এ মাসের বই/ এপ্রিল ২০১৬/ প্রথম পর্ব



The Little Stranger/ Sarah Waters


উৎস গুগল ইমেজেস

একটা চমৎকার দৃশ্য দিয়ে গল্প শুরু করেছেন সারা ওয়াটারস। এলাকার বিখ্যাত বাড়ি হান্ড্রেডস-এর মাঠে মেলা বসেছে। গ্রামের সব লোক ঝেঁটিয়ে এসেছে। বালক ফ্যারাডেও এসেছে মায়ের সঙ্গে। হান্ড্রেডস-এর কর্তা কর্নেল আয়রেস দৃপ্ত ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের পারদর্শিতার পুরস্কার হিসেবে মেডেল দিচ্ছেন  লেডি আয়রেস। পড়াশোনায় ভালো ফ্যারাডেও লাইনে দাঁড়িয়ে সে মেডেল নিচ্ছে। সোনারোদে ঝলমল করছে হান্ড্রেডস-এর বিরাট প্রাসাদ। তার খোলা দামি, ভারি কাঠের দরজা জানালায় বাঁধা রঙিন ফিতে জানান দিচ্ছে মাঠে অবাধ বিচরণের সুযোগ থাকলেও তার ভেতরে ঢোকার অধিকার কারও নেই।

কিন্তু ফ্যারাডের আছে। কারণ তার মা হান্ড্রেডস-এর প্রাক্তন পার্লারমেড। মেলার শেষে ফ্যারাডের সব বন্ধু যখন মাঠ থেকে ফিরে গেছে, মায়ের সহকর্মীদের ষড়যন্ত্রে চুপিচুপি পেছনের দরজা দিয়ে ফ্যারাডে তার মায়ের সঙ্গে হান্ড্রেডস-এর রান্নাঘরে ঢুকে আসে। মা পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করেন আর অন্ধকার রান্নাঘরের বিরাট টেবিলে বসে ফ্যারাডে মেলার জন্য বানানো মিষ্টি খায়। তারপর সবার নজর যখন কোনও কারণে অন্যদিকে সরে গেছে, চুপিচুপি সে চাকরদের অঞ্চল ছেড়ে মূল বাড়িতে ঢুকে আসে। পকেট থেকে পকেটনাইফ বার করে হান্ড্রেডস-এর দেওয়াল থেকে একটি প্লাস্টারের অলঙ্করণ উপড়ে, পকেটে পুরে বাড়ি ফিরে যায়।

তারপর টেমস দিয়ে অনেক জল বয়ে যায়। ইংল্যান্ডের বিশ্বশাসকের মুঠো শিথিল হচ্ছে। (ইন ফ্যাক্ট, যে বছরে লিটল স্ট্রেঞ্জার-এর ঘটনাগুলো ঘটছে, সেটা উনিশশো সাতচল্লিশ, আমরা স্বাধীন হচ্ছি।) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে, কৃচ্ছ্রসাধনের বোঝায় দেশ ধুঁকছে। বংশগরিমা আর সম্পদের গর্বে যারা সমাজের মাথায় চেপে বসে ছিল, তারাও গায়েও আঁচ এসে লাগছে। সোজা কথায়, ‘ব্রিডিং’ ধুয়ে আর জল খাওয়া যাচ্ছে না। ফ্যারাডে বালক থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছেন, ডাক্তারি শিখে আবার পুরোনো গ্রামেই ফিরে এসেছেন। তিনিও খানিক হতাশই বলা চলে। ওয়ার্কিং ক্লাসের চক্রব্যূহ ভেঙে বেরিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তাতে মোক্ষলাভ কিছু হয়নি। প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছেও অকৃতদার রয়ে গেছেন, পসারও যে খুব জমেছে তেমন নয়।

