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা বিহার উড়িষ্যায় কর আদায়ের অধিকার পেল, সুজাউদ্দৌল্লার
ফাইন হল পঞ্চাশ লক্ষ টাকা্। তাছাড়াও এর পর যুদ্ধবিগ্রহ বাধলে কোম্পানির
সৈন্যবাহিনীকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতির অঙ্গ হিসেবে সুজাউদ্দৌল্লাকে চুনার দুর্গের
অধিকার ছেড়ে দিতে হল, তারপর গেল বেনারস আর গাজিপুর, তারপর গেল এলাহাবাদ।
রাজত্বকালের একেবারে শেষপ্রান্তে এসে নবাব সুজাউদ্দৌল্লা লখনৌ শহরে একজন ইংরেজ
রেসিডেন্টকে রাখতে সম্মত হলেন। সেই রেসিডেন্টের জন্য শহরে ব্যক্তিগত
বাসস্থানের ব্যবস্থা করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন তিনি। লখনৌয়ের বুকে বিষবৃক্ষের
বীজ বপন হল।
সুজাউদ্দৌল্লা নিজেও সে কথা বুঝেছিলেন হয়তো, কারণ লখনৌয়ে রেসিডেন্সি নির্মাণের
সিদ্ধান্ত নেওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই তিনি চোখ বুজলেন। তাঁর ছেলে আসফুদ্দৌল্লা
রাজধানী সরিয়ে আনলেন লখনৌয়ে আর ভুলভুলাইয়া বানিয়ে বেগমদের সঙ্গে মহানন্দে লুকোচুরি
খেলতে লাগলেন। তাঁর সময়কালে বিশেষ গোলমাল কিছু হল না, গোলমাল বাধল আসফুদ্দৌল্লার দত্তক নেওয়া ছেলে ওয়াজির আলি সিংহাসনে বসার পর।
ওয়াজির আলি ছিলেন খানিক উদ্দাম প্রকৃতির যুবক। তাঁকে সুবিধেমতো বাগে আনতে না
পেরে ইংরেজরা বলল যে তুমি আসফুদ্দৌল্লার নিজের ছেলে নও, কাজেই সিংহাসনে তোমার অধিকার নেই।
এই বলে তারা বার্ষিক দু’লাখ টাকা অনুদান হাতে ধরিয়ে ওয়াজির আলিকে বেনারসে পাঠিয়ে
দিল, সিংহাসনে এনে বসালো আসফুদ্দৌল্লার ভাই দ্বিতীয় সাদাত আলিকে। প্রতিদানে
কোম্পানিকে দেয় অয্যোধ্যার বাৎসরিক নজরানা বারো লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে সত্তর লাখ
করে দেওয়া হল, অযোধ্যার সৈন্যসংখ্যা কমানোর নির্দেশ দেওয়া হল, সিংহাসনে বসার তিন
বছরের মধ্যে দ্বিতীয় সাদাত আলি তাঁর সাম্রাজ্যের অর্ধেক বিভিন্ন ছুতোয় কোম্পানিকে
লিখে দিতে বাধ্য হলেন।
আর এরই মধ্যে শেষ হল রেসিডেন্সি গড়ার কাজ। লখনৌয়ের বুকের ওপর তেত্রিশ একরেরও
বেশি জমি নিয়ে তৈরি হল ইংরেজদের পাড়া। সে পাড়ায় ছিল তোষাখানা, হাসপাতাল, স্কুল,
ডাকঘর, খেলার জায়গা, বেগমকুঠি, মসজিদ ও ইমামবাড়া। সাহেবমেমদের আমোদের জন্য নবাব
রেসিডেন্সির ভেতর ব্যাংকোয়েট হল বানিয়ে দিয়েছিলেন। ইউরোপিয়ান আসবাব, চীনা
সাজসজ্জার সামগ্রী দিয়ে সে হল সাজানো হয়েছিল। এছাড়াও রেসিডেন্সির ভেতর কোম্পানির
নিজস্ব সৈন্যসামন্ত, ঘোড়া ইত্যাদি থাকার জন্য আলাদা জায়গা ছিল। আরও ছিল বাগান, সে
বাগানে ছিল মার্বেলের ফোয়ারা।
কর্নেল বেইলির সম্মানে বিশেষ গার্ড অফ অনার দিয়েছিলেন নবাব দ্বিতীয় সাদাত আলি
খান, তার চিহ্নস্বরূপ এখনও আছে এই বেইলি গার্ড গেট।
লখনৌয়ের রেসিডেন্সিতে যখন তেড়েফুঁড়ে ফোয়ারা বসানোর কাজ চলছে, তখন বেনারসে
নির্বাসিত নবাবজাদা ওয়াজির আলিকে কেন্দ্র করে এক মস্ত গোলমাল পেকে উঠল। ওয়াজির
আলির বার্ষিক দু’লাখ টাকা অনুদান ধরিয়ে অযোধ্যা থেকে উৎখাত করেই কোম্পানির মন
ভরেছিল না, তাদের খালি মনে হতে লাগল বেনারস অযোধ্যার বড্ড কাছাকাছি, নবাবজাদার মতিগতি
যেমন বাঁকাচোরা তাতে তাঁকে বেনারস থেকেও দূরে কোথাও সরিয়ে দেওয়াই উচিত হবে।
ওয়াজির আলিকে তাঁর পরবর্তী গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার ভার পড়েছিল সাহেব জর্জ
ফ্রেডেরিক চেরির ওপর। নবাবজাদাকে সেই খবর দেওয়ার জন্য তাঁকে নিজের বাড়িতে নেমন্তন্ন
করলেন চেরি সাহেব। দিনটা ছিল চোদ্দই জানুয়ারি, সতেরোশো নিরানব্বই সাল। চেরি সাহেব
নবাবজাদাকে খাতিরযত্নই করতে চেয়েছিলেন হয়তো, কিন্তু ওয়াজির আলির মতলব ছিল অন্যরকম।
তিনি একেবারে হইহই করে সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। চেরি সাহেবের সঙ্গে
ক্যাপ্টেন কনওয়ে আর মিস্টার গ্র্যাহাম নামে আরও দুই সাহেবের প্রাণ গেল। ওয়াজির আলি
তারপর চড়াও হলেন বিচারপতি ডেভিসের বাড়িতে। সিঁড়িকোঠায় খুব লড়াই
হল, বিচারপতি ডেভিস ভয়ানক কেরামতির সঙ্গে ওয়াজির আলি ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গর আক্রমণ
ঠেকালেন। সেই সিঁড়িকোঠার লড়াই নিয়ে ডেভিস পরে একটি বই লিখেছিলেন, সে বই এখন আউট অফ
প্রিন্ট।
এত করেও শেষরক্ষা হল না। কোম্পানির সেনা ওয়াজির আলিকে ধরে ফেলল। জীবনের
সতেরোটি বছর আমাদের ফোর্ট উইলিয়ামের একটি লোহার খাঁচায় কাটিয়ে মাত্র ছত্রিশ বছর
বয়সে মরে গেলেন বিদ্রোহী নবাবজাদা ওয়াজির আলি। সতেরোশো চুরানব্বইয়ে তিরিশ লক্ষ
টাকা খরচ করে যে তেরো বছরের বালক নবাবের বিয়ে হয়েছিল, আঠেরোশো সতেরোয় তাঁর
মরণোত্তর ক্রিয়াকর্ম সমাধা করতে খরচ হয়েছিল মাত্র সত্তর টাকায়। কাশীবাগান কবরখানায়
সেই দরিদ্র, অবাধ্য নবাবের সমাধি এখনও গেলে দেখা যায়।
যতই গালি দিই না কেন, ইংরেজদের সম্পর্কে একটা কথা কিন্তু মানতে হবে। শৃঙ্খলা,
সময়ানুবর্তিতা, পরিমিতিবোধ, রসবোধ, সংযম ইত্যাদির সঙ্গে সঙ্গে ওদের আর একটা ভালো
গুণ হচ্ছে পরদ্রব্য হরণ করার ক্ষমতা। কখন কার থেকে কোন জিনিসটা কেড়ে নিয়ে গিয়ে
