ঠাঁইবদল
আমার এই বাড়িটার বাস ওঠানোর দিন এসে গেল।
বান্টি বলল, “দেখো যেন আবার ফ্যাঁচফেঁচিয়ে
কাঁদতে বোসো না।”
বয়েই গেছে আমার কাঁদতে। কান্নাকাটির কী আছে?
তাছাড়া এগুলো তো সব বাসা, বাসা তো মাঝেমাঝে বদল করতেই হয়। বাড়ি তো যেখানে থাকার
কথা সেইখানেই আছে। রিষড়ায়। কাঁদব আমি যেদিন ওই বাড়িটা প্রোমোটারের হাতে যাবে। গাছবাগান
মুড়িয়ে, নীলসাদা একতলা বাড়িটা গুঁড়িয়ে, কুয়োতলা আর তুলসীমঞ্চ উড়িয়ে হইহই করে যেদিন
একটা কুৎসিত বহুতল উঠবে আর ঘটা করে তার নাম রাখা হবে ‘ঠিকানা’ কিংবা ‘শান্তির নীড়”---সেদিন
কান্না কাকে বলে দেখিয়ে দেব।
তবে এই বাসাটার কথা ভোলা সহজ হবে না, সেটাও
সত্যি। হাজার হোক এটা আমার দিল্লির দ্বিতীয় খেপের প্রথম বাসা। আর সবথেকে বড় কথা
হচ্ছে, এই বাড়িটা অবান্তরের সিংহভাগ পাঠকের সঙ্গে, আপনাদের সঙ্গে আমার প্রথম
আলাপের ঠিকানা। একে কি ভুলব মনে করলেই ভুলে যেতে পারি আমি?
অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বাড়ি বদলের সময়টা আর পাঁচটা
সময়ের থেকে আলাদা। এই সময়টায় পণ্যবাদী জীবনের অসারতা আমার কাছে একেবারে পরিষ্কার
হয়ে যায়। কত দুঃখে যে লোকে মিনিম্যালিস্ট হয়, সেটা হাড়েহাড়ে টের পাই। কেন মরতে
গুচ্ছের পয়সা খরচ করে ওই কায়দার টেবিলল্যাম্প কিনেছিলাম, কাজে তো লাগেনি একটুও,
অথচ এখন টান মেরে ছুঁড়ে ফেলে দিতেও বিবেকে বাধছে। মা’র নীরব অসম্মতি সম্পূর্ণ
অগ্রাহ্য করে একখানা সাদাগোলাপি ফুলফুল টি-সেট কিনেছিলাম। টি-পটটা ব্যবহার করেছি
গুনে গুনে সাতদিন। কাপগুলোর কপালেও পটের থেকে বেশি আদর জোটেনি। বুঝেছি, ডেইন্টি
কাপ ধরে কনিষ্ঠা হাওয়ায় ভাসিয়ে চা খাওয়া দেখতে যত ভালোলাগে, খেতে ততটাই খারাপ।
দুয়ের পরে তিননম্বর চুমুক দিতে গিয়েই চা শেষ। নিকুচি করেছে অমন কাপের। তার থেকে
আমার পাঁচশো এম এল সাইজের গাবদা কফিমাগ ঢের ভালো।
বাড়ি বদলের দিনক্ষণ ঠিক হতে আমরা দু’চারটে ফোন
করলাম।
“হ্যালো, রাহুল? তুমি কোন মুভার্স্ অ্যান্ড
প্যাকার্স্কে নিয়েছিলে গো?”
“ওই তো, ভট্চাজ্। দাঁড়াও আমি তোমাকে ওঁর নম্বর
এস এম এস করে দিচ্ছি।”
শুনলাম সি. আর. পার্কের ভেতর যাঁরাই বাড়ি চালাচালি করেন তাঁদের সবারই ভরসা ভট্চাজ্বাবু। ফোনে কথা হয়ে গেল। ভদ্রলোক রাত
আটটায় দেখা করতে আসবেন বললেন। কাঁটায় কাঁটায় আটটা তিনে বেল বাজল।
কিছু কিছু লোক থাকে না, যাঁদের মঙ্গলগ্রহের
মাটিতে দাঁড়িয়ে প্রথম দেখলেও আপনি একসেকেন্ডে বাঙালি বলে ধরে ফেলবেন? ভট্চাজ্বাবু
হলেন সেই গোত্রের লোক। পাঁচ ফুট সাত, না মোটা না রোগা চেহারা, কাঁচাপাকা চুল, চোখে
কালো ফ্রেমের চশমা, একহাতে বাজারের থলি, আরেকহাতে পাকানো নিউজপেপার। হিন্দু, অফ
কোর্স। ভট্চাজ্বাবু দরজা দিয়ে ঢুকে এলেন। কোনও কথা না বলে চারদিক, রান্নাঘর,
ব্যালকনি ইত্যাদি ঘুরে দেখে এসে ঘরের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে কোমরে হাত দিয়ে বললেন,
“ব্যস্?”
