আসাম ২/ পবনের পিঠে




বেশি সময় থাকলে যেমনতেমন করে খরচ করা যায়। খানিকটা সময় এদিকে ফেললাম, খানিকটা ওদিকে, খানিকটা জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইলাম, খানিকটা ভোঁসভোঁস করে ঘুমোলাম। কিন্তু কাজিরাঙ্গায় আমরা থাকব কুড়ি ঘণ্টার সামান্য কম সময়, কাজেই বুঝেশুনে, প্রায়োরিটি অনুযায়ী সে সময়টুকু খরচ করতে হবে।

কাজিরাঙ্গায় আমাদের এক নম্বর প্রায়োরিটি কী? গণ্ডার দেখা। দু'নম্বর প্রায়োরিটিও একটা আছে। সেটা হচ্ছে হাতিকুলি বাগানের চা আর গোলমরিচ কেনা। কাজিরাঙ্গা যে জেলায়, সেই গোলাঘাটেই অর্চিষ্মানের অফিসের শইকিয়ার বাড়ি। আসাম যাব স্থির করার পর থেকেই অর্চিষ্মান শইকিয়ার কাছে টিপসের জন্য ঘোরাঘুরি করছিলতিনিই বলেছিলেন হাতিকুলির বাগানের চা আর গোলমরিচ দারুণ নামকরা। তিনি আরও বলেছিলেন, যে হাতিকুলি এস্টেটের রিটেল আউটলেট আমরা যে স্টপেজে নামব তার সামান্য আগেই পড়বে, আমরা চাইলে বাস দাঁড় করিয়ে কেনাকেটা সেরে নিতে পারি। তাতে অর্চিষ্মান খুব চমকে গিয়ে বলেছিল, পাবলিক বাস দাঁড় করিয়ে আমি চা কিনতে যাব সে কীরকম? তাতে শইকিয়া আরও অবাক হয়ে বলেছিলেন, আরে সেটাই তো যুক্তিযুক্ত, পথেই পড়ছে যখন। তারপর বলেছিলেন, কোই কুছ নেহি বোলেগা।

এখন আমরা নিশ্চিত কেউ কিছুই বলত না। কিন্তু এইরকমের কিছু করলে বা করার প্রস্তাবটুকুও দিলে কলকাতা বা দিল্লিতে খুন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকত, কাজেই আমরা সে চেষ্টা করিনি। গণ্ডার দেখে যদি টাইম থাকে চা কেনা হবে, নয়তো নয়।

কাজেই কাজিরাঙ্গায় আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য গণ্ডার দেখা, অর্থাৎ সাফারি। সাফারি দু'ভাবে করা যায়। হাতির পিঠে কিংবা জিপে। আমাদের হাতে যেটুকু সময় তাতে যে কোনও একভাবে করা সম্ভব। হয় হাতি নয় জিপ।

এবার আমার আর অর্চিষ্মানের মধ্যে একটা মতদ্বৈত দেখা গেল। আমার ইচ্ছে জিপ, ওর ইচ্ছে হাতি। অর্চিষ্মানের যুক্তি সোজা। জিপে আগেও চড়েছি, পরেও চড়ব। হাতির পিঠে চড়ার সুযোগ আর কোনওদিন পাওয়া যাবে কী না কে জানে। আমার অনিচ্ছের একটা কারণ হচ্ছে, আমার থেকে কম বলশালী (দেহের বল নয়, ক্ষমতার বল) কিছু পেলেই সেটার ওপর চড়ে বসতে হবে সেটা মেনে নিতে আমার বিবেকে বাধে। আর দ্বিতীয় কারণটা হচ্ছে ঝুঁকি। মনমগজওয়ালা জিনিসের ওপর ভরসা আমার চিরদিনই কম। বলা যায় না, গণ্ডারের সামনে গিয়ে যদি বিগড়ে যায়? প্রতিহিংসায় নয়, হয়তো মশকরা করার জন্যই গণ্ডারের সামনে গিয়ে পিঠটা সামান্য ঝাঁকুনি দিয়ে আমাদের ফেলে দিল। তখন? কলকবজাও অবশ্য বিগড়োতে পারে। মাবাবা আমাকে ফেলে যখন কাজিরাঙ্গায় সাফারি করতে গিয়েছিলেন তখন নাকি তাঁদের সামনের জিপের স্টার্ট বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আর সেই সুযোগে নাকি নাকি গণ্ডার এসে জিপের গায়ে গা চুলকেছিল। কাজেই জিপে সাফারি করতে যাওয়াও নিরাপদ নয়। কিন্তু তবু আমার মতে মনের থেকে কলকবজা অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য। বিগড়োনোর চান্স ঢের কম।

