ভালো বই ভালো ছবি



JNU তে গিয়ে দেখলাম ক্যাম্পাস একটাই কিন্তু ইউনিভার্সিটি আসলে দুটো। তাদের ক্লাসরুম আলাদা, সিলেবাস আলাদা, পরীক্ষা আর গ্রেডেশনের সিস্টেম আলাদা, শিক্ষক আলাদা। সবই যখন আলাদা তখন আর ছাত্রছাত্রীই বা এক হয় কেন, তারাও আলাদা। একদল ছাত্রছাত্রী সকালবেলা উঠে দুধপাউরুটি খেয়ে গাধার মতো মোট বইতে বইতে ক্লাসে যায়, বিকেলে লাইব্রেরি যায়, রাত্তিরে ঘুমোতে যায়। অন্য ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীদের অত ঝামেলা নেই, ইচ্ছে হলো ক্লাসে গেলাম, হলোনা গেলাম না গোছের ব্যাপার। তাদের মূল শিক্ষাদীক্ষাটা হয় সন্ধ্যের দিকে ধাবায় বসে। বেশির ভাগ ক্লাস সিনিয়ররা নেন, তবে সহপাঠীরাও শিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে যখন তখন। এখানে বিষয়ের বৈচিত্র্যও অন্য দলের থেকে অনেক বেশি। প্রেম, পরনিন্দা, আন্তর্জাতিক রাজনীতি থেকে শুরু করে সিনেমা, তর্ক, ইকনমিক্স।

আমি এই ভালো ইউনিভার্সিটিটার ছাত্রী ছিলাম। আমার বেশ মনে আছে, প্রথমদিনের তর্কের ক্লাসটার কথা। দাদা বললেন, ভালো আর মন্দ বলে নাকি কিছু হয়না। কিংবা সংস্কৃতি অপসংস্কৃতি। সবটাই পারসপেকটিভ। সাদা কালো বলে কিছু নেই, রিয়্যালিটি আসলে একটা গ্রে এরিয়া। যেটা বুঝতে গেলে মিনিমাম একটা গ্রে ম্যাটার মগজে থাকতে লাগে।

আমি তখনও অর্বাচীন কিনা, তাই প্রতিবাদ করে বলেছিলাম, বাঃ বললেই হলো ভালো মন্দ কিছু নেই? অ্যাদ্দিন যে বাবা মা ঠাকুমা পাখিপড়া করালেন এটা করোনা, ওটা করো; এটা করলে পাপ হয়, ওটা করলে ভগবান খুশি হন; গানই যদি শুনতে চাও তো জীবনমুখীর বদলে জোহরাবাই শোনো, বইই যদি পড়তে হয় তবে বটতলা না পড়ে বরং বিভূতিভূষণ ট্রাই করো। সেগুলো বুঝি ফালতু কথা?

দাদার গভীর হতাশামাখা মুখটা আমার এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে। দুদিকে মাথা নাড়তে নাড়তে ধীরে ধীরে তিনি বলেছিলেন, “ছি ছি ছি, এইভাবে মগজধোলাই করে একটা গোটা জেনারেশনকে গোল্লায় পাঠাচ্ছে বুর্জোয়া গার্জেনগুলো?” তারপরেই হতাশা কাটিয়ে প্রবল উৎসাহে লাফিয়ে উঠে বলেছিলেন, “কুছ পরোয়া নেই, আমরা আছি কী করতে? এতোদিন শ্রেণিশত্রুরা তোকে যা যা ভুল বুঝিয়েছে, আমরা সে সব ধুয়ে মুছে তোর মাথায় নতুন থিওরি ঢুকিয়ে দেবো। ঘাবড়াস না কুন্তলা।”

আমার প্রথম হোমওয়ার্কটা ছিলো ভালোমন্দের সঙ্কীর্ণতা অ্যান্ড এলিটিজম থেকে মুক্ত হওয়া। সেদিন রাতে ভিন্ডির ঝোল দিয়ে রুটি খাওয়া সারা হলে আমি গুটি গুটি হোস্টেলের লাইব্রেরিতে গেলাম। আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম কী বই নেবো। লাইব্রেরিতে তখনও বিশেষ ভিড় হয়নি, বর্ণালীদি সবে রেজিস্টার খুলে তারিখটারিখ লিখছে, আমি চট করে কোণের আলমারিটা খুলে সারি সারি একরকম দেখতে বইয়ের মধ্যে থেকে একটা বই তুলে নিয়ে, সেটা ইস্যু করিয়ে একছুট্টে নিজের ঘরে ফিরে এসে বিছানায় বসে হাঁপাতে লাগলাম।

