গঙ্গা সিন্ধু নর্মদা

কলকাতায় নামার পাঁচ মিনিটের মধ্যে রাস্তার যত ধুলোবালি এসে মুখের ওপর পাউডারের মতো সেঁটে গেল।

সকলেই জিজ্ঞাসা করছে, “দিল্লিতে গরম কেমন, সোনা?” আমি বলছি, “গরম আছে খুবই, কিন্তু তোমাদের মতো ঘাম নেই বাবা।” উঠতে গেলে ঘাম, বসতে গেলে ঘাম। কুটোটি নেড়ে দুটো করতে গেলে ঘাম। কাজেই আমি সেপথে যাচ্ছি না। রেগুলেটর যথাসম্ভব ডাঁয়ে ঠেলে মেঝের ওপর চিৎপাত হয়ে পড়ে আছি।

মার্চে মার্কেটিং করতে এসে বাড়িটাকে যেমন দেখে গিয়েছিলাম এখনও সেরকমই আছে। বেড়েছে কেবল গরম আর চায়ের কাপের গুনতি। চারের জায়গায় আট। বৃহস্পতি, শুক্র পেরিয়ে শনি আসতে আসতে সেটা দশ থেকে বারোচোদ্দতে পৌছনোর সম্ভাবনা। আমার প্রতি মাবাবার ডাকের সুরও অনেক নরম হয়ে এসেছে দেখছি। আগে বাড়ি আসার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে কোনও একটা ছুতো করে দুজনের মধ্যে অন্তত কেউ একজন আমাকে বকে দিতেন, আজ বাড়ি ঢোকার পর এই প্রায় সতেরো ঘণ্টা হতে চলল এখনও সে বকুনির ডোজ পড়েনি। এ যাত্রা বেঁচে গেলাম মনে হচ্ছে।

আমার বিয়েতে যেসব নিয়মে আমি বাদ সেধেছি তাদের মধ্যে একটা অন্যতম হল কাঁদার নিয়ম। কড়া গলায় শাসিয়ে রেখেছি, খবরদার আমি যাওয়ার সময় ফ্যাঁচফ্যাঁচিয়ে কাঁদতে বসবে না। তাতে সবাই ভয় পেয়েছেন মনে হয়েছে। এক ঠাকুমা ছাড়া। ঘণ্টায় ঘণ্টায় তিনি কাঁপাকাঁপা আঙুলে কর গুনতে বসছেন--

এক, দুই, তিন দিন। ব্যস্‌, সোনা আমাদের পর হয়ে গেল।

যেন পর হতে আরও কিছু বাকি আছে। গত এগারো বছর যে সোনা বাঁচল না মরল, দুটি ভাতডাল খেতে পেল না স্রেফ সাবওয়ে চিবিয়ে দিন গুজরান করল সে খবর কেউ নিল না, আজ হঠাৎ আপনপর নিয়ে দুঃখ উথলে উঠলে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে?

ঠাকুমা দমবার পাত্রী নন। চোখের আড়ালটা নাকি আড়ালই না। সে তুমি রিষড়ার বাড়িতে গায়ে সেঁটেই বসে থাক কি হিল্লিদিল্লিঅ্যামেরিকা করে বেড়াও, যতক্ষণ তুমি শান্ডিল্যগোত্রের ততক্ষণ তুমি ঠাকুমার আপন। শনিবার রাত পোয়ালেই শান্ডিল্যগ্রুপ থেকে আমার ঘাড়ধাক্কা পাকা আর সেইসঙ্গে ঠাকুমার ডিকশনারির ‘আপন’ সেকশন থেকেও।

পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলে ঠাকুমার ডানচোখ থেকে টপ করে একফোঁটা জল গাল বেয়ে গড়িয়ে বালিশের ওপর পড়ল।

আমি তাড়াতাড়ি আহা আহা কর কী বলে ঠাকুমার দুহাত চেপে ধরতেই ঠাকুমা গলা ঝেড়ে পরিষ্কার করে নিয়ে বললেন, পর হয়ে যাওয়ার আগে আমি যেন তাঁর একটি ইচ্ছে মিটিয়ে যাই। ধনদৌলত টাকাকড়ি কিচ্ছু তাঁর চাই না, কেবল নাতনির গলায় “গঙ্গা সিন্ধু নর্মদা” গানটা যদি আর একবার শুনতে পান।

যে গানটা আমি ক্লাস থ্রি-তে পড়ার সময় প্রথম হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাইতে শিখেছিলাম। তখনও বেলো বাজাতে গেলে হারমোনিয়ামের ওপর প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়তে হত। সব নতুন শিক্ষার্থীকেই মাস্টারমশাই প্রথম ওই গানটাই শেখাতেন কারণ গানটা সেই বিরল নজরুলগীতিদের মধ্যে পড়ে যাতে খালি শুদ্ধস্বর লাগে।

আমি আধো ভুলে যাওয়া কথায়, আধো ভুলে যাওয়া সুরে গানটা গাইতে লাগলাম। অন্তরা পুরো বাদ চলে গেল, সঞ্চারী আভোগীর কথা এরটা ওর ঘাড়ে উঠে পড়ল, তবু ঠাকুমা দুচোখ বুজে ক্ষীণকণ্ঠে আমার সঙ্গে গাইতে লাগলেন---

আমরা জানি না, জানে না কেউ/ কূলে বসে কত গণিব ঢেউ/ দেখিয়াছি কত দেখিব এও, নিঠুর বিধির লীলা কতই/ কই রে আগের মানুষ কই/

গঙ্গা সিন্ধু নর্মদা কাবেরী যমুনা ওই/ বহিয়া চলেছে আগের মতোই/ কই রে আগের মানুষ কই...