“ব্যস্।”
“মিনিম্যালিস্ট না কী যেন বলে, তোমরা কি সে রকম
নাকি?”
হাসব না কাঁদব ভেবে পেলাম না। একবার ভাবলাম বলি,
“সে রকম যে নই সেটা ওই কাবার্ডটা খুললেই টের পাবেন” কিন্তু বললাম না। হেঁহেঁ করে
হাসলাম শুধু।
ভট্চাজ্বাবু চেয়ারে বসে পকেট থেকে একটা পেন
বার করে হিন্দুর ওপরের বাঁদিকের সাদা অংশটায় কীসব হিজিবিজি কাটলেন, বিড়বিড় করলেন,
মাথাটাথা নাড়লেন। তারপর খরচের এস্টিমেট দিলেন। রফা হয়ে গেল। “ভেরি গুড” বলে খবরের
কাগজ ফের গুটিয়ে, পেন পকেটে চালান করে তিনি জানতে চাইলেন, “আচ্ছা এবার বল, তোমাদের
প্রেফারড্ মোড অফ বাঁধাছাঁদা কী?”
আমরা বোকার মতো তাকিয়ে আছি দেখে ভট্চাজ্বাবু
আরেকটু ভেঙে প্রশ্নটা করলেন।
“মানে প্যাকিং, র্যাপিং না স্যাকিং?”
“অ্যাঁ?”
জানা গেল প্যাকিং মানে তো শুধু প্যাকিং নয়, তারও
রকমভেদ আছে। যেমন ধরা যাক টিভি। একে প্যাক করা ছাড়া গতি নেই। বাব্ল্ র্যাপে
মুড়তে হবে, কার্ডবোর্ডের বাক্সে পুরতে হবে। তার কমে চলবে না। আবার ধরা যাক ফ্রিজ।
এর জন্য শুধু বাব্ল্ র্যাপিংই যথেষ্ট। আর বাকি সব ফালতু জিনিস, জামাকাপড়
থালাবাসন চিরুনিপাউডার চটিজুতো---এগুলো সব ধপাধপ চটের স্যাকে পুরে ভ্যানে তুলে
দিলেই হবে। ওটাকে বলা হবে স্যাকিং।
“আর তোমরা ভ্যানের পেছনে ওয়াকিং করতে করতে চলে
আসবে। এইটুকু তো পথ, পারবে না?”
খুব পারব। ভট্চাজ্বাবু খুশি হয়ে চলে গেলেন।
কথা দিয়ে গেলেন বুধবার সকাল ঠিক সাড়ে ন’টায় উনি লোকলস্কর লাঠিসোটা নিয়ে হাজির
হবেন। আমাদের কিচ্ছুটি করতে হবে না, আমরা শুধু ইম্পরট্যান্ট ডকুমেন্টস্, অর্থাৎ
কি না আমাদের মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক গ্র্যাজুয়েশন ইত্যাদির অ্যাডমিট কার্ড,
মার্কশিট, সার্টিফিকেট ইত্যাদি বুকে জড়িয়ে দূরে দাঁড়িয়ে থাকব।
কবেকার ওই অর্থহীন নম্বরগুলোর থেকে বেশি জরুরি
জিনিস আমাদের জীবনে এখনও কিছু নেই, কোনওদিন হওয়ার সম্ভাবনাও প্রায় শূন্য---এই সত্যি কথাটা
আবারও নতুন করে মনে পড়িয়ে, কাটা ঘায়ে বেশ করে নুনের ছিটে দিয়ে, ব্যাগ দোলাতে দোলাতে
ভট্চাজ্বাবু বিদায় নিলেন।
বলেছিলাম না, বাসাবদলের সময়টা সত্যিই খুব চোখ
খুলে দেওয়া?
"sada-kalo ei jonjale bhora mithye kathar shahore - tomar amar jajabor songsar..."
ReplyDeleteHappy basa badol! Ei notun tthikanao sundor akkhan bhalo-basa hok
আরে বা মনস্বিতা, একেবারে লাগসই লাইনটা মনে করে লিখেছ দেখছি। তোমার শুভেচ্ছার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
DeleteUmm...ota 'tomar amar laal-neel songsar' hobe na?