নিজেদের ওই পুঁচকে দ্বীপটায় জমা করতে হয়, সেটা ওদের থেকে ভালো কেউ জানে না। কখন
বাবাবাছা বলে মাথায় হাত বুলিয়ে কাড়তে হবে, আর কখন গলা টিপে আদায় করতে হবে, সে সব
ওদের নখদর্পণে। কোম্পানির কর্তাদের মধ্যে এই কাজটা যে যত ভালোভাবে করতে পারতেন,
কোম্পানিতে তাঁর উন্নতি তত দ্রুত হত।
এই রকম এক সাহেব ছিলেন লর্ড ওয়েলেসলি। তিনি ভেবে ভেবে সাবসিডিয়ারি অ্যালায়েন্স
নামে এক চুক্তির উদ্ভাবন করেছিলেন। চুক্তির মোদ্দা কথা ছিল, তুমি আমাকে টাকা
দাও, আমি তোমাকে নিরাপত্তা দেব। তুমি যদি টাকা দিতে না পার, তবে আমি তোমার রাজ্য
নেব।
হায়দরাবাদের নিজাম প্রথম এই চুক্তির ফাঁদে মাথা গলালেন, চতুর্থ ইঙ্গ-মারাঠা
যুদ্ধে হেরে গিয়ে টিপু সুলতান বাধ্য হলেন চুক্তিতে সই করতে। অয্যোধ্যা তখনও পালিয়ে
পালিয়ে বেড়াচ্ছিল, কিন্তু ওয়াজির আলির এই ঝামেলার পর আর পারল না। আঠেরোশো এক সালে
দু’নম্বর সাদাত আলির নেতৃত্বে অয্যোধ্যা নিজেকে কোম্পানির “অ্যালি” বলে স্বীকার
করল, নবাব নিজের সেনাবাহিনীর অধিকার ছেড়ে দিলেন, অর্ধেক রাজত্ব কোম্পানি নিয়ে নিল, নবাবকে রাজ্যচালনার কাজে
‘সুপরামর্শ’ দেওয়ার জন্য কোম্পানির লোক নিযুক্ত হল আর সেই সঙ্গে অয্যোধ্যার
স্বাধীনতার সমস্ত রকম ভড়ং সাঙ্গ হল।
এরপর আর বেশি কিছু বলার থাকে না। কোম্পানির হাতের পুতুল নবাবরা একে একে
সিংহাসনে ওঠানামা করতে লাগলেন। রেসিডেন্সিতে আমোদের ফোয়ারা ছুটতে লাগল, অযোধ্যার
রাজকোষ থেকে টাকা ধার নিয়ে কোম্পানি এদিকসেদিক যুদ্ধ বাধিয়ে ফিরতে লাগল, আর সেই
যুদ্ধজয়ের আনন্দে সন্ধ্যের পর সন্ধ্যে জুড়ে জীবন্ত হয়ে উঠতে লাগল রেসিডেন্সির
বাড়িঘর মাঠ ফোয়ারা ব্যাংকোয়েট হল। সাদাত আলির নাতি নবাব নাসিরুদ্দিন মারা গেলে
সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে আবার খানিক গোলমালের সৃষ্টি হল। আবার রাজপুত্রের
জায়গায় রাজার ভাই সিংহাসনে বসলেন। এই ভাইয়ের নাম ছিল মহম্মদ আলি। নবাব মহম্মদ আলি
বেশ ভালো লোক ছিলেন। লখনৌয়ের জন্য অনেক করেছিলেন, ছোটা ইমামবাড়া বানিয়েছিলেন।
মহম্মদ আলির মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসলেন তাঁর ছেলে আমজাদ আলি, আর আমজাদ আলির পরই
ভারতবর্ষের ইতিহাসে হই হই করে এসে পড়লেন নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ।
ওয়াজিদ আলি শাহ যখন সিংহাসনে বসলেন তখন অযোধ্যার সূর্য অস্ত গেছে। নবাব হিসেবে ওয়াজিদ আলি ভালো ছিলেন না মন্দ
সে পরীক্ষার সময় তখন ছিল না, কারণ নবাব তখন নামেই নবাব, পুতুলনাচের সুতো কোম্পানির
হাতে। কিন্তু ওয়াজিদ আলি শাহ যে কত বড় শিল্পী ছিলেন তার পরীক্ষা সময় নিয়েছে, এবং
নবাব তাতে সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছেন।
রাজাবাদশাদের মধ্যে শিল্পের গুণগ্রাহিতা খুব একটা বিরল ব্যাপার নয়, অনেক রাজাই
শিল্পের সমঝদার হন, শিল্পীর কদর বোঝেন। সেসবের সঙ্গে সঙ্গে ওয়াজিদ আলি শাহ ছিলেন
নিজে শিল্পী। স্বয়ং তানসেনের শিষ্যের কাছ থেকে ধ্রপদীসংগীতে তালিম নিয়েছিলেন নবাব।
লেখালিখির জন্য নবাবের দু’দু’খানা ছদ্মনাম ছিল, কাইজার আর আখতারপিয়া। এই দুই নামে
তিনি অসংখ্য গান, গদ্য, কবিতা লিখেছিলেন। সে সব গানের অনেকগুলোই
এখনও লোকের মুখে মুখে ফেরে। কত্থকনাচ আর নাটকেও রাজার ভয়ানক রুচি ছিল।
এমন সময় ভারতবর্ষের ভাগ্যাকাশে আবির্ভূত হলেন লর্ড ডালহৌসি। চুরিবিদ্যায়
অভূতপূর্ব পারদর্শিতার পুরস্কার হিসেবে ইনি একেবারে ভারতের গভর্নর জেনারেল পদে
উন্নীত হয়েছিলেন। ওয়েলেসলি তবু
নিরাপত্তাদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ডালহৌসি অত উদারতার রাস্তায় গেলেন না। তিনি
বললেন যে রাজাই উত্তরাধিকার ছাড়া মারা যাবেন বা যে রাজা অযোগ্য হবেন, মানে লর্ড
ডালহৌসির যে রাজাকে অযোগ্য মনে হবে সে রাজার রাজত্ব কেড়ে নেওয়া হবে।
অযোগ্যতার দৌড়ে সে রাজা ছাড়া কে ফার্স্ট হবে যে কি না গান লেখে আর গান গায় আর
ছবি আঁকে আর নাচ দেখে? ওয়াজিদ আলি শাহের হাত থেকে অযোধ্যা কেড়ে নেওয়া হল, বাৎসরিক
বারো লাখ টাকা অনুদান সহ তাঁকে লখনৌ থেকে চিরদিনের মতো বার করে দেওয়া হল। আঠেরোশো
ছাপ্পান্ন সালের ছয়ই মে প্রচুর আত্মীয়স্বজন, গাইয়েবাজিয়েনাচিয়ে, রাঁধুনি, পোষা
জন্তুজানোয়ার সঙ্গে নিয়ে হুগলী নদীর তীরে বিচালি ঘাটে এসে ভিড়ল নির্বাসিত নবাবের
বজরা। তৈরি হল মেটিয়াবুরুজ। ফেলে আসা তাঁর সাধের লখনৌকে নতুন করে সৃষ্টির চেষ্টায় মেতে থেকে আঠেরোশো
সাতাশি সালের একুশে সেপ্টেম্বর শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন অয্যোধ্যার শেষ নবাব
ওয়াজিদ আলি শাহ।
এনফিল্ড রাইফেলের কার্তুজ যদি অগ্নিসংযোগ হয়, তবে রেসিডেন্সি ঘেরাওয়ের সলতে
পাকানো শুরু হয়েছিল লখনৌ থেকে নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের নির্বাসনের সময় থেকে। দশই মে মীরাটের
সেনাছাউনিতে প্রথম বিদ্রোহের সূত্রপাত হল, সীতাপুর, ফৈজাবাদ, দরিয়াবাদ, সুলতানপুর
পেরিয়ে লখনৌ পৌঁছতে পৌঁছতে তার লেগে গেল প্রায় দু’মাস।
তিরিশে জুন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে কোম্পানির সেনাপতি হেনরি লরেন্স খবর পেলেন
