দোলের মিল
“কী পরে যাব বল তো?”
ল্যাপটপের পাওয়ার কর্ড
গোছাতে গোছাতে আমার হাত থেমে গেল। গলাটা তো অর্চিষ্মানের মতোই শোনাচ্ছে। মুখের
দিকে তাকিয়ে দেখলাম, হ্যাঁ, সেখানেও তো কোনও অমিল নেই। সেই চোখ সেই নাক সেই মুখ
সেই কপাল। আবার প্রশ্নটা এল। এবার খানিকটা তাড়া সহযোগে।
“কী গো?”
অর্চিষ্মান, আমার এক বছর দশ
মাসের বিবাহিত সঙ্গী, তার আগের তিন বছর সাত মাসের প্রেমিক, সব মিলিয়ে পাঁচ বছর
পাঁচ মাস সময়কাল ধরে এই দুনিয়ায় আমার ঘনিষ্ঠতম মানুষ আমাকে জিজ্ঞাসা করছে অফিসে সে
কোন জামাটা পরে যাবে।
পাঁচ বছর পাঁচ মাসে এই
প্রথম।
আমার আর অর্চিষ্মানের অনেক
জরুরি মিলের একটা হচ্ছে পরাপরি নিয়ে আমাদের দুজনের টেনশনের অভাব। আমাদের জীবনে অবান্তর
টেনশনের অভাব নেই। বারান্দার দরজা দেওয়া হয়েছে কি না, গিজারের সুইচ নেভানো হয়েছে
কি না, রাতে কোন দোকান থেকে অর্ডার করা হবে, বাড়িওয়ালাকে কে ভাড়া দিতে যাবে। কিন্তু
অফিসে/শপিং মলে/রেস্টোর্যান্ট/সিনেমা হলে কোন জামাটা পরে যাওয়া হবে এই টেনশনটা গত
পাঁচ বছর পাঁচ মাসে আমাদের কখনও হয়নি। পরিষ্কার এবং ঘরে পরার নয়, এ দুটো শর্ত পূরণ
করতে পারলেই আমরা সে সব জামা পরে বেরিয়ে পড়ি।
শুনলাম অর্চিষ্মানের অফিসে
হোলি খেলা হবে। তাই এমন কিছু পরে যাওয়াটাই সমীচীন যেটা নোংরা হলেও কোনও ক্ষতি নেই।
অর্চিষ্মান আর আমার অনেক
জরুরি মিলের আর একটা মিল হল আমাদের দুজনের ‘অবস্থা-ব্যবস্থা’ লিস্টের মিল। বাঁ
দিকে নানারকম সম্ভাব্য অবস্থা, ডান দিকে সে সব অবস্থা অনুযায়ী ব্যবস্থা। গুরুজন
দেখলে প্রণাম কর, ছোট শিশু দেখলে জিজ্ঞাসা কর বড় হয়ে সে কী হতে চায়, বস্ লিফটের সামনে
দাঁড়িয়ে আছেন দেখলে পাঁচতলা সিঁড়ি ভেঙে ওঠ।
সে তালিকায় অফিসের পাশে
লেখা আছে নিয়মিত উপস্থিতি, ঘাড় গুঁজে কাজ, কাজ শেষ হলে ঊর্ধ্বশ্বাসে অকুস্থল
ত্যাগ। হুড়োহুড়ি করে হোলি খেলার কথা কোথাও লেখা নেই।
কিন্তু আমাদের দু’জনের
সবথেকে বড় মিল হচ্ছে পরিস্থিতি বুঝলে অবস্থা-ব্যবস্থার এই তালিকাটাকে কাঁচকলা
দেখাতেও আমাদের বিন্দুমাত্র বিবেকে বাধে না। অফিসের গোটা টিম যদি হোলি খেলতে রাজি হয়
তব “নিকুচি করেছে টিম বিল্ডিং-এর’ বলে মনের ভাব স্পষ্টাস্পষ্টি জানিয়ে দুমদুমিয়ে
বেরিয়ে আসার মতো শিরদাঁড়া আমাদের কারওরই নেই।
কাজেই অফিস বেরোনোর আগে
জামা বাছার খাতে প’নে দুই সেকেন্ডের জায়গায় প’নে দু’মিনিট খরচা করতে হল।
আমাদের দু’জনেরই মোটের ওপর অপছন্দ এমন একটা জামা। অফিসের উৎসাহীদের দাবি মেনে সে
জামার রং সাদা, তার ওপর আবার একখানা অফিসসুলভ কলারও আছে। সব মিলিয়ে জ্যাকপট।
অর্চিষ্মান সেটা পরে হোলি খেলতে অফিসে চলে গেল।
দিনের শেষে চ্যাটবাক্সে খোঁচা
দিলাম। কেমন লাগল? শুনলাম রং মাখামাখির অংশটুকু ঠিকই আছে, ভুলভাল হয়েছে রং মাখামাখির
পর খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারটা। খেলার শেষে গুজিয়া খাওয়ার প্রস্তাব শুনে প্রথমটা একটু