DeleteEta porte porte amar thik ei linetai mone porchhilo! :D
Amar CR Parker sob bondhura Bhotchaj babur gunogaan gay. Thik lokkei pakrechho dekhchhi! :)
অ্যাঁ, তুমিও ভট্চাজ্বাবুকে চেন বিম্ববতী? যাক, ভরসা পাচ্ছি।
Deleteআগরওয়াল প্যাকারস আমার জীবনের একটা বিরাট অংশ জুড়ে বসে আছে। কলকাতা আর অন্য শহর মিলিয়ে আমার চারটে বাড়িবদল হয়েছে, কুন্তলা । সে যে কী ভয়াবহ ব্যাপার!! চারটে পাঁচটা লোক এসে প্রায় দুদিন ধরে তান্ডব চালায় । এর একটা বড় কারণ অপ্রয়োজনীয় জিনিসের বিপুল অর্থহীন ভান্ডার । তার ওপর বই । যাক,এইবেলা ভালোয় ভালোয় শিফটিং মিটিয়ে ফেলো ।আর জানো , বাসা কথাটা বাঙ্গালরাই বেশি বলে ।
ReplyDeleteমিঠু
আরে আগরওয়াল প্যাকারসের ওয়েবসাইট আমরাও দেখছিলাম তো মিঠু। তারপর রাহুল বলল, তোমাদের বাড়ির জিনিস নিয়ে এপাড়া থেকে ওপাড়া যেতে আগরওয়ালকে ডাকা একটু মশা মারতে কামান দাগার মতো হয়ে যাবে। ভট্চাজ্কেই ডাকো।
Deleteমনে নেই, চিড়িয়াখানা গল্পে/ সিনেমায় মহিলার মুখে "বাসা" শুনেই ব্যোমকেশ ধরে ফেলেছিল যে মহিলা বাঙাল? বাঙালরা তো বাসা বলবেই, বাংলাদেশে ফেলে রেখে আসা ভিটেমাটি আর একটা সুটকেসে নিজের আর ছেলেপুলের প্রাণগুলো সম্বল করে এসে ওঠা কলকাতা শহরের চিলতে ভাড়াবাড়ি---দুটোকেই কি একই নামে ডাকা যায়, না উচিত?
amar thakurda mahal (mane T-da and brothers) shesh din porjonto nijeder ke rephuzee (refugee) aar nijer bari ke bashabari bole gelen!!
Deleteঠিকই করেছেন ঠাকুরদা। সৌমিত্রর একটা সিনেমা দেখেছিলাম, নাম মনে নেই, শুধু এটুকু মনে আছে সৌমিত্র শিক্ষক সেজেছিলেন, সারাজীবন খেটেখুটে তিনি একটা অভিধান লিখেছিলেন আর তাঁকেও ওপার থেকে এপারে চলে আসতে হয়েছিল। সিনেমাটায় একটা ডায়লগ ছিল, সৌমিত্রর মুখে। উদ্বাস্তু কথাটা কত সহজে অভিধানে লিখে দিয়েছি, কিন্তু তার আসল মানেটা জীবন দিয়ে বুঝতে হল...এই মর্মে।
Deleteসিনেমাটা সম্ভবত রাজা মিত্রের 'একটি জীবন'...
Deleteইয়েস ইয়েস। ঠিক বলেছ পিয়াস।
Deleteaije 'basa' sobdoti bebohar korechen, etai dilkhush kore dilo..r bia-er por apnar lekhar strike rate ta besh bereche dekchi..good good..r oi ইম্পরট্যান্ট ডকুমেন্টস্ er modhhe apnar oi sada laptop tike o dhoren..jeti dia abantor er post beroy..bubble,balloon,toshok,kombol ja rap korar kore dien..:P
ReplyDeleteসে তো বটেই সৌমেশ। ল্যাপটপ প্রায় প্রাণের মতোই দামি জিনিস। ওটা কারও হাতে ছাড়ছি না।
Deleteবাসা বদল? শুনলেই বুকটা কেঁপে ওঠে... আহারে, আপনাদের কপালে এই ছিল? আমার বর্তমান বাসস্থানটা আমার জীবনের ষোল নম্বর বাসা... বাড়ি বদলের হ্যাপা আমার চেয়ে বেশি কেউ বোঝে না। আনপ্যাকিং যে প্যাকিংয়ের চেয়ে চারগুণ কষ্টকর, সেটা জানেন নিশ্চয়?