রেসিডেন্সির চারদিকে বিদ্রোহী সেনারা জড়ো হতে শুরু করেছে।
খেপে খেপে রেসিডেন্সি ঘেরাও চলেছিল প্রায় দেড়শো দিন। নভেম্বর মাসের শেষাশেষি
রেসিডেন্সি মুক্ত হলেও লখনৌ শহরের ওপর বিদ্রোহী সেনাদের রাজত্ব কায়েম ছিল গোটা
শীতকাল জুড়ে। আঠেরোশো আটান্ন সালের একুশে মার্চ স্যার কলিন ক্যাম্পবেল তাঁর দলবল
নিয়ে লখনৌয়ের দখল ফেরৎ নিলেন। অযোধ্যার রাজকাহিনীর নটেগাছ চিরদিনের মতো মুড়োলো।
রাজা নির্বাসিত ছিলেন বহু দূরে, কিন্তু বিদ্রোহ চলাকালীন ভারতীয় সেনাদের
নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রাজার পাটরানি বেগম হজরত মহল আর রানির ছেলে বিরজিস। বিদ্রোহ
ব্যর্থ হওয়ার পর বেগম নেপালে চলে যান এবং আঠেরোশো ঊনআশি সালে সেখানেই শেষনিঃশ্বাস
ত্যাগ করেন।
*****
এত ইতিহাস ঘেঁটেঘুঁটে আমাদের খিদে পেয়ে গেল, আমরা বিরিয়ানি খেতে চললাম।
অমনি একদল দাড়িওয়ালা বোদ্ধা কোথা থেকে উদয় হয়ে বললেন, “শুধু খাইখাই করলেই হবে,
কী খাচ্ছ কেন খাচ্ছ সে সব তলিয়ে দেখতে হবে না?”
আমরা বললাম, “খাচ্ছি খিদে পেয়েছে বলে। আর লখনৌ এসে মানুষে যা খায় তাই খাচ্ছি,
বিরিয়ানি।”
বোদ্ধারা বেঁকা হাসি হাসলেন। নিজেদের মধ্যে নিচুগলায় বলাবলি করলেন, “পড়াশোনা
না থাকলে যা হয়।”
তারপর তাঁদের মধ্য থেকে একজন মুখপাত্র এগিয়ে এসে খুব মিষ্টি করে বললেন, “ভাতে চাট্টি
মাংস মিশিয়ে দিলেই কি বিরিয়ানি হল ভাই?”
আমরা অবাক হয়ে বললাম, “হল না বুঝি?”
দাদা বললেন, “মোটেই হল না। তা যদি হত তাহলে তো বাংলাদেশের পোলাও, চীনের Ji Chow Fan, বর্মা দেশের Dan Bauk, জাপানি Oyakodon, স্প্যানিশ Arroz con pollo, থাইল্যান্ডের Khao Mok Gai, সকলেই নিজেদের
বিরিয়ানি বলে দাবি করত।”
এত শক্ত শক্ত শব্দ শুনে আমরা মুহূর্তের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম, সেই
ফাঁকে দাদা আমাদের সাধারণ জ্ঞান আরও খানিক বাড়িয়ে দিলেন।
যা বুঝলাম, ঝামেলাটা প্রধানত ভাত মাংস আলাদা আলাদা করে রেঁধে মেশানো হচ্ছে,
নাকি ভাত মাংস সব এক সঙ্গে রাঁধা হচ্ছে সেই নিয়ে। দ্বিতীয় রকম করে রাঁধলে
সেটাকে বলে কাচ্চি বিরিয়ানি। হায়দরাবাদিরা ওই রকম করে বিরিয়ানি রাঁধে এবং দাবি করে
বিরিয়ানি ওই রকম করেই রাঁধতে হয়, না রাঁধলে সেটা পোলাও, পান্তাভাত, পায়েস আর যা
খুশি হতে চায় হোক, বিরিয়ানি কিছুতেই হয় না। কাজেই লখনৌয়ের মাংসভাতটা বিরিয়ানি নয়,
ওটা হচ্ছে গিয়ে পোলাও। কলকাতার বিরিয়ানিও তাই।
এ সব কথার কোনও উত্তর দেওয়ার দরকার আছে বলে আমি মনে করি না। পোলাও? আচ্ছা,
পোলাওই সই। অ্যাঁ, কী বললেন? পোলাও-ও নয়, স্রেফ পান্তাভাত? নিশ্চয় নিশ্চয়, আপনি
যখন বলছেন তখন পান্তাভাতই হবে। এই পান্তাভাতই না হয় খেয়ে নিন একটু কষ্টমষ্ট করে,
এই বলে লখনৌয়ি বিনয়ে নুয়ে পড়ে বোদ্ধার নিঃশেষিত পাতে আরও দু’হাতা বিরিয়ানি
ঢেলে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই আমাদের করার নেই।
আমরা বিরিয়ানি খেতে গিয়েছিলাম দস্তরখোয়ানে। যদি জিজ্ঞাসা করেন কেন দস্তরখোয়ান,
কেন ইদরিশ, ওয়াহিদ, লাল্লার বিরিয়ানি নয়, তাহলে মুখ বুজে মাথা চুলকোনো ছাড়া কোনও
উত্তর থাকবে না। ধরে নিন দস্তরখোয়ান নামটা
আমাদের পছন্দ হয়েছিল। দস্তরখোয়ান শব্দটা পারসি, মানে হচ্ছে বিবিধ জিভে জল আনা
খাদ্য ও পানীয়সামগ্রীর সমাহার। বাংলায় মহাভোজ শব্দটা কাজে দস্তরখোয়ানের খানিকটা
কাছাকাছি পৌঁছতে পারে হয়তো, কিন্তু কাব্যের দিক থেকে একটু খাটো পড়ে যায়।
দস্তরখোয়ান বাছার দু’নম্বর কারণটা হচ্ছে অশোকাঙ্কুর। লখনৌয়ের টু ডু লিস্ট শোনাতে যেতেই যে বলেছিল, “টাইম বড্ড কম তোমাদের, যাই হোক,
টুণ্ডেতে যেও – আমিনাবাদেরটা নয়, চৌকেরটাতে – দস্তরখোয়ানে খেও, তারপর যা ইচ্ছে কোরো
গে যাও আমাকে জ্বালাতে এস না।”
কাজেই দস্তরখোয়ানে খাব ঠিক করলাম। লখনৌ শহরে খাওয়ার জায়গা, তাও আবার যে সে
খাবার নয়, খোদ বিরিয়ানি খাওয়ার জায়গা বাছাবাছির সমস্যার এত সহজে সমাধান হয়ে যাওয়ায়
আমরা রীতিমত খুশি হয়ে উঠলাম। তারপর দেখলাম দস্তরখোয়ান আছে শহরের তিনটি এলাকায়। এক
হজরতগঞ্জে প্রেসক্লাবের গায়ে, দুই লালবাগে, তিন গোমতী নগরে। আমরা চাট খাচ্ছি
লালবাগে আর ফেলুদা হজরোৎগঞ্জের কিউরিও দোকানেই তদন্ত করতে ঢুকেছিল, তাই আমরা
হজরতগঞ্জের দস্তরখোয়ানেই খাওয়া স্থির করলাম।
রিকশা চেপে হজরতগঞ্জের প্রেসক্লাবের সামনে নেমে দেখলাম, সমস্যা এখনও বাকি
রয়েহে যথেষ্টই। রাস্তার দু’পাশে দুটো দোকান, দুটোরই নাম দস্তরখোয়ান। দাঁতভাঙা শব্দ ব্যবহার অবান্তরের নীতিবিরুদ্ধ, কিন্তু সেই মুহূর্তে আমাদের মনের ভাব যা হয়েছিল
কিংকর্তব্যবিমূঢ় ছাড়া অন্য কোনও শব্দে তাকে প্রকাশ যাবে না।
আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকলাম। থাকতে থাকতে ‘আমি
কেন আমার মায়ের মতো হলাম না’ এ আফসোস আবার নতুন করে আমার মনকে কুরে কুরে খেতে
লাগল। এই পরিস্থিতিতে আমার কী করা উচিত না জানলেও এই পরিস্থিতিতে পড়লে আমার মা
কী করতেন তা আমি জানি।
তিনি সোজা গিয়ে যে কোনও একটা দোকানে ঢুকে জিজ্ঞাসা করতেন, “আপনাদেরটা কি আসল
দস্তরখোয়ান?”
