জয়জয়ন্তী



মুল গল্পঃ The Day It Rained Forever
লেখকঃ Ray Bradbury

*****

খাঁ খাঁ মাঠের মধ্যে বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। কাল থেকে সন্ধ্যে। গনগনে সূর্যের আলোয় পুড়ছে। পালাবে যে তার জো নেই, যতদূরে চোখ যায় দিগন্তরেখা ঘিরে আছে চক্রব্যূহের মতো। গাছপালাও একটা নেই যে তাপ শুষে নেবে। যা ছিল পুড়তে পুড়তে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। থাকার মধ্যে আছে একটা পথ। বাড়িটার সামনে দিয়ে সোজা চলে গেছে উত্তর থেকে দক্ষিণে। খালি চোখে তাকে দেখা যায় না। আগুনের আঁচ থেকে বাঁচতে সেটা যেন মাটির ভেতর যতখানি পারে সেঁধিয়ে যেতে চেয়েছে। তবু যারা জানে তারা জানে যে আছে ওইখানে একখানা পথ। অবশ্য যে পথ দিয়ে কেউ চলে না, তাকে পথ বলা চলে কি না সেই নিয়ে পদ্মরানী অনেক ভেবেছে। রোজই ভাবে। যেমন এখন ভাবছে। বারান্দায় বসে বসে, অদৃশ্য পথটার দিকে চোখ মেলে রেখে। বারান্দায় বসার সময় শুধু এইটুকু। সারাদিন ঘরের বাইরে বেরোনো যায় না। দরজা জানালায় খিল এঁটে মোটা চটের বস্তা ঝুলিয়ে রাখতে হয়। আর ঘণ্টায় ঘণ্টায় জলের ছিটে দিতে হয়। তাতে যদি গায়ে ফোসকা পড়া এড়ানো যায়। সূর্য দিগন্তের নিচে নেমে যাওয়ার  পরও কিছুক্ষণ চারদিকটা গনগনে হয়ে থাকে। তারপর চোরের মতো খিল খুলে পা টিপে টিপে বারান্দায় এসে বসা। আর অদৃশ্য পথটার দিকে তাকিয়ে থাকা আর ভাবা, যদি কেউ না-ই আসে কোনওদিন তাহলে ওটা থেকে লাভ কি?

“একটা ঠাণ্ডা মেশিন কিনলে হয় না?” 

পদ্মরানীর চিন্তার খেই ছিঁড়ে দিয়ে কথাটা বলে উঠল সে বসে আছে কাছেই। বারান্দা থেকে নেমে যাওয়া সিঁড়ির দুটো ধাপ ছেড়ে তিন নম্বর ধাপে, বসে বসে শাড়ির আঁচল নেড়ে নেড়ে মশা তাড়াচ্ছে। 

“এসি কিনলে হয় না একটা?” আবার বলল সন্ধ্যা।

পদ্মরানী জবাব দিল না। উত্তরটা সন্ধ্যা নিজেও জানে। জমানো টাকায় ঠাণ্ডা মেশিনের হাওয়া খাওয়ার বিলাসিতা করা যায় না। পদ্মরানীর বিছানার চেপ্টে যাওয়া তোশকের নিচের লুচিভাজা হিসেবের খাতাটা আছে তাতে গত দশবছর ধরে আয়ের দিকে একটি আঁচড় পড়েনি।  বছর দশেক আগে, সন্ধ্যার মুখের সস্তা পাউডার ভেদ করে যখন সুতোর মতো দাগগুলো ফুটে উঠতে শুরু করেছিল তখন থেকেই আয় কমতে শুরু করেছিল, তারপর খনি চেঁছে কয়লার শেষ তালটুকু তুলে নিয়ে কারখানায় তালা ঝুলিয়ে চলে গেল যখন মালিক, তখন সব শেষ। যেসব মেয়ের বয়স কম ছিল, বুকে সাহস ছিল, বাড়ি খালি করে তারাও চলে গেল। রয়ে গেল শুধু সন্ধ্যা আর বকুল।  

“বকুল কই?” পদ্মরানী জিজ্ঞাসা করল। 

“সে ঘরে দোর দিয়ে শুয়ে আছে। বৃষ্টি না হলে নাকি নামবে না।”

আলোর আভাস একেবারে মুছে যেতে, অন্ধকারে খানিকক্ষণ দেহ জুড়িয়ে নিয়ে উঠে পড়ল ওরা। রান্নাঘরে গিয়ে ভাত চড়াতে হবে। রান্না হলে হাঁড়িতে জল ঢেলে রেখে দেবে, কাল সকালে পান্তা করে কাঁচালংকা আর পাতিলেবু দিয়ে খাবে তিনজনে। রাতের জন্য চিঁড়েমুড়িই যথেষ্ট। 

