জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট
আমাদের বাবামায়ের আমলে পাবলিক ডিসপ্লে অফ অ্যাফেকশনের অত চল
ছিল না। উল্টে ব্যাপারটাকে বেশ নিচু চোখেই দেখা হত। আমি জন্মানোর পর আমার মা, বাবার
সাইকেলের পেছনে বসতেও লজ্জা পেতেন। খুব আবছা একটা দৃশ্য মনে পড়ে। কখনও কখনও
সন্ধ্যের পর গঙ্গার ধার থেকে ফেরার পথে আমি আর বাবামা পাশাপাশি হেঁটে আসছি। ওঁরা দুজনে
পাশাপাশি হাত ধরে আর একপাশে মা বা বাবার হাত ধরে আমি। আমি ওই কুচো বয়সেও হাবলুর
চূড়ান্ত ছিলাম। “আমি দুজনেরই হাত ধরবোওওও” বলে কাঁদুনি গেয়ে মাঝখানে এসে হাড্ডি
হয়ে জুড়ে বসতাম।
আমার মেয়ে যদি এরকম করে তবে তার কপালে দুঃখ আছে।
আরেকটু বড় হয়ে কসমোপলিট্যান পড়ে জানলাম সাকসেসফুল ম্যারেজের
স্ট্র্যাটেজি হচ্ছে ‘টু ডু থিংস টুগেদার।’ ভাত খাওয়া, ঘুমোনো, অফিসকাছারি,
আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে সপ্তাহান্তে সাক্ষাৎ---এই সব বোরিং থিংস নয়, ফান্ থিংস। গোটা সাতদিনের ছুটি জমিয়ে, বাচ্চাকে কোনও একদিকের শ্বশুরশাশুড়ির কাছে জমা দিয়ে
পট্ করে পাটায়া চলে গেলেন। সানশাইন, স্যান্ডি বিচ, বিরাট ছাতার তলায় বসে লং
আইল্যান্ড আইস টি-তে চুমুক। ম্যারেজ চড়চড় করে আরও খানিকটা জমাট বেঁধে গেল।
আমার মাবাবা মধ্যবিত্ত বেরসিক মানুষ, পাটায়া কেন, আমাকে
ছেড়ে পুরী যেতেও তাঁদের মন ওঠে না। স্বর্গদ্বারে বসে হাওয়া খেতে খেতে ফোন করেন,
মিষ্টিওয়ালার থেকে চমচম কিনে খেয়ে মেয়ে খেতে পাচ্ছে না ভেবে অপরাধবোধে জর্জরিত হয়ে
কাঁদোকাঁদো গলায় ফোন করেন। এদিকে আমি হয়তো তখন ইয়েতি চিকেনে বসে ভুটে কো চানা আর
কোঁকরা কো লেডো দিয়ে সুগন্ধী ভাত মেখে খাচ্ছি।
ঘোরাঘুরি না, সিনেমা থিয়েটার বিতর্কসভা না, আমার মনে পড়ে
আমি আমার মাবাবাকে সবথেকে খুশি, পরিতৃপ্ত দেখতাম যখন তাঁরা দুজন আমাদের শোবার ঘরের
খাটের ওপর বসে সংসারের মানি ম্যানেজমেন্ট করতেন। আমাদের সেই কবেকার পুরোনো তোবড়ানো
রিল্যাক্সন ম্যাট্রেসের ওপর দুজনে বাবু হয়ে বসতেন আর চারদিকে পে স্লিপ, পাসবই,
কিষাণবিকাশ, ইন্দিরাবিকাশ, পোস্টঅফিসের বই, এল আই সি, ট্যাক্সের কাগজপত্র ছত্রাকার
হয়ে থাকত। সমস্ত মনোযোগ একত্র করে তাঁরা সঞ্চয়ের হিসেব রাখতেন, দরকারি অদরকারি
খাতে জমাখরচ কমাতেন বাড়াতেন। সংসারের খাতে আরেকটু বেশি, নিজেদের খাতে আরেকটু কম।
আমি এক সন্তান, বেশিক্ষণ অ্যাটেনশন ছাড়া থাকতে পারি না। খানিকক্ষণ
এঘরওঘর ঘুরেফিরে গুটিগুটি খাটের ধারে এসে দাঁড়াতাম। মাবাবা আমার দিকে তাকাতেন
পর্যন্ত না।
“ওটা ধরে না সোনা মা...তুমি বরং একটু ঠাকুমার কাছে গিয়ে
খেলা কর, কেমন?”