এমন সময় একটা ঘটনা ঘটে গেল। পারিবারিক ডাক্তারের অনুপস্থিতিতে হান্ড্রেডস-এর একমাত্র কাজের মেয়ে ‘বেটি’র চিকিৎসার জন্য তাঁর ডাক পড়ল। সেই মেলার দিনের উত্তেজনা বুকে নিয়ে ফ্যারাডে গেলেন হান্ড্রেডস-এ। গিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তাঁর শৈশবের অবসেশন, অচিনপুরী হান্ড্রেডস ধুঁকছে। ভেঙে পড়েছে। সময় লক্ষ লক্ষ বালক ফ্যারাডের রূপ ধরে এসে পকেটনাইফ দিয়ে খুঁড়ে তুলে নিয়ে গেছে হান্ড্রেডস-এর সমস্ত অলংকার, সাজ, দর্প। তার ধ্বংসস্তুপের মধ্যে ভূতের মত ঘুরে বেড়াচ্ছেন দারিদ্র্যকবলিত মিসেস আয়রেস, তাঁর ছেলে রডরিক আর মেয়ে ক্যাথরিন, বেটি আর ক্যাথরিনের পোষা কুকুর জিপ।

চিকিৎসা করতে গিয়ে ডক্টর ফ্যারাডে বুঝলেন বেটি-র আসলে কোনও অসুখ হয়নি। বেটি অসুখের ভান করছে। ডক্টর ফ্যারাডে যখন সে কথাটা ধরে ফেললেন বেটি কেঁদে ফেলল। বলল, ওর এ বাড়িতে থাকতে ভয় করে। অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে, দীর্ঘ করিডর বেয়ে চলাচল করতে আর ওই লাইব্রেরিটা, ওর বুকশেলফের ফাঁকে ফাঁকের অন্ধকারগুলো, ওর পুরোনো পোকায় কাটা হলুদ কাগজের সোঁদা গন্ধওয়ালা ওই লাইব্রেরিটা পরিষ্কার করতে। এ বাড়িতে খুব খারাপ কিছু একটা আছে, বেটি জানায় ডাক্তারকে।

হান্ড্রেডস হাউসে সত্যি খারাপ কিছু আছে কি না, নাকি সবই বেটি-র চোদ্দ বছরের মনের কল্পনা সেটা জানতে হলে আপনাদের বইটা পড়তে হবে। ডক্টর ফ্যারাডে আসার পরে পরেই হান্ড্রেডস-এ যে সব অদ্ভুত, ভূতুড়ে ঘটনা ঘটতে শুরু করে সেগুলোর জন্য কোনও শয়তান অশরীরী শক্তি দায়ী (বেটির বিশ্বাস) নাকি সবগুলোরই একটা সরল যুক্তিগ্রাহ্য বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা আছে ((ডক্টর ফ্যারাডের মত) সেটা জানতে হলেও।

দ্য লিটল স্ট্রেঞ্জার নিয়ে আলোচনা দুটো রাস্তায় করা যায়। গল্পে এভিল-এর উপস্থিতি, এলিট শ্রেণীর পতন ইত্যাদি গুরুতর থিমের উপস্থিতি নিয়ে। কিংবা ভূতের গল্প হিসেবে এর সার্থকতা নিয়ে। আমি কোন রাস্তাটা নেব সেটা নিয়ে আপনাদের নিশ্চয় সন্দেহ নেই।

দ্য লিটল স্ট্রেঞ্জার একেবারে জাত ভূতের গল্প। মাঝে মাঝে বিশ্বাস হয় না এটা লেখা হয়েছে এই সেদিন, দুহাজার নয় সালে। সারা ওয়াটারস-এর ভাষা একেবারেই সেকেলে নয়। কিন্তু গায়ে কাঁটা দেওয়ানোর ধরণটা সেকেলে। আধুনিক জাপানি সিনেমার মতো এখানে টিভি থেকে ভূত সশরীরে বেরিয়ে আসে না, বরং বিরাট প্রাসাদের কোণে কোণে ঘাপটি মেরে থাকে, ধরাছোঁয়ার বাইরে। রাতের অন্ধকারে তাদের পায়ের শব্দ পাওয়া যায়, দীর্ঘ শূন্য করিডরে তারা হেঁটে বেড়ায়। অ্যালগারনন ব্ল্যাকউড, হেনরি জেমস, এইচ পি লাভক্রাফট, এডগার অ্যালান পো ইত্যাদি বাঘা বাঘা ভৌতিক লেখকের অবদান জোরগলায় স্বীকার করেছেন।

