প্যাকিং আনপ্যাকিং আর চিত্তরঞ্জন পার্কের ইতিকথা



বাঙালির টাইমজ্ঞান নেই এই কথাটা যদি অপ্রমাণ করতে হয়, ভট্‌চাজ্‌বাবুকে ডাকতে হবে। সাড়ে ন’টা বলেছিলেন, সাড়ে ন’টায় এসে গেলেন। পরনে আদ্দির ফতুয়া, ট্রাউজার। কাঁধের ছোট্ট ঝোলা ব্যাগে হিন্দু আর জলের বোতল।

আমরাও স্নান করে চুল আঁচড়ে জামাকাপড় পরে গ্যাস্ট্রোজাইম খেয়ে রেডি হয়ে ছিলাম। গ্যাস্ট্রোজাইম কেন খেতে হয়েছিল? পরশু রাতে খেয়াল হল যে ফ্রিজ প্যাক হবে, এবং ফ্রিজের ভেতর পাউরুটি, হ্যাম, টমেটো কেচাপ, লাখখানেক মাদার ডেয়ারির দইয়ের চামচ ছাড়াও খানচারেক কাঁচা ডিম, একখাবলা ভাত আর পাঁচশো গ্রাম মুরগির স্টু পড়ে আছে।

প্রাণে ধরে ফেলতে পারলাম না। ঠুসে ঠুসে সেই রাত্রেই ভাত মুরগি শেষ করা হল। কাকভোরে উঠে দু’খানা করে ডিম সেদ্ধও সাঁটালাম। এর পরেও গ্যাস্ট্রোজাইম না খেয়ে, "দেখিই না কী হয়" বলে বসে থাকব, অত অ্যাড্‌ভেঞ্চারাস্‌ আমরা নই।

আপনাদের কারও যদি সি. আর. পার্কে বাড়ি বদল করতে হয় তবে চোখ বুজে ভট্‌চাজ্‌বাবুর শরণ নেবেন। ভদ্রলোক দিল্লিতে আছেন কে জানে কত বছর, মুভিং-প্যাকিং-এর কাজ করছেন বিশ বছর ধরে। ফলে যেটা হয়েছে, ভদ্রলোক একটা বন্ধ কাবার্ডের দিকে তাকিয়ে বলে দিতে পারেন সেটা প্যাক করতে ক’টা খালি কার্টন লাগবে। ভট্‌চাজ্‌বাবুর সঙ্গীসাথীরাও সব একেকজন হীরের টুকরো। ভদ্র, পরিশ্রমী, আলাপী। আমরা দুজন সত্যিসত্যিই ল্যাপটপ আর সার্টিফিকেটের বান্ডিল ঘাড়ে করে ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে রইলাম। ওঁরা ম্যাজিকের মতো দশমিনিটে আমার কাবার্ড, পাঁচমিনিটে আমার তিনটে ড্রয়ার, সাতমিনিটে আমার রান্নাঘর আর তিনমিনিটে আমার বাথরুম প্যাক করে ফেললেন। বাকি তিন মিনিট গেল টুকটাক ঝাঁটা, ফোলডিং আলনা গোছাতে। সবকিছু আরও আগেই সারা হত যদি না আমি মাঝেমাঝেই ঝাঁপিয়ে পড়ে, “এই তো আমার ঘড়ি! এই তো আমার রেন্ট এগ্রিমেন্ট! এই তো আমার ম্যারেজ সার্টিফিকেট!” বলে ওঁদের কাজে ডিস্টার্ব না করতাম।

সব গোছানো হয়ে গেল। ভট্‌চাজ্‌বাবু পাংচুয়াল বলেই তো সব বাঙালি পাংচুয়াল নয়, ট্রাকওয়ালার অপেক্ষায় বসে থাকতে হল। সে ছোঁড়ার আসার কথা ছিল নাকি এগারোটায়, বারোটা অবধি তার দেখা মিলল না।

তাতে একদিক থেকে সুবিধেই হল অবশ্য। ভট্‌চাজ্‌বাবু সোনুকে পাঠিয়ে আমাদের সবার জন্য চা আর প্লাস্টিকের কাপ আর নিজের জন্য খানচারেক পান আনালেন। তারপর চায়ের কাপ হাতে কার্টন আর ন্যাড়া বক্সখাটের ওপর বসে জমিয়ে গল্প শুরু হল।

ভট্‌চাজ্‌বাবু বলতে লাগলেন, সে অনেক দিনের কথা। তখন সি. আর. পার্কে শেয়াল ডাকত আর সূর্যের আলো ঢলতে না ঢলতে একনম্বর দু’নম্বর বাজারের গুটিপাঁচেক দোকানদার ঝাঁপ বন্ধ করে পালাত। বাঙালি ভদ্রলোকরা তখন সব থাকতেন লোদি কলোনি, বিনয়নগর এই সব জায়গায়। তারপর একটা কথা উঠল, যে দিল্লি ডেভেলপমেন্ট অথরিটির কাছ থেকে ক্যাশ টাকা ধার নিয়ে পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুরা নাকি চিত্তরঞ্জন পার্কে সস্তায় জমি কিনে বাড়ি বানাতে পারে।