খাওয়াদাওয়া সেরে হ্যারিকেন হাতে দোতলায় উঠে এল পদ্মরানী। আজকাল সিঁড়ি বাইতে কষ্ট হয় তার। হাঁটুতে, কোমরে টান ধরে। দোতলায় উঠে এসে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে হাঁফ ছাড়ল কিছুক্ষণ। টানা বারান্দার দু’নম্বর এবং শেষ ঘরটা ওর। ঘরে যাওয়ার আগে প্রথম দরজাটার কাছে একবার থামল পদ্মরানী। দরজার পাল্লায় হাতের তেলো দিয়ে চাপ দিল। মচমচ করে উঠল পুরোনো কাঠ। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। 

‘বকুল, ও বকুল? খাবি না?”

উত্তর নেই। পদ্মরানী অপেক্ষা করল কিছুক্ষণ। তারপর বাকি বারান্দাটুকু পেরিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজার শিক তুলে দিল। না দিলেও কিছু না। আশেপাশে চোরডাকাত নেই। থাকলেও তারা এ বাড়িতে চুরি করতে আসবে না। নেওয়ার মতো কিছুই নেই আর এ বাড়িতে। টাকা পয়সা, হিরেজহরত, যৌবন। পদ্মরানীর ঘরটাই বাড়ির মধ্যে সবথেকে বড়। ঘরের বেশিরভাগ অংশই হ্যারিকেনের আলোর নাগালের বাইরে ঘাপটি মেরে বসে আছে। সলতেটা বাড়িয়ে হেঁটে হেঁটে তক্তপোশের কাছে এল পদ্ম। পালংকখানা গেছে অনেকদিন, এ তক্তপোশের অঙ্গে অঙ্গে পদ্মরানীর মতোই বাত। উঠতে গেলে মচমচ, বসতে গেলে মচমচ। দেওয়ালের কাছে গিয়ে হ্যারিকেনটা উঁচু করে ধরল পদ্মরানী। নতুন ক্যালেন্ডার নিয়ে এসেছে সন্ধ্যা শ্রীগুরু সিমেন্টের দোকান থেকে। শীর্ণ তর্জনী খানিকক্ষণ দ্বিধাভরে বাতাসে ভেসে থেকে অবশেষে একটা খোপে গিয়ে নামল। চোখ কুঁচকে ভালো করে তারিখটা দেখল একবার পদ্মরানী। যা ভেবেছে তাই। কাল ঊনত্রিশে বৈশাখ। 

*****

পরদিন সকালে সূর্য যেন আরও তেজে উঠল। সাতটা বাজতে না বাজতে রান্নাঘরের পুব দেওয়ালের ঘুলঘুলি বেয়ে ধুলোর জীবন্ত থাম বেয়ে নেমে এল তেজী রোদ।  কুয়োতলার জ্বলন্ত কংক্রিটে দু’পায়ের পাতা আলগোছে ফেলে কোনওমতে হেঁটে বালতি দু’য়েক জল এনে সন্ধ্যা দরজা দিল। 

“কী হল তোমার বিষ্টির?” 

“দাঁড়া, সবে তো সকাল।” 

নাকের ভেতর একটা তাচ্ছিল্যের শব্দ করল সন্ধ্যা। পদ্মরানী আমল দিল না। তার জন্মের পর থেকে এমন এক বছরও যায়নি যেদিন ঊনত্রিশে বৈশাখ বৃষ্টি হয়নি। এত বছর বেঁচে, এত অভিজ্ঞতা দিয়ে পদ্মরানী দুটো জিনিস বুঝেছে। মানুষের ওপর ভরসা করা যতখানি বোকামো, ভগবানের ওপর বিশ্বাস হারানো তার থেকেও বেশি বোকামো। আর রোদ বৃষ্টি আকাশ বাতাস ঝড় বন্যা তো একরকমের ভগবানই। ভগবানের দুনিয়ায় নিয়মের এদিকওদিক হয় না। ঊনত্রিশে বৈশাখ যদি বৃষ্টি হওয়ার কথা থাকে, তবে বৃষ্টি হবেই, কেউ আটকাতে পারবে না। 

