পাওভাজি পোলাও



টিফিন খাচ্ছি সেই কবে থেকে, অথচ ব্যাপারটা নিয়ে জীবনে প্রথমবার তলিয়ে ভাবলাম এ’বছর জানুয়ারি মাসের শুরু নাগাদ। যখন নিয়মিত টিফিন নিয়ে স্কুলকলেজে যাওয়ার আমল ছিল, তখন টিফিনের ভাবনা, বাকি সব ভাবনার মতোই, মা ভাবতেন। অফিস যাওয়ার আগে রুটি তরকারি বানিয়ে বাক্সে পুরে দিতেন, পাছে রোজ একঘেয়ে খাবার খেয়ে আমার ট্রমা হয় তাই মাঝে মাঝে মুখ বদলে চাউমিন, সুজি, লুচিপরোটা ইত্যাদিও দিতেন। হয় সেগুলো বার্টার করে আমি বন্ধুর টিফিনের ফ্লুরোসেন্ট রঙের পেয়ারার জেলি মাখানো কাঁচা পাউরুটি খেতাম নয় বাড়ি ফিরে পেছনের জঙ্গলে ছুঁড়ে ফেলে দিতাম। ইউনিভার্সিটিতে মেস ছিল বা স্যান্ডঊইচের দোকান। আর এখন অফিসে ক্যান্টিন আছে। পঁয়ত্রিশ টাকায় আচার, শশা, কাঁচালংকা, ভাত, রুটি, ডাল, সবজি, মিঠাই। সাড়ে বারোটা বাজলেই আমি ক্যান্টিনের দিকে গুটি গুটি হাঁটি। আমার সহকর্মীরা নাক কুঁচকোয়। বলে, খাও কী করে রোজ রোজ ও জিনিস? একই ঝোলে একদিন কুমড়ো, একদিন আলুমটর, একদিন সয়াবিন, একদিন কপি? আমি সত্যি কথাটাই বলি। গরম গরম খেতে দিব্যি লাগে। ভ্যালু ফর মানি-র ব্যাপার তো আছেই। কিন্তু সবথেকে ভালো যেটা সেটা হচ্ছে ব্যাপারটার রুটিন। গেলেই খেতে পাওয়ার নিশ্চিন্তিটা। রোজ দুপুরে কী খাব কোথায় খাব নিয়ে যে মাথা ঘামাতে হয় না, আমার পক্ষে সেটাই যথেষ্ট। এ ব্যাপারে অর্চিষ্মানের আমার সঙ্গে মিল আছে। নিতান্ত দরকার না পড়লে ডিসিশন নেওয়া ওরও ঘোর অপছন্দের। কপালগুণে ওর অফিসেও ক্যান্টিন আছে। ও-ও সেখানেই খায়।


বা খেত। জন্ডিস হওয়ার আগে পর্যন্ত। জানুয়ারি মাসে জন্ডিস ধরা পড়ল, আর বোঝা গেল সামনের কটা মাস ও আর ওই তেলের ঝোল খেতে পারবে না। বাড়ি থেকে টিফিন নিতে হবে। টিফিনবাক্সটাক্স কিনে কোমর বেঁধে টিফিন বানানো শুরু হল। শুরুর দিকে বেশি পরীক্ষানিরীক্ষায় না গিয়ে রুটি তরকারি চালাতাম। তরকারিতে আর কতই বা বৈচিত্র্য আনা সম্ভব, সেই ঘুরিয়েফিরিয়ে আলু, ঢ্যাঁড়শ আর কপি। ওই এক জিনিস রাঁধতে রাঁধতে আর টিফিনবাক্সে পুরতে পুরতে আমি নিজেই বোরের হদ্দ হয়ে যাচ্ছিলাম। নতুন রেসিপি শিকারে বেরোতে হল। আর তখনই দেখা হয়ে গেল পাওভাজি পোলাওয়ের সঙ্গে।