আমার মা বিশ্বাস করেন যদি কাউকে বোঝানো যায় যে ‘এই আমি তোমাকে সম্পূর্ণ
বিশ্বাস করলাম’ তবে সে লোকের পক্ষে সে
বিশ্বাস ভঙ্গ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। খেলতে নেমে নিজের হাতের তাস দেখিয়ে দেওয়ার
পরও যে অপরপক্ষ ঠকাতে পারে সেটা মা তর্কের খাতিরে মেনে নিতে রাজি হন, কিন্তু মনে
নেন না।
আমরা মায়ের মতো নই, আমরা অত সোজাসাপটা রাস্তায় গেলাম না। দুই দস্তরখোয়ানের
মাঝখানে দাঁড়িয়ে নিজেরাই মাথা খাটিয়ে আসলনকল ধরার চেষ্টা করলাম। হুম, বাঁদিকের
দোকানটার নামটা একটু বেশি বড় করে লেখা, ডানদিকের দোকানের বাইরে কিছু নেই, ভেতরের দেওয়ালে
মেনুর পাশে একটা বোর্ডে নাম লেখা আছে। বাঁদিকের দোকানটার মালিক কোমরে হাত দিয়ে
কটমটিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন, ভাবখানা যেন ভালো কথায় কাজ না দিলে এক্ষুনি
কোমরে দড়ি পরিয়ে টানতে টানতে নিজের দোকানে নিয়ে যাবেন। ডানদিকের দোকানের কর্মচারীরা
কাবাব বিরিয়ানির থালা ব্যালেন্স করে হাঁটাচলা করছেন, আমরা তাঁদের দোকানে ঢুকি কি
না ঢুকি সে ব্যাপারে দৃকপাতমাত্র করছেন না। বাঁদিকের দোকানটায়
এখনও ভিড় জমেনি, ডানদিকের দোকানটার তিনচতুর্থাংশ টেবিল অলরেডি ভর্তি এবং সেসব
টেবিলে যাঁরা বসে আছেন তাঁরা আর যাই হোন, টুরিস্ট নন। বাঁদিকের দোকানটা বেশ
পরিষ্কারপরিচ্ছন্ন, ডানদিকের দোকানটার দিকে যেই না তাকিয়েছি, অমনি এক ভদ্রলোক
একহাতে বিরিয়ানির থালা আর এক হাতে টেবিলমোছা ন্যাতা নিয়ে শিস দিতে দিতে চলে গেলেন।
আমরা ডানদিকের দোকানটায় ঢুকে পড়লাম।
প্রথমেই এল পেঁয়াজ, চাটনি, লেবু। আমি খুব কায়দা করে ডেপথ অফ ফিল্ড কমিয়ে তার
দু’খানা ছবি নিতে না নিতেই পরিবেশকের দুই হাতে চেপে ধোঁয়া ওঠা খাবারেরা হইহই করে
এসে গেল।
দো হাফ মাটন বিরিয়ানি, এক হাফ চিকেন কালি মির্চ, এক হাফ শামি কাবাব, এক হাফ
বোটি কাবাব, এক ছোটা থামস আপ।
বিরিয়ানিই হোক আর পান্তাভাতই হোক, আত্মীয়তাস্থাপন যদি করতেই হয় তবে এই রকম
কারও সঙ্গেই করা ভালো। বিরিয়ানি খেতে খেতে আমরা বলাবলি করতে লাগলাম ইংরেজগুলো পাজি
বদমাশ চোর ডাকাত হতে পারে, কিন্তু এই একটা কাজ ভালো করেছে। ওয়াজিদ আলি শাহকে
আমাদের দেশে নির্বাসনে পাঠিয়েছে। এই স্বর্গীয় স্বাদ ও সুবাসের উত্তরাধিকার যে ভারতবর্ষে
আর কারও নয়, কপালগুণে আমাদের ওপরই বর্ষিত হয়েছে, সে কথা মনে করে আমাদের বুক ফুলে
উঠল।
আমরা খেতে থাকলাম। ঝুরঝুরে লম্বা লম্বা চালের দানা, অবিকল কিন্তু স্বতন্ত্র।
আমাদের বিরিয়ানির মতো, তাই না? দিল্লির দোকানগুলো সব কেমন বেঁটে বেঁটে মোটা মোটা
চাল দিয়ে বিরিয়ানি বানায়, বিতিকিচ্ছিরি। আহা, এদের মাংসটা আমাদের থেকে ভালো গো। কী নরম, মুখে দিলে
সিরিয়াসলি মিলিয়ে যাচ্ছে। আহা রে, এমন মাংসের কমতি আলু দিয়ে পূরণ করতে ওয়াজিদ আলি
শাহের বাবুর্চির না জানি কেমন বুক ফেটেছিল। না না, আফসোস করছি না মোটেই। যা হয় সব
যে ভালোর জন্যই হয় সে কথার এর থেকে ভালো প্রমাণ আর হয় না।
আচ্ছা, তোমাকে যদি বলা হয় লখনৌয়ের এই মাখনের মতো মাংসওয়ালা বিরিয়ানি আর
কলকাতার ‘কমা’ মাংস কিন্তু ডিমসেদ্ধ আলুসেদ্ধওয়ালা বিরিয়ানির মধ্যে একটা বেছে
নিতে, তাহলে তুমি কোনটা নেবে?