রোদ যখন পুব দেওয়ালের ঘুলঘুলি ছেড়ে বাড়ির দক্ষিণপশ্চিম দেওয়ালের ঘুলঘুলিতে বাসা বেঁধেছে তখন কিন্তু পদ্মরানীর ভয় লাগতে শুরু করল। কিন্তু এই ভয়কে বিশ্বাস হারানোর সঙ্গে তুলনা করলে ভুল হবে। পদ্মরানীর বিশ্বাস আগের মতোই অটুট। ঊনত্রিশে বৈশাখ বৃষ্টি হয়। যদি না ভগবান কুপিত হন। আর পদ্মরানী জানে ভগবানকে কুপিত করার লোকের অভাব নেই। সে নিজেই সারাজীবনে কম পাপ তো করেনি। সেই ফল এখন হয়ত ফলছে। ঘরের ঠাণ্ডা মেঝেতে শুয়ে শুয়ে পদ্মরানী নিজের পাপের কথা ভাবতে লাগল। আজ বৃষ্টি না হলে যদি সামনের একবছর বৃষ্টি না হয়? 

ঘুম ভাঙা আর চোখ খোলার মাঝের যে সময়টা, যেখানে নিজের ইচ্ছেমতো স্বপ্ন বানানো যায়, সেই তন্দ্রার মধ্যে পদ্মরানীর কানে শব্দটা এল। তীক্ষ্ণ ফলাওয়ালা তীর এসে যেন শক্ত জমিতে পরপর বিঁধে যাচ্ছে। অনেকগুলো সম্ভাবনা পরপর খেলে গেল পদ্মরানীর মাথায়। প্রথমেই মনে হল, বৃষ্টি! তারপর মনে হল, নির্ঘাত সে বৃষ্টির স্বপ্ন দেখছে। তারপর যখন তন্দ্রাটা কেটে চারপাশটা প্রকট হয়ে উঠল তখন সে বুঝল আওয়াজটা আসলে আসছে দরজার বাইরে থেকে। কেউ দরজার কড়া নাড়ছে। 

আঁচল গুছিয়ে উঠে এসে দরজা খুলে পদ্মরানী দেখল সন্ধ্যার ব্যাজার মুখ। পদ্মরানীর দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচিয়ে মাথাটা সামান্য বাঁদিকে ঘোরাল সন্ধ্যা। ওইদিকে বাড়ির সদর দরজা।

"কী হচ্ছে দেখবে চল।” 

ঘুলঘুলি থেকে আলো মুছে গেছে। আবছা সিঁড়ির রেলিং ধরে সাবধানে নেমে এল পদ্মরানী। দিগন্ত ছুঁয়ে ফেলা সূর্যের আলোয় একটা লম্বা ছায়া এসে পড়েছে খোলা সদর দরজার চৌকাঠ পেরিয়ে। ছায়াটার পাশে একটা সুটকেস আর একখানা কাপড়ের থলি। 

“বকুল!"

চোখ ফিরিয়ে তাকাল বকুল। গোটা বাড়িতে সবথেকে সুন্দর চোখ ছিল বকুলের। এখন সেখানে ফ্যাকাসে, শূন্যতাময় দুটো কোটর।

“আমি যাচ্ছি।”

“কোথায়?”

“যেখানে বৃষ্টি হবে।”

বকুলের স্বর নিচু এবং স্পষ্ট। সিদ্ধান্তে স্থির। 

“যাচ্ছিস? যাচ্ছিস মানে? গত দশ বছর ধরে এক পয়সা ঠেকাসনি। আমার পয়সায় খেয়েছিস পরেছিস ফুর্তি করেছিস। যেতে হলে আমার ধার শোধ করে যা।” পদ্মরানীর মাথাটা ঘুরে উঠল হঠাৎ। রাগে, ভয়ে সারা শরীর কাঁপছে। বকুলের দিকে বজ্রদৃষ্টি হেনে দ্রুত এগিয়ে এসে পদ্মরানীকে জাপটে ধরে সাবধানে বারান্দায় রাখা মোড়াটায় বসিয়ে দিল সন্ধ্যা। আঁচল দিয়ে যত্ন করে কপালের ঘাম, ঠোঁটের কোণের থুতু মুছিয়ে দিল।  

খানিকক্ষণ পদ্মরানীর দিকে তাকিয়ে থাকল বকুল। তারপর বলল, “তুমিও চল।”

“শোন, বকুল, আজ রাতটুকু দেখ… আজ ঊনত্‌…“

“তুমি সত্যি বিশ্বাস কর আজ বৃষ্টি হবে? তুমি কি পাগল?” 