এইসব যুক্তি দেওয়ায় অর্চিষ্মান এমনভাবে আমার দিকে তাকাল যে বুঝলাম যে এগুলো ধোপে টিকবে না। কাজেই হাতিতে চড়াই সাব্যস্ত হল।

কিন্তু হাতিতে চড়ব বলেই চড়া যায় না। কারণ সেই আদিঅকৃত্রিম ইকনমিক্স। চাহিদা জোগানের ভারসাম্যহীনতা। হাতি কম, মানুষ বেশি। অরণ্য গেস্টহাউসের বাইরে হাতির পিঠে চড়ার জন্য লাইন দিয়ে টিকিট কাটার ব্যবস্থা আছে। তবে সেটা সবার জন্য নয়। যাদের ডলার আছে তাঁদের ওই লাইনে দাঁড়াতে হবে না। যাঁদের ডলার নেই, কিন্তু মামাদাদা আছে তাঁরাও নিস্তার পাবেন। যাঁদের দুটোর কোনওটাই নেই, যেমন আমরা, তাঁদের জন্য ওই লাইন। গেস্টহাউস থেকে বলে দিয়েছিল সন্ধ্যে সাতটায় কাউন্টার খুলবে, আগেভাগে গিয়ে লাইন দিতে হবে, তবে টিকিট পাওয়ার কোনও গ্যারান্টি নেই। বিকেল পাঁচটার সময় অকুস্থলে পৌঁছে দেখলাম কিছু লোক অলরেডি লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মধ্যে তিনজনের একটি পরিবার, বাকি সবাই অল্পবয়স্ক ছেলেমেয়ে। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম বন্ধুরা মিলে বেড়াতে এসেছে বুঝি। তারপর জানা গেল যে এরা সবাই স্থানীয়। টাকা নিয়ে হাতির টিকিট কেটে দেয়। দুপুর আড়াইটে থেকে লাইন দিয়ে বসে থাকে রোজ। পার হেড চারটি করে টিকিট।

ক্রমে ভিড় বাড়ল। কেউ কেউ পুলিশের সঙ্গে এসে লাইন ভেঙে ঢুকলেন। ঝগড়া হল (সেটা প্রধানত আমিই করলাম কিন্তু তাতে কিছুই কাজ হল না।)

যাই হোক, সব বাধাবিপত্তি কাটিয়ে টিকিট আমরা পেলাম। টিকিট পাওয়াতেই টেনশনের শেষ নয় অবশ্য। হাতি সাফারির তিনটে ট্রিপ হয়। ভোর পাঁচটা কুড়িতে একটা, ছটা কুড়িতে আরেকটা, সাতটা কুড়িতে শেষেরটা। এই আঁকড়াআঁকড়ির পরিস্থিতিতে টাইম বাছার সুযোগ নেই। মানে যারা লাইন ছাড়া টিকিট কেটেছেন তাঁদের হয়তো আছে, আমাদের নেই। গেস্টহাউস থেকে হাতি-চড়া পয়েন্ট তিন কিলোমিটার দূরে। পাঁচটা কুড়ির সাফারির টিকিট পাওয়া মানে ঘুম থেকে উঠতে হবে ভোর চারটে। নাম ডাকা হল, দুরুদুরু বুকে কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়ালাম। উল্টোদিকের ভদ্রলোক খসখস করে কুপন লিখলেন, টাকা নিলেন। কুপনটা হাতে নিয়ে রামনাম জপতে জপতে টাইম স্লটের দিকে তাকিয়ে দেখি লেখা আছে, 7:20 AM.