ব্যস্‌। স্রোতের মতো লোক ঢুকতে শুরু করল। ক’জন তাদের মধ্যে সত্যিসত্যি রিফিউজি তার হিসেব রাখা সম্ভবও ছিল না, রাখলও না কেউ। শুধু একটা জঙ্গুলে জায়গা ঘোষ, চাকলাদার, মুখার্জি, দত্ত, চৌধুরীদের বাংলা কথায়, আড্ডা, পি এন পি সি-তে মুখরিত হয়ে উঠল।

হঠাৎ প্যাঁ প্যাঁ আওয়াজ শুনে সোনু দৌড়ে গিয়ে দেখল গাড়ি এসে গেছে। সে গাড়ির ডাকনাম ‘দিলীপের গাড়ি’ আর ভালোনাম ‘সুরভি টেম্পু সারবিস’। বড়বড় যা জিনিস ছিল সেগুলোকে গাড়িতে তুলে, ছোট পোঁটলাপুঁটলিগুলো কে একটা দোমড়ানো ভ্যানগাড়িতে বেশ করে বেঁধে দেওয়া হল। সব হয়ে যাওয়ার পর সোনু আমাদের দিকে দেখিয়ে বলল, “আর এ মালদুটো কীসে করে যাবে দাদা?”

ভট্‌চাজ্‌বাবু আমাদের দিলীপের পাশে বসিয়ে দিলেন। অর্চিষ্মান সারারাস্তা, “আচ্ছা, যদি টেম্পো উল্টে যায়? যেতেও তো পারে? বলা তো যায় না?” এইসব আকাশকুসুম কল্পনা করতে করতে চলল। কিন্তু অত মজার কিছুই ঘটল না, আমরা দিব্যি অক্ষত অবস্থায় আমাদের নতুন বাড়ির দোরগোড়ায় এসে নামলাম।

তারপর আবার শুরু হল ওঁদের অমানুষিক পরিশ্রম। সব জিনিস দোতলায় তুলে দিয়ে, দেয়ানেয়া মিটিয়ে, “আচ্ছা তবে আসি? যোগাযোগ রাখবেন, নমস্কার।” বলে ওঁরা চলে গেলেন।

আর বাড়িভর্তি সুটকেস আর প্যাঁটরা আর পলিথিনের ঝোলার সমুদ্রের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমরা প্রথমবার টের পেলাম, ঠিক কতখানি বিপদ আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে।

বিপদে পড়লে বাকিরা কী করে জানি না, হয়তো সে বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার চেষ্টা করে। আমরা অত বোরিং নই, আমরা বিপদে পড়লে দৌড়ে সিনেমা দেখতে যাই। বাক্সপ্যাঁটরা যে যেখানে আছে তেমন থাক, সপ্তাহের মাঝে একটা পড়ে পাওয়া ছুটি পেয়েছি, চল সেটার সদ্ব্যবহার করে আসি বলে আমরা ম্যাটিনি শো-তে ‘গো গোয়া গন’ দেখতে চলে গেলাম। তারপর ঘণ্টাদুয়েক কড়া এ. সি. তে বসে, দু’গামলা পপকর্ন আর দু’বালতি পেপসি দিয়ে লাঞ্চ সারতেসারতে টাইমপাস হয়ে গেল।

একেবারে ফাঁকি দিইনি তা বলে। বাড়ি ফিরে রান্নাঘরটা গুছিয়ে ফেলেছিলাম। যাতে আজ সকালের চা-টা অন্ততঃ জোটে। সকালে উঠে দুমদাম করে এই অবান্তর পোস্ট লিখে, চা খেয়ে, ঘরময় ছিটিয়ে থাকা সুটকেস আর কার্টনের মৃতদেহ টপকে পালিয়ে এসেছি। সে ছবি আপনাদের দেখাতে পারতাম, কিন্তু ক্যামেরা হতভাগা এখন কোথায় কীসের নিচে চাপা পড়ে আছে কে জানে।


Comments

  1. Hyderabad theke Kolkatay asar samay amar movers & packers er abhigyota hoyechhilo. Sekhane Bhatchajbabu na thakleo, sotyi onader punctuality ar efficiency dekhe mugdho hoye gechhilam. Jak, apnar ekta baro kaaj mitlo. Go Goa Gone kemon laglo?