পদ্মরানীর ইচ্ছে হল বলে, বিশ্বাস না করলে হবে বুঝি বৃষ্টি? কিন্তু বলল না। হাতটা চোখের ওপর এনে আকাশের দিকে তাকাল। সূর্য ডুবে গেছে। কিন্তু আগুনের আভাস এখনও লেগে আছে আকাশের গায়ে। যেন কেউ সিগারেটের জ্বলন্ত প্রান্ত এতক্ষণ চেপে ধরে রেখেছিল আকাশের গায়ে, সরিয়ে নেওয়ার পরও ক্ষতটা জ্বলজ্বল করছে। পদ্মরানী ঠাহর করতে চাইল সে ক্ষতের ওপর কোথাও মেঘের প্রলেপ পড়েছে কি না। এক ফোঁটাও জলও যদি ঝরে, তার সংসারটা এভাবে টুকরো হয়ে যায় না। 

বকুল মুখ ঘুরিয়ে নিল। ডানদিকে সামান্য ঝুঁকে সুটকেসের দড়ি বাঁধা হ্যান্ডেলে হাত গলিয়ে তুলতে যাবে, এমন সময় শব্দটা কানে এল বকুলের। বকুলের পরেই সেটা শুনতে পেল সন্ধ্যা। পদ্মরানী সব শেষে। 

একটা গুড়গুড় শব্দ আসছে কোথাও থেকে। ক্ষীণ কিন্তু স্পষ্ট।

তিনজনে এসে বারান্দার কিনারে পাশাপাশি দাঁড়াল। মিনিটে মিনিটে স্পষ্ট হচ্ছে আওয়াজটা। দক্ষিণ দিকের আকাশে ধোঁয়ার মতো মেঘ পাকিয়ে উঠেছে। 

তিনজনে ঘাড় টান করল। কারও মুখে কথা নেই। ঘরঘর খরখর আওয়াজটা ক্রমে মৃদু থেকে তীব্র হল, কালো ধোঁয়া জমতে জমতে ক্রমে ঝোড়ো মেঘের পুঞ্জে রূপান্তরিত হল। অবাধ প্রান্তরের ওপর দিয়ে ডঙ্কা বাজাতে বাজাতে ঝড়টা যেন ছুটে আসতে লাগল বাড়িটার দিকেই। তিনটে শীর্ণ হাতের পাঞ্জার ছায়ার তলার তিনজোড়া চোখ লক্ষ্য করে। মুহূর্তে মুহূর্তে ফুলেফেঁপে উঠতে লাগল তার আয়তন। তারপর ধুলোয় আকাশ অন্ধকার করে, একটি প্রবল বিস্ফোরণের মতো আছড়ে পড়ল বাড়িটার ওপর। 

ধোঁয়া খানিকটা পাতলা হলে দেখা গেল বিস্ফোরণের কেন্দ্রে গ্যাঁট হয়ে বসে আছে একটি অতি প্রাচীন মোটরগাড়ি। তার বনেটের ভেতর থেকে সাপের মতো পেঁচিয়ে ওঠা কালো ধোঁয়া প্রমাণ দিচ্ছে যে সেটির অতি প্রাচীন, অতিব্যবহৃত জীবনের সদ্য সমাপ্তি ঘটেছে। গাড়ির ছাদে দড়ি দিয়ে বাঁধা মালপত্র। গাড়ির ভেতর স্টিয়ারিং-এ দু’হাত রেখে স্থির হয়ে বসে আছে প্রায় গাড়ির মতোই প্রাচীন একটা লোক। পাথরের মত স্থির। যেন নিজের সঙ্গীর এই মৃত্যুর ক্ষণটিকে কোনওরকম আলোড়ন দিয়ে বিক্ষুব্ধ করতে চায় না। এই চিরবিদায়ের ক্ষণটির সমস্ত শোক অটুট রেখে নিজের সত্তায়, স্মৃতিতে মিশিয়ে নিতে চায়। 

বনেটের ধোঁয়ার শেষ শিখাটুকু হাওয়ায় মিশে গেলে লোকটা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। শীর্ণ মুখ। তেলচুকচুকে কালো চুলের গোছা সরু কপালের একদিক ঢেকে নেমে এসেছে। গালের উঁচু হাড় আর খাড়া নাকের মাঝে অবতল গাল। তামাকের অত্যাচারে কালো হয়ে যাওয়া ঢেউয়ের মতো ঠোঁটের ওপর যত্ন করে ছাঁটা সরু কালো গোঁফ। 

দরজা খুলে নেমে এল লোকটা। বুকের কাছে হাত জড়ো করে নুয়ে পড়ে বলল, “আজ্ঞে, আমার নাম শ্রী সরিৎ কুমার বিশ্বাস, হিন্দুস্থানী মার্গ সংগীত শিক্ষক, বিশেষ করে ধ্রুপদধামারে তালিম দিয়ে থাকি। আমি আসছি ম-পুর থেকে, যাব প-নগরে। এর মধ্যে…” 