যদিও জিনিসটার আসল নাম পাওভাজি পোলাও নয়। একে কেউ বলে তাওয়া পুলাও, কেউ বলে টমেটো পুলাও, কেউ বলে মুম্বাই কি মস্ত পুলাও। শেষের নামটার কারণ হচ্ছে মুম্বাইয়ের রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে যাঁরা মস্ত গোল লোহার তাওয়ায় খুন্তির ঠুং ঠাং সুর তুলতে তুলতে বিদ্যুৎবেগে স্যান্ডউইচ কিংবা পাওভাজি বানিয়ে ক্ষুধার্তের ক্ষিদে মেটান, পাওভাজির পাও বাদ দিয়ে ভাজির সঙ্গে সঙ্গে ভাত মিশিয়ে হাঁসজারু পদ তৈরি করার মচৎকার আইডিয়াটা তাঁদের মাথাতেই প্রথম এসেছিল।


এত নাম থাকতে আমি আবার সর্দারি করে রান্নাটার নতুন নাম দিতে গেলাম কেন? কারণ আমি রান্নাটা কড়াইয়ে রেঁধেছি, কাজেই একে তাওয়া পোলাও বলে চালানোর কোনও অধিকার আমার নেই। রুটি সেঁকার জন্য একখানা ছোট তাওয়া আছে আমার, কিন্তু তাতে ভাত রাঁধতে গেলে আমার রান্নাঘরের যা চেহারা হবে কহতব্য নয়। মুম্বাই পোলাওই বা বলি কী করে, দিল্লিতে বসে যখন রাঁধছি?  টমেটো অবশ্য দিয়েছি, কাজেই টমেটো পোলাও বলা যেত, কিন্তু সে যুক্তিতে ক্যাপসিকাম পোলাও-ও বলা যেত। কিংবা পেঁয়াজ পোলাও। একবার মাশরুম দিয়ে বানিয়েছিলাম, চমৎকার খেতে হয়েছিল, মাশরুম পোলাও বললেই বা আটকাচ্ছে কে। ইন্টারনেটে অনেককে কড়াইশুঁটি দিতে দেখেছি, কাজেই কড়াইশুঁটিরও অধিকার আছে এ পোলাওকে নিজের নামে চালানোর।


কিংবা নেই। কারণ এ পোলাওয়ে এরা কেউই অপরিহার্য নয়। আপনার ফ্রিজে থাকলে দেবেন, না থাকলে দেবেন না। কিচ্ছু যাবে আসবে না। কিন্তু যে জিনিসটা না দিলে এই পোলাওয়ের পরিচয় নিয়ে টানাটানি পড়বে সেটি হচ্ছে পাওভাজি মশলা। কাজেই।


রান্নার পোস্ট লেখার সবথেকে শক্ত জায়গাটা হচ্ছে রান্নাটা খেতে কেমন সেটা লেখা। টিভিতে কিষান জ্যাম না কীসের একটা বিজ্ঞাপন দেয়, তার ভাষাটা ধার করেই বলি,এ জিনিস টিফিনে দিলে টিফিনবাক্স খালি ফেরৎ আসা গ্যারান্টি।


পাওভাজি পোলাও

কী কী লাগবে

রান্নার তেলঃ এক চামচ
আলুঃ দুটো মাঝারি, সেদ্ধ করে কুচোনো।
পেঁয়াজঃ দুটো মাঝারি, কুচোনো 
আদারসুন বাটাঃ এক বড় চামচ
ক্যাপসিকামঃ দুটো মাঝারি, কুচোনো
টমেটোঃ দুটো মাঝারি, কুচোনো
কাঁচালংকাঃ দুটো, কুচোনো (পাওভাজি মশলায় যথেষ্ট ঝাল থাকে, কাজেই লংকা বুঝে দেবেন)
পাওভাজি মশলাঃ দুই বড় চামচ
ভাতঃ দু’কাপ 
নুনঃ স্বাদমতো
ধনেপাতাঃ ইচ্ছেমতো

