পূর্ণার শিক্ষা
উৎস গুগল ইমেজেস
পূর্ণার সঙ্গে আমার
প্রথম দেখা হয়েছিল ২০০১ সালের অগস্ট মাসের শেষাশেষি। আমার সেটা জীবনের প্রথম মায়ের
নাগালের বাইরে থাকা, আর পূর্ণা ততদিনে জীবনের গোটা বারো বছর গোটাতিনেক হোস্টেলে
ভাগাভাগি করে কাটিয়ে এসেছে।
রুমমেট হওয়ার জন্য
এর থেকে খারাপ জুটি আর হয় না।
কেউ কেউ বলতে পারেন,
কেন, এটাই তো বেশ ভালো ব্যবস্থা। অভিজ্ঞতা আর তারুণ্যের মেলবন্ধন। একজন আরেকজনের
হাত ধরে হোস্টেল লাইফের খুঁটিনাটি শিখবে, আর আরেকজন অন্যজনকে দেখে তার ফেলে আসা
দিনগুলো নতুন করে ফিরে পাবে।
দুঃখের বিষয়,
পূর্ণার পুরোনো দিনগুলোর সঙ্গে আমার হোস্টেলের নতুন দিনগুলোর স্বভাবে, হাবেভাবে,
চেহারায় কোনও মিলই ছিল না। হোস্টেলে হাতেখড়ি হওয়ার সময় আমি ছিলাম ভোটাধিকারপ্রাপ্ত
পূর্ণবয়স্ক একটা লোক আর পূর্ণা ছিল দশ বছর বয়সের বালিকা। আমি মফস্বল থেকে পূর্বা
এক্সপ্রেসে চেপে রাজধানী, আর পূর্ণা ভিড়ে ঠাসা ঘামে ভেজা ঢাকা শহর থেকে জাঁদরেল
পিসির হাত ধরে গুটিগুটি সীমান্ত পেরিয়ে দার্জিলিং লোরেটোর মেঘলা শান্ত গম্ভীর
করিডোর।
“কেঁদেছিলে?”
“কাঁদব না? একে
প্রথম বাড়ির বাইরে থাকা, তার ওপর লোরেটোর ওই উঁচুউঁচু সিলিংওয়ালা কনকনে ঠাণ্ডা ঘর।
সকালবেলাতেও আলো ঢোকে না। রাতের বেলা হাঁটতে গেলে কাঠের মেঝেতে ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ
শুনে ভয়ে প্রাণ উড়ে যায়। তবু যদি বদমেজাজি সিস্টারগুলো একটু ভালোবেসে কথা বলত।”
ঘরভাগাভাগির একবছরে
পূর্ণা আমাকে দুটো জিনিস শিখিয়েছিল। এক, ম্যাগি রান্না। দু’নম্বরটা অবশ্য ঠিক
শেখানো নয়, উপদেশ। দোলের সকালে পুরিভাজি তুলতে গিয়ে দেখেছিলাম মেসের মাঝখানে বিরাট
বিরাট ডেকচিতে ঘোলা ভাং-এ ভাসছে ইয়া বড়বড় বরফের চাঁই আর গুঁড়োগুঁড়ো সবুজ রঙের
ভাং-এর পাতা। পূর্ণার দেখাদেখি আমিও বোতলে জলের বদলে ভাং ভরে নিলাম। তারপর পূর্ণার
হাত ধরে, চাঁদিফাটানো রোদ মাথার ওপর নিয়ে বাকি হোস্টেলগুলোর উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়া
গেল।
পূর্ণা বলেছিল,
কোয়ালিটি কন্ট্রোলের জন্য শুধু নিজের হোস্টেল ছাড়াও বাকি হোস্টেলের ভাং চেখে দেখা
জরুরি।
খান পাঁচেক
হোস্টেলের বুড়ি ছোঁয়ার পর আর খান তিনেক হোস্টেল বাকি থাকতে থাকতেই আমি বুঝতে
পারলাম যে আমার হয়ে গেছে। পূর্ণার কনুই ধরে কোনওমতে ঝিলম লনে পৌঁছে একটা বেঞ্চে
বসে আমি পূর্ণা কে বললাম, “পূর্ণা আমি মরে যাচ্ছি।”
পূর্ণা পাত্তাই দিল
না, ঝাঁকুনি দিয়ে কনুই ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “যাচ্ছিস না, নেশা হলে কেউ মরে না। যদি
মরিস তাহলে গিনেস বুকে নাম উঠবে তোর। এখানে বসে থাক। আমি স্যাট্ করে গঙ্গার
ভাং-টা চেখে আসি।”
আমি দুচোখে টলটলে জল
নিয়ে পূর্ণার কোমর জড়িয়ে ধরে বললাম, “আমাকে ছেড়ে যেয়ো না পূর্ণা। তুমি ছাড়া আমার এ
পৃথিবীতে কেউ নেই।”
পূর্ণা বলল, “আহ্
জ্বালালে দেখছি। শোন, এখানে চুপটি করে বসে থাক। ইচ্ছে করলে শুয়েও পড়তে পারিস।
কিন্তু যাই করিস না কেন খবরদার মুখ খুলবি না। চুপটি করে থাকবি।”
“কিন্তু আমার যে
কাঁদতে ইচ্ছে করছে পূর্ণা?”