জয় বাবা হাতিনাথ।

সকালের আলোয় হাতিকুলি চা বাগান

ততক্ষণে ঘোর অন্ধকার নেমে এসেছে। কোথাও যাওয়ার সুযোগ নেই। শক্তিও না। অর্চিষ্মান আটচল্লিশ ঘণ্টা ওপর জেগে আছে। তবু আমরা ঠিক করলাম গেস্টহাউসে ফিরে যাওয়ার আগে একবার ওই চাবাগানের মধ্য দিয়ে রাস্তাটা দিয়ে একবার হেঁটে আসি। যখন এসেছিলাম তখন ডানদিকে ডুবন্ত সূর্যের আলো ছিল, এখন বাঁ দিকে চা বাগানের মাথায় শুক্লপক্ষের চাঁদ উঠেছে। সমান করে মাঠের মতো ছাঁটা বাগানের মাঝে মাঝে হিলহিলে গাছ। তাদের কোনও কোনওটার গায়ে ঘন লতা পেঁচিয়ে উঠেছে। চাঁদের আলোয় তাদেরকে দিব্যি গলায় মাফলার জড়ানো ভূত বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। হাঁটতে হাঁটতে বড় রাস্তা পর্যন্ত গিয়ে আবার অ্যাবাউট টার্ন নিয়ে গেস্টহাউসে ফিরে এলাম। ডাইনিং রুমে গরম হাতেগড়া রুটি, বাটার দেওয়া ডাল ফ্রাই, মিক্সড ভেজিটেবল আর আলুভাজা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। খেয়ে এসে বিছানায় গা ঢালতেই ঘুম।

সকালের আলোয় অরণ্য গেস্টহাউসের রাইনো কটেজ

কটেজের বারান্দায় কুন্তলা

সকালবেলা হাফ ছুটে হাফ হেঁটে যখন হাতি রাইডিং পয়েন্টে পৌঁছলাম তখনও আগের ট্রিপ শেষ করে হাতির দল ফেরেনি। কাজেই একটু ছবিটবি তোলা হল। আশেপাশে অপেক্ষারত কেউ কেউ বুদ্ধি করে বাইনোকুলার এনেছিলেন, তাঁরা সেগুলো চোখে লাগিয়ে যেদিকে যেদিকে তাকিয়ে রাইনো রাইনো” চেঁচাচ্ছিলেন, আমরা সেদিকে সেদিকে তাকিয়ে ঘাড় উঁচু করে, চোখ সরু করে গণ্ডার দেখার চেষ্টা করছিলাম। ঘাসের বনের মধ্যে একটা ধূসর বিন্দু। মাঝে মাঝে জেগে উঠছে, খানিকটা ভেসে ভেসে যাচ্ছে, আবার ডুবে যাচ্ছে।

উফ্‌ বাবা, মা, তাড়াতাড়ি চল, সব কলা শেষ হয়ে গেল। এই বুড়োহাবড়াদের নিয়ে...(এই অংশটুকু মনে মনে)


এইসময় হাতিরা আগের ট্রিপ থেকে ফিরে এল আর আমরাও দূরের গণ্ডার ছেড়ে তাদের দিকে মনোযোগ দিলাম। হাতির থেকেও মজার হচ্ছে হাতির ছানাপোনারা। আমি আমার সারাজীবনে মাত্র দুতিনবার মায়ের অফিসে গেছি, কিন্তু এরা রোজ তিনবার করে মাবাবার অফিসে যায়। ভয়ানক ব্যস্ত মুখে, শুঁড়টুড় নেড়ে সামনে সামনে হাঁটে। পিঠের বোঝা নামিয়ে বড়রা যখন পেছনের জলায় জল খেতে যায় তখন মানুষদের সঙ্গে মেলামেশা করে। বয়স কম বলেই মানুষের প্রতি ঘৃণাটা কম বোধহয়। অসম্ভব সপ্রতিভ ভাবে সোজা এসে মানুষের জটলায় ঢুকে যায়। আমাদের মতো নিড়বিড়েরা বাবাগো বলে দৌড়ে পালায় কিন্তু সাহসীরা দাঁড়িয়ে থাকে, ছানার মাথায় হাত বোলায়। আমি প্রথমে ভাবছিলাম দেখো, কেমন সামাজিক ছানা, মানুষের আদর পাওয়ার জন্য কেমন কাঙাল। পরক্ষণেই ভুল ভাঙল। কয়েকজন বুদ্ধিমান মানুষ ব্যাগ থেকে কাঁঠালি কলার ছড়া বার করেছেন। ছানারা বাকি সবাইকে ঠেলা মেরে সরিয়ে সেদিকে দৌড়ে গেল।  সোৎসাহে কলাগুলো প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে মুখে পুরেই শুঁড় তুলে মানুষটার হাতে খোঁচা মারতে লাগল। ভঙ্গিটা হচ্ছে, দাদা আরও কিছু ছাড়ুন। নোংরা হাত আমার মাথায় মুছতে দিলাম কি এটুকুর জন্য?