কী করে করবেন

কড়াইয়ে তেল দিন। মাঝারি আঁচে গরম করুন। পেঁয়াজ ছাড়ুন। সামান্য নুন দিয়ে নাড়ুন চাড়ুন। বেশি ভাজার দরকার নেই। ঘামঘাম হলে আদারসুন বাটা দিয়ে মিনিটখানেক পর ক্যাপসিকাম দিন। নেড়েচেড়ে চাপা দিয়ে রান্না করুন। মাঝে মাঝে ঢাকনা তুলে নাড়ুন। কড়াইয়ে লেগে যাচ্ছে দেখলে জলের ছিটে দিন। ক্যাপসিকাম মোটামুটি নরম হলে টমেটো দিয়ে দিন। নেড়েচেড়ে আবার সামান্য নুন, পাওভাজি মশলা, কাঁচালংকা দিয়ে চাপা দিন। মাঝে মাঝে তুলে নাড়ুন। টমেটো একেবারে নরম হয়ে যাওয়া পর্যন্ত রান্না করুন। হয়ে গেলে আলু সেদ্ধ দিয়ে নেড়েচেড়ে ভাতটা দিয়ে দিন। এবার পুরো ব্যাপারটা গরম হতে যা সময়। ধনেপাতা দিয়ে, নুন চেখে গ্যাস নেভান।

গোটা রান্নাটা মাঝারি আঁচেই হবে। রাঁধতে রাঁধতে টিভি দেখতে গেলে আঁচ কমিয়ে যাবেন, বলাই বাহুল্য।

এই টিফিনবাক্সটা রিষড়া বাজার থেকে কেনা।



Comments

  1. এই থ্যাঙ্কু গো,আমার না রোজ রুটি তরকারি নয়তো পাঁউরুটি চিবোতে বিচ্ছিরি লাগে,এবার থেকে মাঝে সাঝে এটাও নিয়ে যাবো। আর এরকম রাইস কিন্ত সাউথ ইন্ডিয়ান ডিশেও পপুলার, লেমন রাইস বা টমাটো রাইস,খুব কম তেলমশলা লাগে,আর খেতেও দিব্য!

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ শাল্মলী। এইটা আবিষ্কার করার পর থেকে কত রকম রাইস যে দেখছি। লেমন রাইস, জিরা রাইস, টমেটো, ক্যাপসিকাম... লোকে যা পেয়েছে তা দিয়ে ভাত রেঁধে টিফিনে খাচ্ছে। এই পদগুলোর অস্তিত্ব সম্পর্কে আমি অবহিত ছিলাম, কিন্তু নিজে করে খাওয়ার কথা কখনও ভেবে দেখিনি, টিফিনে নিয়ে যাওয়া তো দূর অস্ত। তুমি বানিয়ে দেখো তো কেমন লাগে, আমাকে বোলো প্লিজ।

      Delete
    2. টমাটো রাইস আর লেমন রাইস আমি মাঝেমধ্যে বানাই,সঙ্গে রায়তা দিয়ে বেশ লাগে।

      Delete
  2. Khub bhalo post..ranna nischio aro bhalo.

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমাদের তো ভালোই লাগে খেতে, প্রিয়াঙ্কা।

      Delete
  3. Paobhaji moshla kine ante hocche dekchi. Tiffin niye jawa niye amar bariteo roj ak chot hoy. Ma ar vebe paye na ki debe. Goto dui soptaho kolkata te eisan gorom poreche je pet kharap r bhoye roj tiffine vije chire lebu ar chini mekhe teto pachon gelar moto mukh kore gilchi. ar majhe majhe Baba Ramdeb r daliya. Ar niyomito colleague r tiffin bakso te khamcha marchi. ebar ektu Paobhaji polao khele mondo hoy na.