এই কঠিন সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাতে ঘামাতে আমরা মুখ
চালাতে লাগলাম। বোটি কাবাবের বাটি থেকে যতখানি সম্ভব তেল বাঁচিয়ে ঘন ঝোল তুলে
বিরিয়ানির ওপর ছড়িয়ে নিলাম, চিকেন কালি মিরচের প্লেট থেকে টুকরো তুলে কামড় বসালাম।
পুরু গোলমরিচের পুরু বর্ম ভেদ করতেই মোলায়েম মাংসে আমাদের দাঁত ডুবে গেল।
পাশের টেবিলে একদল খাইয়ে ছিলেন, হাবভাব, টুকরোটাকরা কথাবার্তা থেকে যেটুকু
বোঝা গেল তাঁরাও শহরে নতুন। তাঁদের দায়িত্ব নিয়ে লখনৌয়ের খাবার চাখাতে এনেছেন একজন
স্থানীয় পরিচিত। সেই পরিচিতের দেখলাম এই দোকানের সঙ্গে বেশ জানাচেনা আছে, তিনি
মাঝে মাঝেই পরিবেশকদের চেনা নামে ডেকে নানারকম অনুরোধ জানাচ্ছিলেন। বেশ বড় দল, তার
ওপর দেখেই বোঝা যাচ্ছিল দলের কারওরই অম্বলঅজীর্ণর সমস্যা নেই। ওঁদের টেবিল খাবারের ভারে প্রায় ভেঙেই পড়ছিল। চিকেন মাটন দু’রকমের বিরিয়ানি, পাঁচ রকমের কাবাব, চিকেন
কালি মির্চ, চিকেন কোর্মা, রোগন জোশ, রুমালি রুটি, পরাঠা। পাহাড়ের মতো উঁচু পরাঠার
ঢিপি নিমেষে নিশ্চিহ্ন করে ফেলছিলেন ওঁরা। পরাঠার সাপ্লাই দিতে দিতে দোকানশুদ্ধু
লোক ক্লান্ত হয়ে পড়ছিল। কেবল সেই স্থানীয় ভদ্রলোক প্রতিবার নতুন পরাঠার অর্ডার
দিতে গিয়ে বলছিলেন, “অওর থোড়া কুরকুরে বনাইয়ে জনাব। অওর থোড়া লাল লাল।”
বিল মিটিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এলাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে আর ঘড়ি নেই, এই
ফাঁকে কখন ঘোড়া হয়ে গেছে। আমাদের কাজও অবশ্য শেষ। এবার শুধু হোটেলে ফিরে গিয়ে
রিসেপশনে জমা রাখা ব্যাকপ্যাক নিয়ে স্টেশনে গিয়ে ট্রেন ধরা। এখন যদি একটা
রিকশা নিই তবে ধীরেসুস্থে ভদ্রলোকের মতো ট্রেন ধরা যাবে, বা চাই কি স্টেশনে পৌঁছে
রাজুর দোকান থেকে এক খিলি লখনৌয়ি পান কিনে মুখে পোরাও যেতে পারে।
কিন্তু তার বদলে এখন যদি হাঁটতে শুরু করি তবে শহরটাকে শেষবারের মতো দু’চোখ ভরে
দেখে নেওয়া যাবে, শহরটার আকাশাবাতাস বর্ণগন্ধ, মেঘের ফাঁক দিয়ে এতক্ষণে উঁকি মারা
বাদশাহী রোদ্দুর যত চাই গায়ে মেখে নেওয়া যাবে। তবে সেই সঙ্গে চারবাগের জ্যামে অটোর
ভেতর বসে টেনশনে ঘামতে হবে, দমকলের ঘণ্টির মতো “সরি ভাইসাব সরি ভাইসাব” চেঁচাতে
চেঁচাতে লোকজনের গায়ে ব্যাকপ্যাকের গুঁতো মেরে স্টেশনের ভিড়ের ভেতর দিয়ে ছুটতে
হবে।
আমরা হাঁটতে শুরু করলাম।
বিধানসভার পাশ দিয়ে, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের মূর্তি বসানো পার্কটার পাশ
দিয়ে। এই রাস্তা দিয়ে কালকেও গিয়েছিলাম না? আজ সকালেও তো। তাই কেমন চেনা চেনা
লাগছে। আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথের মূর্তিটা যেন কোথায় দেখলাম? এই রাস্তাটা চিনতে পারছি
কি না? পেরেছি পেরেছি, হ্যাভেলের শোরুমের উল্টোদিকের এই রাস্তাটা দিয়ে সোজা গেলেই তো
লালবাগের জৈন চাট ভাণ্ডার, সেটা পেরিয়ে গিয়ে নাকবরাবর গিয়ে ডানদিকে মুড়লেই বাঁহাতে
কাইজারবাগ কোতোয়ালির বাড়িটা আর বাড়িটার উল্টোদিকে বুল টায়ার শপ। শপের সামনে কাল যে
ভদ্রলোক কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাঁর মুখেচোখ থেকে সত্যি সত্যিই দৃপ্ত বুলের
হাবভাব ফুটে বেরোচ্ছিল কিন্তু, দেখেছিলে?
হ্যাঁ হ্যাঁ, এই তো জোরে হাঁটছি। এসেই তো প্রায় গেছি। এল আই সি . . . এল আই সি
. . . ইয়েস! এই এল আই সি-র বোর্ড সাঁটা বাড়িটার উল্টোদিকের রাস্তাটা দিয়ে আমাদের
যেতে হবে। ওই তো আকাশ ফুঁড়ে উঠেছে ক্যাথলিক স্কুলের চার্চের ছাদ। ওর পেছনেই সেন্ট
ফ্রান্সিস কলেজের বিরাট সবুজ মাঠ পেরিয়ে দু’পা গিয়ে ডানদিকে বেঁকলেই হল গিয়ে সপরু
মার্গ আর সপরু মার্গের ডান ফুটের তিন নম্বর বাড়িটাই হল গিয়ে আমাদের হোটেল, যার
রিসেপশনের পাশের ঘরটায় চুপটি করে বসে আমাদের অপেক্ষা করছে আমাদের দু’খানা
ব্যাকপ্যাক।
শহরটার একটা ভীষণ আবছা জলছাপ যখন মাথার ভেতর সদ্য অবয়ব নিতে শুরু করেছে, তখনই
আমরা চলে যাচ্ছি। ভেবে মন খারাপ হয়ে যাচ্ছিল আমার। কী ভাগ্যিস কাছাকাছি
রাম আসরে-র প্রসিদ্ধ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার
ছিল, সেখানে ঢুকে একখানা মালাই পান আর একখানা রসমালাই কিনে দু’জনে হাফ হাফ করে
খেয়ে তবে মন একটু চাঙ্গা হল।
ব্যস, আমাদের লখনৌয়ের আঠাশঘণ্টা শেষ। চারবাগের জ্যামও শেষ, লোকজনকে ব্যাকপ্যাকের
ধাক্কা মেরে ‘সরি ভাইসাব সরি ভাইসাব’ বলতে বলতে ছুটে এসে
কোনওক্রমে শতাব্দী এক্সপ্রেসের লেজ ধরে কামরায় উঠে পড়াও শেষ, সিট নম্বর খুঁজে বসে
পড়াও শেষ। এই তো ঝাঁকুনি দিয়ে লখনৌয়ের মাধ্যাকর্ষণ কাটিয়ে দিল্লি অভিমুখে রওনা
দিয়েছে ট্রেন। লখনৌ এবার সত্যি সত্যি শেষ।
তার মানে কি এবার সময় হয়েছে সেই গানটা গাওয়ার? জানালার তেলচিটে কাঁচে মাথা
ঠেকিয়ে গুনগুন করার, ‘যব ছোড় চলে লখনৌ নগরী, তব হাল আদম পর কেয়া গুজরি”?
