অভ্যেস
নাওয়াখাওয়া ঘুম ইত্যাদি
শারীরবৃত্তীয় কাজকর্ম বাদ দিলে সারাদিনের মধ্যে আপনার আর কোন কাজটা সবথেকে সহজাত
বলে মনে হয়? সহজাত বলতে আমি বোঝাতে চাইছি, যে কাজ আপসে আসে। বিন্দুমাত্র মাথা
খাটাতে হয় না, হাত পা শরীর নিজেরাই মেশিনের মত নড়েচড়ে কাজ গুছিয়ে নেয়, সেটা করতে
আপনার ভালো লাগছে না খারাপ লাগছে এসব আজেবাজে প্রশ্ন উত্থাপিতই হয় না। আমার যেমন
স্নান করতে গেলে কান্না পায়, খেতে গেলে ফ্রিজের খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মাথা
চুলকোতে হয়, এমনকি YouTube দেখতে
গেলে পর্যন্ত একটা বাছাবাছির ব্যাপার থাকে---ইনস্পেক্টর বার্নাবি দেখবো নাকি
ইনস্পেক্টর লিনলি---টস করে ঠিক করতে হয়, সেরকম নয় আরকি।
অনেক
ভেবেচিন্তে আমি বার করেছি, সারাদিনের মধ্যে একমাত্র দাঁত মাজতে গেলেই আমাকে কিচ্ছু
ভাবতে হয়না। আক্ষরিক অর্থেই আমি চোখ বুজে দাঁত মেজে ফেলতে পারি।
কাজেই যখন পড়লাম, বিংশ
শতাব্দীর একেবারে গোড়ায় পেপসোডেন্ট বাজারে আসার আগে মোটে ৭% অ্যামেরিকান বাড়িতে
টুথপেস্ট ছিল আর পেপসোডেন্ট বাজারে আসার দশ বছরের মধ্যে সংখ্যাটা বেড়ে ৬৫% হয়ে
গিয়েছিল, আমার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল। শেষপর্যন্ত দাঁতমাজাও কিনা পুঁজিবাদি
কর্পোরেট চক্রান্ত!
এইসব ইন্টারেস্টিং তথ্য লেখা
আছে চার্লস ডুহিগের ‘দ্য পাওয়ার অফ হ্যাবিটস’ বইতে। ওই যে অবান্তরের নিচে ডানদিকে
যে বইটার মলাটের ছবি দেখতে পাচ্ছেন সেটায়। বইটা নিয়ে হইচই হচ্ছে বেশ কিছুদিন ধরেই,
আমারও অভ্যেস ব্যাপারটা নিয়ে মাথাব্যথা একেবারে নেই সেরকম নয়, তাও আমি এতদিন বইটা
জোগাড় করে পড়ার সাহস পাচ্ছিলাম না। কারণ বইটার নাম শুনলেই ভয় লাগে, এই রে এইবার
জ্ঞান দিল বুঝি। পয়সা খরচ করে (বা লাইব্রেরিতে লাইন দিয়ে, এসব বইয়ের যা ডিম্যান্ড
বাসরে) উপদেশ শোনার মতো মাথাখারাপ হয়নি এখনও আমার।
তারপর হঠাৎ একদিন ঘুরতে
ঘুরতে একখানা অনলাইন ফ্রি সংস্করণ শিকে ছেঁড়ার মত হাতে এসে পড়লো। আমিও সময় নষ্ট না
করে পড়তে শুরু করে দিলাম। ফ্রি-তে দিলে আমি বাইবেল পর্যন্ত পড়তে রাজি আছি, ‘পাওয়ার
অফ হ্যাবিটস’ তো কোন ছার।
চার্লস লিখেছেন সেই আদি অকৃত্রিম সত্যের কথা, মানুষ অভ্যাসের দাস। এবং সেই অভ্যাস যতই তুচ্ছ অকিঞ্চিৎকর হোক না কেন, এই যেমন ধরুন দাঁতমাজা, তৈরি করতে হয়। কারা পারে? শিশুদের অভ্যেস তৈরি করে দিতে পারেন বাবামা, মাস্টারমশাই দিদিমণিরা, আর বুড়োধাড়িদের শেখাতে লাগে কর্পোরেট। তবে যাদেরই শেখানো হোক না কেন, যারাই শেখাননা কেন, চার্লস ডুহিগের মতে শিক্ষণপদ্ধতিটা কাজ করে নিচের ডায়াগ্রাম অনুসারে।