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, বাবা রামদেব দালিয়াও বেচছেন বুঝি এখন? ভালো ভালো। কাকিমাকে এই পাওভাজি পোলাওয়ের আইডিয়াটা দিতে পারো, কুহেলি।

      Delete
    2. ha kuri takar ak packet daliya sarajeebon chole jabe atota kore thake. issh ami ajkeo chire gilechi. :'(

      Delete
  4. bah eita to bhat bhaja jinistar ekta notun songskoron.. besh bhalo idea.. onekdin pore recipe dile.. ekhono porjonto tomar mutton stew super hit no 1. lemon rice er recipe diyo to jodi bhalo lage tomar.. south e kheyechilam bhokti hoyni ..

    ReplyDelete
    Replies
    1. ঠিক বলেছিস, ঊর্মি। ভাতভাজারই রকম্ফের বটে। ভাতভাজা কথাটা কতদিন পর শুনলাম। লেমন রাইস আমারও বানানোর ইচ্ছে আছে। যদি পাতে দেওয়ার যোগ্য হয় তাহলে অবান্তরে লিখব।

      Delete
  5. বহু বছর আগে চাকা নিয়ে একখানা জম্পেশ লেখা নামিয়েছিলেন। এই রেসিপিটা পড়ে মনে হল আপনিও আস্তে আস্তে, স্লোলি বাট শিওরলি, চাকা হয়ে যাচ্ছেন।
    বেশ একটি করিৎকর্মা, নির্ভরযোগ্য, বিপত্তারিণি চাকা। চালিয়ে যান।
    আমি যে কবে চাকা উপাধি পাওয়ার যোগ্য হব!

    ReplyDelete
    Replies
    1. দেবাশিস, আমাকে চাকা বললে, খাঁটি চাকারা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাবেন। তবে চালিয়ে যাওয়ার উপদেশটা মনে ধরল। থ্যাংক ইউ।

      Delete
  6. Ei khan theke lemon rice banate paaro. Aami baniyechi besh bhalo hoyechhilo. https://www.youtube.com/watch?v=bNq4OPjUiic

    Aar ei vah vah chef er sathe tomar porichoy ache kina janina. Tabe enar recipe video guli machatkar. Dekhte paro. Pavbhaji rice try kore dekhbo, bu ek chamach teler ranna shunle nijei lege porbe. :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওয়াহশেফ হচ্ছেন গিয়ে আমার আর অর্চিষ্মানের অন্যতম ফেভারিট টাইমপাস। রেসিপির থেকেও ভদ্রলোককে দেখতে যেন বেশি মজা লাগে। আর হ্যাঁ, ওঁর কায়দায় আমি একবার মাটন বানিয়েছিলাম, মচৎকার হয়েছিল। লেমন রাইস নিশ্চয় ট্রাই করব। থ্যাংক ইউ।

      Delete
  7. Vah chef er kotha bola khub intesting. ..ranna gulo ami nije r moto improvise kore nei... na hole oi bish ingredients jogar korte hole 3 yrs lege jabe..

    ReplyDelete
    Replies
    1. ভদ্রলোক এমন অভিনয় করে করে রেসিপি বলেন, চোখমুখ ঘুরিয়ে, হাত নেড়ে, মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসে থাকতে হয়।

      Delete
  8. Lemon rice banale ager diner banano basi rice diye koro. Texture ta better asbe. R kokhono bisebele bath masala kine seta diyeo bhatbhaja kore dekhte paro. Karnataki der khub priyo khabar. Sukno nonta bonde diye khay. Ami Bangalore e college e porte giye abiskar korechhilam.

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ, চুপকথা। তোমার টিপগুলো নিশ্চয় কাজে লাগিয়ে দেখব।

      Delete
  9. আড়াই বছর লেট কিন্তু আজকে ডিনারে আমি পাওভাজি পোলাও বানিয়েছিলাম কুন্তলাদি। এ রেসিপি দেখেই মনে হয়েছিল হিট না হয়েই যায় না, হয়ও নি। থ্যাঙ্কু।

    ময়ূরী

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে তাই নাকি? ভেরি গুড। জানানোর জন্য অনেক ধন্যবাদ, ময়ূরী।

      Delete

Post a Comment