সে কী! এখনও তো লখনৌয়ের কত কিছু দেখা বাকি রয়ে গেল। চৌকের ভিড়ে দুটো প্রকাণ্ড
চকচকে পাতিলা ভর্তি বিরিয়ানি নিয়ে হাসিমুখে বসে রইলেন পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য
লাল্লাজী, হিঁদুর পো হয়ে যিনি ইদ্রিশ ওয়াহিদদের সঙ্গে টক্কর দেওয়ার মতো বিরিয়ানি
রাঁধতে শিখেছেন। চাটের যুদ্ধে দিল্লিকে অবিসংবাদিত বিজয়ী ঘোষণা করার আগে আরও
দু’চারটে লখনৌয়ি চাট চেখে দেখা হল না। গোমতীর ঘাটে বসে সূর্যাস্ত দেখা হল না, লখনৌ
থেকে মাত্র একঘণ্টার পথ পেরোলেই কুন্তীর নামে নাম রাখা কিন্টুর গ্রামের হাজার
বছরের পুরোনো, পৃথিবীর একটিমাত্র পারিজাত গাছের তলায় ছড়িয়ে থাকা সাদাকমলা ফুল
কুড়িয়ে আনা হল না। সারি সারি দোকানের দেওয়ালের ওপারে ঘাপটি মেরে বসে রইল কত
ম্যাজিক গলি, কত জ্যান্ত ভুলভুলাইয়া, তাদের গোলকধাঁধায় পথ হারানো হল না, হারিয়ে
আবার খুঁজে পাওয়া হল না। এখনই চলে যাওয়ার কথা উঠছে কী করে?
তাছাড়া এত পিছুটান, এত রং, এত মানুষ, এত খাবার, এত ইতিহাস, এত রক্তক্ষরণ, এত
ঐশ্বর্য, এত দারিদ্র্য ছেড়ে কেউ কি সত্যি সত্যি চলে যেতে পারে? কখনওই? যিনি ওই
গানটা লিখেছিলেন, তিনিই কি পেরেছিলেন? ও নির্বাসন তো নামেই নির্বাসন, আসলে তো
নবাবের আত্মার একটুখানি চিরকালের মতো ঘাপটি মেরে লুকিয়ে রইল ভুলভুলাইয়ার কানাগলিতে,
ইংরেজ যার নাগাল পেল না, আর একটুখানি লখনৌ চিরকালের মতো নির্বাসনে গেল নবাবের
বুকের ভেতর বসে, গিয়ে উঠল আমাদের মেটিয়াবুরুজে।
সেই ট্র্যাডিশন এখনও চলছে। নবাব মধ্যবিত্তে তফাৎ করেনি লখনৌ, সে কাজ করতে তার
তহজিব তাকে অনুমতি দেয়নি কখনও, যে-ই এসেছে তাকেই লখনৌ দু’হাত বাড়িয়ে বুকে টেনে
নিয়েছে, যে-ই চলে গেছে তাকেই নিজের খানিকটা ভেঙে দিয়ে দিয়েছে পাথেয় হিসেবে।
আমরাও বঞ্চিত হইনি। আমরাও খানিকটা লখনৌ বুকের ভেতর ভরে নিয়ে চলেছি দিল্লির
পথে, আমাদের খানিকটা রেখে এসেছি রেসিডেন্সির কুয়াশামাখা সকালে, দুপুরের রোদ এসে
পড়া ইমামবাড়ার বারান্দায়, টুণ্ডে কাবাবির কানাগলির হাত ছাড়িয়ে পালানো বিকেলবেলায়।
আর যদি কখনও ফিরে আসা না-ও হয় তারা তো রইল। থাকবে চিরদিন।
Ki sundor, ki sundor. Shesh paragraph ta porey golar kachh ta byatha byatha kore uthlo kirom.
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ, বিম্ববতী। আমি এত দেরি করেছি, এত দেরি করেছি যে লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছিলাম না। তুমি যে পড়ে এত তাড়াতাড়ি মন্তব্য করলে (তাও আবার নিন্দেমন্দ করলে না) সে জন্য মনের একেবারে ভেতর থেকে ধন্যবাদ।
Deleteঅশেষ ধন্যবাদ, দস্তরখান কথাটার আসল মানে বুঝিয়ে দেবার জন্য।
ReplyDeleteআরব্য রজনীর দেশে তাঁরা আসন পেতে বসেন না। তাঁদের দেশে একটা লম্বা কাপড়ের ফালি মেঝেতে পেতে দেওয়া হয়, যার ওপর প্লেট রাখতে হয়। আর সেই চাদরের দুদিকে খাইয়েরা বসেন। আমি অ্যাদ্দিন ভাবতাম সেই লম্বাটে চাদরটাকেই বোধহয় দস্তরখান বলে।
তবে দোষ আমার নয়, দোষ সেই মহাপুরুষের।
"কার্পেটের উপর চওড়ায় দুহাত, লম্বায় বিশ-ত্রিশহাত - প্রয়োজন মত - একখানা কাপড় বিছিয়ে দেয়। সেই দস্তরখানের দুদিকে সারি বেঁধে এক সারি অন্য সারির মুখোমুখি হয়ে বসে।"
কোন বই বলতে পারলে হাততালি।
আর আমি ঠিক জানতাম, জব ছোড় চলে গানটা আপনি ফাঁকতালে ঢোকাবেনই।
আর দ্বিতীয় সাদাত আলিই তো টমাস গডউইনকে পেরিগ্যাল রিপিটার দিয়েছিলেন, তাই না?
আমি জানতাম, বারে বারে ঘুঘু আমি খেয়ে যাই ধান, একদিন অবান্তরের ঘুঘুরা (খারাপ ভাবে নেবেন না দয়া করে) আমার বধিবে পরাণ। এই আমি আগেই বলে দিচ্ছি, আমি প্রশ্ন করতে যত পটু, উত্তর দিতে ততটাই কাঁচা। প্রথম প্রশ্নের উত্তর কি দেশেবিদেশে আর লেখকের নাম কি সৈয়দ মুজতবা আলি? (ভুল হয়েছে তো? জানতাম।)
Deleteআর আমিই যে ফেলুদার সর্বশ্রেষ্ঠ ফ্যান নই, আমারও ওপরে যে আছে, সে কথা আবারও প্রমাণ হয়ে গেল। পেরিগ্যাল রিপিটারের কথা আমার মাথাতেই আসেনি। তবে দুঃখ হচ্ছে না জানেন, দেবাশিস, বরং ফেলুদার এমন ফ্যানেরা যে অবান্তরের বন্ধু, সেইটা ভেবে গর্বে বুক ফুলে উঠছে। থ্যাংক ইউ।
ফাটাফাটি। দেশে বিদেশেই বটে।
Deleteহোয়াট! উত্তর ঠিক হয়েছে? আমার টিপ এত ভালো তো জানতাম না। কী কাণ্ড।
Deleteতবে এইবার একটা কথা বলতে হচ্ছে। হয়তো চলতি কথায় চাদরটাকেও দস্তরখোয়ানই বলে, মানে একটা সময়ের পর যেমন ফোটোকপির সঙ্গে জেরক্স আর সরস্বতী পুজোর সঙ্গে নারকেল কুল সমার্থক হয়ে যায়, তেমনি ওদের দেশে হয়তো ভোজ আর ভোজের চাদর এক হয়ে গেছে। এত কথা বলছি কারণ আমার তো টোকা বিদ্যে, মুজতবা সাহেব তো ভাষাটা বোধ হয় নিজেই বলতে জানতেন, তাই আরকি।
http://en.wikipedia.org/wiki/Dastarkh%C4%81n
Deleteসিধুজ্যাঠা আরও কনফিউজ করে দিলেন। দুটো জিনিসকেই বোধহয় ক্ষেত্রবিশেষে দস্তরখোয়ান বলে।
যাক।
Deleteboi ta amar o mone hochey deshe bideshe..dekha jak..tomar lekhata khub bhalo laglo. pore moner modhye jeno ekta overall chhobi fute uthchhilo.. tobe duto emotion ektu beshi onyogulo r cheye... .last ta pore moner ektu bhar r khabar description dekhe onekkhani hingshe..especially biriyanir chhobi dekhe r description pore :P
ReplyDeleteঠিক উত্তর, ঠিক উত্তর! যাক, আমরা সবাই মিলে দেবাশিসের কাছ থেকে হাততালি আদায় করে নিচ্ছি দেখে বেজায় ভালো লাগছে। আহা, হিংসে করবেন না চুপকথা। আপনি আবার দেখুন যখন লখনৌ গিয়ে বিরিয়ানি খাবেন, তখন আমি বাড়িতে বসে ছাতুমাখা চিবোবো। লেখা ভালো লেগেছে জেনে খুব খুশি হলাম। থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ।
DeleteKuntala, please apni kore likho na. sunte kirom kane lage.. asole generally keu bole na to..ar chhatu makha ke oram oboggya koro na. Thik motn makhle duddhorsho khete lage.. pagla saheber kobor boitay chhatumakhar description pore ekbar utsaho peye baniyechhilam.. seriously osadharon khete..