দ্য লিটল স্ট্রেঞ্জার-এর আরও একটা জিনিস আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। গল্পের একেবারে শেষ পর্যন্ত একটা সাসপেন্স টেনে নিয়ে গেছেন ওয়াটারস। মানে আমি অন্তত বুঝতে পারছিলাম না যে দোষী আসলে কে, ভূত না মানুষ। কারণ হান্ড্রেডস-এ গোলমাল পাকানোর মোটিভ ভূত ছাড়াও আরও অনেকের ছিল। হান্ড্রেডস আর হান্ড্রেডস-এর আশেপাশের বিস্তীর্ণ জমি গিলে খেতে চাওয়া রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার ছিল, বাড়ির সদস্যদের প্রচ্ছন্ন উন্মাদনার ইতিহাস ছিল, ক্যাথরিনের সব মায়ার বাধন কাটিয়ে মুক্তির ইচ্ছে ছিল, আর ডক্টর ফ্যারাডের শৈশবলালিত অবসেশন তো ছিলই।

শেষপর্যন্ত দোষী কে বেরোলো, ভূত না মানুষ, সেটা জানতে গেলে আপনাদের বইটা পড়ে দেখতে হবে।

*****

Midnight in the Garden of Good and Evil: A Savannah Story/John Berendt

উৎস গুগল ইমেজেস

এমনিই খুনখারাপির গল্প মানুষের ভালো লাগে, সে খুনখারাপি যদি সত্য ঘটনা অবলম্বনে হয় তা হলে তো সোনায় সোহাগা। আমাদের চেনা এই ধরণের সাহিত্যের উদাহরণ হল আরুশি তলওয়ারের খুনের ঘটনা নিয়ে লেখা অভিরূক সেনের ‘আরুশি’। অবশ্য ইরফান খান, কঙ্কণা সেনশর্মা অভিনীত ‘তলওয়ার’ সিনেমাটাও ট্রু ক্রাইম শিল্পের উদাহরণ।

বিশ্ববিখ্যাত ট্রু ক্রাইম লিটারেচারের যে কোনও লিস্টের দুই বা তিন নম্বরে যে বইটার নাম থাকবে, সেই বইটা আমি এমাসে পড়লাম। জন বেরেন্ডট-এরMidnight in the Garden of Good and Evil: A Savannah Story। বইটার কথায় যাওয়ার আগে ক্রাইমটার কথা বলে নেওয়া যাক। জেমস আর্থার উইলিয়ামস ছিলেন জর্জিয়া রাজ্যের সাভানা শহরের একজন অত্যন্ত সফল অ্যান্টিক ডিলার এবং হাউস রেস্টোরার। সাভানা অত্যন্ত প্রাচীন শহর এবং সেই প্রাচীন শহরে রেস্টোর করার মতো প্রাসাদের অভাব ছিল না, এবং জিম উইলিয়ামস অচিরেই নিজেকে সে কাজে সফল প্রমাণ করেছিলেন। উনিশশো ঊনসত্তর সালে জিম উইলিয়ামস ‘মার্সার হাউস’ নামে একটি অব্যবহৃত পুরোনো অট্টালিকা কেনেন, এবং রেস্টোর করে বেচে দেওয়ার বদলে নিজেই থাকতে শুরু করেন। একাই। উনিশশো একাশি সালের দোসরা মে, গভীর রাতে ওই মার্সার হাউসের একটি ঘরে একান্ন বছরের জিম উইলিয়ামস তাঁর অ্যানটিক ব্যবসার কর্মচারী এবং নিজের যৌন সঙ্গী একুশ বছরের যুবক ড্যানি হ্যান্সফোর্ডকে গুলি করে মারেন। উইলিয়ামস দাবি করেন ঘটনাটি আত্মরক্ষামূলক। ড্যানি তাঁর দিকে প্রথমে গুলি চালায়, ড্যানিকে তিনি না মারলে ড্যানি তাঁকে মেরে ফেলত। জিমের বন্দুকটির সঙ্গে সঙ্গে সত্যিই পুলিশ অফিসাররা ড্যানির মৃতদেহের ঠিক পাশে আরেকটি বন্দুক (সেটাও জিম উইলিয়ামসের বন্দুক। জিম উইলিয়ামস নিজের বাড়িতে একাধিক বন্দুক রাখতেন এবং বিশ্বশুদ্ধু লোক সে কথা জানত) আবিষ্কার করে। সেই বন্দুকটা থেকেই যে গুলি ছোঁড়া হয়েছে জিম উইলিয়ামস ঘটনার সময় যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন (অ্যাট লিস্ট, যেখান থেকে তিনি ড্যানিকে গুলি করেছিলেন) সেদিকে গুলি ছোঁড়া হয়েছে তার প্রমাণও পাওয়া যায়।