"কাঁদ্ না, যত খুশি
কাঁদ্। চোখ দিয়ে যত খুশি জল পড়ে পড়ুক, গলা দিয়ে আওয়াজ না বেরোলেই হল।"
বলে পূর্ণা
বিশ্বচরাচরে আমাকে একা ফেলে হেলেদুলে বোতল হাতে গঙ্গা হোস্টেলের গেটের ভেতর অদৃশ্য
হয়ে গেল। আমি বাঁচলাম না মরলাম সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করেই। আমার চোখে
কান্না, উড়ন্ত লাল নীল সবুজ গোলাপি হলুদ আবিরের গুঁড়ো, আসন্ন মৃত্যুর ছায়া সব
মিলেমিশে গিয়ে এক অদ্ভুত ঘোর নেমে এল। যখন ঘোর কাটল তখন দেখলাম আমি নিজের ঘরে নিজের
বিছানায় চিৎপাত হয়ে পড়ে আছি। দরজার ওপরের কাঁচের অংশটুকুর বাইরে সন্ধ্যের ছায়া
ঘনিয়ে এসেছে, আর ওপাশের বিছানাটা থেকে পূর্ণার মৃদু নাকডাকা ভেসে আসছে।
যাই হোক, যে
শিক্ষাটার কথা বলতে বসে এত বড় গল্পটা বলতে হল, সেটা হচ্ছে নেশা হয়েছে বুঝতে পারলে
মুখ বন্ধ রাখার শিক্ষা। আপাতদৃষ্টিতে কী সহজ কথা, কিন্তু পৃথিবীতে কত কম লোক এ কথা জানে
সেটা ভাবা যায় না।
'... কিন্তু পৃথিবীতে কত কম লোক এ কথা জানে সেটা ভাবা যায় না। ' - ekebare jake bole khnati sotti. er jonye je ki bhoganti hoi lokjoner.
ReplyDeleteহ্যাঁ, আমার মাতাল দেখলে এমনিই ভয় করে, তার ওপর মাতাল বাচাল হলে তো আর রক্ষে নেই।
Deletehahaha ..majar...sesher ta akdom sotti!