উৎসঃ দ্য পাওয়ার অফ হ্যাবিটস
এতেও নতুন কিছু নেই। সেই
চিরাচরিত খুড়োর কলের সামনে মূলো ঝোলানোর কারসাজি। অবস্থা বুঝে মূলোটা বদলাতে হবে অবশ্য,
বাচ্চাদের জন্য মায়ের চুমু বা দিদিমণির কানমলা, বড়দের জন্য চকচকে দাঁতের ফোটোশপ
করা ফাঁপা প্রতিশ্রুতি।
কিন্তু আসল কথাটা সেটা নয়। চার্লসের বইয়ের আসল কথাটা হচ্ছে, দাঁতমাজা যদি কাউকে শেখানো যায়, মন মাথা শরীর চেতনার ভেতর গজাল মেরে এমনভাবে গুঁজে দেওয়া যায় যে দাঁত মাজতে শুরু করার আগে বিশ্বসংসার কেমন ছিল তার স্মৃতিটুকু পর্যন্ত বিলুপ্ত হয়ে যায়, তবে আরও অনেককিছু এভাবে শেখানো যেতে পারে। এইটা শুনেই চারদিকে হইহই রব উঠে গেছে। লোকে উৎসাহিত হয়ে ভাবছে এইবেলা সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দেবো, রোজ বিকেলে একটা করে অনাবশ্যক কুকি আর খাবোনা এবং পত্রপাঠ ১০ পাউন্ড ওজন কমাবো, খাটের পাশে ‘ট্রিগার’ হিসেবে রানিং শু রেখে ঘুমোতে যাবো যাতে সকালে উঠে সেটা দেখেই দৌড়তে যাওয়ার কথা মনে পড়ে।
কিন্তু আসল কথাটা সেটা নয়। চার্লসের বইয়ের আসল কথাটা হচ্ছে, দাঁতমাজা যদি কাউকে শেখানো যায়, মন মাথা শরীর চেতনার ভেতর গজাল মেরে এমনভাবে গুঁজে দেওয়া যায় যে দাঁত মাজতে শুরু করার আগে বিশ্বসংসার কেমন ছিল তার স্মৃতিটুকু পর্যন্ত বিলুপ্ত হয়ে যায়, তবে আরও অনেককিছু এভাবে শেখানো যেতে পারে। এইটা শুনেই চারদিকে হইহই রব উঠে গেছে। লোকে উৎসাহিত হয়ে ভাবছে এইবেলা সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দেবো, রোজ বিকেলে একটা করে অনাবশ্যক কুকি আর খাবোনা এবং পত্রপাঠ ১০ পাউন্ড ওজন কমাবো, খাটের পাশে ‘ট্রিগার’ হিসেবে রানিং শু রেখে ঘুমোতে যাবো যাতে সকালে উঠে সেটা দেখেই দৌড়তে যাওয়ার কথা মনে পড়ে।
একটা
কথা কিন্তু মানতে হবে, আমরা যতই হাত পা ছুঁড়ে কান্নাকাটি করিনা কেন, মানুষের জীবনে
সমস্যা বিশেষ নেই। মানে সারাজীবনের মত অভ্যাস
গঠনের সোনারকাঠি হাতে এসে যাওয়ার পর সেটা নিয়ে আমরা কিনা শুধুমাত্র জগিং করতে যেতে
চাইছি? কোমরের চারপাশে খানিকটা বাড়তি মেদ ঝরানো ছাড়া আমাদের জীবনে উন্নতি করার মত
আর কোন জায়গাই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না? সবাই মনের আনন্দে আছেন, প্রাণ ঢেলে নিজের কাজ
করে যাচ্ছেন, আত্মীয় বন্ধু পরিজনের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ এবং সদ্ভাব বজায় রেখেছেন,
রাস্তাঘাটে অচেনা লোকজনের সাথে খামোকা খারাপ ব্যবহার করে নিজের ফ্রাস্টেশন জাহির করছেন