হাতির পিঠে কীভাবে চড়া হবে সেই নিয়ে আমার একটা চাপা আগ্রহ ছিল। হাতি কি পা মুড়ে বসবে? নাকি আমরা মই বেয়ে উঠব? তারপর দেখলাম অত হাঙ্গামার কিছু নেই। হাতির পিঠের উচ্চতার মাপে ওয়াচটাওয়ার বানানো হয়েছে। হাতি টাওয়ারের পাশে এসে দাঁড়াবে, আমরা টুক করে উঠে পড়ব।


উঠে পড়লাম। আমাদের হাতির নাম পবন। আমাদের মাহুতের নাম জামশেদ। এই হচ্ছে আমাদের গ্রুপ ছবি। বাঁ থেকে ডানদিকে যথাক্রমে পবন, জামশেদ, কুন্তলা, অর্চিষ্মান।

দুলে দুলে চলা শুরু হল। প্রথমটা দুলুনিতে ভয় লাগে, মিনিট দুয়েক পরে সয়ে যায়। আশেপাশে অন্যান্য হাতিরাও হেলেদুলে চলছিল। পেটুক হাতিরা চলতে চলতে ক্রমাগত এদিকওদিক থেকে ছোট ছোট গাছ ছিঁড়ে মুখে পুরছিল। আমাদের পবনের দেখলাম খাওয়ায় অত রুচি নেই। ক্রমে দুপাশের ঘাস বেড়ে উঠে আমাদের জুতোর সোল ছুঁয়ে ফেলল। গণ্ডার দেখার জন্য এই ঘাসজমিই আদর্শ।


গণ্ডার!

গণ্ডারের সঙ্গে গ্রুপফোটোতে আমরা

আরেকটা গণ্ডার!

'হয়েছে? ছবি তোলা? যত্ত সব" বলে রাগ করে গণ্ডার চলে যাচ্ছেন




হরিং! হরিং! এরা আবার খোলা জায়গায় থাকতে পছন্দ করে, তাতে বাঘমামা কোনদিক দিয়ে আসছেন দেখার সুবিধে হয়। জামশেদজী এইসব হরিণদের কুষ্ঠিঠিকুজি যত্ন করে বলেছিলেন আমাদের, কিন্তু তখন আমরা গণ্ডারের স্মৃতিতে আবিষ্ট হয়েছিলাম, কাজেই সে সব ভুলে মেরে দিয়েছি। শুধু অলরেডি জানা তথ্যগুলোই মনে আছে। একটা দলে একটা পুরুষ আর অনেক মহিলা হরিণ থাকে। পুরুষদের শিং হয়, মহিলাদের হয় না। একপ্রজাতির পুরুষ হরিণদের বারোটা করে শিং গজায়। একটা সময়ের পর সেটা খসে পড়ে যায় তখন আবার নতুন করে শিং গজায়। নতুন গজানো শিং-এর চারপাশে একটা পাতলা লোমের আবরণ থাকে, ক্রমে ক্রমে সেগুলো ঝরে গিয়ে ব্যাপারটা একটা কেঠো চেহারা নেয়।


গণ্ডার আর সহনশীলতা ছাড়াও আসাম বিখ্যাত তার পাখির জন্য। কতরকম যে পাখি। শহরে কেমন জানি না, তবে শহরের বাইরে সারাদিন কানে পাখির ডাক বাজতে থাকে। অনেক পাখিপ্রেমিকরা পাখি দেখার জন্যই আসামের অনেক জলাজঙ্গলে আসেন। পাখি দেখার জন্য উপযোগী অঞ্চলও আছে আসামে। কিন্তু সেসব জায়গায় না গিয়েও বিস্তর পাখি এমনিই দেখা যায়।

আমাদের কাজিরাঙ্গার সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছিল। আমাদের খুব ইচ্ছে ছিল হাতি থেকে নেমে যদি ঝট করে একটা জিপ সাফারি সেরে নেওয়া যায়। কিন্তু সে সময় আর সত্যিই ছিল না। ফেরার পথে ডানদিকে বেঁকে হাতিকুলি চা বাগানের রিটেল আউটলেট থেকে এক প্যাকেট গ্রিন আরেক প্যাকেট ব্ল্যাক টি কিনে গেস্টহাউসে ফিরে এলাম। আমাদের কাজিরাঙ্গা ভ্রমণ ফুরোল।