হাত দিয়ে নিজের মোটরগাড়ির মৃতদেহের দিকে দেখালেন সরিৎকুমার। 

বকুলের চলে যাওয়া নিয়ে একটুক্ষণ আগে যে টানটান উত্তেজনাটার সৃষ্টি হয়েছিল সেটা ঢিলে হয়ে গিয়ে তিনজনের মধ্যে আবার স্বাভাবিক শৃঙ্খলার প্রত্যাবর্তন ঘটল। পদ্মরানী এগিয়ে এসে বলল, “আসুন, ভেতরে আসুন।” 

সরিৎকুমার কৃতজ্ঞতায় নুয়ে পড়লেন। পেছন ফিরে গাড়ির ছাদ থেকে মালপত্র নামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। পদ্মরানীর ইশারায় সন্ধ্যা এগিয়ে গেল সাহায্য করতে। সুটকেস, হোল্ডঅল একে একে এসে বারান্দায় উঠল। সবশেষে সরিৎকুমার গাড়ির পেছনের দরজা খুলে অতি যত্নে একটা সবুজ কাপড়ে মোড়া তানপুরা বার করে আনলেন। সবাই একে একে ঘরে ঢুকে এল। দরজা দেওয়ার আগে বারান্দা থেকে বকুলের সুটকেসটাও ভেতরে নিয়ে এল সন্ধ্যা। বকুল দেখল, কিন্তু কিছু বলল না।

*****

ঘণ্টাখানেক বাদে সদর ঘরের মাঝখানে মাদুর বিছিয়ে, তার ওপর একটি হ্যারিকেন রেখে সেটাকে ঘিরে তিনজন বসে ছিল। মাদুরের মাঝখানে একটা বড় বাটিতে মুড়ি, পাশে স্টিলের গ্লাসে জল। বাটির সামনে বাবু হয়ে বসে ছিলেন সরিৎকুমার, পলার আংটি পরা হাত মুঠো করে অল্প মুড়ি তুলে মুখে পুরছিলেন। পদ্মরানী সৌজন্যের সীমা রক্ষা করে যতখানি কাছে বসা যায়, ততখানি কাছে বসে হাতপাখা নাড়ছিল। সন্ধ্যা বসেছিল আলো থেকে একটু দূরে, এক হাঁটু মুড়ে, তার ওপর চিবুক রেখে। বকুল তার ব্যর্থ বিদ্রোহের জ্বালা বুকে নিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে দোর দিয়েছিল। সন্ধ্যার অনেক ডাকাডাকিতেও খোলেনি।

পদ্মরানী বলল, “তারপর কী হল?”

সরিৎকুমার গ্লাস তুলে একচুমুক জল খেলেন। বললেন, “তারপর রাস্তায় রাস্তায় ঘুরলাম। কোনওদিন খেতে পেলাম, কোনওদিন কলের জল খেয়ে পেট ভরালাম। জল খেয়ে লোকের বারান্দায়, বারান্দা না পেলে গাছের তলায় শুয়ে থাকতাম, শুয়ে শুয়ে অপেক্ষা করতাম কখন মাথা থেকে গান শেখার ভূতটা নামবে, কিন্তু অপেক্ষাই সার হল। 

সরিৎকুমার হেসে উঠলেন। দেওয়ালে হাতপাখার প্রকাণ্ড ছায়া দুলতে লাগল।  

সরিৎকুমার বললেন, “সেই ভূতটাই জুটিয়ে দিল বোধহয়। একদিন জানালার বাইরে থেকে রেওয়াজ শুনলাম। আর বুঝে গেলাম গুরু পেয়ে গেছি।” চোখ বন্ধ করে দুই কানে দু’হাতের আঙুল ছুঁলেন  সরিৎকুমার। 