না---এর থেকে ভালো খবর মানবসভ্যতার জন্য আর কী হতে পারে আমি জানিনা।
অবশ্য এর আরেকটা ব্যাখ্যা হতে পারে। চার্লস যাই দাবি করুন না কেন, কিছু কিছু জিনিস শেখা, বা শেখানো যায় না। আমাদের এক ক্লাস ওপরে পড়তো এমিলিও হারনান্ডেজ, চার বছর না ফুরোতে পি এইচ ডি জমা করেছিল, গোটা পাঁচেক অতি উচ্চমানের পাবলিকেশন হেলায় নামিয়েছিল, প্রত্যেক সপ্তাহে ডিপার্টমেন্টের ছেলেপুলের সাথে জুটে বাস্কেটবল খেলতে যেত, এমনকি একবছর ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টস পার্টিতে সেজেগুজে নিকারাগুয়ান নাচ পর্যন্ত দেখিয়েছিল।
বলাই বাহুল্য, আমি এমিলিও হতে চাইতাম। অনেকেই চাইতো। একবার ওকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “তুমি দিনে কতক্ষণ পড়াশুনো করো?” এমিলিও মিষ্টি হেসে বলেছিল, “সোম থেকে শুক্র আটঘণ্টা পড়ি, শনিরবি চারঘণ্টার বেশি ইচ্ছে করেনা।”
আমি যেভাবে দাঁত মাজি,
এমিলিও সেভাবে পড়তে বসতো।
দুঃখের বিষয়, দাঁতমাজার থেকে পড়তে বসার রিটার্ন বেশি। অন্তত আমরা যে দুনিয়ায় বাঁচি সেই দুনিয়ায়। আর তার থেকেও বেশি দুঃখের বিষয় হচ্ছে যে চাইলে আমি দুবেলার জায়গায় চারবেলা দাঁতমাজার অভ্যেস তৈরি করতে পারি, কিংবা রোজ সকালে দৌড়তে যাওয়ার, কিন্তু এমিলিওর মতো দৈনিক আটঘণ্টা নিরবিচ্ছিন্ন পড়া/কাজ করার অভ্যেস? অসম্ভব।
দুঃখের বিষয়, দাঁতমাজার থেকে পড়তে বসার রিটার্ন বেশি। অন্তত আমরা যে দুনিয়ায় বাঁচি সেই দুনিয়ায়। আর তার থেকেও বেশি দুঃখের বিষয় হচ্ছে যে চাইলে আমি দুবেলার জায়গায় চারবেলা দাঁতমাজার অভ্যেস তৈরি করতে পারি, কিংবা রোজ সকালে দৌড়তে যাওয়ার, কিন্তু এমিলিওর মতো দৈনিক আটঘণ্টা নিরবিচ্ছিন্ন পড়া/কাজ করার অভ্যেস? অসম্ভব।
কারণ ওটা অভ্যেস নয়, ওটা
চরিত্র।
মানুষ আদতে আশাবাদী কিনা,
তাই নিজেকে নিয়ে আশা তার ফুরোয় না। চাইলে আমি সব করতে পারি, এ কথা সে নিজে প্রাণপণ
বিশ্বাস করতে চায়। অন্য কারো মুখে শুনলে তো আর কথাই নেই। চার্লস বুদ্ধিমান লোক,
তিনি সেটাই শুনিয়েছেন। হয়তো তিনি নিজেও এটা বিশ্বাস করেন।
*****
দেখেছেন, রবিবার রাতে পোস্ট
লিখতে বসার এই মুশকিল। মনের যত দুঃখ, হতাশা, আসন্ন পাঁচদিনের যমযন্ত্রণার আশঙ্কা---সব
ফুটে বেরোয়। আপনারা ঘাবড়াবেন না। হয়তো সত্যিই সবকিছু বদলানো সম্ভব। সবাই যখন বলছে,
হয়তো কেন, নিশ্চয় সম্ভব।
আপনারা নিজেদের কোন অভ্যেসটা
বদলাতে চান? বা নতুন করে তৈরি করতে চান? নাকি কিছুই বদলাতে চান না, যা আছে যেমন
আছে তাই নিয়েই সন্তুষ্ট? তাহলে আপনাকে আমি সত্যি সত্যি হিংসে করি।
ইবুকটা ইমেল করে দিবি কুন্তলা?