*****

ভাবছেন এত তাড়া কীসের? তাড়া এই জন্য যে এর পর আমরা যেখানে যাব সেখানে যখনতখন যাওয়া যায় না। সেখানে যেতে গেলে নদী পেরোতে হয়। আর যে ফেরিতে করে নদী পেরোতে হয় সেটাও ছাড়ে ঘণ্টায় একটা করে, শেষ ফেরি ছাড়ে বিকেল চারটেয়।

আমরা যাব মাজুলি। পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম নদী-দ্বীপ। সেখানে যেতে হলে আমাদের প্রথমে যেতে হবে জোড়হাট। জোড়হাট যাওয়াটা কোনও সমস্যা নয়। কোহোরা মোড় দিয়ে লক্ষ লক্ষ বাস, মিনিবাস যাচ্ছে, তাদের একটাতে চড়ে বসলেই হবে। আমরা লটবহর নিয়ে মোড়ে গিয়ে দাঁড়ালাম। অচিরেই বাস এসে গেল। বাইরে থেকে দেখে মনে হচ্ছে সিট নেই, কিন্তু কন্ডাকটর নেমে এসে জানালেন দুজনের জায়গা হয় যাবে। কিন্তু নিজেরা উঠলেই তো হবে না, আমাদের দু'খানা ক্যারি-অন সুটকেসেরও তো জায়গা হতে হবে। হবে হবে, তাদেরও জায়গা হবে। আসামের বাসে কারও জায়গা হবে না এমন হতেই পারে না। পেছনের ঢাকনা উঠে গেল। পেছনের সিটে মাথা কুঁকড়েমুকড়ে একজন বসে ছিলেন, তাঁর পায়ের কাছে একটা চটের মস্ত ব্যাগ। কন্ডাকটর বললেন, ব্যাগ হাতে নাও। তিনি বিনাবাক্যব্যয়ে ব্যাগ হাতে তুলে নিলেন। আমাদের সুটকেস ঢুকে গেল। তার ওপর চটের ব্যাগ চাপল।

আমরা বাসে বসে জোড়হাটের দিকে চললাম। রাস্তার দুপাশে প্রচুর স্কুল। বুনিয়াদি, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক। দুপুরবেলা স্কুল ছুটি হয়েছে, সোনালি রঙের মেখলার ওপর সাদা চাদর জড়িয়ে মেয়েরা বাড়ি ফিরছে। পথে আই এন টি ইউ সি-র অফিসের সামনে দেখলাম সেই মেখলার রঙের এক ভূপেন হাজারিকার প্রায় দু'মানুষ সমান মূর্তি। জোড়হাট আই এস বি টি এসে গেল। এখান থেকে আমাদের যেতে হবে নিমাতী ঘাট, সেখান থেকে ধরতে হবে মাজুলির ফেরি। আই এস বি টি থেকে অটো রিজার্ভ করে ঘাট পর্যন্ত নিয়ে গেলে ভাড়া আড়াইশো আর তা না করে যদি আমরা আই এস বি টি থেকে শাটল অটো নিয়ে জোড়হাট শহরের কেন্দ্রে যাই তাহলে দশ দশ করে দুজনের ভাড়া কুড়ি, আর সেখান থেকে আবার শাটল অটো নিয়ে ঘাট পর্যন্ত গেলে তিরিশ তিরিশ করে দুজনের ভাড়া ষাট। সব মিলিয়ে আশি। সস্তায় ঘোরার থিম বজায় রেখে আমরা শাটল অটো নিলাম।

ঘাট এসে গেল। তিনটের ফেরি দাঁড়িয়ে আছে। ফেরির সওয়ারিরা ভয়ানক বৈচিত্র্যপূর্ণ। মানুষ, মোটরবাইক, এস ইউ ভি। আমি একবার লালগোলা প্যাসেঞ্জারে একটি প্রকাণ্ড পাঁঠার পাশের সিটে বসে যাত্রা করেছিলাম, আমার বৈচিত্র্যের দৌড় ওইখানেই শেষ। অর্চিষ্মান বাংলাদেশে এইরকম ফেরি চেপে পদ্মা পার হয়েছে। ও বলছিল লোকে নাকি গাড়ির মধ্যেও বসে থাকে। আমি প্রথমটা শুনে বিশ্বাস করিনি। তারপর দেখলাম মাজুলির ফেরির এস ইউ ভি-র ভেতরেও জনা পাঁচেক লোক বসে আছেন। শুধু বসে নেই, সিট পেছনে হেলিয়ে চোখ বুজে ঘুমিয়েও নিচ্ছেন।