Deleteকাল দুবার খুলে দেখলাম নতুন লেখা আসেনি। . এখন দুবার পড়লাম :) তোমার গল্প করে ইতিহাস বলাটা দুর্দান্ত জানো ... ফোটোগুলোও খুব ভালো ... কিন্তু তোমার মাথায় পেরিগাল রিপিটার আসেনি ? আমার তো সাদাত আলি দেখেই ওই গল্পটাই মনে পড়েছিল ... ওই গান টা যব ছোড় চলে কখন আসবে সেটাও পড়তে পড়তে ভাবছিলাম ... হেহে সবাই দেখছি ফেলুদায় ডুবে থাকে ... আচ্ছা মালাই পান টা কি জিনিস ?
ReplyDeleteওরে আমাকে আর লজ্জা দিস না রে, ঊর্মি, রিপিটারের কথা তুলে। মালাই পানটা বেশ ভালো জিনিস। পানের মতো দেখতে একটা জিনিস, মালাই/ক্ষীর দিয়ে বানানো। বাইরের মোড়কটা একরকমের মালাই দিয়ে, ভেতরটা আর এক রকমের মালাই দিয়ে। দারুণ জটিল মিষ্টি।
Deleteওহ আমি চকলেটে ডোবানো পান খেয়েছি ...মালাই পান টা মজার জিনিস ... লখনৌ বলে কথা
Deleteচকলেট আর পান? সর্বনাশ।
Deletehingshe hingshe :X :X - tinni
ReplyDeleteহিংসে করিস না, তিন্নি, তুই যে বিকেলবেলা ইচ্ছে হলে সমুদ্রের ধারে হাওয়া খেতে যাস সে জন্য কি আমি হিংসে করি?
Deleteআচ্ছা, ইতিহাস কি তোমার হাতের শরবতের গ্লাস যে দু'এক চুমুক দিচ্ছ আর ফস্ফস্ করে চারটে পাতা উড়ে এসে পড়ছে? তাও আবার আংরেজি ভারতের ইতিকথা। আমার কাছে ভারত ইতিহাসের সবচেয়ে বিরক্তিকর অধ্যায় ছিল। কিন্তু কিমাশ্চর্যম্ অতঃপরম্,তোমার কাছে গুটিকয়েক পাঠ নেবার পর এখন তো দিব্যি লাগছে ! কুন্তলা, সত্যি বলছি, আজেবাজে ভেবোনা, তুমি এইসব চাকরি ছেড়ে দিয়ে কোন কলেজে ঢুকে পড়ো ইতিহাস পড়াতে। তোমার ভ্রমণ বৃত্তান্ত পড়লেই আমার মনে হয়, প্রতিভার কি বিপুল অপচয় হচ্ছে। বিদ্যা হিসাবে ইতিহাস বোধহয় তোমার কাছে অনেক কিছু আশা করে। আরো কত গবেষণার ফসল নষ্ট হয়ে গেল যা আমাদের দেশকে সমৃদ্ধ করতে পারত।
ReplyDeleteহাহাহাহা, আস্তে ক'ন মালবিকা, আমার হিস্ট্রি পড়া বন্ধুরা হেসেকেঁদে খুন হবে। ইতিহাসটা পড়িনি/শিখিনি, ওটা সম্পর্কে কিস্যু জানি না বলেই তাও খানিকটা ভালোলাগা বেঁচে রয়েছে, না হলে ওটার দশা ঠিক ইকনমিক্সের মতোই হত।
Deleteদুজনের কমেন্ট ই ঠিক ... :)
DeleteAmi jokhon Lucknow jai (1993), ichhey chhilo arekbaar phire eshe tanga chorbo ar Residency ta ektu bhalo kore dekhbo! Ekhono se somoy ashe ni. Tober tomar adulate residency ta khub bhalo kore dekhe nilam.
ReplyDeleteধন্যবাদ, রুণা।
DeleteEbar ekta quiz hok. 2015-r prothom quiz!
Deleteতুমি তো দেখছি থটরিডার, রুণা।
DeleteTor sathe sathe Lucknow ta darun ghurlam... Ar Kuntir naam rakha gram a Parijat ful er byapar ta sotti re??? Sotti hole toh darun byapar... geli na keno????
ReplyDeleteওরে ভট্টা, গেলাম না কি আর সাধে? গেছি মোটে আঠাশ ঘণ্টার জন্য, লখনৌ দেখতেই নাভিশ্বাস, তার ওপর একঘণ্টা উজিয়ে কিন্টুরে গাছ দেখতে গেলেই হয়েছিল আর কি। তবে আমার খুব ইচ্ছে গাছটা দেখার, দেখি যদি পরে কখনও সুযোগ হয়। সত্যি মিথ্যে জানি না, সবাই তো বলে। http://timesofindia.indiatimes.com/city/lucknow/Experts-to-save-ancient-Parijat-tree/articleshow/6811856.cms
Deletehttp://en.wikipedia.org/wiki/Parijaat_tree,_Kintoor
Ki shundor bornona! Ki shundor kore goppo guli bolle! History eto shundor agey kokhono lageni. Amar abaar Lucknow jete icche korche.
ReplyDeleteAmio kothao jeno porechilam oi paata chador ta ke e dastarkhan bole.
Photogulo khub shundor hoyeche, Kuntala.
ধন্যবাদ, ধন্যবাদ, শর্মিলা। দস্তরখোয়ানকে বোধহয় ক্ষেত্রবিশেষে দুটো অর্থেই ব্যবহার করা যায়।
DeleteKi darun likhechho.. itihas jeno chokher samne uthe esechhe... ar chhobigulo tato bhalo hoechhe... lekha ar chhobi milie barbar porte ichhe korchhe ei sesh khandotuku... khabar dabarer kotha to chherei dilam... tobe boro lobhonio laglo Lucknow sahor... dekhi kakhono jaoa hoe othe kina...