ReplyDeleteঅ্যাবসলিউটলি।
Deleteঅভ্যাসের সমস্যাটাই এই, সে জিনিসটা আসার আগে যে পৃথিবীটা কেমন ছিল সেটা আর মনে পড়েনা | এই যেমন ধরুন মোবাইল ফোন | আমার ছোটবেলায় বাড়িতে স্রেফ একটা ল্যান্ড লাইন ছিল আর আমার সমস্ত বন্ধুদের ফোন নাম্বার মুখস্থ ছিল | সেলফোন আসার পর কত নাম্বার মুখস্থ আছে বলুন তো আপনার? রিমোট ছাড়া টিভি মনে পড়ে? গ্যাস ছাড়া রান্নাঘর? সিডি ড্রাইভ বা হার্ড ড্রাইভ ছাড়া কম্পিউটার? এগুলো সবই আমি দেখেছি, কিন্তু এখন নিজেরই ভাবলে ঠিক যেন মনে পড়েনা - গুগল না করে কিকরে পড়াশুনো করতাম| একটা মোটা বই খুলে Ctrl+F মেরে কিছু খুঁজে নেওয়ার ইচ্ছে হয় কিনা বলুন?
ReplyDeleteআমার কোন অভ্যাস পাল্টাতে চাই? খুব বেশি ল্যাপটপ নির্ভর হয়ে পড়েছি| খুব বেশি ইন্টারনেট নির্ভর হয়ে পড়েছি| এই দুটো অভ্যাস পাল্টানো গেলে বেশ হত| এর ফলে গল্পের বই পড়া টা কমে গেছে - সেটাকেই নতুন করে বাড়াতে চাই| জিম যাওয়াটাকে আর ধরলামনা - সেটা যে করতে হবে সেটা রোজ-ই আয়নায় নিজেকে দেখে টের পাচ্ছি|
সুগত, কন্ট্রোল এফ-এর ব্যাপারটা একদম ঠিক বলেছেন। আমি তো অনেক কষ্টে হাতে ধরে খবরের কাগজ পড়ার অভ্যেসটা বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছি। থাকতে কি চায়? খালি বলে অনলাইন পড়ে নিলেই পারো।
Deleteইন্টারনেটটা আমারও স্বখাতসলিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। একমুহূর্ত ছেড়ে থাকতে পারিনা। অচিরে কিছু একটা করা দরকার।
এইসব লোকে শুধু ভেবেই যায়; করে আর উঠতে পারেনা| খ্যাক খ্যাক|
Deleteআহা চেষ্টা তো চালিয়ে যেতে হবে। না চেষ্টা করলে তো হবেই না।
DeleteAbhishek er comment tay (especially khyak khyak hashi tay) ami 100 ta like dichhi :D
ReplyDeleteAmar haater lekha (mane pen dhore kagoj e lekha) byapar ta ami bachiye rakhchi. CTRL+F marte onek bar ichhe koreche, search bar thake na keno boi e setao bhebechi. Phone number ta generally ami koyekbar ekta number dial korle mone rakhte pari. Tobu amar office er BlackBerry'r number ta kichutei mone thake na! Khamoka nijeke to ar phone kori na, taii hobe!
নিজের ফোন নাম্বারটা আমারও মনে থাকেনা রিয়া। লোককে বলতে গেলে থেমে দেখে তারপর বলতে হয়।
Delete