    ReplyDelete
    Replies
    1. একেবারে ঠিক কথা। ওঁরা না থাকলে কী হত ভগবানই জানেন। লটবহর নিয়ে মাঝরাস্তায় বসে কাঁদতে হত।

      গো গোয়া গন---'চলতা হ্যায়' লেগেছে।

      Delete
    2. Go Goa Gone ami akta bondhur kach theke pendrive kore enechilam. Dekke adhghonta shok ar shock peye mujjoman hoye bosechilam. Shok coz what a waste of time! Shock karon erom cinema-o loke bananor sahos kore! He bhagoban!

      Delete
    3. হাহা মনস্বিতা, বেজায় খারাপ লেগেছে বুঝতে পেরেছি।

      Delete
  2. Uposthit...pore gelam..
    ami jantam sudhu Tollygunge-a e sial dakto bohu bohu bochor age..C R Park e o dakto buji..sial er ar dosh ki..amra e oder ghor dokhol kore berachhi..hukka hua to korbe e.. :P
    r haan..aaj Kolkatar ja fatafati weather na!!kolpona korte parben na...apni Kolkata e thakle hoyto aaj ek/adhkhan kobita o namia diten..:D

    ReplyDelete
    Replies
    1. উপস্থিত দেখে খুশি হয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু কলকাতার ভালো ওয়েদারের কথা বলে আবার দুঃখী করে দিলেন সৌমেশ। আর কবিতা? ভালো ওয়েদার তো দূরের কথা, খোদ স্বর্গে চলে গেলেও আমার হাত থেকে ও জিনিস হবার নয়। ভয় পাবেন না।

      কবিরা তো অলরেডি বলেই গিয়েছেন, "সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি"? আমি একেবারেই ওই "না-কবি" দলের লোক।

      Delete
    2. Nimnochaper brishti pore
      antenna e boshe bheje
      ekta darkak...
      tai dekhe ami to obak!!

      erom type er kobita likhten noy..tate o amra khushi hotam.. :D:D

      Delete
    3. তালিয়াঁ তালিয়াঁ। কী ভালো কবিতা লিখেছেন আপনি। আমার আর দরকার কী?

      Delete
  3. খুব যে ভাল এবং মজায় আছো তার প্রমাণ এই পোস্টগুলো । এই ভাবেই বোরোলিনের বিজ্ঞাপনের মতোই চালিয়ে যাও ।


    মিঠু

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহাহা, তাই নাকি মিঠু? তা ভালোই আছি, অস্বীকার করে লাভ নেই।

      Delete
  4. sotyi tumi ki bhalo lekho! 'Abantor' er nesha hoye geche amar. Facebook o ajkal roj khuli na, but Abantor e ami dine dubar hajira diyi. :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. উফ্‌ টিনা, মন ভালো করে দিলে যে। তোমার মনোযোগ দখলের লড়াইয়ে অবান্তর ফেসবুককে ফেল ফেলেছে, এটার থেকে ভালো কমপ্লিমেন্ট খুঁজে পাওয়া শক্ত। থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ।

      Delete
  5. CR park er ogginal naam chilo EPDP colony arthat East Pakistan Displaced Persons Colony...later banga shontans came up with the new name...shunechi arekta contender naam subhas nagar gocher kichu chilo...kintu uttar bharat incl. punjab and himachal e subhas nagar er eto chorachori tai mone hoy ota batil holo :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. এই রিষড়ায় আমাদের পাড়ার পাশের পাড়ার নাম সুভাষনগর গো শম্পা। আমরা ওদের দুচক্ষে দেখতে পারি না। খালি আমাদের দুর্গার মুখ টুকে টুকে নিজেদের প্রতিমা বানায়। ভাগ্যিস সি. আর. পার্কের নাম সুভাষনগর রাখেনি, তাহলে আমার এ জায়গাটায় থাকতে দুঃখে প্রাণ বেরিয়ে যেত।

      Delete
  6. 'ভট্‌চাজ্‌বাবু' to darun . jak bhaloi bhaloi sob kaj sere phelechho ar cinema - o dekhe phelechho.

    - Ichhadana

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ, লোকের যে কাজগুলো করার কথা ছিল সেগুলো তাঁরা সব করে দিয়েছেন। আমাদের যে কাজগুলো করার কথা ছিল না, যেমন সিনেমা দেখা, সেগুলো আমরা করে ফেলেছি। এবার আসল কাজটা, অর্থাৎ আনপ্যাকিং, যেটা আমাদের করার কথা, সেইটা কবে হবে এটাই হচ্ছে গিয়ে প্রশ্ন।

      Delete
  7. Cr Park shunleyi amar oi darun phuchka wala ar ghugniwala r kotha mone pore jaay.

    ReplyDelete
    Replies
    1. বাঃ তোমার সঙ্গে তো আমার বিস্তর মিল দেখতে পাচ্ছি পৌষালী। গুড গুড।

      Delete

Post a Comment