ReplyDeleteতবে সব মেঘের মধ্যেই একটা রূপোলীরেখা আছে, এই বাসাটা আপনাদের দাম্পত্য জীবনের প্রথম অ্যাড্রেস, টুকটাক জিনিস কিনে এনে ঘর সাজাবেন, নতুন পর্দা, ম্যাচিং বেডকভার... ভাবলেই মনে হয় আবার বিয়ে করে ফেলি।
ষোওওওলোওওওও! করেছেন কী দেবাশিস। আনপ্যাকিং-এর কথাটা এই মুহূর্তে মনে না করালে আপনার চলছিল না বুঝি?
Deleteআমার খুব ভালো লাগল যে আপনি সংসার পাতার ওই অংশটা ভালোবেসেছেন এবং সেটা মুখ ফুটে বলছেন। বেশিরভাগ মাচো মেনরাই এব্যাপারটা স্বীকার করতে চান না দেখেছি।
কুন্তলা, শুভমস্তু। গত মাসে বাসা বদল করে আমি এখনও তেতে রয়েছি। সপ্তাহ তিনেক লাগল - কারণ সারাদিন কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরে তবে গুছুন্তিপানা, কিন্তু তারই মধ্যে সুজয়িতা আর আমি মিলে সমস্ত কিছু আনপ্যাক করে সাজিয়ে ফেলেছি, রান্নাঘরের তাকে তাকে জিনিসপত্র, বইয়ের আলমারী সাজিয়ে ফেলে এত পুলকিত হয়ে পড়েছি, যে প্রাণে ধরে আর বই বার করে পড়তে পারিনি। আমাদের দিক থেকে সমস্ত ভাল ভাল ভাইব তোমাদের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করলাম।
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ কৌশিক। আশীর্বাদ কর আমরাও যেন তোমাদের মতো ঝটাপট আনপ্যাক করে ফেলতে পারি।
Delete"গাছবাগান মুড়িয়ে, নীলসাদা একতলা বাড়িটা গুঁড়িয়ে, কুয়োতলা আর তুলসীমঞ্চ উড়িয়ে হইহই করে যেদিন একটা কুৎসিত বহুতল উঠবে আর ঘটা করে তার নাম রাখা হবে ‘ঠিকানা’ কিংবা ‘শান্তির নীড়’---সেদিন কান্না কাকে বলে দেখিয়ে দেব।" - এই জায়গাটুকু পড়ে মন খারাপ হয়ে গেল কারণ আমার ছোটবেলার অনেকটা সঙ্গে নিয়ে আমার মামাবাড়িটা খুব শিগগিরই প্রমোটারের কবলে পড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। আর শেষ একবার যে বাড়িটাকে দেখে আসব তারও উপায় নেই।
ReplyDeleteএই যা। এটা সিরিয়াসলি দুঃখের ব্যাপার পিয়াস। কী আর করবে, সময়ের খেলা বলে ধরে নাও। মন খারাপ কোর না।
Deletethikana ba shanti neer naam porle tow bhalo....garden valley, old creek, oak heights ei shob o hotey parey...amar ekta priyo bari jetar naam chilo pitri-matrishraddha seta promoter er haate pore ekhon lotus heights atocho na lotus achey na height...kintu promoter oi naam e diyechey.
ReplyDeleteতাও তো বটে। ওই সব নামগুলোর কথা মনেই ছিল না। শান্তির নীড় তো ওল্ড ক্রিকের কাছে অমৃতের মতো শোনাচ্ছে।
Delete'basa-badol' bapre sanghatik kaj to. ar sob unpack kore guchhie neoa aro sanghatik. onek subhechha roilo. ei basa badol er dhakkai amader kato ki je hariechhe :-(
ReplyDeleteamar samanyo hostel er pat chokatei 1 week dhore jinis potro sort out korte legechhilo, ar e to thikana-bodol... koti koti jinis daan kore ashar porero garir diki puro upche porchhilo jinis potre... uff .. nijer jomanor khomota dekhe haan hoe gechhilum aami..
ReplyDeletetumi "mabhoi" baanir bhorsha niye lege poro..
"bari bodle jay"ami amar biyer por theke kono jaygatei 2 yrs beshi thakte parini..ki chap baapre..tarpor ami abar jinispotro bikri o kori(oi craiglist,quikr etc)..se aro pranantokar obostha..
ReplyDeleteবাবা তুমি তো বেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াস মহিলা দেখছি সুমনা। আমার তো কিনতে গেলেই হাল খারাপ হয়ে যায়, তুমি আবার সেগুলো যত্ন করে বিক্রি কর, প্রতিভা তো।
Delete