“আমার মধ্যে কী দেখেছিলেন তিনিই জানেন” ছদ্ম বিনয়ের হাসি ফুটল সরিৎকুমারের ঠোঁটে, “শ্রীচরণে ঠাঁই দিলেন। তাঁর বাড়িতে থেকে চাকরের কাজ করতাম, খেতাম, পরতাম, আর তিনি যখন ছাত্রদের যখন গান শেখাতেন দরজার বাইরে বসে শুনতাম। ছাত্রদের কপালে শুধু নিজের নিজের ভাগেরটুকু জুটত, আমি সবারটা শিখতাম। ভোরবেলা উঠে গুরু গুরুমার ছাড়া কাপড় কাচতাম, শুনতাম গুরু ভৈরবীতে সুর লাগিয়েছেন। দুপুরবেলায় বৃন্দাবনী সারং, সন্ধ্যেবেলায় কাফি। বছর পাঁচেক পর একদিন ছাত্ররা বিদেয় হলে পর্দার আড়াল থেকে ঘরে ডাক পড়ল। বললেন, “তোর শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়েছে, এবার ভাগ। নিজের গুরুর ঠিকানা দিয়ে দিলেন। সেখানে গিয়ে আরও পাঁচ বছর বাসন মাজলাম, কাপড় কাচলাম, গুরুর ছেলেপুলের কাঁথাকানি কাচলাম। আর যেটুকু সময় পেলাম তাতে গান শুনলাম।”

“তারপর?”

“তারপর শেখার পালা শেষ। শেখানোর পালা শুরু। একটা স্কুলে চাকরি নিলাম। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আসত গান শিখতে। এক এক সপ্তাহে একেকটা রাগ। না হলে সিলেবাস শেষ করা যাবে না।” লন্ঠনের মৃদু আলোও সরিৎকুমারের মুখের বিষাদ লুকোতে পারল না।  “ইমন, ইমনের পর খাম্বাজ, খাম্বাজের পর ভৈরব। আর তিনটে রাগের পর একটা নজরুলগীতি।”

*****

রাতে খাওয়াদাওয়ার পর সরিৎকুমার বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। আজ যে পূর্ণিমা যে সে কথা তাঁর মনেই ছিল না। শহরে এরকম পূর্ণিমা তিনি দেখেননি আগে কখনও। চাঁদের আলোয় চারপাশে ধুয়ে যাচ্ছে। দুপুরবেলায় গনগনে রোদে আসতে আসতে যে ভূমিকে তাঁর নিষ্ফলা, শুষ্ক মনে হয়েছিল, শীতল চন্দ্রালোকে তার যেন অন্তরের সমস্ত রহস্য উন্মুক্ত হয়েছে। সরিৎকুমার দুচোখ মেলে দেখতে লাগলেন। বহু বছর আগে, সমুদ্রধারের এক শহরে গুরুজীর সঙ্গে একবার এক সংগীত সম্মেলনে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল তাঁর। হোটেলের ছাদে দাঁড়ালে সমুদ্র দেখা যেত। একের পর এক ঢেউ এসে আছড়ে পড়ত বালির ওপর, সারাদিন সারারাত। তাঁর চারপাশে এও যেন এক শাপগ্রস্ত সমুদ্র। মৃদু উদ্বেলিত জমি ঢেউ তুলতে তুলতে দিগন্তে মিশে গেছে। 

সন্ধ্যা ডাকতে এল। সরিৎকুমার ভেতরে গেলেন। বাইরের ঘরের মেঝের মাদুর সরিয়ে বিছানা পাতা হয়েছে। বালিশের পাশে ঢাকা দেওয়া জলের গ্লাস। পদ্মরানী অপেক্ষা করছিল, সরিৎকুমারকে দেখে বলল, 

“আপনি এবার শুয়ে পড়ুন।”

সরিৎকুমার বললেন, “আপনারা আমার এত উপকার করলেন, আমি আপনাদের কিছু দিতে চাই।”

ঘরে নিস্তব্ধতা গভীর হয়ে এল। সরিৎকুমার ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। 

“আপনারা ভুল বুঝছেন। আপনাদের দয়ার প্রতিদান দেওয়ার মতো কিছু নেই আমার কাছে। কিন্তু যেটুকু আছে সেটুকু না দিলে গুরুজী আমাকে ক্ষমা করবেন না।” কানের লতি আলতো ছুঁলেন সরিৎকুমার। ঘরের কোণে সবুজ কাপড়ে মোড়া তানপুরাটা নিয়ে এসে চাদরের ওপর বাবু হয়ে বসলেন। আবরণ থেকে তানপুরা বেরিয়ে এল। পালিশ করা গাঢ় মেহগনি কাঠের গাঢ় পালিশ লন্ঠনের মৃদু আলোয় চকচক করে উঠল। সরিৎকুমার আঙুল রাখলেন তারের ওপর। পদ্মরানী দেখল, এই  শুকনো, শীর্ণ শরীরের লোকটার হাতের আঙুল কী মসৃণ। বাকি মানুষটার থেকে হাতের আঙুলগুলোর বয়স যেন তিরিশ বছর কম। সারা শরীরের সমস্ত লাবণ্য যেন এসে জড়ো হয়েছে ওই ক’টি আঙুলে। পেলব মসৃণ আঙুল দিয়ে তারে আঘাত করলেন সরিৎকুমার। ঘরের বাতাস শিউরে উঠল। পদ্মরানী বুঝল সরিৎকুমারের আঙুলের চিরযৌবনের রহস্যটা কী। সব ওই তারের সঞ্জীবনীর কেরামতি। সরিৎকুমার যত্ন করে সুর বাঁধলেন। তানপুরার তীক্ষ্ণ আপত্তিতে কর্ণপাত করলেন না।