আমি বুঝতে পারতাম, তখন তাঁদের কায়াদুটোই শুধু খাটের ওপর বসে
আছে, আসলে তাঁরা জয়েন্ট ফ্যামিলির টোয়েন্টিফোর সেভেন হট্টগোলের নাগালের অনেক বাইরে
চলে গেছেন। অন্য একটা জগৎ, যেটা শুধু তাঁদের দুজনের। সে জগতে আমার বাবামার আর কেউ
নেই, শুধু তাঁরা দুজনে আছেন। দুজনের জন্য। সে জগতে এমনকি আমারও প্রবেশাধিকার নেই।
সেখানে মগ্ন হয়ে বসে, সমস্ত অনিশ্চয়তা, প্রতিকূলতা, রিসেশন আর মুদ্রাস্ফীতির
আকাশছোঁয়া ঢেউকে কাঁচকলা দেখিয়ে আমার বাবামা সংসার গড়ার খেলায় মেতেছেন।
গত সোমবার হাফছুটি নিয়ে আমরা আমাদের জীবনের প্রথম জয়েন্ট
অ্যাকাউন্টটা খুললাম। বন্ধুরা কেউ কেউ সন্দেহের সুরে বলল, আজকাল কি ওসব আর কাজে
লাগে? হয়তো লাগে না। বাবামায়ের মডেলে সংসার করার চেষ্টা করাটা এখন হয়তো স্রেফ
নস্ট্যালজিয়া আর ছেলেমানুষি ছাড়া কিছু না। তবু আমরা অ্যাকাউন্টটা খুললাম। অর্ধেক
কাজ অনলাইনেই হয়ে গেল। বাকি কাজটুকু হাফদিন ছুটি নিয়ে সেরে ফেললাম। ব্যাংকের হেল্প্ফুল
দিদিমণিরা হাসিমুখে বিভিন্ন জায়গায় আমাদের দুজনকে দিয়ে সই করিয়ে নিলেন। রিলেশনের জায়গায় হাসব্যান্ড আর ওয়াইফ।
নমিনি অন্য কাউকে করতে চান?
নাঃ। আমি ওর, আর ও আমার।
যৎসামান্য ডিপোজিট দিয়ে, একটা আস্ত অ্যাকাউন্টের মালিক হয়ে,
ওয়েলকাম কিট, চেকবুক, এটিএম কার্ড ইত্যাদি ব্যাগের ভেতর পুরে দরজা ঠেলে বাইরে
বেরিয়ে এসে টের পেলাম ভীষণ খিদে পেয়ে গেছে। মাতারা-য় ঢুকে ভাত, ডাল, তরকারি, মাছভাজা
অর্ডার করা হল। খাবার আসতেআসতেই আমাদের আর তর সইছিল না।
খামটা ছিঁড়ে দেখ না, কী দিয়েছে?
টেবিলের এপারওপার থেকে আমরা একে অপরকে হাইফাইভ দিলাম।
জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট ডান্। কী মজা। খাবার এসে গেল। খেতে খেতে আমরা খুব গম্ভীর মুখে
আলোচনা করতে লাগলাম, এখনও কত কাজ বাকি বাব্বা। পিপিএফ অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে, মেডিক্লেম,
লাইফ ইন্সিওরেন্স্......।
মনে করিয়ে দিয়ো তো, বাবাকে ফোন করে এজেন্টের নম্বরটা নিতে
হবে।
বলতেবলতে দুজনেরই হাসি পেয়ে যাচ্ছিল। ভাবা যায় বস্। দুদিনও
হয়নি, এর মধ্যেই কী বোরিং হয়ে গেছি। আমাদের মতো দিক্পাল ইন্টেলেকচুয়ালদেরও কি না
শেষে সেই মেডিক্লেমের গোষ্পদেই ডুবে মরতে হল? জঘন্য।
সব তোমার দোষ। আমি হলে শুধু ল্যাপটপ আর টাটা ফোটন সম্বল করে
হিমালয়ে গিয়ে ধ্যানে বসতাম।
কী সাংঘাতিক, আমারও তো এক্স্যাক্টলি এই প্ল্যানটাই ছিল! ইস্,
কেন গেলাম না। চল এখন যাবে?