ফেরি ছেড়ে দিল। ঘাটের গা ঘেঁষে বোল্ডার গড়িয়ে ফেলে ভাঙা পাড় বাঁধ দেওয়া হচ্ছে। ক্রমে সে সব মুছে গিয়ে চোখের সামনে খালি জল, জঙ্গল আর আকাশ পড়ে রইল। জানালা দিয়ে তাদের দেখতে দেখতে আমরা ব্রহ্মপুত্রের বুকে ভেসে চললাম।



*****

কাজিরাঙ্গা গেস্ট হাউসে ফেরার পর রিসেপশনের ভদ্রলোক ভদ্রতা করে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আমরা গণ্ডার দেখতে পেয়েছি কি না। তাতে আমি বললাম, দেখেছি মানে? প্রায় হ্যান্ডশেক করেছি। গণ্ডার রীতিমত থেমে আমাদের চোখে চোখ ফেলে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিল। ভদ্রলোক বললেন, ভেরি গুড ভেরি গুড। আমি বললাম, কেন যে লোকে মিথ্যে ভয় পায়, কী শান্ত চোখ, কী ভদ্র ব্যবহার। ভদ্রলোক একটু অনিশ্চিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি বললাম, কাজিরাঙ্গার গণ্ডাররা বোধহয় অ্যাটাকট্যাটাক করে না, তাই না? ভদ্রলোক বললেন, এমনিতে করে না তবে হাথি কে দাঁত লম্বা হোনে সে ডর যাতা হ্যায়, তব অ্যাটাক কর সকতা হ্যায়।

এই আমাদের পবন। জামশেদজী খুব গর্ব করে বলেছিলেন, গোটা সাফারির হাতিদের মধ্যে পবনের মতো সুন্দর দাঁত নাকি আর কোনও হাতির নেই।

                                                                                                             (চলবে)



Comments

  1. ভারি মনোরম গন্ডারময় লেখা । এক গণ্ডা (+১) গণ্ডারের ছবি এবং ক্যাপশন গুলিও দারুণ হয়েছে ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, কমেন্টটাও তো গণ্ডারের মতোই ভালো হয়েছে, সত্রাজিৎ। থ্যাংক ইউ।

      Delete
  2. darun laglo !!!gandar er sange group photota khub bhalo hoyeche :) tinni

    ReplyDelete
    Replies
    1. গণ্ডারকে গ্রুপফোটো তুলতে কেমন রাজি করিয়েছি বল, তিন্নি?

      Delete
  3. খুবই মনোরম বর্ণনা। পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
    ইসে, ঘাটের নাম নিমাতি, নেমতি নয়।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওহ, থ্যাংক ইউ, দেবাশিস।

      Delete
    2. কেউ কেউ নেয়ামগ/নিয়ামত ঘাটও বলে থাকেন

      Delete
    3. correction নেয়ামত not নেয়ামগ। sorry for the inconvenience

      Delete
    4. কেউ কেউ নেয়ামত / নিয়ামত ঘাটও বলে থাকেন।

      Delete
  4. Haati safari niye bhaloi korecho ... height ta bhalo. Ar besh dule dule aste aste jaye. Jeep safari te boddo tarahuro kore ... tachara jeep er noise level jongol ghora ekkebare maati kore deye.
    Chobiguli khub shundor.
    Ar shesh er punch ta oshadharon ... bhaggish daanter golpo ta agey shononi. :-)

    ReplyDelete
    Replies
    1. এটা ঠিকই বলেছ, শর্মিলা। হাইটটা বেশ সুবিধেজনক। তাছাড়া জিপে তো চাইলেই ঘোরা যায়, হাতি আর পাচ্ছি কোথায়।

      Delete
  5. Gondar to dekhlen, akhon daku gondariya ke dekhle i hoi.