জিম উইলিয়ামসকে পুলিস গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেল। বিচার হল। ড্যানি হ্যান্সফোর্ডের এলাকায় যা পরিচিতি ছিল, তাতে আত্মরক্ষার জন্য উইলিয়ামসের গুলি চালানোর দাবিটা খুব একটা অবিশ্বাস্য ছিল না, কিন্তু কয়েকটা সামান্য ডিটেলের উপস্থিতি, বা অনুপস্থিতি, জিম উইলিয়ামসকে প্যাঁচে ফেলে দিল। ড্যানির বন্ধুদের সাক্ষ্য, ড্যানির মৃতদেহের পড়ার ভঙ্গি ইত্যাদি। নির বন্ধুরাও ড্যানির মতোই ছিল, তাদের সাক্ষ্য খুব একটা অসুবিধে করতে পারত না। জিম উইলিয়ামসকে প্যাঁচে ফেলল আরেকটা ছোট্ট ডিটেল। বা ডিটেলের অনুপস্থিতি। ড্যানি হ্যান্সফোর্ডের হাতে, জামায়, শরীরের কোথাও গানপাউডারের চিহ্নমাত্র ছিল না।

জর্জিয়া রাজ্যে জিম উইলিয়ামস প্রথম ব্যক্তি একই অপরাধের জন্য চারবার যাঁর ট্রায়াল হয়। উনিশশো বিরাশি সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রথমবার জিম উইলিয়ামস খুনের দায়ে যাবজ্জীবন সাজা পান এবং পুনর্বিচারের জন্য আবেদন করেন। এর মধ্যে উইলিয়ামসের উকিলের কাছে নতুন তথ্যপ্রমাণ এসে জড়ো হয় এবং আগের রায় বানচাল হয়ে যায়। দ্বিতীয়বার ট্রায়াল শুরু হয়, জিম উইলিয়ামস আবার সাজা পান। আবার নতুন প্রমাণ আসে। তৃতীয়বার ট্রায়াল শুরু হয়। এবার যেটা হয় সেটা প্রায় টুয়েলভ অ্যাংরি ম্যান-এর গল্পের মতো। বারো জন জুরির মধ্যে এগারো জন জিমের অপরাধ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া সত্ত্বেও একজন মহিলা জুরির অনমনীয়তায় ট্রায়ালটি মিসট্রায়াল হিসেবে গণ্য হয়।