অবাক হলেও অর্চিষ্মান উৎসাহের সঙ্গে গুজিয়ার পক্ষে ভোট দিয়েছিল। তারপর খাওয়ার সময়
বেচারার চক্ষুস্থির।
অর্চিষ্মান আশা করেছিল এই।
অর্চিষ্মানের কপালে জুটেছে
এই।
দুটি ছবিরই উৎস গুগল ইমেজেস।
আমি চ্যাটবাক্সে যতখানি গা-জ্বালানি হাসি হাসা সম্ভব ততখানি হাসলাম। বাড়ি এসে অর্চিষ্মান বলল, “এই জামাটা তুলে রেখে দিও। পরের বছর আবার হোলির দিন এটা পরেই অফিস যাওয়া যাবে’খন।”
আর অমনি আমার বাবার দোলের
জামাটার কথা মনে পড়ে গেল। বাটিক ছাপ হাফ হাতা শার্ট। সেটা পরে দোলের দিন সকাল
এগারোটা নাগাদ বাবা “কিছু আনতে হবে?” বলে হাওয়ায় একখানা হাঁক ছাড়তেন। সংসারে
সবসময়েই কিছু না কিছু আনার থাকে, এই ব্যাপারটা তখন আমার অবিশ্বাস্য লাগত, এখন চক্ষুকর্ণের
বিবাদভঞ্জন হয়েছে। মা দৌড়ে এসে একখানা লিস্ট বাবাকে দিতেন, বাবা লিস্ট পকেটে পুরে
সাইকেল চেপে বাজারের দিকে রওনা দিতেন। সাড়ে বারোটা নাগাদ গা মাথা জামা ভর্তি রং
নিয়ে এসে সাইকেলের হ্যান্ডেল থেকে ব্যাগ ছাড়াতে ছাড়াতে অভিযোগের সুরে বলতেন, “বাচ্চাকাচ্চারা
সব দিয়ে দিল। তারপর আবার বাজারেও ওরা সব খেলছিল, আজকের দিনে না তো করা যায় না।”
ভাবখানা যেন বাবার মনে না করার দারুণ ইচ্ছে ছিল, নেহাত ভদ্রতা করে করতে পারলেন না।
অর্চিষ্মানের হোলির জামা
কাচার জামাকাপড়ের বান্ডিলে রাখতে রাখতে আমি ভাবলাম, শুধু আমার আর অর্চিষ্মানের নয়,
আমাদের সবার জীবনেই কী মিল। একশো বছরের একের চার ভাগ কেটে গেছে, তবু কিছু কিছু
জিনিস থেমে আছে অবিকল একই জায়গায়। সেটা হতাশার না আশ্বাসের সেটা আমি অনেক ভেবেও
স্থির করতে পারলাম না।
সেই অনিশ্চয়তা মগজে নিয়েই
আপনাদের সবাইকে দোলের বিলম্বিত শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। হ্যাপি হোলি।
tomar lekhata bhalo laglo.. Tobe ei dol/holi tar sathe ami thik identify korte parina.. Doler rong e chemical thakto bole baba r strict nishedhagga chhilo sokalbelay holi khelar byapare... Amader dol hoto bikel bela.. Sobar khela sesh hole baba ma o tader bondhubandhob mile 8-10 ta family tader anda bachha niye karor ekta chhade jomayet hoto.. Sekhane abir niye khela.. tar sathe ekta harmonium niye porer por gan r tar fanke chhade stove jaliye rannabanna..Sob miliye sesh hote hote rat 2 to beje jeto... Mone achhey amar madhyamik porikkhar dudin age holi chhilo..Ami jothariti ma baba r sathe holite present.. Sebar amar porikkhar jonya concession diye rattir 1 ta holi celebration sesh kora hoyechhilo.
ReplyDeleteবাঃ, এ তো চমৎকার দোলখেলা, চুপকথা। এমন দোলের জন্য মাধ্যমিককে বুড়ো আঙুল দেখানোই উচিত। ছাদে স্টোভ জ্বালিয়ে রান্নাবান্নার ব্যাপারটা শুনলেই মন ভালো হয়ে যায়।
Deleteki sundor kore je tumi lekho, oti sadharon ghotona gulo-o kemon asamanyo smriti hoe othe..chhotobelar dingulor katha mone pore jay..