সেই আমার প্রথম মিলস অ্যান্ড বুন পড়া।  মানে পড়ার মতো করে পড়া। আগে দোলনের কাছে এক দু পিস দেখেছিলাম, পাতা উল্টে নাকটাক কুঁচকে রেখেও এসেছিলাম, আবার দোলনকে ধমকও দিয়ে এসেছিলাম, “এসব কী ছাইপাঁশ পড়িস?” বলে।

যাই হোক। দাদার কথা শোনার সুফল ফললো। মিলস অ্যান্ড বুন-এর ফ্যান হয়ে যেতে আমার ওই একরাতই লেগেছিলো। (আমি এতোদিন স্মার্টলি মিলস অ্যান্ড বুনস বলতাম, এখন উইকিতে দেখছি মিলস অ্যান্ড বুন...হোয়াটেভার)। আপনি এতোদিন যেখানে যা-ই অপপ্রচার শুনে থাকুননা কেন, আমি বলছি আপনাকে, মিলস অ্যান্ড বুন অত্যন্ত ভালো বই। বিনোদনের সাথে শিক্ষার নিখুঁত মেলবন্ধন। বিচিত্র সব সিরিজ, মডার্ন, চেরিশ, ডিজায়ার, স্পেশাল মোমেন্টস, হিস্টোরিক্যাল, ব্লেজ...কিন্তু প্লটের ঐক্য চোখে পড়ার মতো। আমি এতোদিনের রিসার্চে মোটে তিনটে প্লট খুঁজে পেয়েছি। এক, কন্যের বিলিওনেয়ার বাবা উইল করে সব টাকাপয়সা উকিলের কাছে জমা রেখে গেছেন, যতদিন না মেয়ের ২০ বছর বয়স হয়। উকিলটি দিব্যি মডেলের মতো দেখতে, পয়সারও অভাব নেই, কিন্তু তাও মেয়ের উকিলকে ঘোর অপছন্দ। আজকালকার মেয়ে, কীসে যে মন ওঠে ভগবানই জানেন। দু’ নম্বর প্লট হচ্ছে ধু ধু র‍্যাঞ্চে কাউবয় আর শহুরে মেয়ের প্রেম। তিন নম্বর প্লটে, কাউবয় আর উকিলের কিছু একটা পারমুটেশন, কম্বিনেশন। আমার অত মনে নেই, আজকের কথা নাকি?  

কোণের আলমারিতে যত মিলস অ্যান্ড বুন ছিলো সে সব গোগ্রাসে পড়ে শেষ করতে আমার বড়জোর মাসতিনেক লেগেছিলো। সেটা অবশ্য আমার কৃতিত্ব নয়, অভিজ্ঞ মিলস অ্যান্ড বুন পাঠক মাত্রেই জানেন, পুরো বইটা পড়ার জন্য লেখা হয়না। ইম্পরট্যান্ট জায়গাগুলো পাতা উল্টে উল্টে পড়ে নিতে হয়। পরের লাইব্রেরি কমিটির মিটিঙে আমি নতুন মিলস অ্যান্ড বুন কেনার খাতে পয়সা ধার্য করা হোক বলে খুব গলাবাজিও করেছিলাম। সে গলাবাজি কাজে দিয়েছিলো কিনা সেটা আমার মনে নেই। উফফ বলছিনা, আজকের কথা নয়?


ছবি গুগল ইমেজেস থেকে


*****

আরও একটা ভালো জিনিসের কথা বলবো আপনাদের আজ। আমার অনেকদিনই সন্দেহ ছিলো প্রতিভার ভাগবাটোয়ারার হিসেবটা ভগবানের একেবারেই আসেনা, এই ছবিগুলো দেখে সে সন্দেহ বিশ্বাসে পরিণত হলো। আপনার এখনো সন্দেহ যায়নি? নিজের চোখেই দেখে নিন তবে।


Comments

  1. M&B er plot jai hok na keno, ekta byapar constant.

    hero hoben tall dark handsome (jakey boley TDH)...with strong jawline, high cheekbones, jet black eyes and...ruthless.

    aar heroine hoben fair, beautiful, and ahem! ...vulnerable :)) kintu oi vulnerbale maal e ruthless er hriday'r opor kobja korben!

    eitai holo ashol dictatorship of the proletariat!

    ReplyDelete
    Replies
    1. যা বলেছো শম্পা। ডিক্টেটরশিপই বটে।

      Delete

Post a Comment