এই সব কাণ্ড হচ্ছিল সাভানাতেই। জিমের উকিলদের সেটা গোড়া থেকেই পছন্দ হচ্ছিল না। তাঁরা গোড়া থেকে কলরব করে আসছিলেন যে ড্যানি বদমাশ হোক, লুচ্চা হোক, লুম্পেন হোক, প্রমিসকিউইয়াস প্রস্টিটিউট হোক, তবু সে হচ্ছে সাভানার সন অফ দ্য সয়েল, কাজেই এ শহরে জিম উইলিয়ামসের নিরপেক্ষ বিচার সম্ভব নয়। অবশেষে তাঁদের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ল। ড্যানির হত্যার আট বছর পর চতুর্থ ট্রায়াল শুরু হল সাভানায় নয়, অগস্টায়। জুরি একঘণ্টার মধ্যে ফিরে এসে রায় দিল, জিম উইলিয়ামস নির্দোষ।

সসম্মানে ছাড়া পাওয়ার ছ’মাস পর জিম উইলিয়ামস, মাত্র ঊনষাট বছর বয়সে, তাঁর সাভানার মার্সার হাউসে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। সেই ঘরে, যে ঘরে ন’বছর আগে তিনি ড্যানিকে আত্মরক্ষার্থে গুলি করে মেরেছিলেন। মিডনাইট-এর লেখক বেরেন্ডট দাবি করেছেন, ন’বছর আগে ড্যানির গুলি যদি সত্যি সত্যি জিম উইলিয়ামসের গায়ে বিঁধত, তাহলে তিনি ঘরের ঠিক যে জায়গাটায় পড়ে মরতেন, হার্ট অ্যাটাকটাও নাকি হয়েছিল অবিকলসেই স্পটে। তবে বেরেন্ডট সেটা সাহিত্যের খাতিরে রং চড়িয়েছিলেন কিনা সে সম্বন্ধে আমার সন্দেহ রয়েই যাচ্ছে।

এবার গল্পে আসা যাক। গল্পের লেখক জন বেরেন্ডট নিউ ইয়র্কে সাংবাদিকতা করতেন, কিন্তু সিটির গোলযোগ থেকে বাঁচতে তিনি সাভানা বেড়াতে যান এবং পত্রপাঠ সাভানার প্রেমে পড়ে যান। তালেগোলে জিম উইলিয়ামসের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বও হয়। গোটা দশ বছর তিনি সাভানার জীবনযাত্রার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে ছিলেন। সেই সময়েই জিম উইলিয়ামস এবং ড্যানি হ্যান্সফোর্ডের চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি ঘটে। একদিক থেকে দেখতে গেলে মিডনাইট বেরেন্ডট-এর সাভানা বাসের স্মৃতিকথা। গোটা বইটি লেখা হয়েছে ছোট ছোট চ্যাপ্টারে। শুরুর দিকে বেশ কয়েকটি চ্যাপ্টারে সাভানার বিভিন্ন চরিত্রের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। বিচিত্র, বর্ণময় সব চরিত্র। একজন বুড়ো লোক আছেন তিনি সাভানার রাস্তায় রাস্তায় হাঁটেন, লোকজন আসছে দেখলে দাঁড়িয়ে তাদের অপেরার গান শোনান, আর মাঝে মাঝে পেছন দিকে তাকিয়ে একটি অদৃশ্য কুকুরকে বলেন পা চালিয়ে আসতে। চরিত্রগুলো এতই গল্পের মতো যে বেরেন্ডট তাদের সত্যি সত্যি সাভানায় দেখেছিলেন নাকি মন থেকে বানিয়ে লিখেছেন সন্দেহ জাগে। এই সব গল্পের মাঝে মাঝে জিম উইলিয়ামস-এর জীবনে ঘনিয়ে আসা ঝড়ের আভাস যে পাওয়া যায় না তা নয়, তবে তা ওই আভাসই। শেষদিকের ক’টি চ্যাপ্টারে লেখক সম্পূর্ণভাবে জিম উইলিয়ামস-এর ট্রায়ালের বর্ণনায় ডুব দেন। সেটা প্রত্যাশিত, কারণ ওই সময় উইলিয়ামসের বিচারের থেকে বেশি আলোচিত ঘটনা সাভানায় আর ছিল না।