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, ইচ্ছাডানা। লখনৌ নিশ্চয় করে ঘুরে যাবেন, ভালো লাগবেই লাগবে।
DeleteWazir Ali Khan er kotha ami jantam na. Onek dhonyobad Lucknow er itihas-er ei bidrohi nawab -er shonge porichoy koriye deoar jonyo. Tarpor aro ektu ghanttte-ghantte bicharpoti Davis -er lekha out of print boitar shondhan paoa gyalo. Apni nischoi dekhechhen, tobu ar ek bar link ta post kore dilam, abantor er onyo pathhok der shubidharthe:
ReplyDeletehttps://archive.org/details/vizieralikhanorm00davi
iti
Shuteertho
অবান্তরের সকলের তরফ থেকে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, সুতীর্থ, লিংকটা দেওয়ার জন্য। ওয়াজির আলির কথা আমিও জানতাম না। ভাবুন, একটা টিনএজার ছেলের কত সাহস ছিল সে সময়।
DeleteSeriously, eto bhalo lekho ki kore bolo to ? Anthony bourdain Porte parle lajja pabe.
ReplyDeleteহাহা রুচিরা, ভাগ্যিস পড়তে পারেন না, পারলে তোমার এই কমেন্টটা দেখে অক্কা পেতেন, রুচিরা। লেখা ভালো লেগেছে জেনে খুশি। অনেক ধন্যবাদ।
DeleteJedin ami Luknou (mone rakhben, feluda sobuj khatai likhle ei banan tai likhten) jabo, sedin mone thakbe jeno duto tunde ar tinte dastarkhon ei kheye aschi...tate vulvulaiya bad geleu apotti nei. Ar prothombar ami apnar cheye ekiti boi age pore felechi vebe nijeke Arsalan er Biryani treat ta dite ichhe korlo..Gone Girl amar jothesto valo legechilo..emon ki cinema tau bes ga chomchome.
ReplyDeleteহাহা, অর্ণব, গন গার্ল আমারও দিব্যি লাগছে। আমি অবশ্য বেশি দূর পৌঁছইনি এখনও। বইটা পড়া হয়নি বলে সিনেমাটাও দেখতে পারছি না। তুমি লখনৌ গেলে টুণ্ডে আর দস্তরখোয়ানে তো খেওই, ভুলভুলাইয়াটাও বাদ দিও না, পস্তাবে না।
DeleteIss first part duto miss hoye gechhe.. darao abar porte hobe!! erokom bhabe keu jodi pathyo boi er Itihas likhto, tahole amio letter marks petam! :Papiya
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ, পাপিয়া।
Deleteashadharan likhecho Kuntala...jemon itihasher katha sherakam khabarer barnona...shab mile mishe ekebare jome kheer... Tourism corpus-er upor kaj karar shamay thekei Lucknow jaoyar icche baro probal hoyechilo...biriyani, nargisi kofta eishaber akarshane,,,tomar lekhata pore she icche abar probal holo
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, দেবশ্রী। লখনৌ ঘুরে এস, জলদি।
Deleteটেরিফিক লেখা হয়েছে। আমি সেলফ স্টাইল্ড বিরিয়ানিভক্ত (যদিও আমার ভোটটা হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানির দিকেই) ইতিহাস আর পাতিহাঁসের মেলবন্ধন একেবারে বাসমতী আর চাঁঁপের টুকরোর মিশেলের মতো হয়েছে। কুর্ণিশ
ReplyDeleteহাহা, থ্যাংক ইউ, সৌরাংশু।
DeleteKuntala di .... Lucknow er itihash er description ta gaa k(n)ata deoar moto likhecho ..... ami 2006 e gachilam Lucknow erom kom somoyer jonnoi, khub nostalgic laaglo. Ebar deshe firle nischoi abar jabo okhane ... r khaoar bornona sune amar 6 din er byangachir o jubhe jol chole elo :D
ReplyDeleteআহা রে, ব্যাঙাচি ব্যাঙাচি কোরো না, শুভব্রত, এবার ছানার একটা নাম দাও। এই চরম ব্যস্ত সময়েও তুমি অবান্তর পড়ছ এবং কমেন্ট করছ দেখে যারপরনাই পুলকিত হচ্ছি। থ্যাংক ইউ।
Deletehistory part ta beshi bhalo, na biryani part ta beshi bhalo bola mushkil. durdanto hoyeche. ar kichu na hok, shudhu khawar lobhei lucknow chole jawa jaye.
ReplyDeleteamar suggestion ta kaje lagiyecho dekhe khub khushi hoyechi. :)
তোমার সাজেসশনটা ভয়ানক কাজের, কুহেলি। থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ। লখনৌয়ের লেখা পড়তে ভালো লেগেছে জেনে খুশি হলাম।
DeleteEi post ta aami Lunch er aagey porlam. #JustSaying
ReplyDeleteহাহা, তন্ময়, আশা করি খিদেটা চাগিয়েছিল।
Deleteআমার কমেন্টটা কাল আসেনি দেখছি!
ReplyDeleteযাই হোক, দুর্দান্ত, অনবদ্য, অসাধারণ লাগলো। :)
ধন্যবাদ, ধন্যবাদ, অরিজিত।
Deletetomar next boi howa uchit bhromon kahini with generous sprinkling of local food, naki duto different project e korbe seta? bhishon sundor lekha gota lucknow bhromon. - Bratati.
ReplyDeleteহাহা, বলছ, ব্রততী? মাথায় রাখলাম তবে।
Deleteআপনার এই তিন পর্বকে গাইডবুক বানিয়ে লখনৌ ঘুরে এলাম। দুঃখের বিষয় মাঝপথে শরীরটা এমন বেগড়বাঁই করলো যে ঠিকমতো ঘোরা আর ঠিকমতো খাওয়া, কোনোটাই হলোনা। আফসোস।
ReplyDeleteতবে তার আগে বেনারস গেছিলাম। একটা জ্যান্ত মিউজিয়াম। অবশ্যই ঘুরে আসবেন বেনারস।
এহে, লখনৌ গিয়ে শরীর খারাপটা খুব দুর্ভাগ্যজনক, বৈজয়ন্তী। বেনারস ভালো লেগেছে শুনে খুশি হলাম। আমি ছোটবেলায় বাবামায়ের সঙ্গে গিয়েছিলাম একবার, আরেকবার যাওয়ার সময় এসে গেছে।
Deleteআমি কমেন্ট করিনি এ পোস্টে আগে ভেবেই অবাক লাগছে । লখনৌ ঘুরে এলাম হুড়ুম দুড়ুম করে আর তোমার ব্লগ ভয়ানক সাহায্য করেছে, তোমার দস্তরখোয়ানের গলৌটি কাবাব আর চিকেন কালিমির্চ পাওনা রইলো ।
ReplyDeleteদুটো কথা - আর কখনো লখনৌ গেলে লাল্লা তে যেও না , অতি বাজে বিরিয়ানি । আর দস্তরখোয়ান রাস্তার দুপাড়ের দুটোই , মানে একই মালিক । খেতে বসে জেনেছি :)
আরে দারুণ তো, প্রদীপ্ত। ভালো লাগল লখনৌ? ওকে, নো লাল্লা তাহলে।
Deleteহ্যাঁ দারুণ লেগেছে । তোমার ব্লগটা পড়েই কিন্তু যাবার ইচ্ছে হয়েছিলো। যে যে জায়গা গুলো ঘুরে এসেছো তার এমন চমৎকার বর্ননা দাও যে ওগুলো যেতেই হবে লিস্ট এ ঢুকে যায় :)
Deleteএ লেখাটার জন্যনাবার একবার থ্যাংকু ^_^