    ReplyDelete
    Replies
    1. হা হা, যা বলেছেন, ঘনাদা।

      Delete
  6. ema,majulir galpo gulo koi..aar oi feri theke bramhaputra nodir ar kota chobi dao na..
    prosenjit

    ReplyDelete
    Replies
    1. মাজুলি পরের পর্বে আসছে, প্রসেনজিৎ।

      Delete
  7. protyek ta chhobir caption bhari chomotkar hoyeche. tar modhye cottager barandaye kuntala ta amar sobchaite pochondo hoyeche. Kajiranga nischoi chomotkar jayega, but tomar lekhar gune aro beshi bhalo mone hocche.
    assam er bus passenger ra tale bus thamiye bajar haat o korte jaye. besh besh. 'ebar ki bari theke passenger deke niye asbi?' - ei jonopriyo line ta bodhoy assam er kotha vebei kono ak somoy chalu hoyechilo. ke bolte pare.
    ending ta akdom fatafati hoyeche. tumi bhromonkahini'r boi lekho Kuntala di.

    ReplyDelete
    Replies
    1. oh ami shurute vebechilam Kajiranga giye tumi Paban namer kono loker dokane giye khub famous pithe puli kheyecho.

      Delete
    2. হাহাহা, এইটা ভালো ভেবেছিলে, কুহেলি। খুবই যুক্তিযুক্ত।

      সিরিয়াসলি। ওই বাড়ি থেকে প্যাসেঞ্জার তুলে আনার রসিকতাটার প্রায় বাস্তব রূপান্তর দেখলাম। মানে লোকজন কমপ্লিটলি উল্টোদিকে যাবে, কিন্তু কন্ডাকটর ঝুলোঝুলি করছে। সেটা না হয় তবু মানলাম, কিন্তু গোটা প্রক্রিয়াটায় কোনওপক্ষ, যাত্রী, কন্ডাকটর, অলরেডি বাসে বসে থাকা যাত্রীরা- মেজাজ হারাচ্ছে না কেন, সেটা আমার মতো বদমেজাজি লোকের মাথায় কিছুতেই ঢুকছিল না।

      Delete
  8. ha ha , darun monorom lekha ....kichu niye ghy6an ghyan na korata sob chaite bere lage ...hain kichu lok subidhe pay, onyoay ki korbo kadar theke line e dariye ticket kete cha bagan ghora bhalo (y) -PB

    ReplyDelete
    Replies
    1. সেটা আমিও বিশ্বাস করি, প্রদীপ্তা। হাতিতে চড়া এমন কিছু মহার্ঘ নয় যে লাইনে দাঁড়িয়ে ঝগড়া করতে হবে। তার থেকে এমনি রাস্তায় ঘোরা ভালো। যদিও আমি নিজে ঠিক উল্টোটাই করি। আজন্মের জ্ঞানপাপী।

      Delete
  9. "গণ্ডারের সঙ্গে গ্রুপফোটোতে আমরা" eta darun hoechhe ... ami lekha pore r chhobi dekhe bhabchhi erpor kothai berate jabo

    ReplyDelete
    Replies
    1. কোথায় যাবেন ঠিক করলে জানাবেন কিন্তু, ইচ্ছাডানা।

      Delete
  10. chhobi r bornona duii khub sundor. Bratati.

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ, ব্রততী।

      Delete
  11. বললে বিশ্বাস করবে ক্কিনা জানিনা কুন্তলা, মানে আমি নিজের চোখ কেই বিশ্বাস করতে পারছিনা!!
    আমিও ডিসেম্বর এর শেষে কাজিরাঙ্গা ও মানস ঘুরে গন্ডার দের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে এলাম !

    মানে আরেকটু হলেই তোমার সঙ্গেও হ্যান্ডশেক করতে পারতাম, ইশশ :(

    তোমার পরামর্শ মত হুমাযুনস টুম্ব ও দেখে এসেছি, সত্যি অপূর্ব লেগেছে, বিশেষ করে চূড়ায় নীল কারুকাজ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. বাঃ বাঃ, হুমায়ুনের সমাধি ভালো লেগেছে জেনে খুব খুশি হলাম, কাকলি। তোমরা তো এবার গ্র্যান্ড ইন্ডিয়া ট্রিপ করলে! সত্যি কাজিরাঙ্গাটা একটা দারুণ সমাপতন।

      Delete
  12. আপনার লেখার নামটা দেখে এক মুহুর্তের জন্য ভেবেছিলাম পবন নামের কোনো পিঠে বানানেওয়ালার দোকানের পিঠে খেয়ে তার সুখ্যাতি করবেন এবার। ছবিগুলো খুব সুন্দর হয়েছে, বিশেষ করে গ্রুপ ফটোটা।

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, থ্যাংক ইউ, সুগত।

      Delete

Post a Comment