মিডনাইট গল্পের ভালো আর মন্দ একে অপরের সঙ্গে এমন মেশামেশি হয়ে আছে যে আলাদা করে তাদের চিহ্নিত করা খুব মুশকিল। মানুষের চরিত্রের একই বৈশিষ্ট্য যেমন পরিস্থিতি ভেদে গুণ এবং দোষ হিসেবে পরিগণিত হতে পারে, মানে অংক না মেলা পর্যন্ত খাতা ছেড়ে না ওঠার গোঁয়ারতুমি যেমন প্রশংসনীয়, তেমন টিভি দেখা বা বড়দের কথা না শোনার ক্ষেত্রে সেই গোঁয়ারতুমিই মহা দোষ, মিডনাইট- বইয়েরও সেরকম ব্যাপার। লেখকের সাভানাবাসের মেমোয়ার হিসেবে যদি দেখতে যান তাহলে মিডনাইট চমৎকার। কিন্তু যদি নন-ফিকশনাল ক্রাইম উপন্যাসের ধ্বজাধারী হিসেবে একে প্রতিষ্ঠা করতে যান, তাহলে মুশকিল। তাহলে আপনার চোখে পড়বে একটা ঢিলে-বাঁধুনি উপন্যাস, যার শুরুর অর্ধেকটার শেষের অর্ধেকটার সঙ্গে যোগ প্রায় নেই। শুরুটা যেন ক্যারেকটার স্টাডিজ-এর সিরিজ, একেকটা চ্যাপটার যেন একেকটা ছোটগল্প। আর শেষের অর্ধেক যেন হুড়মুড়িয়ে বলা একখানা কোর্টরুম ড্রামা। 

জন বেরেন্ডট-এর লেখার হাত সুন্দর। ছবির মতো সাভানা দেখতে পাবেন আপনি। কল্পনাশক্তি বা ইমপালস বেশি হলে ভিটেমাটি তুলে সাভানায় গিয়ে তাঁবু ফেলার ইচ্ছেও আশ্চর্য নয়। 

ও হ্যাঁ, আর উনিশশো একাশির দোসরা মে রাত্তিরে সত্যি সত্যি কী ঘটেছিল, জিম উইলিয়ামস ড্যানি হ্যান্সফোর্ডের দিকে আত্মরক্ষার্থে গুলি চালিয়েছিলেন না ঠাণ্ডা মাথায় খুন করেছিলেন, সেটা চার নম্বর এবং শেষ ট্রায়াল শুরু হওয়ার আগে তিনি বেরেন্ডটকে বলে গিয়েছিলেন। সেই সত্যিটা জানতে হলে আপনাদের কী করতে হবে সেটা আমি আর বলছি না।

মিডনাইট নিয়ে লেখার শুরুতে বলেছিলাম বিশ্ববিখ্যাত ট্রু ক্রাইম সাহিত্যের লিস্টের দুই বা তিন নম্বরে এই বইয়ের নাম থাকবে। ওই লিস্টের এক নম্বরে যে বইটার নাম থাকবে সেই বইটাও আমি পড়েছি এই মাসেই, কিন্তু সেটা নিয়ে লেখার আমার এই মুহূর্তে ধৈর্য নেই, ওটা পার্ট টু-এর জন্য তোলা রইল।

                                                                                                                  (চলবে) 



Comments

  1. Emaser boi-er jonyo saramaas opekkkha kore thaki :) Khub bhalolaglo ei entry-ta pore.

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ, সায়ন। আরে এ মাসে লেখাই হচ্ছিল না বই নিয়ে। এদুটো বই ভালো লেগেছে নিঃসন্দেহে, কিন্তু আরও ভালো লেগেছে যে দুটো বই, তাদের কথা পরের পর্বে আসছে। আশা করি শিগগিরই।

      Delete

Post a Comment