সুর বাঁধা হলে সরিৎকুমার শিরদাঁড়া টান করে, চোখ বুজলেন। ছেঁড়া ছেঁড়া সুরের শেষটুকু মিলিয়ে গিয়ে যখন সম্পূর্ণ নীরবতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা হল ঘরের হাওয়ায় তখন সরিৎকুমারের গান ধরলেন। নাভি থেকে উৎসারিত হল গম্ভীর, শান্ত ষড়জ। গুরু শিখিয়েছিলেন, শুধু যন্ত্র বাঁধলেই চলে না, নিজেকেও বাঁধতে হয়। সা-এ নিজেকে বেশ করে বাঁধলেন সরিৎকুমার। ঋষভ, কোমল গান্ধার ছুঁয়ে নেমে এসে ধৈবত হয়ে পঞ্চমে সামান্য বিশ্রাম নিয়ে, নিষাদ মধ্যমের মীড়ে ভেসে গিয়ে আবার ঋষভে এসে থামলেন। সরিৎকুমারের চোখের পাতায় বহু বহুদিন আগের এক দিনশেষের ছবি কাঁপতে থাকল। সূর্য ডুবে গেছে, সাতরঙা কোনও পাখি তার শরীরের সমস্ত পালক যেন উড়িয়ে দিয়ে গেছে সারা আকাশ জুড়ে। তার বুকের রক্তের লালে, পালকের রামধনুতে মাখামাখি হয়ে আছে চারদিক। দক্ষিণপশ্চিম কোণে দৈত্যের মতো গুঁড়ি মেরে উঠছে কালো মেঘের দল।     

দামিনী দমকে, ডর মোহে লাগে। উমঙ্গে দলওয়া, ঘন শ্যাম ঘটা।

বাইরে জ্যোৎস্না নিভে এল। কোথা থেকে গানের টানে দলে দলে ভেসে এল সমঝদার মেঘের দল। সরিৎকুমারের রেওয়াজি মীড়ের দোলায় দুলতে লাগল, দীর্ঘ বিস্তার সম্পূর্ণ করে সরিৎকুমার যখন স্থায়ীতে ফিরতে লাগলেন, অদৃশ্য কিন্তু অমোঘ তালবাদ্যের সঙ্গে নিখুঁত সমে ‘দমকে’-র ‘দ’ মিশে গেল বারবার, তারিফে তারিফে উদ্বেল হয়ে উঠল। 

আলাপ সম্পূর্ণ হল।  রাগ এখন তৈরি। তার সাজ শেষ। সাত স্বরের অলংকার যথাস্থানে পরে সালংকারা রাগ এসে দাঁড়াল পূর্ণ সভার মাঝে। লাগাম ছাড়া ঘোড়ার মতো উদারামুদারাতারা একাকার করে সপাট তান ছুটে গেল, হর্ষে ফেটে পড়ল আকাশ। সরিৎকুমারের রেওয়াজি গলার গিটকিরির জবাবে বাজ আছড়ে পড়ল বকুলের বন্ধ জানালার পাল্লায়, কাঠচেরা ফাঁক দিয়ে ঝলসে উঠল বিদ্যুৎ। ভয়ে শিউরে উঠল বকুল। এক্ষুনি যেন পাল্লা ভেঙে ফেলে ঝড় ঘরে ঢুকে আসবে। তাকে উপড়ে তুলে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে আবার। এই পৃথিবীতে তার চেনা একটিমাত্র কুটোর কথা মনে পড়ল বকুলের, যাকে আঁকড়ে ধরে সে বহু ঝড় থেকে রক্ষা পেয়েছে। একদৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এসে পদ্মরানীর কোল ঘেঁষে গুটিসুটি মেরে বসল বকুল। 