সত্যি কথাটা বলব? হিমালয়ে যেতে পারলাম না বলে একটুও আফসোস হচ্ছে
না। বাবামা’রা যে খেলাটায় হিংসে করে অ্যাদ্দিন আমাদের খেলতে নিচ্ছিলেন না, সেটা
আমরা এখন নিজেরাই খেলতে শিখে গেছি
ভেবে বরং ভীষণ ভালো লাগছে।
himalaya giye kono labh nei...NRI complex, ATM, big bajar aar mall aajkal okhaneo pouchey
ReplyDeletegechey :)
অ্যাঁ, সে কী কথা।
Deleteapnar post e 'ami' 'amra' dia replace hote dekhe besh bhalo lagche.. :)
ReplyDeleteতাই তো। আমি নিজেই এই ব্যাপারটা খেয়াল করিনি দেখেছেন সৌমেশ।
DeleteAh, premer post! Ei garome ak jhalok thanda thanda cool cool batas... (fichel hasi)
ReplyDeleteএ মা, হাসি কীসের মনস্বিতা? প্রেমেরই গল্প তো, হাসির গল্প তো নয়। অবশ্য প্রেম ব্যাপারটাই খুব হাসির, সেদিক থেকে দেখলে ঠিকই আছে।
DeleteTomra dujone preme erom habudubu khachcho, dekhleo shanti… ar hasi niye matha garom koro na, amader mato niros premheen kettho manushra kato fichel, michke, kutkute, ga jwalano hasa hasbe… osob niye oto bhable chale? - preme porle "kuchh to log kahenge..."
Delete:-) amader songsar surur galpo mone korie dile Kuntala. ki ja bhalo laglo. mone hochhe amar chokher samne aj theke tero bachhhor ager ghatona keu chhobir moton tule enechhe. khub khusi hoe gelam sokkal sokkal . Tomder notun songsar tortorie taroni beye egie choluk. ar Abantor - o :-).
ReplyDeleteEkta kotha onekdin dhorei bolbo bole bola hoe uthchhena, Abantorer post ar post er songe comments , purota miliei darun akorshonio. ajkal to comments gulo (tomar comments o ) portei abar ghure ghure aste hoi.
"Tomder notun songsar tortorie taroni beye egie choluk." কী সুন্দর একটা কথা বললেন ইচ্ছাডানা। আপনার ইচ্ছেপূরণ হোক আমারও সেইটাই ইচ্ছে।
Deleteকমেন্টের ব্যাপারে আমি আপনার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, জানি---অবান্তরের মুখ্য আকর্ষণ তার পাঠক। আমার অনেক চেনা লোক আমার লেখা না পড়ে আপনাদের কমেন্ট পড়ে, জানেন তো?
খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি আমার মনের ভিতরে...চলুক তবে এই খেলা । না আছে হার, না আছে জিত ।
ReplyDeleteমিঠু
সব খেলাগুলোই যদি এরকম হত মিঠু। হারজিতহীন।
DeleteAmi amar baba maa ke kono din haat dhorteo dekhini jano. Tobe maa koek din er jonye kothao gele baba'r prochondo asubidhe hoy. amar jethima kakima ra jotoi korun na keno, baba'r discomfort ta sposhto bojha jay. etai amar kache baba maa er prem. R amar baba maa o every 6 months oi Indira Bikash, Kishan Bikash ogulo niye bosen. R ami ogulo dekhte bhishon pochhondo kortam. Oi brown khaam gulo dekhlei amar khub excitement hoto. :P
ReplyDeleteআর ওই ব্রাউন খাম আমার ততখানিই খারাপ লাগত টিনা।
Deleteআসলে যত সময় যাচ্ছে, সবকিছু মুখ ফুটে, হাতে ধরে বোঝানোর দিন আসছে। প্রেম, হিংসে, আঁতলামো, আজকাল সবাই সবকিছু প্রকাশ্যে করে (আমি শুদ্ধু)।
বাহ্ বাহ্ বাহ্ ... বেশ একটা ভাঙাগড়ার খেলায় মেতে উঠেছ দুজনে। ভাঙা বলতে ঐ তোমারই ভাষায় 'দিক্পালসম ইন্টেলেকচুয়ালিটি' ভাঙার কথা ভাবছি। চিন্তা নেই সবই হবে, পিপিএফ হবে, মেডিক্লেম হবে, লাইফও ইন্সিওরড হবে এবং নমিনির জায়গায় 'আমি ওর, আর ও আমার' হবে। আগে আগে দেখো আরও কি কি হয়!
ReplyDeleteআর জয়েন্ট ফ্যামিলির হট্টগোলের নাগাল এড়িয়ে সংসার গড়ার খেলা-র জায়গাটা হৃদয় ছুঁয়ে গেল। হাই ফাইভ রইল। কি দরকার ছিল, সে সময় তোমার ওদের ডিস্টার্ব করার?
আরে আমি কি আর তখন অতশত বুঝি আবির? আমার মাথা তখন হার্ডলি খাটের ধার ছাড়িয়ে ওপরে ওঠে।
Deleteayyyynnn...amio biye korbo :(
ReplyDeletemairi bolchi, post ta poRe sobtheke prothome etai mathay elo! khub bhalo laglo poRe. erokom sada matha biyer golpo aro likho to, mane prem factor ta ke background e fele normal life! khub bhalo hoyeche!
- Sumana
সে তো করবেই সুমনা। আমি বদবুদ্ধি দিচ্ছি ভেব না, কিন্তু ব্যাপারটা একটু পিছিয়ে করলে, সিংগলহুডটাও বেশিক্ষণ এনজয় করতে পারবে, বিয়ে তো পারবেই। গাছেরও হল, তলারও হল আর কি।
Deleteলেখাটা ভালো লেগেছে জেনে খুশি।
ল্যাপটপ আর টাটা ফোটন নিয়ে হিমালয়ে আমি রোজই মনে মনে চলে যাই। ওটা বেশ বিলাসবহুল কল্পনা। তবে এখনও হয়ে ওঠেনি। আমাদের মনের ইচ্ছেগুলো সবই লিখে ফেলছেন দেখছি। দিব্যি লাগছে পড়তে, চালিয়ে যান।
ReplyDeleteআরে নতুন পাঠক দেখছি। কী মজা। ল্যাপটপ, টাটা ফোটন আর হিমালয়ের জন্য হাই ফাইভ। মন্তব্য রাখার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
Deletekhuub khuub bhalo post.
ReplyDeleteধন্যবাদ রাখী।
Deleteখুব ভাল লাগলো, বাবা-মায়ের সংসার খেলার গল্পটা দারুণ হয়েছে... আমরাও অল্প অল্প শিখছি খেলাটা (প্রধানত আমার দোষেই শিখতে বেশ সময় লাগছে), তবে যে খেলা আমরা নিয়মিত খেলি, সেটা ঠিক জয়েন্ট ব্যাপার নয়- ভাগের ব্যাপার। ঠিক কি করে অন্যের ঘাড়ে কোন একটা খরচ পুরোটা চাপিয়ে দেওয়া যায়, সেই খেলাটা আর কি... :D
ReplyDeleteতাড়া কীসের শিখে যাবে, আমি এই বুড়ো বয়সে শিখছি দেখছ, তোমরা তো শিশু সুনন্দ।
Delete