ReplyDeleteএকেবারে তিন সত্যি তিন্নি।
Deleteকাকতালীয় ঘটনা হল আমার সঙ্গে । সকালে ভোগান্তি , ওই মুখ খোলার জন্য। আর অবান্তর খুলেই এই লেখা । এতো শিক্ষামূলক ব্যাপার হে ।একেবারে চোখে আঙুল দাদা
ReplyDeleteমিঠু
দেখেছ। তোমরা তো দৈবে বিশ্বাস করো না। এখন প্রমাণ হল তো।
Deleteথুড়ি,নেশার জন্য নয় ,আমার ক্ষেত্রে দু কথা শুনিয়ে দেবার ইচ্ছে দমন করতে পারিনি তাই। চুপ থাকলেই শান্তি থাকতো ।
ReplyDeleteমিঠু
হাহাহাহা মিঠু, তুমি যে সক্কাল সক্কাল উঠেই নেশা করনি এটা না ক্ল্যারিফাই করলেও বুঝতে পারতাম। তোমার দ্বারা যে ও জিনিস হবে না সেটা তোমার কমেন্ট পড়েই আন্দাজ করা যায়।
DeletePurna bhishon mature. Kokhon mukh bondho rakha uchit, ei shikkha ta sotyi important. nesha na kore thakleo. :)
ReplyDeleteহাই ফাইভ টিনা। আমি তো সজ্ঞানেই এমন ভুলভাল জায়গায় কথা বলি যে কী বলব। জীবন রাখতে ইচ্ছে করে না।
Deleteএই পূর্ণা দিদিমনিই তো রেস্টোরেন্টে খাবার ভালো লাগলে মালিক না পাচক ঠাকুর কাকে যেন 'চুম্মা' দিতে চাইতেন, তাই না? উনি সত্যিকারের ভূয়োদর্শী মানুষ। তা ইনি তোমার বিয়েতে আসছেন তো?
ReplyDeleteনা হে আবির। পূর্ণা কোথায় কে জানে। তবে না জেনে হয়ত ভালোই হয়েছে। ও যদি বদলে গিয়ে থাকে, সেটা আমি সহ্য করতে পারব না।
Deleteexactly same golpo amay ek rajasthani colleague-friend amay suniachilo..frame by frame same...beshi bhang er nesha chorle naki ai "more jachhi" feelings ta hoy..
ReplyDeleteসৌমেশ, আপনার বন্ধু এক্কেবারে ঠিক কথা বলেছে। মনে হয়, এই হয়ে গেল। আর পৃথিবীর মাটিতে হেঁটে চলে বেড়াতে হবে না। শুধু আমি বলছি না, অভিজ্ঞ অনেকেই বলেছেন, ভাঙের নেশা হওয়ার পর যে শারীরিক কষ্টটা হয়, সেটা অনেক বড় অসুখেও হয় না।
DeleteTobe Purnar elem achhe bolte hobe, ato gallon gallon bhang khabar por-o ato sagyani kathabarta... tomar-amar mato horrible chhichke amateur nay je du fota kheyei horibol... ar don't forget je Gangar bhang kheyeo se shudhu nijeke nay tomakeo safely ghoshrate ghoshrate hostel-e nijer bichhana obdi enei tab nijer naak dakiyechhe... meye bote ek-khana! Purna, tumi jekhanei achho, selam.
ReplyDeleteমনস্বিতা, পূর্ণার থেকে বেশি দস্যি, বেশি দিলওয়ালা মানুষ আমি সত্যি আর দেখিনি। ওকে চেনা আমার পক্ষে একটা চরম সৌভাগ্যের ব্যাপার। সেলাম করার মতো মেয়েই বটে।
Delete***** - ar kichu bolar nei...
ReplyDeleteএইবার আমার সিরিয়াসলি কৌতূহল হচ্ছে তুমি কী বলতে চেয়েছিলে জানতে।
Deleteaha! Ota to 'Five Star'... mane A Class! :)
Deleteভাগ্যিস জিজ্ঞাসা করলাম। আমি ভাবছিলাম, তুমি ছাপার অযোগ্য একটা কিছু লিখতে চেয়ে স্টার দিয়েছ। থ্যাংক ইউ।
Deleteদু'দিন বাদ দিয়ে, প্রাথমিক ভালোলাগাটা কাটিয়ে নিয়ে, দ্বিতীয়বার পড়ে, নিশ্চিত হয়ে লিখছি - হাল্কা, খুব হাল্কা প্রেমে পড়ে গেছি। বৌকেও পড়ালাম। এই ভালো লেখাটার জন্য স্তুতি -
ReplyDeletehttp://littlemissdorkette.tumblr.com/post/3118512524/date-a-girl-who-reads-by-rosemarie-urquico
আরে বাঃ অনির্বাণ, এই তো চাই। আর তুমি যে লেখাটার লিংক দিলে সেটা আগেও পড়েছি, পড়ে ইচ্ছে করেছে লোকজনকে পড়ানোর। তুমি লেখাটার কথা মনে পড়িয়ে দিলে থ্যাংক ইউ।
Delete