সরিৎকুমার মগ্ন হয়ে গেয়ে চললেন। বাইরে ঝড় থেমে গিয়ে বৃষ্টি নামল। জ্যোৎস্না ধুয়ে জলের ধারা পড়তে লাগল ফুটি ফাটা মাটির ওপর। হাঁ হয়ে থাকা ফাটল চুঁইয়ে গভীরে গিয়ে ঘুম ভাঙাল মাটির। স্তব্ধ সমুদ্র দুলে উঠল। কেঁপে উঠল পদ্মরানীর বাড়ি, সংসার। সন্ধ্যা আর বকুলকে দুহাতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বসল পদ্মরানী। তার এতদিনের নোঙর ফেলা ভেলা অবশেষে ভাসতে শুরু করেছে। কোথায় গিয়ে ভিড়বে কেউ জানে না। 

*****



Comments

  1. Uff ... ki bhalo likhecho! Mon bhore gelo. Tumi ki hindustani classical shikhecho?

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ শর্মিলা, এককালে মা বাবা শিখিয়েছিলেন।

      Delete
  2. Asadharon. Kudos to you :). Ki bhalo laglo bole bojhate parchi na.mochotkarer cheye oo beshi bhalo. Erokom aro chai.

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ, প্রিয়াঙ্কা।

      Delete
  3. অন্বেষা সেনগুপ্তMay 26, 2016 at 7:46 PM

    " এক এক সপ্তাহে একেকটা রাগ। না হলে সিলেবাস শেষ করা যাবে না।” লন্ঠনের মৃদু আলোও সরিৎকুমারের মুখের বিষাদ লুকোতে পারল না। “ইমন, ইমনের পর খাম্বাজ, খাম্বাজের পর ভৈরব। আর তিনটে রাগের পর একটা নজরুলগীতি।”
    অসামান্য ইত্যাদি বলে এটাকে ছোট করতে চাই না, তবে অনুরোধ, শিগগিরই মৌলিক রচনায় হাত দিন, রূপান্তর করে সময় নষ্ট করবেন না !

    যদি অপরাধ না নেন তো আমার একটা কথা ছিল| " ঘরঘর খরখর আওয়াজটা ক্রমে মৃদু থেকে তীব্র হল, কালো ধোঁয়া জমতে জমতে ক্রমে ঝোড়ো মেঘের পুঞ্জে রূপান্তরিত হল। অবাধ প্রান্তরের ওপর দিয়ে ডঙ্কা বাজাতে বাজাতে ঝড়টা যেন ছুটে আসতে লাগল বাড়িটাকে দিকেই। তিনটে শীর্ণ হাতের পাঞ্জার ছায়ার তলার তিনজোড়া চোখ লক্ষ্য করে। মুহূর্তে মুহূর্তে ফুলেফেঁপে উঠতে লাগল তার আয়তন। তারপর ধুলোয় আকাশ অন্ধকার করে, একটি প্রবল বিস্ফোরণের মতো আছড়ে পড়ল বাড়িটার ওপর। " - এখানে তত্সম ভারী ভারী শব্দগুলো ব্যবহার না করলেই কি নয়? রূপান্তরিত, আয়তন, বিস্ফোরণ ?

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ অন্বেষা। শব্দ নিয়ে আপত্তি মনে রাখলাম।

      Delete
    2. Maap korben Anwesha-debi, ami ekmot hote parlam na. Totsomo sobdo gulo sothik jaiga te sothik bhab i byakto koreche.

      Delete
  4. আসলটা এত ভালো ছিল না এ আমি ১০০-১০০০ বার বলতে পারি। কি লিখেছ কুন্তলাদী। আহা চমত্কার

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ, প্রদীপ্ত।

      Delete
  5. কুর্নিশ
    মিঠু

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, আরে থ্যাংক ইউ, মিঠু।

      Delete
  6. Replies
    1. থ্যাংক ইউ, ইচ্ছাডানা।

      Delete
  7. ki je ashadharon lekha, sesh ta kemon haoay bhasiye dile! tomar bhabanubad emon je otake konobhabe anubaad bola jay na.

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, কাকলি, অনুবাদ তো বলতেই হবে, আইডিয়াটাই তো ধার করা। লেখাটা তোমার ভালো লেগেছে জেনে খুব খুশি হলাম। থ্যাংক ইউ।

      Delete
  8. Replies
    1. থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ, রুণা।

      Delete
  9. Ei lekha ta osadharon hoyeche, apnar sreshto lekha gulo-r modhye ekti. Mul golpo-ta amar pora nei, majhe majhe onubad-o moulik golpo hoye othe, ei golpe-o tai hoyeche. Amar samprotik kalke pora jabotiyo lekhar modhye prothome thakbe.

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ, ঘনাদা।

      Delete

Post a Comment