ReplyDeleteachchha second gujiya tao to besh bhalo, tai gondogol ta kothay thik bujhlam na..in fact amar oitai beshi bhalo lage karon prothom option ta boddo beshi mishti mone hoy.. tomader ki case ta ulto? Bratati.
আসলে এই গুজিয়ার পক্ষপাতিত্ব একেবারেই নস্ট্যালজিয়ার ব্যাপার, ব্রততী। একটা গুজিয়া ছোটবেলায় খেতাম, অন্যটা খেতাম না, ব্যস। লেখাটা তোমার ভালো লেগেছে জেনে খুব খুশি হলাম। থ্যাংক ইউ।
DeleteHappy holi Kunti.. ( aj school er namei daklam.) Ar Archisman keo happy holi... Dol khela toh college life er por e chere diyechi....ei byapare ami obolilai team building ke kachkola dekhai.... Rong mekhe bhut petni sajte probol apotti amar... Emnitei jothesto rokomer petni ami.... Nirdosh ekta abir er tip lagale apotti kori na khub ekta..
ReplyDeleteGujiya ta aj o amader barite khub procholito khabar... Tuktuk er jor nirdesh ache ofc theke bari dhokar somoi hate kono khadyo niye dhukte hobe... Roj kinder joy ar dairy milk na kine majhe majhei gujiya niye dhuki... Tobe obossoi prothom ta...
হাহা, নামটা এখনও তোর মনে আছে, ভট্টা? গুড গুড। টুকটুকের কথা শুনে আমার নিজের কথা মনে পড়ে গেল। আমিও মা ফিরলে প্রথম কথা বলতাম, "কী এনেছ মা?" সে ট্র্যাডিশন সমানে চলছে দেখে ভালো লাগল। তোর সেই মুহূর্তের চেহারাটাও কল্পনা করতে পারছি, এবং সেটা মোটেই পেত্নীর মতো দেখাচ্ছে না।
Deleteআমিও তোমাদের বিলম্বিত শুভ দোল বলছি।
ReplyDeleteদোলের জন্য জামা খোঁজা বড্ড নস্টালজিক হয়ে প্রথমেই একরাশ রং মাখিয়ে দিল। অর্চিষ্মানের চাওয়া এবং পাওয়া গুজিয়া এই লেখার সবচেয়ে মজার অংশ। হাসতে হাসতেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, হবেনা কেন, দিল্লীর ভূত যে সব। কিন্তু এরম না হলে আমরা হাসতাম কি করে বলো?
জগতের তাবৎ বাবার অ্যাটিটিউড এত একরকম হয় কি করে? দোলের দিন বাজার যেতেই হবে, মা একটা লিস্টি ধরাবে, একটা সাদা জামা পরে বাজার গিয়ে রঙে ভূত হয়ে বাড়ি ফিরবে। বাবারা পারতোও বাবা ।
লেখাটা মনের মধ্যে দোলের মজা ছড়িয়ে দিয়ে গেল/
সেটাই তো মালবিকা, কিছু কিছু জিনিস কখনও বদলায় না। বিশেষ করে বাবামা'রা। লেখাটা আপনার ভালো লেগেছে জেনে আমারও খুব ভালো লাগল।
Deletechaoya/paoya gujjiya r chobi gulo dekhe khub haashi pelo. eastern UP te gobor diye lyapa unoon ke gawja boley. amar maa'r kache shunechilam je biye r por maa r erokom chaoya paoya mismatch hoyechilo :)
ReplyDeleteগোবর লেপা উনুনের নাম গজা? লোকে পারেও বটে, শম্পা।
DeleteGota poschimbongobasir madhyamik porikkha ses hole holi pore.. ar tara sadh mitiye holi khele.. ek matro amarai ovaga chilam jader holir poreu porikkha chilo.. ei dukkho ghochate college er 4 bochor e 3 din dhore holi khele tar sodh niyechi..
ReplyDeleteবেশ করেছ, অর্ণব। মনের সাধ অপূর্ণ রাখতে নেই।
DeleteHoli/Dol kheleta ghototoro opochhondo! Gujiya khaota totodhik pochhondo!
ReplyDeletebelated happy holi Kuntala di. nanan karone timely comment kora hoy na, mail e post gulo dhokar sathe sathei pore feli jodio. gujiya niye confusion jekono Bangalir pokkhei osavabik noy. amaro age chilo.
ReplyDeletear roj apish jawar age jama bachte amar motamuti dosh minute somoy lage je somoy ta ami almari khule just haa kore dariye thaki, mental calculation cholte thake. :D
তোমাকেও আমার তরফ থেকে অনেক শুভেচ্ছা জানাই, কুহেলি।
Deletee baba tomra tere naam dekhoni..okhane ei rakam obangali gujiya ache..hehe besh hoeche
ReplyDelete